ছোট্টবেলার টুকরো স্মৃতিগুলো........
লিখেছেন লিখেছেন ঘুম ভাঙাতে চাই ১৩ অক্টোবর, ২০১৬, ০৯:১১:৩২ রাত
#কলিং বেল বাজানোর পর ঘরের দরজাটা খুলে গেল, কাজের মেয়ের কোলে থাকা আমার ৯ মাসের ভাস্তিটা হাত-পা ছুড়োছুড়ি শুরু করল, এ্যা এ্যা.. অভিমানী কান্না অর্থাৎ আমাকে কোলে নাও- কাজের মেয়ে বিরক্ত হয়ে আমার কোলে ওকে দিয়ে চলে গেল আর আমার কোলে আসতেই বাচ্চাটার জগৎ জুড়ানো বিজয়ের হাসি-ওর দিক তাকালে মনে হয় পৃথিবীর বাকি সমস্ত কিছুই তুচ্ছ। ওকে দেখে মাঝেমাঝে হারিয়ে যাই আমার ছেলেবেলায়। ছোটবেলা বলতে আব্বু-আম্মু, আমি আর আমার বোন। সারাদিন ওর সাথে খুনসুটি আর একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকা আর কিছু হলেই আব্বু-আম্মুর কাছে বিচার নিয়ে হাজির হওয়া। মারামারিতে আমার বোন ছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, আমাকে পিটাত খুবই দক্ষতার সাথে, তাই আমি নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে ওর সাথে ঝগড়া করতাম আর আমাকে দৌড়ানি দিলে আমি সোজা আম্মুর পিছনে গিয়ে লুকাতাম। ঐ সময় ওকে আমার আলিফ লায়লার মালিকা হামিরার মত ভিলেন মনে হত। বারবার ঝগড়ায় বলতাম, তোর মত বোন না থাকলে ভাল হত, ঝগড়াটি, হিংসুটে, শয়তান। আমি ভাবতাম ও আমাকে একদম দেখতে পারেনা তাই আমিও ওকে একদম ভালবাসিনা, এমন দস্যি বোনকে ভালবাসা যায় নাকি? স্কুলের ছুটিতে সেবার আমরা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গ্রামে সারাদিন দস্যিপনার জন্য ওর জ্বর আসল আর রাতে হটাৎই অনেক জ্বর বেড়ে গেল, মাথায় বারবার পানি দেয়া হল কিন্তু জ্বর কমেনা এরপর হটাৎই অজ্ঞান হয়ে গেল আর কোন কথা বলছিলনা। সেসময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলনা তাই সন্ধা নামলেই পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে যেত। সব মানুষ গভীর ঘুমে অচেতন, চারদিক বুক ধুকধুক করা অন্ধকার আর সুনসান নীরবতা, ঝিঝি পোকা আর শেয়ালের ডাক। আব্বু-আম্মু হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল আমাকে শুধু বলল, তোমার ফুফুর বাড়িতে এক্ষণি যাও। ফুফুর বাড়ি ৭-৮ মিনিটের দুরত্ব আর আমি তখন খুবই ছোট, অন্ধকার ভয় পাই কিন্তু সেদিন কি হল জানিনা, আমি পরিমরি করে সেই অন্ধকারের মাঝে ফুফুবাড়িতে ফুফাত ভাইদের ডাকতে ছুটলাম। আমার চোখ দিয়ে শুধু পানি পরছিল আর আমি বলছিলাম, আল্লাহ তুমি আমার বোনকে নিয়ে যেওনা আমি ওর সাথে আর একদম ঝগড়া করবোনা দেখে নিও! ফুফাতো ভাইরা এল, চাচা-চাচী, ফুফুও এল। পাশের গ্রামে একজন ডাক্তার থাকেন তারা ছুটলেন সাইকেল নিয়ে সেদিকে। পরেরদিন সকালে ও অনেকটাই সুস্হ হল। সেদিন বুঝলাম ওকে আমি কত ভালবাসি। যদিও আমি কথা রাখতে পারিনি আগের মতই আমাদের ঝগড়া আর খুনসুটি চলল।
#নানাবাড়ি ছিল বড় শহরে আর বাড়িটাও ছিল অনেক বড়। আর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুলের ছুটি হলেই নানাবাড়িতে আমরা বেড়াতে যেতাম। বড় মামা-আর অন্য খালারাও এই সময়টায় এসে নানাবাড়িতে হাজির হতেন আর আমরা সব কাজিনরা একসাথে হতাম। নানাবাড়িতে আম্মু-মামা-খালারা সব ভাইবোন একসাথে হলে তাদের খাওয়া-ঘুম কোন কিছুরই ঠিক থাকতনা তাই নানা-নানিই আমাদের দেখাশুনা করতেন। আমরা কাজিনরা সবাই নানাজির সাথে খেতে বসতাম।আমার বস ছিল "শায়লা আপু" সে যা বলত আমি তাই চিরন্তন সত্য বলে বিশ্বাস করতাম। বড় হয়েছি কিছুটা কিন্তু তখনও আম্মুই হাতে করে খাইয়ে দেয় তাই ভালভাবে ভাত মাখাতে পারিনা। ভাত মাখাচ্ছিলাম ৫ আঙ্গুল দিয়ে তা দেখে শায়লা আপু বলল, ঘুম এভাবে ৫ আঙ্গুল দিয়ে ভাত মাখাচ্ছিস কেনো? আমি আহত গলায় উত্তর দিলাম, আমি ভাত মাখাতে পারিনা। শায়লা আপু জবাব দিল, ৩ অঙ্গুল দিয়ে খেতে হয়, ৫ আঙ্গুল দিয়ে খেতে হয়না বুঝেছিস? আমি ভেংচি কেটে বললাম, হ্যা! তোমাকে কে বলেছে? শায়লা আপু জবাব দিল: দাদা (আমার নানা) বলেছে, যারা ৫ আঙ্গুল দিয়ে ভাত খায় বড় হলে তাদের বিয়ে হয়না, বুঝেছিস? আমি আৎকে উঠলাম কি সাংঘাতিক ব্যাপার!! নানাজানের কথা মিথ্যা হতেই পারেনা!! ভয়ে ভয়ে বললাম, আমাকে ৩ আঙ্গুলে খাওয়া শিখিয়ে দাও আপি। শায়লা আপু দেখিয়ে দিল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ৩ আঙ্গুল দিয়ে খেতে পারিনা। বারবার ভাবছিলাম, এখন কি হবে? বড় হলে আমার বিয়ে হবেনা!!! খুব চিন্তায় ছিলাম অনেকদিন।
#তখন খাওয়া শিখে ফেলেছি নিজের হাতেই কিন্তু ২ ঘন্টা লাগে খাবার গিলতে তাই আম্মু অধৈর্য হয়ে যান। তখন আইসক্রিম ছাড়া সকল খাদ্যই এত বিশ্রি লাগত বলার মত না তাই সুযোগ খুঁজতাম আর আম্মু একটু এদিক সেদিক সরেছে কি প্লেট নিয়ে ভো দৌড় সরাসরি বাথরূমে, ভাত ফেলে দিয়ে আবার উসাইন বোল্টের গতিতে খালি প্লেটে ঘরে ফীরে আসতাম, আম্মু দেখত প্লেট খালি, তিনি খুব খুশি আমি দ্বিগুণ খুশি... কিন্তু হাজার হোক ছোট চোর, বুদ্ধি কম তাই ধরা পরে গেলাম আর ঠাসঠুস পিঠের উপর।
#দাদা-দাদীকে আমি পাইনি। দাদি নাকি আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরত যখন আমার বয়স কয়েকমাস হবে। নানা-নানীর সাথে আমার ভাব অনেক বেশি। নানা-নানীকে সারাদিন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতাম কিন্তু তারা কোনদিন সামান্য বিরক্ত হতনা, রাগ করতোনা। নানা-নানী মারা গেছেন বছর ৩ ও ৪ হবে। যখন ভাবি আমার নানা-নানী নেই, মাথাটা ঘুরে ওঠে, সব কিছু হটাৎ কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যায়, চোখের পানি আটকে রাখটে পারিনা।
# আমি এখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছি। চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাবছি আচ্ছা আমি কার মত দেখতে? আম্মুর মত, নাকি আব্বু? একবার মনে হয় আব্বু, আরেকবার আম্মু। আসলে দুজন নর-নারীর মিশ্রণ আমি, তাই নিজেকে আলাদা করা কঠিন। যেসব মানুষগুলো নিজেদের মানুষ পরিচয় থেকে মেয়ে মানুষ বা ছেলেমানুষ পরিচয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, একে অপরকে ছোট করে বা নিছক আবেগের ফুলঝুড়ি ছড়ায় বা একে অপরের প্রতি বিষোদগার করে, তাদেরকে আমার কখনোই স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়না, মানুষিকভাবে অসুস্হ মনে হয় কারণ সে নারী বা পুরুষ যাই হোকনা কেন, সে তো অন্য দুজন নারী-পুরুষেরই মিশ্রণ, সে একাই একজন পুরুষ বা একাই একজন নারী হয়ে জন্ম নেয়নি। আমি যখন কারো সাথে কথা বলি তখন আমার কথা বলার ধরণ, আমার আচার আচরণ সব কিছুতেই আমি অবাক হই আর ভাবি, আরে এটাতো আমার আম্মু করে, এভাবে তো আব্বু বলে!! আমার মাঝে আব্বু-আম্মুর ব্যাপারগুলো এল কিভাবে?
# এটাই হয়ত পৃথিবীর নিয়ম। কিছু মানুষ আসে, তারা বেড়ে ওঠে, বীপরীত লিঙ্গের কাউকে জীবনে টানে তারাও নতুন মানব সন্তানের জন্ম দেয়, তাতে ডুবে থাকে হয়ত ভাবে, সময় বুঝি শেষ হবেনা, কিন্তু বেলা শেষ হয় আর মানুষগুলো পাড়ি জমায় অন্য পথে, না ফেরার দেশে। একসময় আমি ছোট ছিলাম কিন্তু তা এখন স্মৃতি, আজ আমি কিছু লিখছি কিন্তু এটাও হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি, স্মৃতি জমতে জমতে আমিও একদিন পৃথিবীর পাতায় হয়ে রইব স্মৃতি।
বিষয়: বিবিধ
২০৮৯ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দখল
আসলে দুনিয়াটাই এমন। জীবন থেকে দেখতে দেখতে পঁচিশটি বসন্ত পার হয়ে গেলো। কিন্তু আমার পাথেয় কতটুকু হলো?!
নিজের পাত্রের দিকে তাকালে শুধু শূন্যতাই দেখি।
ভাবতেই কেমন লাগে ------------ আমি কখনো আমার ভাইয়া ,মামনিকে ছেড়ে যাব না ।
ভাল লাগল ধন্যবাদ ।
@আফরা
অনেকদিন পর একটু হাসলাম ...
(যদিও আজ তারিখটা অশ্রুবর্ষণের)
নোটিশজারী তো হয়েই গেছে, আর কটা দিন!!<:-P <:-P
মানুষগুলো পাড়ি জমায় অন্য পথে, না ফেরার দেশে। Excellent Apu।
সময় চলে যায়। বদলে যায় সম্পর্ক এই পৃথিবি।
চমৎকার লিখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ্।
"ফিরিয়ে দাও সেই শৈশব এর শ্রাবন সেই কাগজের নেীকা বৃষ্টি জল"
এখনো মনে পড়ে তিন দশক এরও বেশি সময়ের আগের শৈশব। স্মৃতি রোমন্থন করে নস্টালজিক হয়ে যাই।
-আপনার বোনটির এখনকার অবস্থা কী?
-৫ আঙ্গুল এবং ৩ আঙ্গুলের ব্যাপারটার ফলাফল এড়িয়ে গেছেন কিন্তু!
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালাে লাগলো স্মৃতিময় শৈশব।
মন্তব্য করতে লগইন করুন