আম্মু খুব ঠাণ্ডামাথায় আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন বললেন,“উজমা শুনো তোমার আব্বু শহীদ হয়েছেন
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান সিরাজী ২৭ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:৫১:১৭ সন্ধ্যা
অনেকদিন ধরেই আব্বুকে নিয়ে লেখালেখির কথা ভাবছিলাম, কিন্ত যখনই লেখতে বসি তখনই এক চাপা কষ্ট এসে বুকের মাঝে ভর করে,মনে পরে যায় সেই ভয়ংকর স্মৃতির কথা, কিছুতেই আর লেখার সাহস হয়না। অনেক কষ্ট করে অনেকখানি সাহস যোগিয়ে এইবার লেখতে বসলাম।এই ডিসেম্বরেই আব্বুর ঘটনার একবছর হয়ে যাচ্ছে, মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা!
আব্বু ঘটনার এক সপ্তাহ আগ থেকে অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের দেখার জন্য। সারাদিন ফোন এর পর ফোন, কখন আসবি আম্মু? তাড়াতাড়ি আয় এই বুড়া বাপটার কাছে, সারাদিন কল করে সেই একই কথা। আমি অবশ্য একটু অবাকই হয়েছিলাম আব্বুর এত অস্থিরতা দেখে,কারন আব্বু কখনও বাসায় আসার জন্য আমাদের এইভাবে রিকুয়েস্ট করতেন না। তখন লক্ষীপুরের রাজনৈতিক অবস্থাও খুবই খারাপ ছিল, টানা হরতাল-অবরোধ চলছিল। যার জন্য ঠিক কবে বাসায় যাব তা ডিসাইড করতে পারছিলাম না। যাক অবশেষে আমরা ডিসিশন নিলাম যে ১৪ ই ডিসেম্বার, শনিবার বিকালে হরতাল শেষে আমরা লক্ষীপুরের উদ্দেশে রওনা করবো। হটাৎ ১২ তারিখে লক্ষীপুরের রাজনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগলো, অনেক মানুষ গুলিবিদ্ধ হল। খবর শুনে আব্বুকে কল দিলাম, ফোন ধরে বললেন যে আম্মু পরে কথা বলব আমি এখন অটি তে আছি, দোয়া কর অনেক মানুষ আহত হয়েছে, কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, কোন হসপিটালই এদের এডমিট করছে না। সারাদিন আর আব্বুর সাথে কথা হলনা, রাতের বেলা হটাৎ আব্বুর ফোন, সাইফকে (আমার হাজবেন্ড) চাইলেন, অনেক্ষন কথা বললেন, অনেক উপদেশ দিলেন,আমি একটু অবাকই হচ্ছিলাম কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল জীবনধারনের জন্য শিক্ষণীয় বাস্তবসম্পন্ন কিছু কথা বললেন।
তারপর আমি আব্বুকে বললাম যে পরিস্থিতি খুব একটা ভালনা চারদিকে ধরপাকড় চলছে তুমি কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এসে বেড়িয়ে যাও। আব্বু শুনে হাসলেন বললেন যে “আমি চলে গেলে আমার রুগী গুলা দেখবে কে? আর আমি তো কিছুই করিনাই তো আমি কেন এভাবে সরে থাকব? শোন যে আল্লাহ কে ভয় করে তাকে পৃথিবীর সকল প্রানিই ভয় পায়, আর যে আল্লাহ কে ভয় পায়না তাকে সবাই ভয় দেখায়। আর ওসামা বিন লাদেন তো আমেরিকা থেকে কত লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ওবামা কি তাকে খুঁজে পায় নাই? ঠিকই খুঁজে বের করেছিলো। শোন যার মৃত্যু যেখানে আছে সেখানে আসবেই, কেও ঠেকাতে পারবে না।” আব্বুর এইসব কথা শুনে আমার আর কিছু বলার সাহস হলোনা।
এর পরেরদিন ছিল ১৩ তারিখ,শুক্রবার, সাধারনত আব্বু শুক্রবারে হসপিটাল নিয়ে অনেক ব্যাস্ত থাকতেন, তার উপর ওইদিন আবার আগেরদিনের ঘটনায় নিহত কয়েকজনের জানাজাও পরেছিলেন, সব মিলিয়ে মনমানসিকতা খুব একটা ভাল ছিল না। আম্মুর কাছ থেকে শুনেছিলাম সকালবেলা নাস্তার টেবিলে আব্বু নাকি অনেকক্ষন কান্না করেছিলেন সেইসাথে আল্লাহর দরবারে শাহাদাত কামনা করে দোয়া করেছিলেন। আর বেলাল ভাইয়া আর আম্মুকে বলেছিলেন যে, “সামনে তো বান্নার পরীক্ষা তোমরা এক কাজ করো বউমাসহ সবাই কালকেই ঢাকায় চলে যাও, আমি এখানে একাই থাকতে পারবো, কোন সমস্যা হবেনা।”(কি অবাক ব্যাপার! পরেরদিন শনিবার ঠিকই কিন্তু আব্বুকে একা ফেলে রেখে আমদের সবাইকে বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে আসতে হয়!!)
ঐদিন সন্ধ্যারপরে আমরা তিন ভাইবোন একত্রিত হয়েছিলাম তখন আব্বুর সাথে ফোনে কথা হয়, আব্বু যখন শুনলেন যে আমরা সবাই একসাথে আছি তখন খুশি হয়ে বললেন, “তোদের কতই না মজা তোরা সবাই একসাথে থাকবি” ঐ সময় আব্বুর কথাটা ঠিক বুঝতে পারিনি, শুধু আব্বুর অট্ট হাসিটাই কানে বাজছিল। এরপর শেষবারের মতন দুই নাত্নির সাথে কথা বললেন। জুনায়রা (বড়আপুর মেয়ে) ওইসময় টুকটাক কথাবলা শুরু করেছিল,সাধারনত আব্বুর মেজাজ খারাপ দেখলেই আমরা জুনায়রাকে ফোনটা ধরিয়ে দিতাম, সাথেসাথেই ম্যাজিকের মতন আব্বুর মুডটা একেবারেই ঠান্ডা হয়ে যেত, আগেপিছে কি হয়েছিল সেকেন্ডের মধ্যে সব ভুলে যেতেন। ইউসায়রা (বড় ভাইয়ার মেয়ে) ওইসময় মাত্র দাদু ডাকা শুরু করেছিল, তাই আব্বুর সৌভাগ্য হয়েছিল দাদুভাইয়া ডাকটা শুনে যাওয়ার।
বাসায় পোঁছানোর পর রাত ৯:৩০টার দিকে আব্বুর সাথে আবার কথা হয়, আর ওইটাই ছিল আব্বুর সাথে আমার জীবনের শেষ কথা। খাওয়াদাওয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই হেসে বললো যে, “আজকে আমার ছোট বউমা রান্না করেছে, রান্নাটা ভালই হয়েছে।” এরপর টুকটাক কথাবলে ফোনটা রেখে দিলেন। ওইদিন অনেক টায়ার্ড থাকায় তাড়াতাড়ি শুয়ে পরি। এরপর হটাৎ রাত ২টার দিকে ফোনের সাউন্ডে ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাকিয়ে দেখি ৭টা মিসডকল, দেখেই বুকটা ধড়ফড় করতে থাকল, সাথেসাথেই বান্না ভাইয়াকে কল দিলাম, ভাইয়া ফোন ধরে বলল যে বাসায় র্যাবের অভিযান হয়েছে ওরা আব্বুকে এরেস্ট করে নিয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি রেডি হও আমরা লক্ষীপুরে যাচ্ছি। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ভাইয়া ফোনটা কেটে দিল। ফোনটা রেখে কেন জানি ইন্নালিল্লাহি ওয়িন্নালিল্লাহির রাযিউন পরলাম, আর এর মাঝে আব্বু আম্মু সহ বাসার সবার ফোনে ট্রাই করতে থাকলাম কিন্তু সবারই ফোন অফ পাচ্ছিলাম। তারপর ভাবলাম যে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছাই। আমি কেন জানি তখন ব্যাগে সব বোরকা ঢুকাচ্ছিলাম এইভেবে যে, আব্বুর জামিনের প্রোসেসিং গুলাতে হয়তোবা আমাদের মেয়েদের দোড়াদোড়ি করা লাগতে পারে, কারন ভাইয়াদেরও তো আবার এরেস্ট হওয়ার রিস্ক আছে আর তাছাড়া আব্বুর সাথে তো ডেইলিই দেখা করতেই হবে! এরমাঝে হটাৎ এক ফ্রেন্ডের কল, বেলাল ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করলো, বলল যে ওরা নাকি ভাইয়াকেও ধরে নিয়ে গেছে। ওকে আর কিছু না বলে তাড়াতাড়ি বাসার টিএনটিতে কল দিলাম, কয়েকটা রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে আম্মু ফোন ধরলেন। আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম যে তোমাদের ফোনের কি হইছে কাউকেই তো পাচ্ছিলাম না। আম্মু শুধু বললেন যে ওরা সবার মোবাইল নিয়ে গেছে। এরপর আমি আম্মুকে অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করতে থাকলাম, কখন আসছিল ওরা বাসায়? আব্বুকে কখন নিয়ে গেছে ওরা? বেলাল ভাইয়া কোথায়?? আম্মু ওইপাশ থেকে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন, তারপর শুধু বললেন বেলাল ভাইয়া ঠিক আছে, ওকে সেইফ জায়গায় রাখা হয়েছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম আব্বু কোথায়? তখন আম্মু খুব ঠাণ্ডামাথায় আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন বললেন,“উজমা শুনো তোমার আব্বু শহীদ হয়েছেন! আমি শুনে বললাম আম্মু তুমি এইসব কি বলতেছো? বান্না ভাইয়া তো বলল আব্বুকে তো ওরা এরেস্ট করে নিয়ে গেছে! আম্মু শুধু বললেন যে, আম্মু ধৈয্য ধরো, তোমার আব্বু আর নেই ওরা তোমার আব্বুকে ছাদ থেকে গুলি করে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে!! আমি শুধু চিৎকার করছিলাম আর বলছিলাম যে এটা কিভাবে সম্ভব??? আম্মু তুমি সত্যি বলেতেছতো?? কোনোভাবেই ক্যালকুলেশন মিলাতে পারছিলাম না, কারন র্যাবের অভিযান হলে তো ওরা বড়জোর আব্বুকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবে কিন্তু এভাবে মেরে ফেলবে কেন ??? সবশেষে আম্মু শুধু বললেন যে, তোমার আব্বুকে ওরা ট্রাকে করে তুলে নিয়ে গেছে, দোয়া করো মা ওরা যেন লাশটা গুম করে না ফেলে। আমি কিছুক্ষন হতভম্ভ হয়ে থাকলাম কি করবো কিছুই বুঝতেই পারছিলামনা। কিছু না ভেবে সিযদায় পড়ে গেলাম আর আল্লাহর কাছে শুধু একটা দোয়াই করলাম, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো, আমরা যেন এটলিস্ট আব্বুর লাশটা ফিরে পাই। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করলেন, অনেকক্ষণ পর আমরা জানতে পারি ওরা আব্বুকে সদর হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে গেছে।
আমাদের পক্ষ থেকে আব্বুর লাশটা গ্রহন করার মতন কাউকে পাচ্ছিলাম না, সবাই ঘটনা জানলেও নিজেদের প্রানভয়ে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল আমার আব্বুটা হাসপাতালে একা পড়ে আছে কিন্তু আমরা কেউই তার কাছে যেতে পারছি না! নিজেদের অসম্ভব helpless মনে হচ্ছিল, সারারাত আব্বু ওইভাবে একা পড়ে থাকলেন। অবশেষে সকালের দিকে আমাদের কয়েকজন রিলেটিভ হাসপাতালে যেতে পারেন। ওদিকে আম্মুদের জন্য প্রচণ্ড খারাপ লাগছিলো, তাদের চোখের সামনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ সাপোর্ট দেওয়ার মতন আশেপাশে কেউই ছিলনা। আমার আম্মু যখন দোতালার জানালা দিয়ে নিজের চোখের সামনে দেখতে পেলেন যে আব্বুর রক্তমাখা নিথর দেহটি নিচে পড়ে আছে আর ঐ অবস্থাতেই ওরা আব্বুকে ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে আর বলতে থাকছিল যে রক্তের দাগ মুছার জন্য ওরা আবারও আসবে..., তখন কেমন লাগছিলো আম্মুর?? তখন উনিতো চিৎকার করেও ওদের বলতে পারেননি যে আপনারা ডাঃ সাহেবকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?? সব কস্টগুলো বুকে চাপা দিয়ে চুপচাপ নিরবে সহ্য করে গেলেন!! আম্মু আর আমার ছোটভাবী ঐ অবস্থায় সারারাত একাকি থাকলেন, একবার ভাবুন তো ওইরকম একটা ঘটনার পর খালি বাসায় সারারাত ঐভাবে একা কাটানো কতটা ভয়ংকর কষ্টের!!
এদিকে আমরা লক্ষীপুরে যাওয়ার জন্য কোন গাড়ি manage করতে পারছিলাম না, ওইদিন লক্ষীপুরে হরতাল থাকায় কেউই রিস্ক নিতে চাচ্ছিল না, শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম আল্লাহ প্লিজ আমাদের তাড়াতাড়ি বাসায় পোঁছানোর একটা ব্যবস্থা করে দাও। অবশেষে সারারাত অপেক্ষার পর ফজরের দিকে আমরা ঢাকা থেকে রওনা দিতে পারলাম। রাস্তায় রাস্তায় গাছ দিয়ে বেরিকেট দেওয়া ছিল, ভাইয়ারা গাড়ি থেকে নেমে গাছ গুলো সরাচ্ছিল। এইভাবে অনেক বাধা উপেক্ষা করে অবশেষে বাসায় পোঁছালাম।
সবকিছু জানা সত্তেও কেন জানি বারবার নিজের মনটাকে সান্তনা দিতে থাকলাম আব্বু হয়ত এখনও বেঁচে আছেন, দরজায় দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে আমাদের আসার অপেক্ষা করছেন !!! কিন্তু সব ভুল ভেঙ্গে গেল যখন অনেক মানুষের ভিড় ঠেলে একটু সামনে এগিয়ে আমার আব্বুর রক্তমাখা কাপড় জড়ানো নিথর দেহটার সামনে এসে দাড়ালাম। যেই কপালে চুমু না খেলে রাতের ঘুমটা পরিপূর্ণ হতনা, তাকিয়ে দেখি সেই কপাল বেয়ে তখনো অঝরে রক্ত ঝরছে। ঠিক কোথায় আদর করবো সেই জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তারপরও ঐ অবস্থাতেই শেষবারের মতন আব্বুর কপালে চুমু খেলাম! নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলামনা মানুষ এতটা নির্মম হয় কি করে? কিভাবে পারলো ওরা? কি দোষ ছিল আমার আব্বুর??? এ কোন দেশে আছি আমরা, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সাধারন মানুষ নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, সেখানে তারাই কিভাবে পারে এভাবে একটা নির্দোষ মানুষকে এতোটা নির্মমভাবে হত্যা করতে? এত সস্তা মানুষের জীবন, এত অবলীলায় প্রকাশ্যে ধরে নিয়ে গুলি করে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা যায় এদেশে??
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৩ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শহীদদের গায়ের প্রতিটি ফোঁটা রক্ত আর নির্যাতিত-নিপীড়িতদের চোখের প্রতি ফোঁটা পানি বাংলাদেশের এই পবিত্র জমিনকে সমৃদ্ধি ও শান্তি নিশ্চিতকারী শুধুমাত্র ইসলামের জন্যই উপযুক্ত করে তুলছে এবং তুলতে থাকবে।
ইসলামের ছড়িয়ে পড়া এবং বিজয় মহান রাব্বুল আ'লামীনের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার - এখন দরকার শুধু সুযোগ্য নেতৃত্ব ও মানানসই মুক্তিকামী জনগণের...
মন্তব্য করতে লগইন করুন