আফগানিস্থানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও তালেবান, আল কায়েদাসহ বিভিন্ন জঙ্গীদের ইতিকথা
লিখেছেন লিখেছেন এম আর মিলন ০৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৬:১০:৪২ সকাল
আফগানিস্থান দেশটির নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধ বিধস্ত একটি দেশ,গৃহযুদ্ধে জর্জরিত, বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপের আন্ত:লড়াই, আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরাশক্তিদের হস্তক্ষেপের একটি লীলাভূমি, এককালীন বিশ্ব সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেনের দুর্গ, তালেবান, আলকায়েদাসহ বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গীদের প্রজননক্ষেত্র ! আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে চেঙ্গীস খান, পারস্য, আরব ও আধুনিক যুগের সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, যুক্তরাস্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিবর্গ প্রত্যেকেই কোনো না সময় এইদেশটি হস্তক্ষেপ করেছে মূলত এই দেশটির ভৌগলিক অবস্থান ও এর ভূ-প্রকৃতির কারণেই। আমরা আফগানিস্থানকে যেরকমটি দেখতে অভ্যস্ত আফগানিস্থান একসময় মোটেও সেরকম ছিল না।দেশটিতে আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয় সেই ১৯২০ এর দশকে রাজা আমানুল্লাহর শাসনকালের সময়, কিন্তু পরবর্তীতে বিশেষ করে স্বায়ু যুদ্ধকালীন দেশটি হয়ে পড়ে দুই বিশ্বপরাশক্তির শক্তি পরীক্ষার লড়াই! এই লড়াইয়ে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দেশটিতে একমিলিয়নেরও বেশি আফগান নিহত হয়! যুক্তরাস্ট্র আফগানিস্থান থেকে সোভিয়েতপন্থী সরকার উৎখাতে তার তৎকালীন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে নাস্তানুবাদ ও পরাজিত করতে সারা বিশ্বব্যাপী মদত দিতে থাকে ইসলামিক চরমপন্থীদের। বিশ্ব থেকে কমিউনিজম নির্মূল করতে যুক্তরাস্ট্র যে নীতি অবলম্বন করে তার নাম Zbigniew Brzezinski's green belt doctrine. সেই ডকট্রিন অনুসারে আফগানিস্থানে গঠিত হয় তালেবান ও আল কায়েদা।সুদূর সৌদি থেকে ডেকে আনা হয় ওসামা বিন লাদেনকে। সিআইএর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, অর্থায়নে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় আল কায়েদা । প্রথমদিকে মূলত মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে এই সংগঠনগুলি পরিচালিত হত। অবশ্য যুক্তরাস্ট্র, পাকিস্থান ও সৌদি, আরব রাজা বাদশাহদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, কিন্তু কোনো জনসমর্থনের মাধ্যমে নয় আল কায়েদা ও তালেবানরা যৌথভাবে আফগানিস্থান থেকে সোভিয়েত উৎখাতে সক্ষম হয়।ক্ষমতাসীন হয় তালেবানরা যাদের ছিল না কোনো রাজনৈতিক জ্ঞান ও জনভিত্তি। আর এখন দিন যত যাচ্ছে আফগান সরকার ততবেশি শক্তিশালী হচ্ছে । বর্তমানে আফগান সরকার যতটা শক্তিশালী এটা দু’বছর আগেও ছিল না । আফগানিস্থানের সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ মিলে চার লাখের বেশি সদস্য। যেখানে বর্তমান আফগান সরকারের বৈধতা আছে সারা বিশ্বে সেখানে তালেবানদের কোনো বৈধতা ছিল না । এমনকি যখন তারা ক্ষমতায় ছিল তখনও তালেবানদের বৈধতা দেয়নি বিশ্ব। মাত্র তিনটি দেশ তালেবানদের স্বীকৃতি দিয়েছিল । পাকিস্থান, সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত । যে যুক্তরাস্ট্র তালেবানদের ক্ষমতায় এনেছিল তারাও তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়নি ! সেই থেকে ইসলামিক জঙ্গীদের উত্থান শুরু যা এখন পর্যন্ত বহমান আর যুক্তরাস্ট্রের এই কাজে তার প্রধান সহযোগী হলো পাকিস্থান, সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরবরাস্ট্রগুলি।কিন্তু মজার বিষয় যে, পাকিস্থান তার প্রতিবেশী আফগানিস্থানকে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে যুক্তরাস্ট্র ও সৌদির যৌথ প্রযোজনায় জন্ম দিয়েছিল তালেবান ও আলকায়েদা আর আজ সেই পাকিস্থান নিজেই তালেবান ও আলকায়েদা জঙ্গীদের তাণ্ডবলীলীয় বিপর্যস্ত ! পাকিস্থান এখন জঙ্গীদের আর এক প্রজননক্ষেত্র !
এটা চিরন্তন সত্য যে পাকিস্থান তালেবান ও আলকায়েদা উত্থানে যেমন প্রধান সহায়তাকারী রাস্ট্র ছিল তেমনি আফগানিস্থান থেকে তাদের উৎখাতেও যুক্তরাস্ট্রের প্রধান সহযোগী ছিল, কিন্তু তা প্রকৃত অর্থেই যুক্তরাস্ট্রের কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অর্থ সাহায্যের নিমিত্তেই। যুক্তরাস্ট্রকে দৃশ্যত পাকিস্থান সরকার সহায়তা করলেও পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা আএসআই ও সামরিক বাহিনী কখনই ইসলামিক জঙ্গীদের নির্মূলে আন্তরিক ছিল না, বরং তারা ভিতরে ভিতরে মদত দিকে থাকে তালেবান ও আলকায়েদা জিহাদিদের। এমনকি ৯/১১ এর ঘটনার পর পাকিস্থান তার ভূমি তালেবান ও আলকায়েদা জিহাদিদের জন্য মুক্ত করে দেয়। এই জিহাদিরা আফগানিস্থান থেকে সরে এসে পাকিস্থানে আস্তানা গাড়ে, আরো অবাক করার বিষয় কমিউনিজ হঠাতে র্যাডিক্যাল ইসলামের জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে আফগানিস্থান ও পাকিস্থানের মাদ্রাসাগুলি ব্যবহরা করা হয়েছে ও জন্ম দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার জিহাদী! সেই মাদ্রাসাগুলি থেকে এখন হাজার হাজার তরুণ বের হচ্ছে যারা আল কায়েদা ও তালেবানের জিহাদী মতাদর্শ লালন করে ও প্যান ইসলামিজমে বিশ্বাসী। এই র্যাডিক্যাল তরুণ প্রজন্ম পাকিস্থানসহ পুরো বিশ্বের জন্য আশু বিপদ ! বিশেষ করে সেকট্যারিয়ান বিভেদ যেমন শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব ও পাইকারী হারে শিয়া নিধন,ভিন্ন মতাবলম্বীকে অসহ্য, খুন,গুম, হত্যা, অগ্নি সংযোগ এমনকি মসজিদ,গির্জাসহ ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে হামলা, আত্মঘাতি হামলায় এরা নিয়োজিত ! একটু মতের অমিল হলেই যে কোনো ব্যক্তিকে এরা হত্যা, গুম করতে ভুলে না , পাকিস্থানে এরকম ঘটনা নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার । পাকিস্থানের আমজনতা থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী কেউ আজ নিরাপদ বোধ করেণ না ! এমনকি জঙ্গীদের নারকীয় তাণ্ডব থেকে প্রতিবেশী রাস্ট্রের মানুষও বাদ যায় না । এমনকি অবস্থা এখন এমন দাড়িয়েছে আফগানিস্থানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীগণ আফগানিস্থানকে পাকিস্থানের তুলনায় নিরাপদ বলে উল্লেখ করতেছেন। আফগানিস্থানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আশরাফ ঘানি বলেছেন, করাচির চেয়ে কাবুল নিরাপদ, লাহোরের চেয়ে মাজার শরিফ নিরাপদ !
আফগানিস্থান অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে উপনীতি হয়েছে।দেশটির প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা আফগান সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাস্ট্র ও ন্যাটো পর্যায়ক্রমে দেশটির নিয়ন্ত্রণ আফগান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে। এই ২০১৪ সালেই চুক্তি অনুসারে বিদেশী সৈন্য আফগানিস্থান ত্যাগ করার কথা, কিন্তু যুক্তরাস্ট্র চাচ্ছে নতুন চুক্তি করে কিছু সংখ্যাক ৮/১০ হাজার আমেরিকান সেনাকে আফগানিস্থানের মাটিতে রেখে দিতে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই নতুন করে কোনো চুক্তি করতে নারাজ ! হামিদ কারজাই সংবিধান অনুসারে আর প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না তাই হয়তো তিনি নতুন চুক্তির দায় দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। বর্তমান ৮ জন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর সবাই যুক্তরাস্ট্রের সাথে নতুন নিরাপত্তা চুক্তি করতে আগ্রহী।কারণ তারা যুক্তি হিসাবে বলছেন, আফগানিস্থানের সেনাবাহিনী এখনও জঙ্গী দমনে পুরোপুরি দক্ষ হয়ে ওঠেনি ও এজন্য তাদের আরো কিছু সময় প্রয়োজন।এছাড়া অস্ত্রগত ঘাটতিও আছে।অবশ্য তারা বলেছেন, আল কায়েদা ও তালেবান যদি পাকিস্থানের অভ্যন্তর থেকে সমর্থন না পেত তাহলে কারজাই সরকারের বিগত ১২ বছরের মধ্যেই জঙ্গীদের নির্মূল করা যেত।আফগানিস্থানের প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন হয় যার প্রায় অধিকাংশই পুরণ করে যুক্তরাস্ট্র ও তার মিত্ররাস্ট্রগুলি। তাই অর্থনৈতিক কারণেও তারা যুক্তরাস্ট্রের সাথে নিরাপত্তাগত চুক্তি করতে আগ্রহী।তবে তারা শর্ত দিয়েছেন, আফগানিস্থানে খুবই অল্প সংখ্যাক বিদেশী সেনা অবস্থান করবে এই শর্তে যে তারা শুধু আফগানিস্থানের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিবে।
গতকাল আফগানিস্থানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল। ফলাফল জানা যাবে শীঘ্রই ।কে হবেন হামিদ কারজাইয়ের উত্তরসূরি ? আটজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তিনজনের মধ্যে।আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ, আশরাফ ঘানি আহমদজাই ও জালমাই রাসুল এদের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে।হামিদ কারজাই তার ১২ বছরের শাসনামলে অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করেছেন। যুক্তরাস্ট্রের আর্শীবাদে ক্ষমতাসীন হলেও ইরানের সাথে যেমন সুসম্পর্ক স্থাপন করেছেন পাকিস্থানের চিরশত্রু ভারতের সাথেও অত্যন্ত সুসম্পর্ক স্থাপন করেছেন।তিন প্রধান প্রার্থীর মধ্যে জালমাই রাসুলকে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের ঘনিষ্ট বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। অবশ্য এই তিনজনের প্রত্যেকেই যেমন উচ্চ শিক্ষিত তেমনি হামিদ কারজাই সরকারের অধীনে তারা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় আফগানিস্থানের মত একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে এই প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে যাচ্ছে।সাংবিধানিক বাধার কারণে হামিদ কারজাই তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারছেন না । আরো অবাক করার বিষয় তারা ইতিমধ্যেই একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পেরেছে যা গত বছর আফগান পার্লামেন্ট অনুমোদন করে যা আমাদের বাংলাদেশ এখনও করতে পারেনি! আফগানিস্থান যেমন ভৌগলিকভাবে আ্ঞ্চলিক পরাশক্তি ও বিশ্ব পরাশক্তিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আফগানিস্থানের ভূ-প্রকৃতি ও জাতিগত বৈচিত্রও অনন্য! প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই জাতিগত পরিচয়ও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তবে প্রার্থীগণ জাতিগত পরিচয়ের উর্ধে্ব ওঠার কথা বলেছেন এজন্য তাদের অনেকেই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ভিন্নজাতি থেকে বাছাই করেছেনে।এদিকে নির্বাচন উপলক্ষ্যে তালেবানরাও বসে নেই । তারাও হুমকি দিয়েছে হামলার।ইতিমধ্যে তারা কয়েকটি হামলাও করেছে! তারপরেও জনসমর্থনহীন তালেবানরা তেমন সুবিধা করতে পারবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। আশা করা হচ্ছে, আফগানিস্থানের জনগণ তাদের জন্য যোগ্য একজন নেতাকে বাছাই করবে যিনি একই সাথে বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা, দেশে শান্তি, পুর্নগঠন ও জঙ্গীদমনে অধিক তৎপর হবেন।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৩৭৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন