আদালতে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (র.) এর জবানবন্দি
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান সিরাজী ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:৪১:১৪ সকাল
মিরপুরের কশাই কাদের এর দোষ ফরিদপুরের আবদুল কাদের মোল্লা এর উপর চাপিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজের পক্ষে জবানবন্দী দিয়েছিলেন। গত বছরের ১৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল-২ এ ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে দেয়া জবানবন্দীতে তিনি জীবনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন। বলেছেন মুক্তিযদ্ধের পুরো সময়ই তিনি ফরিদপুরের গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকা তো দূরের কথা গ্রামে অবস্থান কালে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং হাইস্কুলের ছাত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংও নিয়েছেন।
জবানবন্দীতে কাদের মোল্লা বলেন, একসময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সাথে একসাথে মিছিল-মিটিং ও রাজনীতি করেছি। যাদের সাথে একত্রে রাজনীতি করেছি তাদেরই মধ্যে একটি পক্ষ আজ জামায়াতে ইসলামী করায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা ছিল না বা নেই। গত ৪০ বছর সময়ে মধ্যে কোনো পত্রপত্রিকা বা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি।
ট্রাইব্যুনালে দেয়া নিচে তার সেই জবানবন্দীর বিবরণ তুলে ধরা হলোÑ
জবানবন্দী : আমার নাম আবদুল কাদের মোল্লা, আমার বাবার নাম মো: সানাউল্লাহ মোল্লা। আমার জন্ম তারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৪৮। আমার জন্ম স্থান জরিপের ডাংগি, ইউনিয়ন- চর বিষ্ণুপুর, থানা ও উপজেলা- সদরপুর, জেলা- ফরিদপুর। আমার বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা- গ্রাম : আমিরাবাদ, ইউপি- ভাষাণচর, থানা ও উপজেলা- সদরপুর, জেলা- ফরিদপুর।
আমার প্রাথমিক শিক্ষা হয় জরিপের ডাংগি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৮ সালে আমি প্রাথমিক শিক্ষা বৃত্তিসহ সম্পন্ন করি। আমি ১৯৫৯ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হই, এটি একটি হাইস্কুল। আমি ১৯৬৪ সালে ওই স্কুল থেকে এসএসসি প্রথম বিভাগে পাস করি। ওই বছরেই সম্ভবত জুলাই মাসে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হই। ওই কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করি। ওই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করি। এরপর প্রায় এক বছর চার মাস বাইশরশি শিবসুন্দরী একাডেমীতে শিক্ষকতা করি। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এমএসসি কাসে ভর্তি হই। আমি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ওই সময় পুরো বছরই প্রায় কাস হয়েছে, মাঝে মধ্যে হরতাল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বিঘœ ঘটেছে ফলে প্রায় সময়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ডিসেম্বরে পরীক্ষা ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার তারিখ পড়েছিল সম্ভবত ১২ বা ১৩ মার্চ ১৯৭১। কিন্তু ঐতিহাসিক ৭ মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক চূড়ান্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ায় উল্লিখিত তারিখের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। তখন আমরা জিজ্ঞেস করি পরীক্ষা কবে হবে। তখন তিনি বলেন, দেশের যে পরিস্থিতি তাকে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয়। আরো বললেন তোমরা হলে থাক আমি তোমাদের অচিরেই আমার সিদ্ধান্ত জানাব। আমরা যারা হলে ছিলাম তারা বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে আমরা নিজেরাই আবারো তার সাথে দেখা করি। এই পরিস্থিতিতে তিনি আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঢাকায় যাদের থাকার ব্যবস্থা আছে তাদের নিজ নিজ বাসায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আর যাদের ঢাকায় বাড়ি ঘর নেই তাদের তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বললেন। যাওয়ার আগে ডিপার্টমেন্টের অফিসে প্রত্যেকের ডাক এবং টেলিগ্রাম ঠিকানা দিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।
এরপর ১১ বা ১২ মার্চ, ১৯৭১ আমি আমার নিজ গ্রামের বাড়ি আমিরাবাদ চলে যাই। সেখানে যাওয়ার পর প্রতি দিনই বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজপড়–য়া ছাত্ররা যারা বাড়িতে চলে এসেছে তারা এবং স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকেরা আমরা একত্রে আমিরাবাদ হাইস্কুলের মাঠে বসতাম এবং রেডিওতে প্রচারিত প্রতিদিনের খবরাখবর শুনতাম। ইতোমধ্যে আমাদের সাথে অবসর প্রাপ্ত জেসিও আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। এভাবে এক সপ্তাহ বা তার কিছু সময় বেশি পার হয়ে যায়।
২৩ মার্চ, ১৯৭১ আমাদের এলাকায় তখনো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি যায়নি। অধিকাংশ বাড়িঘরে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। শুধু থানা হেড কোয়ার্টারে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ওই দিন আমরা ১২টার সময় জেসিও সম্ভবত উনার নাম ছিল মফিজুর রহমানোর ডাকে আমরা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজপড়–য়া ছাত্র এবং স্কুলের উচ্চ শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র একত্রিত হই। মফিজুর রহমান সাহেব আমাদের বললেন তিনি বিকাল থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেবেন এবং সেই লক্ষ্যে তিনি কিছু কাঠের তৈরি ডামী রাইফেল জোগাড় করেছেন। তিনি আরো বললেন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তাই আমাদেরকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা ওই দিন বিকালে তার পরামর্শ মতামতো ৩০-৪০ জন একত্রিত হই। তিনি প্রাথমিক পরীক্ষা নেয়ার পর ২/১ জন বাদে প্রায় সবাই প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য মনোনিত করেন এবং ওই দিন থেকেই আমরা পিটি, প্যারেড শুরু করি। তিনি প্রথম তিন দিন আমাদের ডামি রাইফেল দেন নাই। পরে ২০-২১টি ডামি রাইফেল আমাদের দেন এবং এই রাইফেলগুলো দিয়েই আমরা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩০ এপ্রিল বা ১ মে তারিখে ফরিদপুরে পৌছার দিন পর্যন্ত আমরা ট্রেনিং চালিয়ে যাই। ফরিদপুরে সেনাবাহিনী পৌঁছার পর কয়েক দিন আমাদের ট্রেনিং বন্ধ থাকে। এর কয়েকদিন পর আবার ট্রেনি চালু হয়। যেদিন পাক সেনারা ফরিদপুর থেকে বরিশালের দিকে যায় সেদিন আমরা আমাদের স্কুল থেকে কামানের গোলার শব্দ শুনতে পাই। কামানের গোলার শব্দ শুনার পর আমরা মাঠ থেকে স্কুলঘরের ভেতরে ঢুকে যাই। এরই মধ্যে একদিন কয়েকটি যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার উপর দিয়ে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যায় ফলে সবাই সাংঘাতিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায় এবং আমাদের ওস্তাদ ট্রেনিং বন্ধ করে দেয়। এই সময়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে অবসরপ্রাপ্ত অথবা এলপিআর’এ থাকা বা ছুটিতে থাকা সব সামরিক কর্মকর্তা ও সিপাহীদের কাজে যোগদান করার নিমিত্তে নিকটবর্তী থানা অথবা সেনা ছাউনিতে যোগদানের আহ্বান জানান হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর আমি লেখাপড়ার জন্য ঢাকা আসার চেষ্টা করতে থাকি। জবানবন্দীতে উল্লিখিত ব্যক্তি-ব্যক্তিগণের সাথে ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করি যাতে আমার লেখাপড়ার কোন ক্ষতি না হয়। তারা তিনজনই আমাকে একযোগে পরামর্শ দেন এখন ঢাকায় যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন তোমার ভূমিকা সম্পর্কে ঢাকায় কারো জানা নাই। সেখানে গেলে বর্তমান অবস্থায় যেকোনো ধরনের বিপদ হতে পারে। আমরা তোমার ভূমিকা সম্পর্কে জানি তাই তুমি বাড়িতে থাক। আমরা খোঁজখবর নেই, তারপর সব কিছু জানা শুনার পর এবং বঙ্গবন্দু দেশে ফিরে আসলে ছড়ানোর ছিটানো অস্ত্রপাতি সরকারের হাতে জমা হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, জানমালের নিরাপত্তা বিধান হবে, তখন আমরাই তোমাকে ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব।
এরপর তাদের পরামর্শ মোতাবেক আমি বাড়িতে এবং উপরে উল্লেখিত পীর সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকি এবং চৌদ্দরশি বাজারে ব্যবসায় করতে থাকি। তখন মাঝে মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা হাসান, মাকসুদ, আবদুল হাই প্রমুখের কাছ থেকে আমি চিঠি পেতে থাকি, তারা লেখে যে, তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আসো। এই চিঠিপত্র সম্পর্কে আমি সদরপুর থানার উল্লিখিত তিন ব্যক্তিকে জানাই। তারা বললেন, একটু দেখেশুনে যাওয়াই ভালো, এই চিঠি যে তারাই লিখেছেন তার কী প্রমাণ আছে।
১৯৭২ সালের সম্ভবত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সদরপুর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি শাহজাহান তালুকদার নিজেই আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং আমাকে শহীদুল্লাহ হলের গেটে নামিয়ে দেন। আমি আসার পর ছাত্রলীগের বর্ণিত নেতৃবৃন্দ আমার ভর্তির এবং হলে থাকার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন। কারণ তারা আমার কাস মেট ছিলেন এবং আমি তাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করতাম এবং তাদের সাথে আমার আন্তরিকতাও ছিল।
১৯৭১ সালের সম্ভবত জুলাই মাসের শেষের দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অফিস থেকে টেলিগ্রাম এবং ডাকযোগে খবর পাই যে, পরীক্ষা শুরু হয়েছে, আমি যেন এসে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দেই। আমি এই বার্তা মোতাবেক জুলাই মাসের শেষের দিকে আমি ঢাকায় আসি এবং হলেই উঠি। সপ্তাহ খানেক প্রাকটিক্যাল কাসও করি। কাস শেষ হওয়ার দুই-তিন দিন পর তিন দিনের বিরতিসহ দুই দিনব্যাপী প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা চলে। পরীক্ষা শেষে সপ্তাহ খানেক পর আবার বাড়ি চলে যাই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় আমার ব্রেক অব স্টাডি হয় এবং এ কারণে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি করা হয়নি। ১৯৭৪ সালে আমি আইইআর (ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ) এ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশনে (সোস্যাল সাইন্স) ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন পাস করি।
আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করি। এরপর ডিগ্রি প্রথম বর্ষে যখন পড়াশুনা করি তখন ইসলাম অ্যান্ড কমিউনিজমের তুলনামূলক পড়াশুনা করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পেরে আমি ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের কাজ করতে থাকি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পড়াশুনা করি। পড়াশুনা শেষ করে ওই সালেই আমার রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার আগেই আমি কিছুদিন ইসলামি ফাউন্ডেশনে চাকরি করি। পরে বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে চাকরি করি। আমি সেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমি উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে শিক্ষকতা করেছি। আমি মানারাত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম।
১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে আবার আত্মপ্রকাশ করার পর আমি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করি। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম পুনঃপ্রকাশিত হয়। আমি মানারাত থাকা অবস্থায় ওই পত্রিকায় শিক্ষা বিভাগের পাতার পরিচালক ছিলাম। আমার সাংবাদিকতার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে আমি সংগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে যোগদান করি তবে তখনো আমি মানারাত ট্রাস্টের সদস্য ছিলাম। ইতোমধ্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রাথমিক সদস্য পদ লাভ করি। ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দুইবার নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলাম তার সাথে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকি। সম্ভবত ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক নিয়োজিত হই। ১৯৮৭ সাল আমি ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির নির্বাচিত হই এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করি। ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে আমি কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলাম।
কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য থাকার কারণে তৎকালীন এরশাদবিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ উভয় দলের সিনিয়র নেত্রীবৃন্দের সাথে আমার সখ্য গড়ে উঠে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ জামায়াতের সমর্থন চায়। জামায়াতে ইসলামের সমর্থন পেলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারবেন না। এ কথা আওয়ামী লীগকে জানানো হয়। এরপর বিএনপি আমাদের কাছে সরকার গঠনের জন্য সমর্থন চাইলে বিএনপিকে সমর্থন দেই এবং শর্ত দেই যে, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি এই কারণে আমরা পরে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির সাথে একীভূত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করি। আন্দোলনের সময় মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের বাসায় প্রায়শই লিয়াজোঁ কমিটির মিটিং হতো এবং আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম। নাসিম সাহেব এই লিয়াজোঁ কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন। আমি এগুলো নোট করে নিয়ে এসে বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতাম। আন্দোলন তীব্রতর রূপ লাভ করলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আমাকে এবং আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদকে একই দিনে গ্রেফতার করে, আটকাদেশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি মুক্তি পাই।
আমাদের আন্দোলন চলেতে থাকে। একপর্যায়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে আইন পাস করে। আন্দোলনের কারণে জামায়াতের সাথে বিএনপির দুরুত্ব সৃষ্টি হয় ফলে ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে জামায়াত এবং বিএনপি আলাদাভাবে নির্বাচন করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং আমাকে বললেন আমরা তো সরকার গঠন করলাম, আমাদের কিছু পরামর্শ দেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর মুখ্যসচিব ছিলেন এবং তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রিসিভ করেন। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দেই যা শুনে তিনি আমাকে সাধুবাদ দেন। একইভাবে তিনি পরে আমাকে আরো দুইবার ডেকেছিলেন।
এখন আমি মনে করছি দীর্ঘ দিন যাদের সাথে রাজনৈতিক আন্দোলন করলাম, মিটিং মিছিল করলাম, সুসম্পর্ক রাখলাম, সখ্য রেখে চলেছি তারা এখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর সাথে আমার বিন্দুমাত্র কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং নেই এবং আমি কোনোভাবেই ওই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলাম না। বিগত ৪০ বছর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কারোর পক্ষ থেকে পত্র-পত্রিকায় বা কোন কর্তৃপক্ষের বরাবরে আনীত কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিষয়: বিবিধ
২০৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন