আসন্ন রামাদান : আগাম প্রস্তুতি – কিছু টিপস
লিখেছেন লিখেছেন উমমু_শাবাব ২৩ জুন, ২০১৩, ০৮:৫২:৫০ সকাল
রামাদান মাস আসার আগে থেকে এই পবিত্র মাসকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে মুসলিম বিশ্বে শুরু হয়ে যায় অন্যরকম এক আয়োজন। প্রত্যেকটি মসজিদে রামাদানকে নিয়ে বিশেষ কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। পারিবারিকভাবেও আমাদের কিছু পরিকল্পনা হাতে নেবার দরকার। বছরের এই একটি মাসের জন্যে আমরা সারা বছর খুবই আগ্রহ করে অপেক্ষা করি, কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা না থাকার কারণে অনেকসময় রোজার শেষে মনে হয় , “আহারে , কিভাবে রোজার মাসটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো দেখতে দেখতে! কিছুইতো করতে পারলামনা ঠিকঠাক মতন, সময় যে কোথা হতে কোথায় গড়িয়ে যায়!” তাই রামাদানের আগেই অন্ততঃ একমাস আগে থেকে কিছু পরিকল্পনা হাতে নেয়া দরকার যাতে পারিবারিক কাজকর্ম ও পরিবার বিশেষ করে পরিবারের বাচ্চাদেরকে নিয়ে রামাদানের এই দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত নিখুঁতভাবে কাজে লাগানো যায়।বছরের প্রথম থেকেই যদি কারো এই মাসটি নিয়ে চিন্তাভাবনা পরিকল্পনা থাকে তাহলেতো আর ভাল।
আসুন , আমরা প্রত্যেকে রামাদান মাসকে পারিবারিকভাবে কিভাবে আসলেই একটি প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে কাজে লাগাতে পারি তার একটি আগাম পরিকল্পনা করে নেই। মনে রাখা দরকার শুধু পারিবারিকভাবে এই প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ভাইবোনদের সবারই পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলেই আশা করি ইনশাল্লাহ্ প্রত্যেকটি পরিবারেই রামাদান মাসটি যথেষ্ট সুন্দরভাবে পরিকল্পনামাফিক কেটে যাবে।
রোজার মাসের বেশ আগে থেকেই ঘরবাড়ি , ক্লোজেট, রান্নার রুমটা, ক্যাবিনেটসহ বিশেষভাবে পরিষ্কার করে ফেলা দরকার যাতে রোজার মাসে সেগুলোতে হাত দেয়ার দরকার না হয়। বড় বড় লন্ড্রি’র কাজও কিছুটা সেরে ফেলা যেতে পারে। যারা বাগানের কাজ করেন বাগানের জন্যে সময় সংক্ষিপ্ত করুন, রোজার আগে নিড়ানী বা অন্যান্য গার্ডেনিংযের কাজ শেষ করুন। যারা এই সময়টাতে কাজ থেকে ভ্যাকেশনে যেতে পারেন, অন্ততঃ শেষ দশদিন বা এক সপ্তাহের জন্যে ভ্যাকেশন নেবার পরিকল্পনা করুন। প্রত্যেকেই চেষ্টা করুন এই মাসটাতে কাজের পরিমান কিছুটা কমিয়ে আনার ব্যাপারে। টাইমটেবলটা এমনভাবে ঠিক করা দরকার যাতে ইফতার, তারাবীহ্ এবং কিয়ামুল লাইলের সময়গুলো পরিবারসহ বা মসজিদে করা যায়।
রামাদান মাসে বারবারই মনে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের অনেক বোনেরাই রান্নাবান্নার মেন্যূ নিয়ে বিশেষভাবে ব্যস্ত হয়ে পরেন। হ্যাঁ, ভাল কিছু রান্নাবান্না অবশ্যই দরকার রয়েছে। বিশেষ করে, যে পরিবারে টিন-এইজ ছেলেমেয়েরা, বা আরো ছোট ছেলেমেয়েরা রোজার রাখার প্র্যাক্টিস করছে, তাদের আবদার অনুযায়ী মাঝে মাঝে কিছু খাবার করা দরকার। আবার অনেক সময় ডায়াবেটিস ও অন্যান্য সমস্যায় ভুক্তভোগীদের জন্যে কিছুটা স্পেশাল ডায়েট দরকার হয়। তবে খাবারদাবার নিয়ে সময় যাতে অনেক নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে খাবারের মেন্যু তৈরী করা দরকার। অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার তা যেন অতিরিক্ত বা অতিমাত্রিক হয়ে না যায়।
খাবারের ব্যাপারে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার যে, গরমের সময় এতোগুলো ঘন্টা রোজা রাখার পর ইফতারের খাবার তৈলাক্ত বা মশলাযুক্ত হলে তা স্বাস্থ্যের জন্যে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। খাবারে প্রচুর পানিজাতিয় খাবার, সালাদ, ফল, ইসবগুলের ভুষি, ফ্ল্যাক্স সীড, তোকমাদানা, তেতুলের শরবত ,লেমোনেড, জাউভাত এ ধরণের খাবার রাখা যেতে পারে।
এবার আসুন পুরো মাসের একটা সময়সূচী তৈরি করার ব্যাপারে। শুরু করা যাক্ রামাদানের কয়েকদিন আগে থেকে। রাসূলুলুল্লাহ্ ( সাঃ) তাঁর পরিবারকে শাবান মাস থেকেই বিশেষ তোড়জোড় করে প্রস্তুতি নিতে বলতেন। প্রথমেই নিজের কিছু পড়াশোনা , বিশেষ করে কোরআন চর্চা ও হাদীস চর্চার প্ল্যান নেয়া দরকার। কিছু বিশেষ সূরা ও একটি হাদীসের খন্ড (volume) স্টাডি করার জন্যে একমাসের প্ল্যানে রাখা দরকার। অনেকেই এই মাসে পবিত্র কুরআনুল কারীম খতম দিতে চান। এই নিজস্ব স্টাডি করার জন্যে বিশেষ একটা সময় বের করা দরকার । বেশীর ভাগ সময় দেখা যায়, সেহেরী’র পরে ভোরের সময়টাই উপযুক্ত সময় নিজস্ব স্টাডি করার জন্যে। প্রত্যেকদিন ভোরে এক থেকে দেড় ঘন্টা স্টাডি করা যেতে পারে। পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতেরও সুন্দর সময় এটা। বাচ্চাদেরকেও উৎসাহিত করা দরকার এই সময়টা কিছুক্ষণ তিলাওয়াত করার জন্যে। এরপর চাকুরীজীবি ভাইবোনেরা সাথে রাখতে পারেন প্ল্যানমাফিক বই বা সেটার ফটোকপি। যারা কুরআন মুখস্থ করেন তাঁরা সাথে একটা বা দুটো আয়াত করে রাখতে পারেন ।
প্রথম দশদিনঃ রহমত
• দেশে যাকাত পাঠানো বা এখানে যাকাতে দেবার প্ল্যান রাখা।
• আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করা, খোঁজখবর নেয়া।
• কাউকে আর্থিক সাহায্য করতে চাইলে তা এ সময়েই দিয়ে দেয়া।
• লোকাল মসজিদে খাবার দেয়ায় অন্ততঃ একদিন ,দু’দিন শরীক হওয়া।
• ঘরোয়াভাবে বোনেরা একদিন সবাই মিলে ইফতার করার প্ল্যান করা।
• অন্ততঃ দুইদিন পারিবারিক কিয়ামুল লাইলের পরিকল্পনা রাখা।
• পরিবারকে নিয়ে অন্ততঃ দুইদিন একত্রে স্টাডি করার সময় বের করা। পারিবারিক স্টাডির প্রথম সেশন একেবারে প্রথমদিকে কিংবা একেবারে রামাদান মাস শুরুর আগে দিয়ে করা দরকার যাতে পারিবারিকভাবে সবাই রোজার নিয়মকানুন, গুরূত্ব সম্পর্কে একট মেসেজ পেয়ে যায়। অনেকেই রোজার মাসলা মাসায়েল, গুরূত্ব সবকিছু সম্পর্কে খুবই ভালো জ্ঞান রাখেন, তবে আমি মনে করি যতই জ্ঞান থাকুক পরিবার নিয়ে এভাবে ঘন্টাখানেক এই স্টাডি/আলোচনায় নিজেরো অনেককিছু ঝালাই হয়ে যায়, আর পরিবারের সবাই মিলে আলোচনায় সবারই একটা রিভিউ হয়ে যায় রোজার প্রস্তুতি হিসেবে। এই পারিবারিক স্টাডির সেশনে সম্ভাব্য টপিকসমূহঃ রোজার গুরূত্ব, রোজা রাখার নিয়মকানুন, কি কি কারণে রোজা ভংগ হয়, তারাবীহ্ নামাজের নিয়মকানুন, সেহেরী ও ইফতারের নিয়মকানুনো গুরূত্ব, ইত্যাদি।
• পরিবারের সবাইকে প্রাত্যাহিক কুরআন ও ইসলামিক পড়াশোনা এবং বিভিন্ন কাজের রুটিন তৈরি করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা। এক্ষেত্রে নিজের প্ল্যানটা সবাইকে আগেভাগে জানালে পরিবারের অন্যেরাও এতে উৎসাহিত হতে পারে।
দ্বিতীয় দশদিনঃ মাগফিরাত
• কিয়ামুল লাইল করা বেশী বেশী, পারিবারিক, ও সামষ্ঠিকভাবে ।
• শেষরাতের দিকে সবাই মিলে উঠে নিজের, পরিবারের ও দুনিয়ার সকল মুসলিমের জন্যে মাগফিরাতের জন্যে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা,
• পারিবারিক স্টাডি সেশন করা, এটা কিয়ামুল লাইল ও স্টাডি সেশন একত্রে হতে পারে। কিছু টপিকঃ রোজা সম্পর্কিত হাদীসগুলো একত্রে আলোচনা করা, কুরআনের মর্যাদা , কুরআন থেকে রোজার আয়াতসমূহ আলোচনা করা, ইত্যাদি।
শেষ দশদিনঃ জাহান্নাম থেকে মুক্তি
• রোজার ফিতরা আদায় করা , পরিবারের সব সদস্যদের জন্যে।
• ইতেকাফের প্ল্যানও রাখতে পারেন অনেকে এইসময়ে।
• প্রায় প্রত্যেকরাতেই সম্ভব হলে কিয়ামুল লাইল করা।
• প্রত্যেক রাতেই কুরআন তিলাওয়াত ও চর্চা করার উদ্যোগ রাখা।
• দিনগুলোকেও বিশ্রাম ও কাজ দিয়ে ভাগ করে নেয়া যাতে রাতে জাগার জন্যে যথেষ্ট এনার্জি পাওয়া যায়।বিভিন্ন আল্লাহপাকের যিকর মুখে, মনে ও বাচ্চাদের সাথে চর্চা করা।
• পারিবারিক স্টাডির শেষ দুইটি সেশনে, টপিকঃ কদরের রাতের গুরূত্ব ও ফযীলত, কদরের রাতের সন্ধানে অবিরাম সাধনা করা, সুরা আল-কদর স্টাডি ও আলোচনা, আল্লাহপাকের কাছে সবাই মিলে কান্নাকাটি করা, জাহান্নামের আগুন থেকে পরিবার ও উম্মাহ’র জন্যে বিশেষভাবে কান্নাকাটি করা।
আসন্ন পবিত্র রামাদান মাসে আসুন আমরা সবাই সবার জন্যে দোয়া করি। ঈদের শপিংয়ে যতটা সম্ভব সময় ও অর্থ সংক্ষিপ্ত করার বিশেষ অনুরোধ রইলো। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদের জামাতে শামিল হওয়া উচিত। আল্লাহপাকের দরবারে হাত তুলে এই দোয়াই করি, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্যে আমরা সবাই যেন এই রামাদান মাসকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি এই তৈফিক দান করুন, এই রামাদান মাস আমাদের সবার জন্যে আল্লাহপাকের রহমত, মাগফিরাত ও বারাকাহ নিয়ে আসুক, আমীন।
বিষয়: বিবিধ
২২০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন