ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও আহমেদ ছফার কামরাঙ্গীর চরে মাদ্রাসা।
লিখেছেন লিখেছেন এম আর মিলন ১৬ জুন, ২০১৩, ০৫:০৩:৪৭ বিকাল
ইরানের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড.হাসান রোহানী।
গত ১৪ জুনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল । নির্বাচনের ফলাফলও ইতিমধ্যেই জানা হয়ে গেছে। সংস্কারপন্থী প্রার্থী হাসান রোহানী এই নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন !
ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জনগণের সরাসরি ভোটেই নির্বাচিত হয়। কোন প্রার্থী ৫০%+ ভোট পেলে তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে প্রথম দফার প্রার্থীদের মধ্যে কেউ ৫০%+ ভোট না পেলে প্রথম দুজনের মধ্যে নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ায়।তবে এবার দ্বিতী দফায় যায়নি । প্রথম দফায় জনগণ যে চমক দেখিয়েছে তাতে অনেক বিশ্লেষকই অবাক হয়েছেন কারণ সবার ধারণা ছিল নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় যাবে কিন্তু হাসান রোহানীর ভূমি ধ্বস বিজয় সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়েছে।
ইরানের এবারের নির্বাচনটা ছিল এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ইরানই একমাত্র মুসলমান প্রধান দেশ যাদের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা থাকার পরেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও বিশ্বে পশ্চিমা গোষ্ঠীর যুদ্ধবাজ নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ তাইতো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সাথে ইরানের অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক এছাড়া বিগত ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেশ ও বিদেশে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল এবং পরাজিত প্রার্থী ভোট কারচুপির অভিযোগ করেছিলেন যদিও পরে দেখা গেছে ইরানকে অস্থিতিশীল করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলি বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। ইরানের পরমানু কর্মসুচি নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে বিরোধ, জাতিসংঘ ও পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া ইরানে অর্থনৈতিক অবরোধ ও সর্বপরি দেশটি সিরিয়া নিয়ে জড়িয়ে পড়েছে মার্কিন, ইউভূক্ত দেশগুলি, তাদের আরব মিত্র ও তুরস্কের সাথে বিরোধে। আর সঙ্গে যুক্ত আছে ইরানে তরুণদের আকাঙ্খা, সংস্কার ও চাকুরীর নিশ্চয়তা ।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থীগণের মধ্যে একমাত্র হাসান রোহানীই ছিলেন ধর্মীয় নেতা আর বাদবাকি ৭ জনই ছিলেন স্যুট, কোট পড়া ভদ্রলোক যদিও সব প্রার্থীই পিএচডি ডিগ্রীধারী। ইসলামের উপর ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হাসান রোহানী প্রাথমিক জীবনে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করার পর তেহরান বিশ্বদ্যিালয় থেকে আইন শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।এরপর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো কালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ ও পিএইচডি লাভ করেন হাসান রুহানি।তিনি ইসলামি বিপ্লবের একজন সক্রিয় কমী ছিলেন ও পরবর্তীতে ইরানের ইসলামি সরকারের বিভিন্ন গুরু দায়িত্ব পালন করেন । এর মধ্যে আছে দীর্ঘকালীন সংসদ সদস্য, সংসদের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির প্রধান,
ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া আগ্রাসী যুদ্ধ চলাকালে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিরক্ষা উচ্চ পরিষদ, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার এবং সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট খাতামির শাসনামলে তিনি ছিলেন ইরানের প্রধান পরমানু আলোচক।এছাড়াও দীর্ঘকালীন তিনি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ইরানের নীতি নিধারণী পরিষদের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।শতাধিক বইয়ের লেখক রুহানি ইংরেজি, আরবি এবং ফার্সিতে অনর্গল কথা বলতে পারেন। তার গবেষণাপত্রের সংখ্যা সাতশ’র বেশি।
নির্বাচন কেন্দ্রে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি, রোহানীর বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ও পরাজিত প্রার্থীদের পরাজয় স্বীকার করে রোহানিকে অভিনন্দন দেওয়াতে পশ্চিমা বিশ্বের গালে ইরানি জনতার একটা বড়সড় চপেটাঘাত বলা যায়।তাইতো ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মান, ইতালি ও ইউ ইরানি ব্যাপক হারে ভোট দেওয়াতে ইরানি জনগণের প্রশংসা করেছেন।ব্রিটেনের সাবেক পররাস্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্রু রোহানী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াতে রোহানির উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলেন, ”আমি পার্সনালী জানি রোহানী একজন অত্যন্ত উচুমাপের কুটনীতিক ও দেশপ্রেমিক।”
বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক আহমেদ ছফা “কামরাঙ্গীর চরে মাদ্রাসায় শিক্ষা বিপ্লবের সূচনা” নামে মাদ্রাসা ও আলেম সমাজ নিয়ে আলেম সমাজের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার বর্ণনা ও ভবিতব্য নিয়ে বিশ্লেণমুলক একটি আর্টিকেল লিখেছেন । লেখক সেখানে দেখিয়েছেন আমাদের আলেম সমাজের আধুনিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অভাব এবং অনীহা এদেশকে কিভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। আহমেদ ছফা মনে করেন আমাদের দেশের মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা নেহাৎই কম নয় অথচ এই বিশাল একটা শ্রেনী পিছিয়ে থাকার কারণে আমাদের দেশও এগিয়ে থাকার সম্ভবনা কম ।কারণ তারাও আমাদের জাতির একটা বৃহত্তর অংশ ও আমাদের বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের মধ্যে মোল্লা-মওলানাদের অপ্রতিহত প্রভাব রয়েছে। তাই তাদেরকে উপেক্ষা করা আমাদের যেমন ঠিক হবে না তেমনি তাদেরও আধুনিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা কোনক্রমেই ঠিক হবে না । এজন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণসহ তাদের বিজ্ঞান মনস্ক করে গড়ে তুলতে হবে আর এজন্য তাদেরও স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে।
তবে আমাদের দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক ভদ্রলোকই নিজেদের প্রগতিশীল ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।আহমেদ ছফার ভাষায়, “এ ভদ্রলোকরা মনে মনে নিজেদের প্রগতিশীল ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের সামান্যতম জ্ঞান নেই।”
এই শ্রেনীর মানুষেরা মনে করে মোল্লা-মৌলভীরা সমাজের প্রগতির অন্তারায় তাই তাদের প্রতিহত করেই বিপ্লব সাধিত করতে হবে কিন্তু তারা নিজেরাই এমন এক অন্ধ বিশ্বাসের জগতে বসবাস করে সেখানে তাদের মোল্লা মৌলভীদের ঘৃণা করা ছাড়া উপায় থাকে না ।এজন্য আহমেদ ছফা বলেছেন, ”ঘৃণা করে তারা এমন একক ধরণের চিত্তসুখ খুঁজে পায়। যাদের ঘৃণা করছি তাদের চাইতে আমরা অনেক উৎকৃষ্ট প্রাণী।যে সমস্ত মানুষ নিজদের উৎকৃষ্ট প্রজাতি হিসেবে ভেবে থাকেন তারা ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকে বিজ্ঞানচিন্তা সহায়ক একটা বিষয় বলে ধরে নিয়ে থাকেন। বিজ্ঞানীদের মধ্যে আস্তিক মানুষ যেমন আছেন তেমনি নাস্তিকও রয়েছেন।”
তাই আহমেদ ছফা মনে করেন শুধু মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিকরণ করলেই হবে না তার আগে দরকার আধুনিক শিক্ষারও আমূল পরিবর্তন। যে শিক্ষা আমাদের তরুণ ও যুব সমাজকে সাম্রাজ্যবাদের মতাদর্শিক ও বরকন্দাজে পরিণত করবে না ।
যাইহোক, এখানে ইরানের প্রসঙ্গ এজন্য বলা হল যেখানে আমরা মোল্লা-মৌলভীদের পশ্চাৎপদ, বিজ্ঞান অন্যমনস্ক ও প্রগতির অন্তরায় হিসাবে জানি সেখানে ইরানের আলেম সমাজই ইরানকে আজ বিশ্বের বুকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, বিজ্ঞানমনস্ক , বিপ্লবী ও প্রগতিশীল একটি দেশ হিসাবে পরিচিত করিয়েছেন। ইরান আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নত। এই মার্কিন মদদপুষ্ট প্রবল পরাক্রম শালী রেজা শাহ পাহলভীকে উৎখাত করিয়েছেন ইরানের আলেম সমাজই । আবার বিপ্লবের পর ইরানের শাসন ব্যবস্থার যে সংস্কার দরকার তারই নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই আলেম সমাজেরই একটা বৃহত্তর অংশ । ইরানে সাম্প্রতিক নির্বাচনে যে ছয়জন প্রাথী ছিলেন তাদের পাঁচজনই ছিলেন রক্ষণশীল ও একমাত্র উদার ও সংস্কারপন্থী প্রার্থী হলেন এই ধর্মীয় নেতা হাসান রোহানী।জনগণ বিপুল মাত্রায় ভোট দিয়ে তাকেই নির্বাচিত করেছেন !
এছাড়াও ইরানে যে দলটি ইরানে আরো অধিকমাত্রায় গণতন্ত্র, প্রগতি ও উদারতার পক্ষে সেই দলটিরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইরানের ধর্মীয় নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও রাফসাজানি।
১৯৮০’র দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালীন মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে ইরানে মওলানা হাফেজী হুজুরকে দূত হিসাবে পাঠিয়েছিলেন । তিনি ইরান ভ্রমন করে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, “এটা কি করে সম্ভব ইরানে আলেম সমাজই বিপ্লব করল ও তারাই এখন দেশ পরিচালনা করছে ?”
আমি বলতেছি না আমাদের আলেম সমাজকে ইরানের মত কোন ইসলামী বিপ্লব করতে হবে এবং এজন্য উৎসাহিতও করতেছি না কিন্তু যেখানে ইরানের আলেম সমাজ বিজ্ঞানমনস্ক, উদারতা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে ও জনগণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত সেখানে আমাদের আলেম সমাজের এ করূণ দশা কেন ? বাংলাদেশের আলেম সমাজকে কখনো দেখা যায়নি আমাদের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্চ করতে বা সরকারের দেশ বিরোধী কোন নীতির প্রতিবাদ করতে । যেখানে ইরানে অন্য প্রার্থীকে টপকিয়ে আলেমই বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় সেখানে আমাদের আলেম সমাজ ভোটই পায় না ! আমাদের পার্লামেন্টে তাদের আসন নেই বললেই চলে । এর কারণ এই নয় যে জনগণ তাদের পছন্দ করে না আগেই বলেছি জনগণের মধ্যে তাদের যথেষ্ট প্রভাব আছে এবং আহমেদ ছফাও তাই মনে করেন কিন্তু তারা ভোট পাওয়ার মত যোগ্য নন বা নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করেননি বিধায় জনগণ তাদের ভোট দেয় না । এইসব দিকগুলো আমাদের আলেম সমাজ কি ভাববেন ? নাকি তারা কে কাফের,কে মুসলমান আর কে মুরতাদ ও কে ফাসেক এই নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন ?
কাজী নজরুল ইসলাম এজন্যই বলেছেন,
”বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকাহ ও হাদীস চষে.”
বিষয়: রাজনীতি
২২৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন