সেনা অভ্যূত্থান কি হতে যাচ্ছে নাকি অনিশ্চিত পথে মিশর ?

লিখেছেন লিখেছেন এম আর মিলন ০৩ জুলাই, ২০১৩, ০১:৪৯:০৩ দুপুর

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের মাধ্যমে কখনো কোন দেশে বিপ্লব সাধিত হয়েছে কি ? আমি এখানে বিপ্লবের কথা বলতেছি এই জন্য যে কোন একটা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও সেই দেশের ঔপনিবেশিক আমলের শাসন যন্ত্রের খোলসসমেত আমূল পরিবর্তন কখনো গণতন্ত্রের মাধ্যমে হয় না । হাঁ, হয় না যে এর চাক্ষুস প্রমান মিশর।

আমি এপ্রসঙ্গে দুটো দেশের বিপ্লবের কথা এখানে উল্লেখ করব। কিউবা ও ইরানের বিপ্লবের কথা। কিউবায় বিপ্লব হয়েছিল ফিডেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে মার্কিনপন্থী বাতিস্তা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং পরবর্তীতে কিউবা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। অন্যদিকে ইরানে ১৯৭৯ সালে বিপ্লব হয়েছিল আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে মার্কিনপন্থী শাসক রেজাশাহ পাহলভীকে উৎখাত করে এবং বিপ্লব হওয়ার পরপরই তেহরানের মার্কিন দুতাবাস দখলকে কেন্দ্র করে যুক্তরাস্ট্র ইরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল দুটি দেশেই বিপ্লব এখনো টিকে আছে আর এই টিকে থাকার মুল কারণ হল মার্কিনপন্থী সরকারকে উৎখাত করার পর ফিডেল ক্যাস্ত্রো ও খোমেনী দুজনেই সাবেক সরকারের কাউকে তাদের নতুন শাসন ব্যবস্থায় রাখেননি, তাদের সবাইকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছেন এবং তারা দুজনেই কিউবা ও ইরানের শাসন ব্যবস্থার পুরো পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, কারণ গণআন্দোলন ও বিপ্লব তাদের নেতৃত্বেই হয়েছিল তবে পার্থক্য হল কিউবাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কমিউনিস্ট সরকার ও ইরানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামি সরকার আর দুটো দেশই বর্তমানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অন্যতম রাস্ট্র।

সাম্প্রতিক আরব জাগরণে যেটাকে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম অ্যাখ্যায়িত করেছে আরব বসন্ত হিসাবে সেই বসন্তের হাওয়া লেগেছিল মিশরে । সেই মরু ঝড়ে মাত্র অল্প কয়েকিদেনর মধ্যেই গদি হারালেন তিন দশক ব্যাপিয়া একচ্ছত্র মার্কিন ও ইসরায়েলী তল্পীবাহক মোবারক, কিন্তু মোবারকের গদি হারানোই মিশরীয়( আরব) বসন্তের সফলতা নয় । এজন্য বলা হয় স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাই কঠিন। কোন একটা গণআন্দোলন এমনি এমনি রাতারাতি গড়ে উঠে না ।শাসন যন্ত্র দ্বারা জনগণ যখন নিষ্পেসিত হয় দিনের পর দিন, নির্যাতিত হয় বছরের পর বছর, জনগণের পিঠ দেয়ালে যখন ঠেকে যায় তখনই জনগণ জেগে উঠে কিন্তু জনগণের ডাকা আন্দোলন সাময়িক সফলতা পেলেও সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সেটা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল দিতে পারে না । মিশরে হয়েছে তাই ।

মিশরে যে মোবারক বিরোধী আন্দোল শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলনে মিশরের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে ব্রাদারহুডের ভূমিকা খুবই সামান্য মাত্রায় ছিল অথচ সেই ব্রাদারহুডই সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। ব্রাদারহুডের বর্তমান রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ এখানেই নিহিত। কারণ যে যুব সমাজ মিশরের পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিল সেই যুব সমাজের কাছে পরিশেষে কোন নেতৃত্ব থাকেনি আর তাদের কাঙ্খিত পরিবর্তনও মিশরে হয়নি অর্থাৎ মুরসির সরকার সেই ইপ্সিত পরিবর্তন আনতে পারেনি।বলা যায়, ব্রাদারহুড সেই মোবারক বিরোধী বিক্ষুব্ধ জনতাকে তাদের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারেনি।কারণ ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে মিশরের সেই আন্দোলনও হয়নি।

এটা ঠিক, মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরের একটি অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল। দলটি প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই সরকারের রোষানলের শিকার। এই দলের প্রতিষ্ঠাতাসহ বিভিন্ন শীর্ষ নেতা ও তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী তৎকালীন সরকার দ্বারা হত্যা, গুমসহ নির্যাতিত হয়ে এসেছিল।তবে দলটি দীর্ঘকালীন নিষিদ্ধ থাকলেও তাদের কার্যকক্রম তারা কখনো বন্ধ রাখেনি । অনেকটা স্বতন্ত্রভাবেই তারা তাদের কার্যক্রম গোপনে ও প্রকাশ্যে চালিয়েছিল । তবে তারা নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে বিশেষ করে মনোযোগ দিয়েছিল বিভিন্ন চ্যারিটি মূলক কার্মকান্ডে । এতে তারা জনগণের ভালই সাড়া পেয়েছিল। মোবারক বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি সক্রীয় না হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটা ছিল তারা নতুন করে আর সরকারের রোষানলে পড়তে চায়নি।কারণ মিশরের তরুণ প্রজন্ম যে আন্দোলনকে এতদুরে নিয়ে যেতে পারবে ব্রাদারহুডের হয়তো সেটা কল্পনাতেও ছিল না ! ব্রাদারহুডের কল্পনাতেও হয়তো ছিল না তারা মিশরীয় তরুণ সমাজকে যেভাবে চিনেছিল সেটারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে । সেই মিশরীয় তরুণ সমাজ মোবারকের জো হুকুম জাহাপনার মত আর নেই। এটা বুঝতে পেরেই যুক্তরাস্ট্র তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র হুসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিল।

মোবারক কোন সমৃদ্ধশালী ও উন্নত মিশর রেখে যাননি। সেখানকার বেশিরভাগ জনগণেরই অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই করুণ। জনগণের একটা বৃহত্তর অংশ কবরস্থানে, খোলা আকাশে রাত্রি যাপন করে। এছাড়া বিদেশী ঋণে জর্জরিত মিশর । তারপরেও বিশেষ করে যুক্তরাস্ট্রের অর্থনৈতিক সহায়তার উপর মিশর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ইসরায়েলের পর মিশরই যুক্তরাস্ট্রের অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়ে থাকে। দীর্ঘদিন থেকে ইসরায়েল ও যুক্তরাস্ট্রের বরকন্দাজের ভূমিকা পালনকারী মিশর যুক্তরাস্ট্রের সহায়তা সামরিক জেনারেল ও উচ্চভিলাসী শাসকচক্রের আয়েশ আরাম মেটাতেই খরচ হয়ে যায় । মুরসি ক্ষমতায় এসে এ ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন করতে পারেনি । তাই জনগণের ভাগ্যেরও কোন উন্নয়ন হয়নি।মুরসি যেমন পারেননি সেনাবাহিনীর মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে তেমনি পারেননি বিচার বিভাগেরও কোন পরিবর্তন আনতে।

আগেই বলেছি মিশরের রাজনীতিতে ব্রাদারহুডের উত্থান অনেকটা স্বাভাবিকই ছিল যদিও মোবারক বিরোধী আন্দোলনে ব্রাদারহুডের ভূমিকা অত্যন্ত গৌণ ছিল। মোবারক চলে যাওয়াতে মিশরের ক্ষমতার যে শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়েছিল আগে থেকেই সংগঠিত হওয়ার কারণে সেই শূন্যস্থান রাতারাতি পূরণ করে ব্রাদারহুড অন্যতম একটি শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। রাজনীতির মাঠে বিপর্যস্ত ব্রাদারহুড তথা মুরসির অন্যতম ভরসা এখন উগ্র সালাফিরা । অবশ্য সালাফিরা মিশরের রাজনীতিতে একটি শক্তি হলেও এ যাত্রায় ব্রাদারহুডকে কতটুকু সহায়তা করতে পারবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এই সালাফিদের তুষ্ট করতেই মুরসির সরকার সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আর অন্যদিকে যুক্তরাস্ট্রকে তুষ্ট করতেই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছে । তারপরেও কুল রক্ষা করতে পারছে না মুরসি।

যে তরুণ প্রজন্ম মিশরের ক্ষমতা পরিবর্তনের নিয়ামক হয়েছিল এবং ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল সেই তরুণ প্রজন্মই আবার ফিরে এসেছে তাহরির স্কয়ারে।তাই মোবারক সময়ের শেষের দিকের উত্তপ্ত মিশর এখনো উত্তপ্ত রয়ে গেছে । এর মাধ্যে নতুন করে আবার শুরু হয়েছে মুরসির পদত্যাগের আন্দোলন । প্রেসিডেন্ট মুরসিকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়েছে বিরোধী দল। মোবারক বিরোধী আন্দোলনে তাহরির স্কয়ারে যত লোক সমাগম হয়েছিল তারচেয়েও বেশি লোক জড়ো হয়েছে মুরসি বিরোধী আন্দোলনে ! মুরসির মন্ত্রীসভা থেকে পাঁচজন মন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন ইতিমধ্যেই, এমনকি সরকারের মুখপাত্রও পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন । সেনাবাহিনী মুরসিকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলেও মুরসি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন । অবশ্য মুরসি একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট । তার সে আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান না করে উপায় ছিল না । আবার সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপের হুশিয়ারী দিয়েছে। এরমধ্যেই পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষনা করেছে। সংবিধান স্থগিত করার কথাও কানে আসতেছে । যদি তাই হয় তাহলে এটাকে সামরিক অভ্যূত্থান বলা ছাড়া উপায় থাকবে না । হয়তো মুরসি ক্ষমতা হারাচ্ছেন শীঘ্রই । তহালে কি মিশর দেখবে নতুন কোন সেনা শাসক ? ৯০ এর দশকে আলজেরিয়ার কথা স্মরণ করুন । সেখানে কিন্তু অনেকটা এরকম পরিস্থিতি হয়েছিল । নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরেও সেখানে শেষ পর্যন্ত ইসলামিক পার্টিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি।উপরুন্ত পরবর্তীতে সেই ইসলামিক পার্টির হাজার হাজার নেতা কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। যারা ফলাফল দীর্ঘ মেয়াদে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল আল জেরিয়া। অবশ্য মিশরের বিরোধী দল সেনা অভূত্থানের বিরোধীতা করেছেন।আশা করি সেটা হয়তো হবে না । কারণ সেনা শাসক সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের জন্য বিপদের কারণ হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার ও বিরোধী দল সংলাপের পথে গেলে অবাক হব না । শোনা গেছে বিরোধী দল প্রধান আলোচক হিসাবে জাতিসংঘের সাবেক পরমানু কর্মকর্তা মোহাম্মদ এল বারাদির নাম প্রস্তাব করেছেন যদিও তিনিও একজন পশ্চিমাপন্থী তারপরেও এটাই হবে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ পথ ও সবার জন্য মঙ্গল। তা না হলে যদি মুরসি উৎখাত হয় তাহলে তো ব্রাদারহুডেরও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে আর তখন কি ব্রাদারহুড আঙ্গুল চুষবে ? প্রশ্ন থেকে যায় ।

মিশরীয় সমাজ বর্তমানে নানা ভাগে বিভক্ত। চরমপন্থী সালাফিরা যেমন সক্রিয় তেমনি মডারেট মুসলিমসহ ব্রাদারহুড, সেক্যুলার ও বামপন্থীরাও সক্রীয়। মিশরের বিরোধী দল কয়েকটি অংশে বিভক্ত এর মধ্যে আছে সেক্যুলার ও বামপন্থী আর আছে মোবারক পন্থী মানে মোবারক আমলের সুবিধাভোগীরা এবং এরা প্রশাসনেও ব্যাপকমাত্রায় সক্রিয় আর রাজনীতিতে বামপন্থীদের অবস্থানও যথেষ্ঠ শক্তিশালী। মিশরে সেনাবাহিনী ও এমনকি এখনো বিচার বিভাগ মোবারকপন্থীদের নিয়ন্ত্রনে। মিশরে সেই অর্থে আমরা বিপ্লব বলতে পারি না । ক্ষমতার পালা বদল বলতে পারি অর্থাৎ পুরাতন বোতলে নতুন মদ। যে কারণে জনমনে মোবারক বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধেছিল সেই নিয়ামকগুলি মিশরে এখনো বর্তমান । তাই মিশর এখনো অস্থিতিশীল । এটা ঠিক, যে মিশরীয়দের আগে বাক স্বাধীনতা ছিল না সেই মিশরীয়রা এখন বাক স্বাধীনতা ভোগ করতেছে তবে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে সেই বাক স্বাধীনতা দিয়ে কি হবে ? এখানেই মূল রহস্যটা । এক বছরের মুরসি সরকারকে সফল যেমন বলা যায় না তেমনি চুড়ান্তভাবে হয়তো ব্যর্থও বলা যায় না কারণ তার এখনো কয়েক বছর বাকি। তবে মিশর বর্তমানে এক অনিশ্চিৎ গন্তব্যের পথে ..........

বিষয়: আন্তর্জাতিক

১৯৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File