কাল্পনিক গল্প - মা
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী আশরাফ ১১ মে, ২০১৪, ১১:০৭:২১ সকাল
প্রচন্ড প্রসব বেদনায় রিতিমত চিৎকার করে কান্না করছে নিঝুম...চারপাশ থেকে তার শাশুড়ী, বড় ননদ, ডাক্তার, নার্স তাকে শান্তনা দিচ্ছে...শাশুড়ী পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে মা আর একটু আর একটু...আল্লাহকে ডাক মা...আল্লাহকে ডাক...শাশুড়ীর মুখ থেকে মা ডাকটি যতবার শুনে ততবারই তার মনে শান্তির পরশ ছুঁয়ে যায়...বিয়ের পর থেকেই এই মহিলা তাকে মায়ের আদর দিয়ে আসছে
মায়ের আদর কেমন নিঝুম তা কখনোই জানতোনা...জানবেইবা কি করে...সে তো কখনো মায়ের আদর পায়ইনি...সে যখন তার গর্ভধারীনি মায়ের পেটে তখন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া এই সন্তান বৈধ না অবৈধ এই নিয়ে...শেষ অবধি ডিবোর্সে সমাধা হয় ঝগড়ার...কোনমতে প্রসব কাজ শেষ করে নিঝুমকে ফেলে রেখে মা চলে যান নিজের ক্যারিয়ার গঠনে উচ্চ শিক্ষার স্বার্থে অষ্ট্রিয়ায়...সেই থেকে নিঝুম বড় হয় নানীর কাছে...
নিঝুম যখন থেকে বুঝতে শিখে তখন থেকেই দেখে...বাড়ীর সবাই তার সাথে কেমন যেন অদ্ভুত আচরন করে...হুকুম ফরমায়েশ পালন করতে করতেই তার শিশুকাল দৌড়ে পালালো...আল্লাহর দান ছিল নিঝুম ছিল অত্যন্ত মেধাবী...কোন গৃহশিক্ষক ছাড়াই একা একা সবসময় ভালো রেজাল্ট করতো...তার সাথেই পড়ে মামাতো বোন গুলো দুইটা গৃহশিক্ষক রেখেও তার সাথে পাল্লা দিয়ে পারতো না...মামাতো বোনদের পুরাতন কাপড়ই ছিল তার ভরসা...শোনতো প্রবাস থেকে তার মা তার খরচা পাঠায়...সেই শোনা পর্যন্তই শেষ...মাঝে-মধ্যে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার সুযোগ হলেও মাকে কখনো বলা হয়না..."মা,ওরা আমাকে তুমি যা দাও তা দেয়না...তোমার পাঠানো পুতুল দিয়ে আমার মামাতো বোনেরা খেলা করে...চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে মা তুমি বিদেশ কেন? কি করো ওখানে? সবার সাথেই তার মা-বাবা থাকে...আর আমার বাবা কে তাতো জানিই না...তুমিও নেই কাছে...তোমার ছবি দেখেই বড় হলাম...তোমার কোলে কখনো মাথা রাখতে পারলামনা..."
মনে আছে এস এস সি রেজাল্টের দিন বাড়িতে বিশাল ঝগড়ার ঝড়-তুফান বয়ে যায় তাকে নিয়ে...সাতটা বিষয়ে এ+ সহ জিপিয়ে ৫ পাওয়াতে সবাই খুশি হওয়ার কথা...কিন্তু বাঁধ সাধলো তার মামাতো বোন ফেল করাতে...মামী ওকে গাল-মন্দ করছে...মারছে...সাথে যা বলছে তাতে কানে তুলো দিয়েও রক্ষা পাওয়া সম্ভ্যব নয়...আনন্দের বদলে নিঝুম অঝরে কেঁদেছে সারাদিন...রাতে একাকী ঘরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তার অবৈধ শরীরের সব অঙ্গ...সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় শেষ...এই অবৈধ রক্তমাংসে গড়া দেহটি আর জীবিত রাখবোনা...শেষ বারের মতো ফেইসবুক আর ব্লগের বন্ধুদের সাথে বিদায় নিয়ে হারিয়ে যাবে অজানার পথে...কিন্তু যাদের কখনো দেখেনাই সেই ব্লগের বন্ধুরাই রুখে দিল তার চলে যাওয়া...আত্বহননের বদলে মেরুদন্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে শপথ করেছিলো সেদিন...
টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচা নিজেই যোগান দিতে শিখেছে...বাড়ির কাজের মেয়ের মতো কাজ করেও পড়াশোনায় থাকে ঠিকঠাক...ইতিমধ্যেই সে সব জেনে গেছে...পৃথিবীতে সত্যিই সে এক অবৈধ সম্পর্কের ফসল...তাই মায়ের সাথে তার প্রচন্ড অভিমান...রাগে-ক্ষোভে গর্ভধারীনী মায়ের সাথে নেই কোন যোগাযোগ...একমাত্র আদর করা নানীও বিদায় নিয়েছে ধরত্রী থেকে...পৃথিবীতে তার আপন বলতে আর কেউ নেই...তাই পুরো পৃথিবীটাই তার...পৃথিবী জয় করাই তো তার সাজে...তাইতো এইচ এস সি তে আবারো এ+ পেয়ে সোজা ঢাকা ইউনির্ভাসিটিতে ইংরেজীতে অনার্সে চান্স পেয়ে যায়...অপ্রতিরোধ্য নিঝুম জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছে জীবনের পথে...
২য় বর্ষে পড়াকালীন এক ধনী ব্যাবসায়ী তার সব জেনে একদিন তার মায়ের সাথে নিঝুমের কথা বলে, মায়ের আপত্তি না থাকলে এই দু:খী মেয়েটিকে জীবন সাথী করতে চায়...ছেলের কাছ থেকে দু:খী মেয়েটির জীবন কথন শোনে চোখের জল আটকাতে পারেনি মায়াবতী মা...আবেগে গলে ছেলেকে অনুরোধ করে যেন কালই তাকে নিয়ে যায় দু:খী মেয়েটিকে দেখতে...এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসে...প্রথম দিনেই নিঝুমকে বুকে জড়িয়ে বলে তুমি কিন্তু মা আমার ছেলের বউ নও...তুমি আমার আর একটি মেয়ে...যে মেয়ে জীবনে কখনো মায়ের আদর পায়নি তার মা হবার সৌভাগ্য যেন আমার হয়...আমি আর তোমার চোখের পানি মাটিতে পড়তে দেবোনা...নিঝুম আনন্দে ঝর্ণার মতো কেঁদেছিল সেইদিন...মায়ের আদর এতো মধুর...এতো গভীর...এতো আবেগীয়...এতো তীব্র তা কখনোই অনুভব করেনি...নিঝুমের কাছে এই ভদ্রমহিলা মানুষ না...মানুষরূপী ফেরেস্তা...মা ছাড়া নিঝুমকে ডাকই দেয়না...পড়াশোনা ঠিকঠাক মতো করছে কিনা তার নজরদারী তো আছেই...ছোট ননদও প্রায় তার বয়সী...তাইতো মাকে মাঝে মধ্যে টিকা টিপ্পনী কাটে নতুন মেয়ে পেয়ে তো পুরান মেয়েকে ভুলেই গেছ...মাও কম যায়না তুই তো এত বছর মায়ের আদর পেয়েই বড় হয়েছিস এবার না হয় এই মেয়েটি একটু বেশিই পেল...আনন্দে মাঝে-মধ্যে কেঁদেই ফেলে নিঝুম...ইচ্ছে করেই ঘুমন্ত শাশড়ীর পায়ের তলায় শ্রদ্ধার চুমু খায়...
মা এতো ভাল...ভাবতেই ভাল লাগে...আজ সে নিজে মা হতে যাচ্ছে...আর কিছুক্ষন পরেই সে নিজে মা হবে...আরে একি শাশুড়ীর কোলে কাকে দেখে? কি সুন্দর ফুটফুটে একটি বাচ্চা...তাহলে কি তার প্রসব সম্পন্ন হয়ে গেছে...আরে তাইতো প্রসব বেদনা তো আর নেই...প্রসব বেদনায় কখন যে জ্ঞানশুন্য হয়েছে আর কখন যে বাচ্চা প্রসব হয়েছে...কিছুই বলতে পারেনা নিঝুম...আনন্দে গদগদ করতে করতে তার শাশুড়ী তার কোলে বাচ্চাটিকে দিয়ে বলে, "এবার তুমিও একজন কন্যা সন্তানের মা হলে...আগলে রেখ তাকে মায়ের মমতায়"
বিষয়: বিবিধ
২৩৭৫ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন