'মজলুম' জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম ও আমার তওবা
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান সিরাজী ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:২৬:৩৩ সকাল
১. হাজার হাজার বই, লক্ষ লক্ষ পোস্টার আর কোটি কোটি মানুষের মুখে 'মজলুম' জনতেন অধ্যাপক গোলাম আযম উচ্চারণ হওয়ার কারণেই হয়ত আল্লাহ বেচারাকে 'মজলুম' হিসাবেই কবুল করেছেন এবং 'মজলুম' হিসাবেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে, জীবনের শেষ প্রান্তে জালিমের জিঞ্জিরে তিনি আটক। প্রিয় নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে এবং ঘাদানিকদের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় রাজশাহীর কাটাখালিতে মিছিল এবং ১৯৯৩ সালে 'মজলুম জননেতা' অধ্যাপক গোলাম আযমের মুক্তি চাই নামক পোস্টারিং করার মাধ্যমে উনার সম্পর্কে জানতে পারি। যেদিন থেকে প্রিয় নেতার সম্পর্কে জেনেছি, সেদিন থেকেই দেখছি উনি 'মজলুম'।
২. উনাকে প্রথম দেখেছিলাম সম্ভবত ১৯৯৪ সালে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে। জেল থেকে সসম্মানে বের হয়ে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে উনার সমাবেশ। ঘাদানিকদের হরতাল উপেক্ষা করে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে উপচে পড়া ভীড়ের মাঝে দুর থেকে নুরানী চেহারার অধ্যাপক গোলাম আযমকে দেখে আমাদের বন্ধুদের সাথে যে কথা হয়েছিল তাহলো, 'খালেদা জিয়ার চেয়েও গোলাম আযম দেখতে অনেক সুন্দুর'।
৩. আমার দেশের বাড়ী সিরাজগঞ্জ কিন্তু বাবার চাকরির সুবাদে আমার জন্ম ও বড় হওয়া রাজশাহীতে। আমি প্রতি সপ্তাহেই রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জে বিনা টিকেটে ট্রেনে যাতায়াত করতাম। তখন রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ মেইল ট্রেন ও পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেন চলত। মেইল ট্রেনে কোনদিন টিকেট কাটতাম না আর ট্রেনের টিটির সাহস ছিল না টিকেট চাওয়ার, কারণ বেশী বাড়াবাড়ি করলেই ট্রেনের টিটিকে জামতৈল স্টেশনে নামিয়ে মাইর দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাজশাহী থেকে ছেড়ে ঈশ্বরদী আবার ঈশ্বরদী থেকে ছেড়ে উল্লাপাড়া এবং উল্লাপাড়া থেকে ছেড়ে সিরাজগঞ্জে থামত। এখন অবশ্য ট্রেনটি অনেক স্টেশনেই যাত্রা বিরতি করে। পদ্মা এক্সপ্রেস ঈশ্বরদী থেকে ছাড়ার পর ট্রেনের সামনের দিক থেকে ম্যাজিস্ট্রেট, জিআরপি পুলিশ সহ টিকেট চেক করতে করতে পিছনে আসত এবং উল্লাপাড়া আসার পূর্বেই ট্রেনের শেষ মাথায় পৌছত। টিটি ও ম্যাজিস্ট্রেটরা টিকেট চেক করতে করতে সামনে থেকে পিছন দিকে আসত আর আমরা যারা বিনা টিকেটের যাত্রী তারাও পিছন দিকে আসতাম এভাবেই ট্রেনটি মুলাডুলি স্টেশরনের কাছাকাছি আসলে আমরা স্থানীয় ভাষায় 'ভ্যাকাম মারা' অর্থ্যাৎ ট্রেনের 'ভ্যাকুয়াম টিউব' খুলে দিয়ে ট্রেম থামিয়ে দিতাম এরপর ট্রেন থেকে নেমে ট্রেনের সামনের বগির দিকে উঠতাম। এভাবেই টিকিট চেকিংয়ের হাত থেকে বাঁচতাম। আবার আমাদের নামতে হতো জামতৈল স্টেশনে সেজন্য রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ আসার সময় জামতৈল স্টেশনে এসে ভ্যাকাম মেরে ট্রেন থেকে নেমে বাড়ী যেতাম এমনি ভাবে সিরাজগঞ্জ থেকে রাজশাহী যাওয়ার সময় বাড়ীর সামনে গিয়ে ভ্যাকাম মেরে ট্রেন থামিয়ে বাড়ী যেতাম, এসব কাজ যে অন্যায় তা জানতাম না, মনে হতো আমার বাবার ট্রেন। উল্লেখ্য, ভ্যাকাম মেরে ট্রেন থামানো অত্যন্ত সহজ। ট্রেনের প্রতি কামড়ার দরজার সাথে উপরের দিকে একটা লৌহার দন্ড বের হয়ে থাকত, ওটা ঘুরিয়ে দিলেই ট্রেন পং পং পং করে থেমে যেত।
১৯৯৯ সাল আমি শিবিরের সাথী। রাজশাহীর লোকনাথ স্কুলে জরুরীভাবে তলব করা হলো। অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে স্টাডি সার্কেলের মত প্রোগ্রাম। শতাধিক সাথী-সদস্য নিয়ে আসর নামাযের পর প্রোগ্রাম শুরু হলো। কোরআন পাগল গোলাম আযম কোরআনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করছেন, ডেলিগেটরা উত্তর দিচ্ছেন। তাঁর প্রশ্ন এমন, "দ্বীন সম্পর্কে একজন একটি আয়াত বলো, একজন তেলাওয়াত করল, অপরজন এটা কোন সুরার, অন্যজনকে বলল এটা কত নম্বর আয়াত, অন্যজনকে তুমি আয়াতটির অর্থ বলো।" এভাবে কোরআনের মহা শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর নাতির বয়সের ছাত্রদের কোরআনের বিষয় ভিত্তিক আয়াত, সুরা, অর্থ, আয়াত নম্বরসহ শিক্ষা করার দিক নির্দেশনা দিলেন। অর্ধেক সেশনের পর এবার আমরাও উনাকে বিভিন্ন জটিল জটিল প্রশ্ন করলাম, উনিও সুন্দর ভাবে উত্তর দিলেন।
আমাদের একভাই প্রশ্ন করল, "আমরা অনেক সময় বাস বা ট্রেনে ভাড়া দেয় না বা অর্ধেক ভাড়া দেয় এটা কি ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক"?। উনি উত্তর করলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম তদুপরি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এসব কাজ করা মোট্রে শোভনীয় নয়, তিনি বললেন, ' তোমরা ইসলামী আন্দোলনের কর্মী, তোমরা মানুষের জন্য মডেল, তোমরা কেন এসব কাজ করবে। ট্রেনের টিকেট না কাটার অর্থ হলো ১২ কোটি মানুষের হক নষ্ট করা, এজন্য আল্লাহর কাছে কঠোর জবার দিতে হবে।" আমার ভিতরে তোলপাড় শুরু হলো, রাত্রে আল্লাহর কাছে তাওবা করলাম, কাফফারা হিসাবে পরবর্তীতে অনেক টিকেট কিনে ছিড়ে ফেলেছি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রেন বা বাসের টিকেট না করে ভ্রমন করেছি বলে মনে হয় না। আল্লাহ তাঁর মজলুম বান্দা অধ্যাপক গোলাম আযমের উপর রহম করুন।
বিষয়: বিবিধ
১৯০২ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"মনের দিক দিয়ে গোলাম হলেই মানুষ ভৌগলিক ভাবে গোলাম হয়। মজলুম জননেতা অধ্যাপক গোলাম আজম"
বড় ভাইয়ের দেয়া এমন লিখিত একটা ষ্টিকারের মাধ্যমে প্রথম পরিচয়।আস্তে আস্তে জানা-শোনার পরিধি বাড়ে ওনার সম্পর্কে,শ্রদ্ধা আর বিশ্ময় বাড়তেই থাকে ওনার ব্যক্তিত্ব ঘিরে। ১৯৯৮সালে প্রথম আমার সৌভাগ্য হয় তাকে দেখার,তাও আবার ওনার মালিবাগের বাসায়! অপরিচিত আমাদের দু'ভাইরের প্রতি এমন আন্তরিকতা দেখালেন মনে হল আমরা উনার পরম মেহমান।অনেক সময় দিলেন তিনি।পরিবারের সবার কথা জিগ্যেস করে খবর নিলেন।আমার নানা মাওলানা বুরহান উদ্দীন জেনে আরো কাছে টেনে নিলেন যেন।নানার মাগফেরাত সহ আমাদের জন্য দোয়া করলেন।সুযোগ পেলে বাড়ী বেড়ানোর ওয়াদা করলেন।
এখন বুঝতে পারি অনেক বড়মনের মানুষ- এমনি হোন তারা।
মহান আল্লাহর রহমতের বিস্তির্ণ ছায়া ওনাকে ঘিরে রাখুন, আমিন।
সংগঠন করার সুযোগ না পেলেও ওনার সম্পর্কে ভাল ধারণাই ছিল,রাজাকার শব্দটাকে খারাপ লাগে না আমার।
বাজারের কাজীর লেইনের অফিসে সাক্ষাৎ করেছি। ওনার ইমামতি নামাজও পড়েছি।
সারা জীবন ইসলামী আনন্দোলনের জন্য কাজ
করছেন। কাজীর লেইনের মসজিদে তাফসিরের
আয়োজন করতেন। আজ মহান নেতা জালেমের কারাগারে আটক।
আমি শৈশবে আমার বড়চাচার সাথে রেলভ্রমনে এ শিক্ষা পেয়েছিলাম! স্টেশনে পৌঁছতেই ট্রেন ছেড়ে দিল, মেইল ট্রেন, গন্তব্যের মাঝে মাত্র একটি স্টপেজ ছিল- টিকিট করা গেলনা, টিটিও এলোনা!
গন্তব্যে নেমে তিনি উল্টাপথের মেইলট্রেনের টিকিট কাটলেন এবং ছিঁড়ে ফেললেন। আমি প্রশ্ন করলে বললেন- "ভাড়াটা দিয়ে দিলেম, তা না হলে আখেরাতে ধরা পড়তে হবে যে!"
আসলে শৈশবই উত্তম চরিত্র ও শিক্ষার উত্তম সময়!
মন্তব্য করতে লগইন করুন