মিসরে গণহত্যা অত:পর কোন পথে মিসর ?
লিখেছেন লিখেছেন এম আর মিলন ১৬ আগস্ট, ২০১৩, ০৬:১৪:১২ সন্ধ্যা
মিসরের সাম্প্রতিক গণহত্যায় একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে-যারা এতদিন সেনা কর্তৃক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি উৎখাতকে সেনা অভ্যুত্থান বলতে নারাজ ছিলেন তারাও এখন বলতে বাধ্য হচ্ছেন মিসরে মুরসি উৎখাত সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই হয়েছিল এবং যারা মুরসি উৎখাতকে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা হিসাবে দেখেছিলেন তারাই এখন বলতেছেন-মিসরে গণতন্ত্রের মুত্যু !
মিসরের ঘটনার প্রেক্ষিতে মিসরকে আলজেরিয়ার ৯১ সালের ঘটনার সম্ভবনার দিক তুলনা করেছিলাম, অনেকেই দ্বিমত পোষন করেছিলেন, কিন্তু ঘটনার বর্তমান প্রেক্ষিতে মিসর এখন একটি নতুন আলজেরিয়া ! মিসরে যা হলো তা ঘটনার কেবল শুরু মাত্র ! সামনে আরো অপেক্ষা করতেছে ভয়াবহ রক্তপাত ! ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব যতই বলুন যে তারা শান্তিপূর্ন বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন, কিন্তু ব্রাদারহুডের তরুণ প্রজন্ম ও বড় একটা অংশ বর্তমান ঘটনার প্রেক্ষিতে যে অস্ত্র হাতে তুলে নিবেন না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই । মানে মিসর এখন গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি ! এর সীমানা শুধু মিসর নয়, ক্রমেই গ্রাস করবে অপরাপর আরব দেশগুলিকে, করেছেও ইতিমধ্যেই । ইরাকে চলছে ভয়াবহ শিয়া-সুন্নি লড়াই, সিরিয়ার সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে লেবাননে। বাহরাইন ও ইয়েমেন ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীল, সৌদিতে চলছে শিয়া -সুন্নি লড়াই, তিউনিসিয়ায় চলছে সরকার বিরোধী আন্দোলন যদিও সেই আন্দোলন খুব একটা এখন পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তবে মিসরের পরই লক্ষ্য ছিল তিউনিসিয়া আর এরপর তুরস্ক । ইরানও ছিল বাট ইরানে তা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।
সবেচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, লড়াই শুধু শিয়া-সুন্নির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এই লড়াই এখন সেক্যুলার, বাম, শিয়া, সুন্নি, সালাফি, ওহাবী, তালেবান, আল কায়েদাসহ সব মত ও পথের মানুষ র্পায়ক্রমে শামিল হচ্ছে ! শমিল হচ্ছে না বরং বলা যায় সব শ্রেনীর মানুষদের শামিল করানো হচ্ছে । করানো হচ্ছে- এই করানোর কর্তা হলেন মধ্যপ্রাচ্যের মাত্র দুটি দেশ-ইসরায়েল ও সৌদি আরব আর আছে যুক্তরাস্ট্র । সৌদি এজন্য তার তেলের উৎপাদন প্রতিদিন বাড়িয়ে দিচ্ছে যাতে বর্তমান সংকটকে আরো দীর্ঘস্থায়ী ও বিস্তৃত করা যায়, কিন্তু এই ধর্মীয়, জাতিগত বিভাজন ও লড়াই হয়তো একদিন সবপক্ষকে আত্মপোলব্ধিতে সহায়তা করবে । একসময় ইউরোপিয়ানরাও নিজেদের মধ্যে শত শত বছর ধরে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে আজ তারা একতাবদ্ধ ।তেমনি বর্তমান ধ্বংসজজ্ঞ থেকে আশা করা যায় নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে ।
মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে যা হচ্ছে তা মূলত লড়াইটা হলো-পরাশক্তি ও আঞ্চলিক পরাশক্তিদের লড়াই-যুক্তরাস্ট্র, ইসরায়েল, সৌদি, কাতার, তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে। এতসব খেলোযাড়ের মধ্যে ইসরায়েল ও সৌদিই বর্তমান পর্যন্ত এগিয়ে। মিশরের মুরসি সরকার নিজেই এই লড়াইয়ের একটা অংশ হতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন নিজেই সেই লড়াইয়ের বলি !
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংকটের বীজ বপন করা হয়েছিল সেই তুর্কি খেলাফতকে ধ্বংস করার সময়ই । সে সময় আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের প্রবল চেতনা জাগিয়ে তোলা হয়েছিল এবং এরপরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে বৃহত্তর আরব তুর্কি খিলাফতকে অস্বীকার করে ইঙ্গো-মার্কিন চক্রান্তে খন্ড-বিখন্ড হয়ে পড়ে । ব্রিটেন, ফ্রান্সের মত সাম্রাজ্যবাদী রাস্ট্রগুলি সেই আরব ত্যাগ করার সময় আরবদের জাতীয়তাবোধকে কাজে লাগিয়ে তুর্কি খিলাফতকে ধ্বংস করে খন্ড বিখন্ড আরবকে স্বৈরাচার, ডিকটেটর ও রাজতান্ত্রিকদের কাছে ছেড়ে দেন । সীমানা নিয়ে বিরোধ, সংখ্যালঘুকে শাসনভারের দায়িত্ব সেই সময়ে করা ও দেওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইরাকে সংখ্যালঘু সুন্নির শাসন, বাহরাইনে সংখ্যালঘু সুন্নির শাসন, সিরিয়াতে সংখ্যালঘু আলাভি শাসন, আবার কোনো দেশে অন্য দেশের কাউকে এনে শাসনভারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যেমন জর্ডানে ও বাহরাইনে। আর দীর্ঘদিন ডিকটেটর ও রাজতন্ত্র কর্তৃক শাসিত হওয়ার ফলে সেসব দেশে একটা সুবিধাবাদী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে । এই সুবিধাবাদী শ্রেনীটা এখনো ক্ষমতার নিয়ামক। মানে আরব দেশগুলিতে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোনো শাসক গোষ্ঠী নেই ।দীর্ঘদিনের এসব শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অনাচার, অত্যাচার ও শোষনে অতিষ্ঠ হয়ে আরব জনগণ জেগে উঠে । শুরু হয় আরব বসন্ত।
আরব বসন্তের কারণে যে দেশটা সবচেয়ে আতংকিত ও ভীত হয়েছিল তা হলো ইসরায়েল। বিশেষ করে সেই বসন্তের ঢেউ যখন মিসরে আঘাত হানে তখন তো ইসরায়েলের জন্য আরো ভয়ংকর ব্যাপার হয়েছিল। কারণ মিসরে ইসরায়েলের জন্য দরকার মোবারকের মত কাউকে, আর না হলে এরকম অস্থিতিশীল ও উত্তপ্ত একটা মিসর, কিন্তু কোনোক্রমেই গণতান্ত্রিক মিসর নয় যদিও মিসরের মুরসি ইসরায়েল, আমেরিকা ও সৌদি অখুশি হয় এমন কিছুই করেননি বরং অনেক চেষ্টা চরিতার্থ করেছেন ইসরায়েল, সৌদি ও যুক্তরাস্ট্রের মন জোগানোর। সিরিয়া ও মিসরের বর্তমান ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল আপাতত সেই ভয়টা কাটিয়ে উঠেছে। ইসরায়েল এখন তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত নয় বরং ইসরায়েল এখন ব্যস্ত কি করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বাকি জমিটুকু দখল করে নেওয়া যায় ! বিশ্ব মিডিয়া যখন ব্যস্ত সিরিয়া ও মিসর নিয়ে ইসরায়েল তখন ব্যস্ত ফিলিস্তিন ভূমিতে বসতি স্থাপন নিয়ে ! জোর কদমে ফিলিস্তিন ভূমিতে ইসরায়েলের চলছে বসতি স্থাপন !
যুক্তরাস্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদির অনুমতি ছাড়া মিসরের সেনা প্রধান সিসি এরকম একটা ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত করেছেন তা কোনো পাগলেরও বিশ্বাস করার কথা নয়।ইসরায়েল ও যুক্তরাস্ট্রের জন্য কোনো স্থিতিশীল ও শক্তিশালী মিশর নয় বরং বর্তমান মিশরই তাদের প্রত্যাশা । সিসি এখানে কিছুই নয় তিনি শুধুমাত্র দাবার ঘুটি হয়েছেন মাত্র আর ইসরায়েল, সৌদি ও আমেরিকার ফর্মুলা বাস্তবায়ন করেছেন মাত্র, সেই বাস্তবায়নের তিনি এখন শেষ পর্যায়ে । অচিরেই সিসিকে সরিয়ে দেওয়া হবে এবং তৎস্থলে আসবেন নতুন কোনো মোবারক।
যাইহোক, মুরসিকে এভাবে উৎখাত ও সামরিক অভিযান চালিয়ে গণহত্যা না করলেও চলত কারণ মুরসির ব্রাদারহুড ইসরায়েল ও আমেরিকার জন্য কোনো আসন্ন বিপদ ছিল না । আর ব্রাদারহুড তো সমঝোতার জন্য প্রস্তুতই ছিল।খবরে প্রকাশ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কুটনীতিতে ব্রাদারহুড শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়েছিল মুরসিকে সাময়িক পুনর্বহাল করে মুরসি নিয়মাতান্ত্রিকভাবে কোনো অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করত, এটা বাস্তবায়িত হলে সব পক্ষেরই মঙ্গল হত। সম্ভবত এল বারাদি এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন । তাই তো তিনি গণহত্যার কারণে পদত্যাগ করেছেন । কিন্তু মিসরের সেনা সরকারও সে প্রস্তাব শুনেনি।কারণ, সেনা সরকারের উদ্ধেশ্য হলো মিসরের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ব্রাদারহুডের কোনো জায়গা না রাখা, কিন্তু একটা আদর্শকে এভাবে ধ্বংস করা কখনই সম্ভবপর হয় না , বরং ধ্বংসজজ্ঞ থেকে যে আদর্শ নতুন করে উঠে আসে সেটা পরবর্তীতে কারো জন্য সুখকর হয় না, হয়ে উঠে ভয়ংকর !
এই কারণে ভয়ংকর হবে যে এরা গণতন্ত্রকে মেনে নিয়েছিল, ব্যালট বক্সে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, সবার সাথে সুসম্পর্ক চেয়েছিল, এমনকি মুসলমান ও আরবদের জাত শত্রু ইসরায়েলের সাথেও এরা সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল ও করেছিল, কিন্তু এদেরকে বুঝলনা পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলে । বরং তাদের এই ধারণাই দেওয়া হলো গণতন্ত্র তোমাদের জন্য নয় । তোমরা অন্য পথ দেখ । মুসলমানদের মধ্যে যারা সশস্ত্র পথে বিশ্বাসী তাদের যুক্তিটাকে বড় করে দেখানো হলো এবং ব্রাদারহুডকে বরং তাদের দিকেই ঠেলে দেওয়া হলো । এতে আপাতত ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বের লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে কোন লাভ হবে না । কারণ এর পরের ব্রাদারহুড হবে ইসরায়েল ও আমেরিকার জন্য ভয়ংকর ! আমাদের সামনেই এর প্রকৃষ্ট উদারহরণ ইরান, কিন্তু ব্রাদারহুড কতটুকু পারবে সেটাই দেখার বিষয়।
সিরিয়ার ঘটনার মাধ্যমে আরব বসন্তকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর মিসরের ঘটনার মাধ্যমে আরব বসন্তকে কবর দেওয়া হলো ।এখানেই ইসরায়েল, সৌদি ও আমেরিকার সফলতা ।এজন্য সৌদি ও আরব রাজতন্ত্রের আয়ু হয়তো আরো দীর্ঘায়িত হলো, কিন্তু সেই কফিন থেকে যদি লাশ জিন্দা হয়ে উঠে সেই জিন্দা লাশ হবে ইসরায়েল, আমেরিকা ও সৌদির জন্য আরো ভয়ংকর। তখন আর কোনো সিসি দ্বারা কাজ হবে না । সেই কবরেই নতুন লাশ হবে ইসরায়েল ও সৌদি রাজতন্ত্র, আর পালাবার পথ পাবে না যুক্তরাস্ট্র ।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৬০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন