কবি ফররুখ আহমদ (আজ তার ৯৫ তম জন্মদিন)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী আশরাফ ১০ জুন, ২০১৩, ০৬:১৯:৪৩ সন্ধ্যা
কবি ফররুখ আহমদ
স্কুল জীবনে যে কয়েকজন কবির কবিতা আমার হৃদয় স্পর্ষ করেছে তাদের মধ্যে কবি ফররূখ আহমদ ও একজন...তার অনবদ্ধ সৃষ্টি পাঞ্জেরি কবিতাটিই সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে হৃদয় জুড়ে...আজ সেই প্রিয় কবির জন্মদিন। আসুন আজ এইদিনে তার সম্পর্কে সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করি।
কবি ও তার পরিবার:
প্রিয় কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ই জুন যশোরের মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতা - পুলিশ-অফিসার খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ও মাতা - রওশন আখতার। তিনি রমজান মাসে জন্মগ্রহন করেছিলেন বলে তার দাদী তাকে আদর করে রমজান বলে ডাকতেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে মা রওশন আখতার মারা গেলে জমিদারকন্যা দাদীমা তাঁকে লালন পালন করেন। পুণ্যবতী সুশিক্ষিতা দাদীমার কাছেই তাঁর কাব্যমানস তৈরি হয়েছিল। দাদীমা তাঁকে শুনিয়েছেন দাতা হাতেমতায়ী, দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীন, সত্যসাধক বাদশা আলমগীরের মজার মজার কাহিনী।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন।
কবির শিক্ষাজীবন:
দাদীমার তত্ত্বাবধানে নিজ বাড়িতেই শিক্ষার হাতেখড়ি তাঁর। প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা নিজ গ্রামের পাঠশালায়। পরে তিনি কলকাতা মডেল এম.ই. স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে সে স্কুল ছেড়ে তিনি বালিগঞ্জ স্কুলে ভর্তি হন। পরর্তীতে তিনি আবারো স্কুল পরিবর্তন করে খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানে থেকেই ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন।১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ করেন এবং কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্সে ভর্তি হন। পরে ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ভর্তি হন যদিও নানা সমস্যার কারনে বি. এ পরিক্ষা দিতে পারেননি।
কবির কর্মজীবন:
১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিসে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতায় এরপর সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টেও কিছু দিন কাজ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি বিখ্যাত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশ বিভাগের পরপরই তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় যোগদান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন রেডিওর স্টাফ আর্টিস্ট কাম স্ক্রিপ্ট রাইটার।
কবির লেখনী:
বিস্ময়ের বিষয় হলেও সত্য যে, ফররুখ আহমদ রচিত অর্ধশতাধিক গ্রন্থের মধ্যে মাত্র সামান্য কয়েকটি গ্রন্থই প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনকালে। অথচ বেঁচে থাকতেই কবি অসাম্যান্য কবি-খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর কাব্য প্রকাশে আগ্রহী প্রকাশকের সংখ্যাও কম ছিল না। এতৎসত্ত্বেও তাঁর অধিকাংশ রচনাই অপ্রকাশিত ছিল তাঁর জীবনকালে। এমনকি, তাঁর যে কয়টি গ্রন্থ তাঁর জীবনকালে প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে বেশ কয়টি গ্রন্থের সকল কপিই সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো পুনঃমুদ্রণের ব্যাপারে তাঁর তেমন কোন আগ্রহ দেখা যায়নি।
কাব্যগ্রন্থ -
সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪)
সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২)
নৌফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১)
মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩)
ধোলাই কাব্য (জানুয়ারি, ১৯৬৩)
হাতেম তায়ী (মে, ১৯৬৬)
নতুন লেখা (১৯৬৯)
কাফেলা (অগাস্ট, ১৯৮০)
হাবিদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১)
সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩)
দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪)[১০]
কবির কবিতার পড়তে এখানে ক্লিক করতে পারেন...Click this link
শিশুতোষ গ্রন্থ -
পাখির বাসা (১৯৬৫)
হরফের ছড়া (১৯৭০)
চাঁদের আসর (১৯৭০)
ছড়ার আসর (১৯৭০)
ফুলের জলসা (ডিসেম্বর, ১৯৮৫)
ফররুখ আহমদকে কবি হিসেবে জানলেও তিনি তার প্রথম জীবনে অনেক গল্প লিখেছেন -
মৃত বসুধা নামে গল্প সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৩৪৫ সালে বুলবুল পত্রিকায় ‘যে পুতুল ডলির মা’ নামে আরও একটি গল্প ছাপা হয়।
সিকান্দার শা-র ঘোরা নামক একটি উপন্যাস মৃত্তিকা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
১৯৪৬ সালে তার ‘আজাদ করো পাকিস্তান’ নামে আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
তার লেখা গ্রন্থ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন...Click this link
কবি শিক্ষা জীবনে যাদের সান্যিধ্য ব্যক্তিগন -
স্কুলজীবনের এ উচ্ছলতাময় সময়ে সংস্পর্শ পান কবি গোলাম মোস্তফা, কবি আবুল হাশিম ও সাহিত্যিক আবুল ফজলের এবং সখ্য গড়ে ওঠে সত্যজিৎ রায়, আবু রুশদ, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন প্রমুখের সাথে। কলকাতা রিপন কলেজ এবং স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কবি বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, প্রমথনাথ বিশীর মতো বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লেখকদেরকে শিক্ষক হিসেবে এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও ফতেহ লোহানীকে পান বন্ধু হিসেবে।
কবির কিছু হাতের লেখা -
কবির কিছু ছবি -
কবির জীবনে ও মরণোত্তর পুরষ্কার ও পদক:
১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক "প্রাইড অব পারফরমেন্স"
১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার।
১৯৭৭ একুশে পদক।
১৯৭৮ স্বাধীনতা পুরস্কার।
১৯৭৯ ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার।
১৯৮০ জুন মাসে বাংলা একাডেমী কতর্ৃক 'ফররুখ আহমদ রচনাবলি', ১ম খণ্ড প্রকাশিত।
১৯৮১ জুন মাসে বাংলা একাডেমী কতর্ৃক 'ফররুখ আহমদ রচনাবলি', ২য় খণ্ড প্রকাশিত।
১৯৮২ ঢাকায় 'ফররুখ একাডেমী' প্রতিষ্ঠিত। প্রাতিষ্ঠানিক ফররুখ চর্চার শুরু।
১৯৮৩ আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা উদ্যাপন কমিটি কতর্ৃক অন্য নয়জন বিশিষ্ট ভাষা-সৈনিকের সাথে 'ভাষা-সৈনিক সংবর্ধনা ও পুরস্কার (মরণোত্তর)' প্রদান।
কবি ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনে মৃত্যুবরণ করেন।
********************
পোষ্টটি ষ্টিকি হয়েছে তাই প্রিয় কবিতাটি যুক্ত করার লোভ সামলাতে পারলামনা...
পাঞ্জেরি
ফররুখ আহমদ
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলার এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
... রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা, পেরেশান মুসাফির দল।
দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে
নিরাশায় ছবি এঁকে!
পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের গান জুলমাত হেরি!
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।
মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।
কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!
ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।
পাঞ্জেরি!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!
**************************************
পরিশেষে বলা যায় কবি ফররুখ আহমদকে ইসলামী রেনেসাঁর কবি, গণজাগরণের কবি, ইসলামী ঐতিহ্যবাদী কবি, মন্বন্তরের কবি, বড় কবি এবং চল্লিশের শ্রেষ্ঠ কবি প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়ে থাকে।
তথ্যসুত্র:১. উইকিপিডিয়া
২. ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেষন
৩. ফেইসবুক ফররুখ ফান পেইজ
৪. প্রাইমখবর অনলাইন পত্রিক
৫. অনুরনন অনলাইন ম্যাগাজিন
বিষয়: বিবিধ
৬৩৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন