ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে সিরিয়া ( ২য় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন এম আর মিলন ২৩ জুন, ২০১৩, ০২:২০:৩১ দুপুর
সিরিয়াতেও আরব বসন্তের ঢেউ লেগেছিল সেটা আগেই বলেছি কিন্তু সেই ঢেউ যেমন পারেনি শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে তেমন পারেনি নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে।আর ইসরায়েল, আমেরিকা ও মার্কিনপন্থী পুতুল আরব শাসকরা নিজেরাও এরকম একটা সুযোগ খুজতেছিল । কারণ এই মার্কিনপন্থী পুতুল আরব শাসকরা ইসরায়েলকে যতটা না হুমকি মনে করে তার চেয়ে শতগুণে তারা হুমকি মনে করে ইরানকে যদিও এরকম কোন নজির নেই যে কম করে হলেও পাঁচশত বছরের মধ্যে ইরান আরবদের কোন দেশ আক্রমণ করেছে অথচ ইসরায়েলের এরকম ভুরি ভুরি প্রমান আছে । সিরিয়া, ইরান, হামাস ও হিজবুল্লাহ যেহেতু মিত্র আর এরা সবাই মার্কিন-ইসরায়েল বিরোধী একটি অক্ষশক্তি আর আরব শাসকদের ক্ষমতার উৎস তাদের জনগণ নয় বরং তাদের ক্ষমতার উৎস হল মার্কিন ও ইসরায়েলী তাবেদারী তাই তাদের প্রভুদের সন্তুষ্ট করা ও আরবের বসন্তকে হাইজ্যাক করা যাতে সেই বসন্তের ঢেউ স্বৈরাচারী রাজাবাদশাহদের শরীরে না লাগে এজন্য সিরিয়ার শান্তিপূর্ণ ঢেউকে সশস্ত্র বিপ্লেবে রুপ দেওয়া ছিল এই পাপেট আরবদের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য । আর আমেরিকা-ইসরায়েলের উদ্দেশ্য হল সিরিয়াকে ধ্বংস বা দুর্বল করে আমেরিকা-ইসরায়েল বিরোধী জোটকে নির্মূল করা আর ফিলিস্তিনিদের বাকি খন্ড খন্ড জমিটুকু ইসরায়েলের জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া । তুরস্কের উদ্দেশ্য হল মধ্যপ্রচ্যে ইরানের প্রভাব খর্ব করে নিজের ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অবস্থায় ফিরে আসা যেখানে তুরস্কই হবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির নিয়ন্ত্রনকর্তা কিন্তু তুরস্কের এটা মনে হয় উপলব্ধিতে নেই যে ন্যাটোর অংশীদার, আমেরিকা-ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে মুসলমানদের নেতৃত্ব দিতে গেলে সেটা বুমেরাং হবে । হয়েছেও তাই । এখন তুরস্ক পাকিস্থানের মত নিজের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত । তাকসিম চত্বর অন্যতম উদাহরণ।
এখন আসা যাক সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কারা কারা ?
সিরিয়াতে লড়াইরতম বেশিরভাগই যোদ্ধা হল বিদেশী। এর মধ্যে আছে আল কায়েদা, তালেবান, ফাতাহ আল ইসলাম,জুনুত আল ইসলাম,হিজবুত তাহরীর, ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপ ইন লিবিয়াসহ আরো অনেক বিদেশী জঙ্গী আর এর সঙ্গে আছে সিরিয়ার আর্মির সামান্য একটু বিচ্যুত অংশ। সৌদি আরব, কাতারসহ কতিপয় আরবদেশগুলি থেকে হাজার হাজার দাগী আসামীকে যারা খুনসহ বিভিন্ন ভয়ংকর অপরাধে অভিযুক্ত তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সিরিয়ায় এই শর্তে যে তারা সিরিয়ান সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এছাড়া চেচনিয়া,লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার উগ্রপন্থী মুসলিম যোদ্ধাগণ সিরিয়ার যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল- জাওয়াহিরির ভাই মুহাম্মাদ আল-জাওয়াহিরি সিরিয়ায় আটক হয়েছেন। সিরিয়ার সামরিক বাহিনী তাকে দারা শহর থেকে আটক করেছে বলে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে।আল কায়েদার সিরিয়া শাখার নাম হল আন্ নুসরা । এই কয়েকদিন আগে সৌদি আরবের গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স বন্দর বিন সুলতান বিন আব্দুল আজিজ আলে সৌদ সিরিয়ার বিদেশি মদদপুষ্ট বিদ্রোহীদের আল-কায়েদার নেতৃত্বে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আল-কায়েদার সিরিয় শাখা আন্-নুসরার নেতৃত্বে কাজ করতে অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের হত্যা করা হবে। এই ফ্রি সিরিয়ান আর্মি পরিচালিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং ন্যাটো রাষ্ট্রগুলোর সরাসরি তত্বাবধানে। ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে তুরস্কে। অর্থায়ন করতেছে সৌদি, কাতার ও তাদের প্রভূ যুক্তরাস্ট্র, ইসরায়েলসহ ইউরোপিয়ান দেশগুলি।এসএনসি নামে দেশের বাইরে একটি সংগঠন আছে যাদেরকে যুক্তরাস্ট্র, ইউ ও কতিপয় আরব দেশ সিরিয়ার বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ।এই এসএনসির প্রধান হলেন জর্জ সাবরা ও পরে মুয়াজ আল খতিব। যিনি সম্প্রতি বলেছেন ইসরায়েল আসাদের পতনে আমাদের সহায়তা করলে আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতিসহ ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করব। অবশ্য ইসরায়েলে ইতিমধ্যেই সিরিয়ার জঙ্গীদের সহায়তা করতেছে তারো প্রমান অনেক আছে। মজার ব্যাপার হল সিরিয়ান অভ্যন্তরে লড়াইরত যোদ্ধাগণ এই এসএনসিকে তাদের বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকার করতেছে না । যারা বিদেশের মাটিতে বসে সাম্রাজ্যবাদীদের পরামর্শে সিরিয়ার বৈধ প্রতিনিধিকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে তারা ক্ষমতায় আসলে সিরিয়ার পরিণতি কি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
জাতিসংঘের হিসাবমতে সিরিয়ার সহিংসতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮০,০০০+ লোকের প্রাণহানি হয়েছে কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল সিরিয়ায় বর্তমানে যা হচ্ছে তা কোনক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে আলকায়েদা, ওয়াহাবী, সালাফী সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষন দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে সরকার পরিবর্তন কতটুকু যুক্তিসম্মত বা সমর্থনযোগ্য ? সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরোধী একজন নেতা ইহুদিবাদী ইসরাইলের চ্যানেল-টু টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদই তার একমাত্র শত্রু এবং আসাদের বিরুদ্ধে কথা বললে তিনি সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনকেও শ্রদ্ধা করতে প্রস্তুত !!!
সিরিয়া বর্তমানে পরিণত হয়েছে পরাশক্তি ও আঞ্চলিক পরাশক্তিদের যুদ্ধক্ষেত্র । সিরিয়ায় সহিংসতার এর মুল ভূমিকায় আছেন তুরুস্ক ও কাতার, সৌদি, যুক্তরাস্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাবিশ্ব। আমি এখানে সিরিয়ার ঘটনার সাথে স্পষ্টই মিল পাচ্ছি ৮০’র দশকে আফগানিস্থানের ঘটনার সাথে তবে পার্থক্য হল জঙ্গি আফগানরা সেসময় লড়েছিল বাহিরের শক্তির সাথে আর সিরিয়ায় জেহাদীগ্রুপ গুলো লড়তেছে সিরিয়ার বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে। সেই সময় আফগানিস্থানে পাকিস্থান, সৌদি ও যুক্তরাস্ট্রের সক্রিয় সহযোগীতায় গঠিত হয় আল কায়েদা ও তালবান আর এই আল কায়েদা ও তালেবানরা উৎখাত করে সোভিয়েতদের কিন্তু এরপর তালেবানরা ক্ষমতায় এসে আফগানিস্থানের কি অবস্থা করল ? আফগানিস্থান ফিরে গেল পাথরের যুগে।সিরিয়াতেও একই নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে। আর যুক্তরাস্ট্র-ইসরায়েল এখানে খেলতেছে জটিল এক গেম । যে যুক্তরাস্ট্র আল কায়েদা ও এরকম মতাদর্শের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষনা করেছিল সেই যুক্তরাস্ট্র কৌশলে সেই যুদ্ধকে সিরিয়ায় সম্প্রসারিত করেছে । এরফলে যুক্তরাস্ট্রের লাভ হয়েছে যে যুক্তরাস্ট্রকে এখন থেকে আগের মত আর আল কায়েদা বিরোধী লড়াই করতে হবে না । কারণ আল কায়েদা, সালাফি ও ওহাবী মতাদর্শের উগ্র যোদ্ধাগণ ছুটছে সিরিয়ার পানে সেখানে লড়াই হচ্ছে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে । মানে দাড়ালো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা । এত মারা যাচ্ছে বা হতাহত হচ্ছে দুপক্ষের লোকজন অথচ এই দুই শক্তিই ইসরায়েল-আমেরিকার বিরোধী ।সিরিয়াতে যুক্তরাস্ট্র শিয়া-সুন্নি লড়াই বাধাতে পারলে যদিও তা করতে সক্ষম হয়েছে অনেকটা তাহলে যুক্তরাস্ট্র ও ইসরায়েল তখন নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাবে !
মাস কয়েক আগে যখন বিদ্রোহীরা কোণঠাসা তখনই এরা বিদ্রোহীদের স্বীকৃতি দিয়ে গৃহযুদ্ধ আবার উস্কে দিলেন । যদি তা মেনে নেন তাহলে বাহরাইনে যা হচ্ছে সেখানে তথাকথিত জাতিসংঘ, ওয়াইসি ও আরবলীগের ভূমিকা কি ? পশ্চিমা বিশ্ব কেন সেখানে নিরব ? কারন একটাই বাহরাইন সরকার হল তাদের হাতের পুতুল, তাদের সেবাদাস। আরো সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো যে আরবরা সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের অস্ত্র পাঠাচ্ছে তাদের সিরিয়ান ভাই বোনদের হত্যা করতে অথচ সেই আরবরা যখন ইসরায়েল গাজায় নির্বিচারে হত্যযজ্ঞ চালায় তখন তারা একটি বুলেটও পাঠানোর সাহস পায়নি কারন মার্কিন ও ইসরায়েলী মুরব্বি যে নাখোস হবে !!!
যুক্তরাস্ট্র, ইউরোপ রাশিয়া ও চীনসহ বিশ্বশক্তিগুলো জেনেভা সম্মেলনে একমত হয়েছিল যে সিরিয়ায় সবপক্ষকে নিয়ে একটা ঐক্যমত্যের সরকার গঠন করা হবে এবং সেই প্রস্তাবে ইরানসহ স্বয়ং সিরিয়া পর্যন্ত সমর্থন করছিল কিন্তু যুক্তরাস্ট্র, তুরস্ক ও কতিপয় আরব রাস্ট্রের হঠকারিতার কারনে সেই প্রস্তাব ভেস্তে গেছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় সৌদি, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাতের মত দেশগুলিতে কোনদিন কোন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি আর আজ তারাই সিরিয়ায় তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে !!!
এরই মধ্যে ইরান সিরিয়ার সমস্যা সমাধানের জন্য ছয়দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছে যা হল মুলত অস্ত্রবিরতি, বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা, ত্রাণ সরবরাহ ও সর্বোপরি সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা । রাশিয়া এই পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছে কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হল রাশিয়া, ইরান ও চীন আর অন্যদিকে তুরস্ক, সৌদি, কাতার ও তাদের মিত্র আমেরিকা, ইউরোপ সবাই নো অফ রিটার্ন পজিশনে চলে গেছে।তাই মনে হয় না ইরানের প্রস্তাব কার্যকরী হবে । রাশিয়া ইতিমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছে সিরিয়ায় কোন বাইরের হেলমেট ঢুকতে দেওয়া হবে না । শেষ পর্যন্ত ন্যাটো হয়তো হস্তক্ষেপ করবে না কিন্তু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলতে পারে বছরের পর বছর ধরে যতদিন না পর্যন্ত কোন একটা পক্ষ পরাজিত হয়। এতে প্রাণহানী যেমন ঘটবে সীমাতীত তেমনি সিরিয়ায় হয়তো ক্ষমতায় আসবে তালেবানী ধারা এবং সিরিয়া যাবে প্রস্তরযুগে ফিরে আর এর ফলাফল ইরান ও আরব বিশ্বসহ বাদবাকী বিশ্বকেই ভোগ করতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিরিয়ান তথাকথিত বিদ্রোহীদের উপলব্ধি হয় ততই মঙ্গল । সবপক্ষই বসে একটা গ্রহযোগ্য সমাধানে পৌছাতে পারলেই সিরিয়া ও বাদবাকি বিশ্বের মঙ্গল। যুক্তরাস্ট্রের বিরোধীতা সত্তেও মিশরের প্রেসিডেন্ট মুরসির উদ্যেগে গঠন করা হয়েছিল কন্টাক্ট গ্রুপ ইরান, তুরস্ক, সৌদি ও মিশরকে নিয়ে। তবে মন্ত্রী পর্যায়ের কায়রো বৈঠকে সৌদির কোন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। যার ফলে সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যুক্তরাস্ট্রের অনুমতি ছাড়া সৌদিরা যে এক পা বাইরে ফেলতে পারেন না এটা আর একটা প্রমান। আর মিশর ইতমধ্যেই সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করেছেন।
অন্যদিকে তুরস্ক মরিয়া হয়ে উঠেছিল সিরিয়াকে আক্রমন করার জন্য। সিরিয়া আক্রমন করার জন্য তারা পার্লামেন্টে বিলও পাশ করিয়েছে। ন্যাটো ঘোষনা দিয়েছে তুরস্ককে রক্ষায় তারা পদক্ষেপ নিবে । যেমন কথা তেমন কাজ । ন্যাটোর প্যাট্রিওট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম এখন তুরুস্কে তথাকথিত সিরিয়ান জুজুর ভয়ে। রাশিয়া ও ইরান তুরুস্কের এ পদক্ষেপের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারন করেছে। এর প্রতিবাদের ইরানি প্রেসিডেন্ট তার পরিকল্পিত তুরুস্ক সফর বাতিল করেছেন। রাশিয়া ন্যাটোর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে যে ন্যাটোকে লিখিত দিতে হবে যে প্যাট্রিওট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম রাশিয়ার জন্য কোন হুমকি নয় কিন্তু ন্যাটো তা প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন স্পষ্টই এই ডিফেনস্ সিস্টেম ইরানের জন্য হুমকি ও সম্ভবত ইরান আক্রমনের প্রস্তুতি কারন সিরিয়াকে প্রতিরোধ করার জন্য ঐ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের কোন প্রয়োজন ছিল না । কারন, সিরিয়ায় ন্যাটো বা তুরুস্কের হস্তক্ষেপ মানে ইরান বাধ্য সিরিয়ার সঙ্গে করা সামরিক চুক্তির বলে সেই যুদ্ধে যোগ দিতে আর সিরিয়ায় রেজিম চেন্জ করে পশ্চিমাদের পরবর্তী টার্গেট হল ইরান ।
আর সৌদি, কাতার, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স তো অজস্র ডলার ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতেছে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের তারপরেও কোন কুল কিনারা তারা পাচ্ছেন না। গত বছর সিরিয়ান এক রাষ্ট্রদুত প্রকাশ করে দিয়েছেন যে কাতার সরকার তাকে ডলার দিয়ে কিনে নিতে চেয়েছিলেন এবং এ জন্য প্রতিমাসে তাকে ২০,০০০$ করে বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল থাকা ও নিরাপত্তা সুবিধাসহ।। এরপরেও ঐ রা্ষ্ট্রদুত তাদের পক্ষালম্বন করেন নি। অন্যদিকে ইরানও বসে নেই।ইরান ঘোষনা করেছে সিরিয়া বহিশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা চুপ করে বসে বসে দেখবে না। ইরানও সেনা পাঠাবে। গত বছর ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সিরিয়ার সাথে এখনো আমাদের নিরাপত্তাগত চুক্তি কার্যকর।এই কিছুদিন আগে ইরানের পররাস্ট্রমন্ত্রী আলী আকবর সালেহী বলেছেন, তেহরান সিরিয়ার রেজিম চেন্জ করতে কখনোই পশ্চিমাদের অনুমতি দিবে না ।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদও চাচ্ছেন দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে।পশ্চিমাদের দাবি আসাদের পতনই একমাত্র সমাধান। এর মাধ্যমেই পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র বোঝা যায় তারা চাচ্ছে সিরিয়াকে তাদের একটা পাপেট রাস্ট্র বানাতে যেমন বানিয়েছে আফগানিস্থান ও লিবিয়াকে কিন্তু রাশিয়া বলেছে তারা সিরিয়াকে কোনমতেই লিবিয়া হতে দিবে না । গত ৬ই জানুয়ারী বাশার আসাদ জাতির উদ্দেশ্য ভাষন দিয়ে বিদ্রোহীদের অস্ত্র পরিত্যাগ করে সংলাপে বসার আহবান জানিয়েছেন। ভাষনে প্রেসিডেন্ট আসাদ বলেন, "দেশে যে লড়াই চলছে তা সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে নয় বরং সিরিয় জাতি এবং তার শত্রুদের মধ্যে লড়াই।" প্রেসিডেন্ট আসাদ তার ভাষণে একটি নতুন শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছেন। এ পরিকল্পনায় সংহতি সম্মেলন ও জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ সরকার দেশটিতে নতুন নির্বাচন, নতুন সংবিধান অনুমোদনে গণভোটের আয়োজন এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয় তদারকি করবে।ভাষনে আসাদকে খুবই আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে । ইরান, রাশিয়া, লেবানন, ইরাক আসাদের শান্তিপ্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে আর স্বভাবতই পশ্চিমা আসাদের দেওয়া শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে । দেখে শুনে মনে হচ্ছে সিরিয়ার জনগণ ঐ পশ্চিমারাই । আর কয়েকটা বিদ্রোহী গ্রুপ অবশ্য আসাদের শান্তি প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে আর বাদ বাকি গ্রুপ প্রত্যাখান করেছে।
এরমধ্যেই সিরিয়ার গুরত্বপূর্ণ একটি শহর কুসাইর সিরিয়ার সেনাবাহিনী দখলমুক্ত করেছে যা পশ্বিমা মিডিয়াগুলোতে একে বিদ্রোহীদের জন্য একটি বিরাট চপেটাঘাত হিসাবে বর্ণনা করেছে কারণ এই শহরটাই ছিল বিদ্রোহীদের রসদ পরিবহনের প্রধানতম রুট । এই ঘটনার পর বিদ্রোহীদের আত্মবিশ্বাসে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে । এজন্য বিদ্রোহীরা আমেরিকা ও তাদের আরব মিত্রদের কাছে অস্ত্র সহায়তা চেয়ে পাঠিয়েছে । না হলে তারা আসন্ন জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিবে না । অবশ্য তাদের আবদনে সাড়া দিয়ে সৌদি ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার ডলারের উন্নত অস্ত্র পাঠিয়েছে , আমেরিকাও অস্ত্র পাঠানোর পথে আর সাথে ইসরায়েল তো আছেই ।
সিরিয়া সংঘাতে যুক্তরাস্ট্রের দ্বিমুখী ভুমিকা লক্ষনীয়। যে যুক্তরাস্ট্র বলে আসতেছে তারা সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেই যুক্তরাস্ট্র আল কায়েদা ও তালেবান সদস্যদের তুরস্কের সহযোগীতায় গণহারে সিরিয়ায় পাঠাচ্ছে যুদ্ধ করার জন্য। আর অন্যদিকে বাহরাইনের গণআন্দোলন ও বাহরাইনের আমীরের জনগণের প্রতি নির্যাতনের ব্যাপারে পুরোপুরি নিরব কারন বাহরাইন আর যাইহোক যুক্তরাস্ট্রের সেবাদাস।
ইরান, রাশিয়া কতটুকু দোষী তার চেয়ে বলা যায় সিরিয়ায় যে প্রাণহানী ঘটতেছে সেখানে ইন্দোন জোগাচ্ছে যুক্তরাস্ট্র, ইসরায়েল, ইউরোপিয়ানরা, তুর্কি, সৌদি, কাতার ও বাদবাকি পাপেট আরব রাস্ট্র । তারা সিরিয়ান বিদোহীদের ( যাদের বেশিরভাগই বাইরে থেকে আগত) দেধারছে অস্ত্র দিচ্ছে যদিও তাদের সাহস নেই ফিলিস্তিনিদের জন্য একটা বুলেট পাঠাতে। সিরিয়ার সেনাবাহিনী দ্বারা কিছু লোক নিহত হয়নি তা বলা যাবে না কিন্তু সেখানে রিবেলরাও ফেরেস্তা নয় । তারা এমনকি কবর থেকে রাসুলের সাহাবার লাশও তুলে নিয়ে গেছে। এই রিবেলরা সিরিয়ান যুবতী ও কিশোরী মেয়েদের পাচার করতেছে পশ্চিমা দেশগুলিতে।
এদরই একজন, সিরিয়ান এক সেনার লাশ কেটে কলিজা ভক্ষণ করেছে ইন্টারনেটে সেই ভিডিও অনেকেই দেখেছেন।
যুদ্ধের সময় কিছু বেসামরিক মানুষ মারা যেতেই পারে। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হাতেই বেসামরিক মানুষ বেশি মারা যাচ্ছে। বাশার সমর্থক এক মসজিদের ইমামসহ ৪২ জন মুসল্লি একদিনেই বিদ্রোহীদের হামলায় নিহত হয়েছে। পাশ্চাত্যের মিডিয়া যেহেতু বিদ্রোহীদের সমর্থনে খবর প্রচার করছে সে জন্য প্রকৃত তথ্য পাওয়া কঠিন।এজন্য সিরিয়ার গণআন্দোলনের শুরুতে যারা অনেকেই বাসার আসাদ সরকারের বিরোধী ছিলেন তাদের বেশিরভাগই এখন আসাদ সমর্থক । কারণ এইসব নাগরিকেরা এখন যেভাবেই হোক সিরিয়ার স্থিতিশীলতা চান ।
আসাদের পতন যে সহজেই হচ্ছে না তা অনেকটা নিশ্চিত। আমি সিরিয়ার আন্দোলনের শুরুতেই বলেছিলাম যে সিরিয়া কোন মিশর বা লিবিয়া নয় যে আসাদের পতন সহজেই হবে ।সমস্যার শান্তিপুর্ন সমাধান না হলে বিশ্ববাসী অচিরেই যে একটা সিরিয়া নামক নতুন আফগানিস্থান বা সোমালিয়া দেখবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।আর যদি তাই হয় তাহলে এর শেষ পরিণতি কোথায় ? এর শেষ পরিণতি হবে মধ্যপ্রাচ্যে মানচিত্র পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। ইরাকের কুর্দিস্থান প্রায় স্বাধীন । স্বায়ত্বশাসেনর নামে তারা ভোগ করতেছে স্বাধীনতা । ইরাকের কুর্দিস্থান সরকারের বাইরের কোন দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে বাগদাদ সরকারের কোন অনুমতি লাগে না । তাছাড়া কুর্দিদের রয়েছে আলাদা পুলিশ বাহিনী। আর তুরুস্কের কুর্দিরা স্বাধীনতা চাচ্ছে সেই কয়েকযুগ থেকে। তাদের কয়েকটা স্বাধীনতাকামী সংগঠনও আছে যেমন পিকেকে। মাঝে মাঝেই তুরস্কের সেনাবাহিনীর সাথে এদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায় আর বাকি থাকলো সিরিয়ার কুর্দিরা । আসাদের পতন হওয়া মানে তারা মুক্ত । এরই মধ্যে আসাদ তার নিয়ন্ত্রিত কুর্দিস্থান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আর সিরিয়ার কুর্দিস্থান এখন পুরোপুরি কুর্দিদের নিয়ন্ত্রনে। এর মানে দাড়ালো স্বাধীন কুর্দিস্থান হতে আর বেশি দেরি নেই। তুরুস্কের অটোমান সাম্রাজ্যে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। কুর্দিরা লড়বে স্বাধীনতার জন্য আর সিরিয়ার বাকি অংশে চলবে সোমালিয়ার মত বছরের পর বছর লড়াই আর এক অংশ নিয়ন্ত্রন করবে আসাদপন্থিরা আবার হয়তো অন্যদিকে নিয়ন্ত্রন করবে বিদ্রোহী গোষ্ঠীসহ জঙ্গীরা । থেমে থেমে চলবে সংঘর্ষ। ধীরে ধীরে এ লড়াই গ্রাস করবে তুরস্ক, লেবাননসহ পাশ্ববর্তী আরব দেশগুলিতে । মাঝখানে লাভবান হবে ধুর্ত ও চতুর ইসরাইল ।
(......চলবে)
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৪৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন