আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার। একজন ইরম শর্মিলা।

লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৪ নভেম্বর, ২০১৩, ০৩:২০:৪৩ রাত

আইনের শাসন কথাটি জনপ্রিয় যথেষ্ট। এর প্রবক্তারা আইনের শাসন এ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষের সমাজ জিবনে শান্তিু ও সচ্ছলতা আসে বলে দাবি করেন। ইতিহাসে অনেক শাসকই দেখতে পাওয়া যায় যারা আইনের শাসক হিসেবে খ্যাত। যারা আইনের কাছে নিজের শাসন ক্ষমতা কে সমর্পন করে আইনের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছিলেন। কিন্তু আইন যিনি তৈরি করেন তিনি যদি এমন আইন তৈরি করেন যে আইন তাকে আইনের উর্দ্ধে রাখবে তাহলে তিনি যে আইনই ভাঙ্গুন না কেন তিনি আইনের উর্দ্ধে থেকে যাবেন সে ক্ষেত্রে যেই ক্ষতিগ্রস্থ হোক বলা যাবেনা আইনের শাসন ভঙ্গ হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়াতেই ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতবর্ষে অসংখ্য স্বাধিনতা সংগ্রামিকে ফাঁসিতে ঝুলান হয়েছিল কিংবা উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল কামানের গোলায়। খোদ ভারত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিচার করেছিল একটি চাটার্ড লিমিটেড কোম্পানি দ্বারা গঠিত আদালত। একটি স্বাধিন দেশের সম্রাটকে জোরপুর্বক আটক করে তথাকথিত বিচার এর মাধ্যমে নির্বাসন দিয়ে দাবি করা হয়েছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে আদালতটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এভাবেই আইনের শাসন এর নামে ক্ষমতাশালিরা সবসময় নিজের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করে গেছে। বাহাদুর শাহ জাফর থেকে মুহাম্মদ মুরসি পর্যন্ত অনেক রাষ্ট্রনায়ক,সেনাপতি জননেতা থেকে শুরু করে সাধারন মানুষকেও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে আইনের শাসন এর নামে। এ যেন হবুচন্দ্র রাজার গল্প। কাঁদলে মৃত্যদন্ডের আইন করে পোষা পাখির মৃত্যুতে নিজেই কেঁদে ফেলে শেষে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মৃত্যদন্ডে দন্ডিত হন।

বাস্তব জিবনে ফরাসি সেনাবাহিনীর ক্যপ্টেন আলফ্রেড ড্রেইফুস এর কাহিনী এই আইনের শাসন এর প্রতি সন্দেহযুক্ত করে তুলে সকলকে। ফরাসি সেনাবাহিনীর অফিসার ড্রেইফুস কে জার্মান পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে যাবজ্জিবন কারাদন্ড দেয়া হয়। যদিও প্রকৃত দোষি ছিলেন তার সিনিয়র কর্নেল জর্জি পিকহার্ট। কিন্তু সামরিক বাহিনীর আইন অনুযায়ি সিনিয়র অফিসার এর বিরুদ্ধে অভিযোগ গৃহিত হয়নি। ড্রেইফুস এর স্ত্রী তার নির্দোষিতার সপক্ষে প্রমান যোগাড় করে ঘুরতে থাকেন সরকারের দ্বারে দ্বারে। ব্যার্থ হয়ে দারস্থ হন সাহিত্যিক দার্শনিক এমিল জোলার। জোলা তাকে প্রথমে সহায়তা করতে রাজি না হলেও তার কাগজপত্রগুলি দেখে নিশ্চিত হন ড্রেইফুস নিরপরাধ।এক প্রবন্ধে ত্রিব্র ভাষায় তিনি এ্ই অবিচারের প্রতিবাদ করেন। কিন্তু অবিচারের প্রতিবাদ এর জন্য তিনিই বিচারের মুখোমুখি হন আইনের শাসন কে বাধাগ্রস্থ করার অভিযোগে। এমনকি প্যারিসের রাস্তায় উচ্ছৃঙ্খল মানুষের হাতে অপমানিতও হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমানিত হয় ড্রেইফুস নিরপরাধ। কিন্তু এই প্রমানের জন্য আইনের পথে কোন সুযোগ ছিলনা। জোলা, আনতোল ফ্রাস সহ কয়েকজন মানবতাবাদির নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তার প্রেক্ষিতেই শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার নতুন করে এই বিচার করতে বাধ্য হন। আইনের শাসন কিন্তু এখানে সত্যকে নয় বর্ং মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

আমাদের প্রতিবেশি ভারতের উত্তর পুর্বঅঞ্চলিয় রাজ্যগুলিতে জারি আছে আর্মড ফোর্সেস ষ্পেশাল পাওয়ার এক্ট বা আফস্পা নামে একটি আইন। যে আইনের বলে এই অঞ্চলে নিযুক্ত যে কোন সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনি সদস্য এই অঞ্চলের যে কোন অধিবাসিকে আটক এমনকি হত্যাও করতে পারবেন যার জন্য কোন জবাবদিহি করতে হবেনা্। অর্থাত এই কাজ গুলি সাধারন দৃষ্টিতে অপরাধ বলে মনে হলেও আইনের দৃষ্টিতে এগুলি অপরাধ নয়। ২০০০ সালে এই আইনের বলেই ভারতিয় আসাম রাইফেলস এরসদস্যরা মন্পিুরের ইম্ফল জেলার মালম শহরে হত্যা করে বাসের জন্য অপেক্ষারত দশজন মনিপুর বাসি নারি-পুরুষ কে। এই ঘটনার দুইদিন পর এর বিচারের দাবিতে অনশন শুরু করেন এক সামান্য চাকুরিজিবি তরুনি। ইরম শর্মিলা চানু। ছোটবেলা থেকেই সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে উপোষ থাকতেন ইরম শর্মিলা। ঘটনাটি ঘটে মঙ্গল বার। বৃহস্পতিবার তার নিয়মিত উপোষ এর দিন থেকে অনশন শুরু করেন শর্মিলা। দাবি আফস্পা আইন বাতিল এবং মনিপুরি সাধারন মানুষদের হত্যাকান্ডের বিচার। তিনদিন পর গ্রেফতার হন শর্মিলা ভারতিয় পেনাল কোড এর ৩০৯ ধারা (বাংলাদেশেও একই ধারায় একই আইন আছে) অনুযায়ি আত্মহত্যার চেষ্টার অপরাধে। পুলিশের হাতে থাকা অবস্থায় ও অনশন চালিয়ে যান শর্মিলা। জেল আইন এর দোহাই দিয়ে জোর করে তার নাক দিয়ে খাবার ঢুকান হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দশ বছর নেসাল ফিডিং ও স্যালাইন এর উপর নির্ভর করে বেচে আছেন শর্মিলা। কখনও জেলে কখনও বা বাড়িতে। কিন্তু তার প্রতিবাদ তিনি বন্ধ করেননি। দশটি বছর তিনি ন্যায় বিচারের আশায় আইনের নামে অত্যাচারের প্রতিবাদে যন্ত্রনা সহ্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু তার পরিবর্তে আইনের কাছ থেকে পেয়েছেন ন্যায়বিচারের বদলে আইনের শাসন এর নামে অবিচার। মহাত্মা গান্ধির দেশে এটা খুবই হাস্যকর নয়কি যে অনশন ধর্মঘটের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হওয়া! কিন্তু আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য শর্মিলা কিংবা বাস স্ট্যান্ড এর দশ নর-নারির চেয়ে আইন প্রনেতাদের ইচ্ছাতে কয়েকজন খুনি নিরপরাধ। শর্মিলা এই বছর দিল্লিতে আদালতের মুখোমুখি হয়ে সুষ্পষ্ট ভাষায় বলেছেন আত্মহত্যার কোন ইচ্ছা তার নাই। তিনি শুধু চান ভারত সরকার মানবতা বিরোধি আফস্পা আইন প্রত্যাহার করুন। কিন্তু আইন যতদিন আছে ততদিন মনিপুরের লেীহমানবি খ্যাত ইরম শর্মিলা চানুই বিচারের মুখোমুখি হবেন। হত্যাকারিরা নয়। নয় তাকে জোর করে নেসাল ফিডিং কারিরা।

আইনের শাসন যদি হয় এই তাহলে মানবতার স্থান কোথায়? আইন প্রনয়নকারিদের ইচ্ছাই যদি প্রদান করে আইনের মাধ্যমে হত্যাকে বৈধতা দেয়া তাহলে সেই আইনের শাসন এক জন্ অত্যাচারিত কে কি বঞ্চিত করবেনা ন্যায়বিচার থেকে। তাহলে মানবরচিত আইন যখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে মানুষকে বঞ্চিত করে তার প্রাপ্য ন্যায়বিচার এর অধিকার থেকে সেই আইন এর শাসন কি প্রতিষ্ঠা করতে পারে শান্তি।

বিষয়: বিবিধ

১৫৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File