কারা এই খারেজী ও শিয়া/রাফেজী সম্প্রদায়? শিয়াদের চোখে আল মাহদি (আঃ) ও শিয়া নেতৃত্বদানকারী ইরানের আসল লক্ষ্যই বা কি?১ম পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন ঘুম ভাঙাতে চাই ২৯ মার্চ, ২০১৫, ০৮:১৩:২০ সকাল
ধারাবাহিক-১ম পর্ব
তারা যিলকাদ মাসের শেষভাগে মদিনা অবরোধ করল এবং জিলহজ্জ মাসের ১৮ তারিখ শুক্রবার পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত রাখলো। উসমান (রাঃ) কে তারা নিজ গৃহে আবদ্ধ করে ফেলল এবং তার বাড়িতে খাবার-পানির সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি তার বাড়ির কতিপয় লোককে হত্যা করল। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ), হাসান বিন আলী (রাঃ), কানবার (রঃ) কে রক্তাক্ত করল। তারা উসমান (রাঃ) কে সাফ জানিয়ে দিল "খলিফার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে" নতুবা তোমাকে খারাপ ভাগ্য বরণ করতে হবে। তোমাকে আর খলিফা হিসাবে মানিনা।"
কিন্তু উসমান (রাঃ)স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, এটা তোমাদের ব্যাপার। তোমাদের যাকে ইচ্ছা খলিফা হিসাবে নির্বাচন কর কিন্তু আল্লাহ আমাকে যে পোশাক পরিধান করিয়েছেন আমি কোনভাবেই সে পোশাক খুলবোনা। কারণ রাসূল (সাঃ) আগেই বলেছিলেন,"হে উসমান! আল্লাহ হয়তো তোমাকে একটি জামা পরিধান করাবেন। লোকেরা যদি তোমাকে তা খুলে ফেলতে চাপ দেয় তবে তুমি তা খুলবে না। (কিতাবুল মানাফিক, মুসনাদে আহমাদ, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদিস সংখ্যা:২৫৬৭৭, পৃষ্ঠা ১৪৯) (হাদিসটি তীরমিযী শরীফেও আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে।)
৩৫ হিজরীর ১৮ জিলহজ্জ, শুক্রবার ভোরে অবরুদ্ধ খলিফার ঘুম ভাঙল। ইবনে উমার (রাঃ), স্ত্রী নায়েলা (রাঃ) ও কাছের মানুষদের জানালেন, আজ আমি রাসূল (সাঃ) কে স্বপ্ন দেখলাম। "তিনি আমাকে বলেছেন, হে উসমান! আমাদের কাছে এসে ইফতার করো।"
খলিফা তখনই রোজার নিয়ত করলেন এবং কোরান তেলাওয়াতে বসে গেলেন অবরোধকারীরা তার ঘরে প্রবেশ করল নির্মমভাবে তাকে হত্যা করল। তার রক্তে কোরানের পাতাগুলো ভিজে গেল। তিনি শহীদ হয়ে গেলেন ইন্নালিল্লাহ আল্লাহু আকবার!
কারা এই হত্যাকারী? কিই বা ছিল তাদের পরিচয়?
মিশর, কুফা, বসরার কিছু নির্বোধ লোক যারা আবদুল্লাহ ইবনে সাবা নামের এক ইয়াহুদি (সে তার ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে) প্রতারকের দ্বারা বিভ্রান্ত হয় আর তার চক্রান্ত বাস্তবায়নে ব্যাবহৃত হয়। আর মারওয়ান ইবনুল হাকাম (উসমান রাঃ এর আত্বীয়) নামক ব্যক্তির নির্বুদ্ধিতায় পরিস্হিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে এবং বিভ্রান্ত লোকদের হাতে জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটে। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ তাই মদিনাবাসীর পক্ষে এত লোকের বিপক্ষে দাড়ানোও সম্ভব ছিলনা। তারা (বিশেষ করে মিশরিয়রা) আলী (রাঃ) কে খিলাফতের দায়িত্বভার নিতে চাপ প্রয়োগ করে। পৃথিবীতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী তালহা (রাঃ), যুবায়ের (রাঃ) সহ বেশ কিছু সাহাবী আলী (রাঃ) এর কাছে উপস্হিত হয়ে উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করলেন। কিন্তু নির্বোধ ১০,০০০ লোক বর্শা উচিয়ে সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো, "আমরা সবাই তার হত্যাকারী সুতরাং যারা কিসাস নিতে চায় তারা যেন তাদের সকলের নিকট থেকে কিসাস গ্রহণ করে।"
আলী (রাঃ) ছিলেন নিরুপায় তিনি বললেন, আমি কিভাবে এত লোকের বিরুদ্ধে দাড়াব, যারা উল্টা আমাদেরকেই নিয়ন্ত্রণ করছে? অন্যদিকে উসমান (রাঃ) এর স্ত্রীকে হত্যাকারীদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনিও বলেন, তারা যেহেতু মদিনার বাইরের লোক তাই আমি তাদের চিনতে পারিনি। হজ্জ উপলক্ষে আয়েশা (রাঃ) মক্কায় অবস্হান করছিলেন। তালহা (রাঃ), যুবায়ের (রাঃ) সহ বেশ কিছু সাহাবী তার সাথে গিয়ে দেখা করেন এবং দাবি তুলেন তারা আলী (রাঃ) কে বাধ্য করবেন উসমান (রাঃ) হত্যার বিচার করার জন্য। আলী (রাঃ) চাইলেন অবরোধকারীদের মদিনা থেকে বের করে নিয়ে যাবেন কারণ মদিনা আল্লাহর রাসূলের শহর এখানে আর কোন রক্তারক্তি হোক এটা তিনি চাননি তাই তিনি রওনা দিলেন ইরাকের দিকে। এবং ইরাকীদের নির্দেশ দিলেন তার অনুগামী হতে। উদ্দেশ্য রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় স্হানান্তর। কিন্তু আয়েশা (রাঃ) এর সাথে বিভিন্ন এলাকার লোক এসে যোগ দিল উসমান (রাঃ) হত্যার বিচারের দাবিতে। তারা আলী (রাঃ) এর পথে বাঁধা হয়ে দাড়ালেন। উভয়পক্ষ মুখোমুখি অবস্হানে তবে কিছু উত্তেজনাকর কালক্ষেপনের পর উভয় পক্ষের সাহাবীরা আলাপ-আলোচনা করে সমঝোতায় পৌছে গেলেন যে, হত্যাকারীদের বিচার করা হবে। খবর পৌছে গেল আবদুল্লাহ ইবনে সাবার নির্বোধ অনুসারীদের কানে। তারা বাঁচার পথ হিসেবে গোপনে আয়েশা (রাঃ) এর শিবিরে হামলা করে বসে। ফলে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে আয়েশা (রা) এর শিবিরও আলী (রাঃ) এর শিবিরে হামলা চালায়। সাবাইদের প্রতারণায় বেঁধে গেল যুদ্ধ শেষ হল প্রায় ১০,০০০ মুসলিমের জিবনের বিনিময়ে। তবে তা তাড়াতাড়িই মিটমাট হয়ে যায়।
ঘটনা শেষ না হতেই মুয়াবিয়া (রাঃ) ও একই যুক্তিতে আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন এবং ঘটনা গড়ায় সিফফিনের যুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ, সমঝোতা ও খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে আলী (রাঃ) এর পক্ষে প্রতিনিধি আবু মুসা আশআরী (রাঃ) ও মুয়াবিয়া (রাঃ) এর পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর নিয়োগ প্রদান, পরবর্তীতে সমঝোতায় পৌছাতে ব্যার্থতা_ এসব ইতিহাস আমরা সকলেই কম বেশি জানি। আর মূল আলোচনা এখান থেকেই শুরু কারণ এঘটনা থেকেই ইসলামে জন্ম নেয় দুটি মতবাদ। তা হল: খারেজী ও শিয়া মতবাদ।
খারেজী: বনু তামিম গোত্রের লোকেরা যারা ছিল সিফফিনের যুদ্ধে আলী (রাঃ) এর পক্ষে, তারা আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে বসে। তারা সিফফিনের যুদ্ধ, প্রতিনিধির মাধ্যমে সালিশি সমঝোতা ইত্যাদি কর্মকান্ডের জন্য আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আনে। খারেজীদের নিকট আলী (রাঃ) কর্তৃক প্রেরিত সাহাবী প্রতিনিধিদলের দ্বারা তাদের কিছু সংখ্যককে বুঝিয়ে ফীরিয়ে আনা এবং নাহরোয়ানের যুদ্ধে আলী (রাঃ) এর কাছে শোচনীয় পরাজয়ের কারণে তাদের মাঝে আলী (রাঃ) বিদ্বেশ আরো তীব্র হয়। তারা আলী (রাঃ) ও মুয়াবিয়া (রাঃ) উভয়কেই হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাদের হাতে আলী (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন এবং মুয়াবিয়া (রাঃ) আহত হন।
তাদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন:
"মূসা ইবনে ইসমাইল (রঃ)..ইউসায়ের ইবনে আমর (রাঃ)হতে বর্ণিত।তিনি বলেন,আমি সাহল ইবনে হুনায়েফ(রাঃ) কে জিঙ্গাসা করলাম,আপনি নবী (সাঃ)কে খারেজীদের সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন কি?তিনি বললেন,আমি তাকে বলতে শুনেছি, আর তখন তিনি তার হাত ইরাকের দিকে বাড়িয়েছিলেন যে,সেখান থেকে এমন একটি কওম বের হবে যারা কুরআন পড়বে সত্য,কিন্তু তা তাদের গলদেশ অতিক্রম করবে না, তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। (বুখারী-৬৪৬৫)"
চলবে_____
বিষয়: বিবিধ
৩০৩২ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার সুন্দর উপস্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার জন্য প্রাণভরে দোয়া করি পরম করুণাময় অন্তর্যামী আপনাকে দ্বীনের পথে অবিচলিত রেখে চলার পথ সুগম ও দুনো জাহানের কামিয়াবী অর্জনের তৌফিক দান করুণ। আমীন।
ইতিহাসকে স্মরন করার জন্য এবং লোকজনকে জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ
ধন্যবাদ ঘুম ভাঙনিয়া ভাইয়া ।
আপনার লেখায় ফিরে যাই।
কেন মিশর থেকে বা কূফা থেকে মুসলিম সৈনিক বা প্রতিবাদকারীদের মদিনায় আসা দরকার পড়ল – সেটা আপনি লেখেন নি! কেন? কারণগূলো লেখা কি জরুরী নয়? সে সময়ের আর্থ সামাজিক অবস্থা- পরিবর্তনের পট ভূমি, স্বজন বা গোত্র প্রীতি এগুলো লেখা দরকার নেই? উসমান ( রাঃ) এর বিরুদ্ধে যে গনরোষ ধুমায়িত হয় –আয়শা ( রাঃ) তাঁর শুরু করেন মদিনায়! তিনি তা কেন করলেন? কেনই বা আয়শা ( রাঃ) নিয়ে মসজিদে নববীতে উসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে রাসূল (সাঃ) এর জুতা হাতে নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হলেন তা লিখুন। লিখুন উসমান ( রাঃ) এর সময়ে ঊমাইয়া গোত্রের হাতে কিভাবে ‘ক্ষমতা কূক্ষীগত হয়ে পড়ল, মক্কা- ইরাক- কূফা- সিরিয়া- মিশর- সর্বত্র ঊমাঈয়া গভর্নর ! কেনই বা উসমান ( রাঃ) এর সৎ ভাই- গভর্নর ওয়ালীদ কূফার মসজিদে মাতাল অবস্থায় নামাজে ইমামতি করতে এসে বমি করে মীম্বর ভাসিয়ে দিল, কেন উসমান ( রাঃ) সেই অনাচারের বিচার করলেন না- কেন মানুষ এসব কারণে ক্ষিপ্ত হল- সে সব কথাও। কেন ইসলামের ‘ আধ্যাত্মিক আর রাষ্ট্রীয় শাসন ভার একই নেতার হাতে না থেকে (রাসূল (সাঃ) প্রতিষ্ঠিত সিস্টেম ), ঊমাঈয়া গোত্রের হাতে- বিশেষ করে মূয়াবীয়া ঈবণে আবূ সূফীয়াণ এর হাতে প্রাক -ইসলামিক ‘গোত্র তথা রাজতন্ত্রে পর্যবেষিত হল, কেনই শাসক শ্রেণী তাদের অধীনে বেতনভুক্ত ইমাম শ্রেণী তৈরি করল, তারই ধারাবাহিকতায় আজ ও, বেতনভুক্ত ইমাম শ্রেণী আল্লাহ্র হুকুমের চাইতে তাদের ‘বেতনদাতার হুকুমকে ‘প্রায়োরিটি’ মনে করেছে বা করছে ( যদিও ব্যতিক্রম আছে!) । সেটাই তারা প্রচার করছে, যা শাসক কূলের স্বার্থ রক্ষা করে!
বিষয় গূলো এত সহজ নয়! ইসলাম তো এক দিনে আজকের পরিস্থিতিতে আসে নি!
লিখলে ‘দু পক্ষের কথাই লিখুন- বাস্তব সত্য- যা ঘটেছিল- সেসময়ে । তা নাহলে, ১৪০০ বছর পরে আবার এক পেশে কাহিনী বলে শিয়া সুন্নি বিভাজনের আগুনে ঘী না ঢাললেই ভাল হয়। যে ঘটণা গূলো ঘটে গেছে- তা তো আমরা পরিবর্তন করতে পারব না, তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার, শিয়া সুন্নিদের বিভাজনে এখনো শুধু এক শ্রেণীর বা একই প্রকৃতির মানুষই লাভবাণ হবে- যারা ইসলামের শত্রু। আসুন, সেই পরিস্থিতিতে - বরং ঐক্যের মন্ত্র প্রচার করি, শিয়া সুন্নীদের ঐক্য হলে ইসলাম শক্তিশালী হবে। (যদিও ঐ সময়ের ‘নিরপেক্ষ তথ্য পাওয়া মুশকিল, ( তথ্য সমূহও – তথ্যদাতার ধর্মীয় সংযুক্তি বা AFFILIATION এর ভিত্তিতে ‘প্রভাবিত ) তবে - আল তাবারী কিম্বা সংক্ষেপে পড়তে চাইলে, অধুনা প্রকাশিত After the Prophet: The Epic Story of the Shia-Sunni Split in Islam , 2010 by Lesley Hazleton (Author) পড়তে পারেন)
ধন্যবাদ ।
আশাকরি সামনের পর্বগুলো দ্রুত পাব ইনশা আল্লাহ!সুন্দর উদ্যোগ! জাযাকাল্লাহু খাইর!
মন্তব্য করতে লগইন করুন