তোমরা যারা ছাত্রলীগ কর- অনিক লুম্বা(জাফর ইকবাল স্যারের কল্পিত চরিত্র)
লিখেছেন লিখেছেন রাফায়েল ২৮ মে, ২০১৩, ০১:৫৭:৪১ দুপুর
১
কিছুদিন আগের কথা। আমি আমার বাসায় বসে আছি, তখন হকার পত্রিকা দিয়ে গেল। পত্রিকায় দেখলাম এক ছাত্র রাইফেল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কাউকে মারার জন্য যে গুলি নিয়ে বের হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যা সন্দেহ করেছিলাম তাই, ছেলেটা আমাদের সোনার ছেলে, ছাত্রলীগ কর্মী।ছাত্রলীগ নাম আর কেন যে অব্যাহত রাখে হয়েছে তা আমার বোধগম্য না।সে যাই হোক গত কয়েক বচর ধরেই এই দৃশ্যটা মানুষকে অনেকটা অভ্যস্ত করে ফেলেছে। ১৯৭১ সালের পর থেকে আওয়ামিলীগ দেশের ছাত্রজনতাকে যেভাবে সন্ত্রাস বানিয়েছে তার জন্য তাদেরকে জাতি কোনদিন ক্ষমা করবে না।
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই দীর্ঘ জীবনে আমি সবচেয়ে বিচিত্র, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিষয় কী দেখেছি। আমি এতটুকু দ্বিধা না করে বলব, সেটি হচ্ছে ছাত্রলীগ। তার কারণ, যে বয়সটি হচ্ছে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার বয়স, সেই বয়সে তারা ভালোবাসে চোর বাটপারদের, যারা এই মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। যে বয়সে একজন তরুণের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা অনুপ্রাণিত হয় চেতনাব্যবসায়িদের দিয়ে। যে বয়সে তাদের স্বপ্ন দেখার কথা দেশের বড় বড় লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিককে নিয়ে, সেই বয়সে তারা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সেই সব মানুষের, যারা বর্তমানে এই দেশের লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী আর সাংবাদিকদের হত্যা করছে অথবা তাদের কন্ঠে তালা ঝুলাচ্ছে! যে বয়সে তাদের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করার কথা, ষোলোই ডিসেম্বরে স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার কথা, পয়লা বৈশাখে রাজপথে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা ফেনিসিডিল আর গাজার আড্ডায় নিজেদেরকে ব্যাস্ত রাখছে, এমনকি শহীদ মিনারের সামনে নিজেদের মধ্যে শক্তির লড়াইয়ে অংশগ্রহন করছে। যে বয়সে তাদের মুক্তচিন্তা শেখার কথা, গান গাওয়ার কথা, নাটক করার কথা, আদর্শ নিয়ে ভাবালুতায় ডুবে যাওয়ার কথা, সেই সময় তারা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আটকে রাখতে শেখে, সন্ত্রাস হতে শিখে, মানুষ খুন করতে শেখে। যে বয়সে ছেলে আর মেয়ের ভেতর সহজ ভালো লাগা ভালোবাসা জন্ম নেওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা সেই অনুভূতিগুলোকে অশ্রদ্ধা করতে শেখে কখনও কখনও তারা রেপের সেন্ঞুরী পর্যন্ত করে— সেটা করে আবার উদযাপন করার মত বর্বরতা তারা করেছে বাংলার মাটিতে। যখন এই বাংলাদেশের সব ছাত্ররা নিজের মেধা দেখিয়ে বড় বড় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হচ্ছে ভাল সার্টিফিকেটের আশায় , তখন ছাত্রলীগ নামে এই সংগঠনের হতভাগ্য তরুণদের পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে সব ইউনিভার্সিট বন্ধ করার জন্য। খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই, এখনো দেশের আনাচকানাচ থেকে তাদের ধরে জেলে ঢোকানো হচ্ছে আবার ছেড়েও দেয়া হচ্ছে দল ক্ষমতায় আছে বলে,দল ক্ষমতায় না থাকলে কি অবস্থা হবে একবারও কি ভেবে দেখেছ ? আমার খুব জানার ইচ্ছে করে যে নেতারা তাদের বুঝিয়েছে, রাস্তায় নেমে চোরাগোপ্তা হামলা করে নিজের ভাইকে মারতে হবে, নিজের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে হবে। সেই সব নেতা কি তাদের সন্তানদেরও পথে নামিয়েছে? আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেটি ঘটেনি। আমি আগেও দেখেছি, এই নেতারা যখন তাদের কর্মী বাহিনীকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, তখন তাদের সন্তানেরা ইংরেজি মিডিয়াম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে। একটু বড়হওয়ার পর তারা চলে যায় বিদেশে। পরে দেশে এসে তোমাদের উপরেই আবার নেতাগিরি ফলায়।
আমি অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনি, কেমন করে বাংলাদেশের মতো রক্তস্নাত একটি দেশে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নৃশংস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, সেখানে একজন মানুষ ক্ষুনি, লুটেরাদেরকে ভালবাসতে পারে!
একজন ছাত্র কেমন করে লীগ করে, তার একটি উত্তর অবশ্য আমি একবার খুঁজে পেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র একবার বলেছিল যে সে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, খুব ভালো ছাত্র এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার খুব ইচ্ছে। তার বিভাগীয় প্রধান বামপন্থী আওয়ামিলীগ মদদপুষ্ট লোক এবং তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সে যদি লীগের সক্রীয় সদস্য না হয় , তাহলে তাকে শিক্ষক হতে দেওয়া হবে না। সে জন্য সে লীগে যোগ দিয়েছে এবং এটি নিয়ে তার কোনো অহংকার নেই। তার কথাটিতে আমি একজন মেরুদণ্ডহীন অসহায় হতভাগা মানুষকে আবিষ্কার করেছিলাম। তার জন্য কোনো মমতা নয়, আমি করুণা অনুভব করেছিলাম। আমি ইচ্ছে করলেই সেই ছাত্রটিকে খুঁজে বের করতে পারতাম, তার নীতিহীন বিভাগীয় প্রধানের পরিচয় জানতে পারতাম কিন্তু আমি তার কিছুই করিনি—আমার রুচি হয়নি।
আমার মাঝেমধ্যে জানার ইচ্ছে করে, এ ধরনের কারণে কতজন তরুণ লীগে যোগ দিয়েছে—কোনো স্বপ্ন নয়, কোনো আদর্শ নয়, শুধু স্বার্থ, শুধু চাওয়া-পাওয়া। মাঝেমধ্যেই শুনতে পাই, আওয়ামিলীগের এখনকার সব বড় বড় নেতা নাকি নাম্বার ওয়ান গডফাদার। এই দলে যোগ দিলে নাকি চাকরি পাওয়া যায় তাদের প্রতিষ্ঠানে এমনকি প্রশাসনেও। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা হল দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই হলে সিট পাওয়া যায়। তারা কলেজ দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই কলেজে ভর্তি হওয়া যায়। পত্রপত্রিকায় দেখি, পরিচিতদের কাছে শুনি, তাদের দল নাকি অন্তকোন্দলে ভরপুর।অন্তকোন্দলের সংগঠন যারা কিনা নিজেদের লোক নিজেরাই মেরে আনন্দ পায় তারা কি খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে? দীর্ঘদিন মিলিটারির শাসনে থাকার কারণে মানুষের বিভ্রান্তিতক কাজে লাগিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে। শুধুমাত্র ঠুনকো কিছু ক্ষমতার আশায় জীবনের ঝুকি নিয়ে তোমরা এইসব গডফাদারদের খেলার পুতুল হিসেবে কাজ করে সমাজের কাছে নিজেদেরকে সন্ত্রাস হিসেবে পরিচিত করে কয়দিন টিকে থাকতে পারবে। কাজেই গডফাদার,হায়েনা কিংবা লুটেরাদের বাচানোর চেষ্টা করে কেউ সফল হতে পারবে না।বাংলার মাটি থেকে তারা উচ্ছেদ হবে অচিরেই।
৩.
আমার এই লেখাটি তোমরা যারা ছাত্রলীগ করো, তাদের জন্য। আমি জানি, এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি কাজ—আমার এই লেখাটি তোমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবে না এবং তোমরা যারা পড়ছ তারা আমার এই লেখায় বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে এর মধ্যে নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়েছ। শুধু তা-ই নয়, তোমাদের প্রিয় জায়গা—ইন্টারনেটে সম্ভবত এই লেখার বিরুদ্ধে বিশাল একটা প্রচারণা শুরু হবে। কিন্তু তবু আমার মনে হয়েছে, আমার এই কাজটুকু করা উচিত, তোমাদের কখনো যে সত্য কথাগুলো বলা হয়নি, আমার সেটা বলা উচিত।
তোমাদের কাছে আমার প্রথম যে প্রশ্ন সেটি হচ্ছে, তোমরা কি জানো আবুল হোসেন নামের যে মানুষটির টাকার জোরে দলটি টিকে ছিল দলটির ক্রান্তিলগ্নে সেই মানুষটিকে সারা বিশ্ব এখন চোর বলে জানে।গত এক বছর ধরে চোর শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে এখন সুরন্জিত হয়ে গেছে। তোমরা কি জানো আওয়ামিলীগ একটি চেতনাব্যবসায়ীর দল, এটি সব সময় চেতনার কথা বলে মানুষকে ধোকা দিয়ে লুটপাট করেছে? যখন এই দেশে পাকিস্তান নামের দানবকে পরাস্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তখন তারা বাংলাদেশের ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গিয়ে মানুষের কোন উপকারে আসে নি?
আমার ধারণা, তোমরা যারা লীগ করো, তাদের বেশিরভাগই ঠিকমত লেখাপড়াই কর না,শুধু মাস্তানী করার নতুন নতুন কায়দা বের কর। তোমরা সব সময়ই নিজেদের সঙ্গে নিজেরা কথা বলো, একে অন্যকে উৎসাহ দাও, একে অন্যের ওপর নির্ভর করো কিন্তু তোমাদের দলের বাইরের মানুষেরা তোমাদের সম্পর্কে কী ভাবে, কখনোই তার খোঁজ নাওনি। যদি খোঁজ নিতে, তাহলে হয়তো তোমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ছবি দেখতে পেতে। তোমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করতে, তোমাদের যেভাবে যা কিছু শেখানো হয়েছে, তার সবকিছু সত্যি নয়। কদিন আগেই শুনলাম , সাধারণ মানুষ তোমাদের ধাওয়া করছে, তোমাদের আক্রমণ করছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এটি ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকবে। তোমরা নিজেদের জন্য যে জীবন বেছে নিয়েছ, তার মধ্যে কি বিন্দুমাত্র মর্যাদা আছে? আত্মতুষ্টি আছে?
আজ থেকে কয়েক যুগ আগেও এই পৃথিবী যে রকম ছিল, এখন সেই পৃথিবী নেই। এই পৃথিবী অনেক পাল্টে এই নতুন পৃথিবীর মানুষেরা অসাধারণ, তারা একে অন্যের মতকে সম্মান করতে শিখেছে, একে অন্যের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে উপভোগ করতে শিখেছে, একে অন্যের চিন্তাকে মূল্য দিতে শিখেছে। এই নতুন পৃথিবীতে মানুষে মানুষে কোনো বিভাজন নেই। দেশ-জাতির সীমারেখা পর্যন্ত ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে।
তাই এই নতুন পৃথিবীতে যখন কেউ চেতনা দিয়ে মানুষকে বিভাজন করে রাজনীতি করতে চায়, পৃথিবীর মানুষ তখন তাকে পরিত্যাগ করে।
আমি জানি, যদিও আমি এই লেখাটি লিখেছি যারা ছাত্রলীগ করে তাদের উদ্দেশে কিন্তু তারা আসলে আমার একটি কথাও বিশ্বাস করবে না। যদি বিশ্বাস করেও ফেলে, তার পরও তাদের কিছু করার থাকবে না। এ ধরনের রাজনৈতিক দল যখন তৈরি করা হয়, তখন অনেক লোভ দেখিয়ে দলে টানা হয়। কিন্তু দলে যোগ দিয়ে যদি মোহভঙ্গও হয়, তবু তারা আর দল থেকে বের হতে পারে না। অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো এক অন্যকে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে হয়।
যারা এখনো লীগে যোগ দেয়নি, তারা হয়তো এই লেখাটি পড়ে একটুখানি ভাববে। যখন তাকে এই দলে যোগ দেওয়ার কথা বলবে, হয়তো তারা একটিবার চিন্তা করবে, আমাদের এই ভালোবাসার দেশটিকে যারা টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছিল, আমি কেন সেই দলে যোগ দেব? দেশকে যখন ভালোবাসার কথা, তখন কেন আমি দেশের সঙ্গে বেইমানি করব?
মাতৃভূমিকে ভালোবাসার নাম করে যারা দেশের সম্পদ লুটপাট করে তীব্র আনন্দ যারা উপভোগ করে, যারা ভবিষ্যতেও দেশের সম্পদ লুটপাট করে তীব্র আনন্দ অনুভব করবে আমি সেসব হতভাগ্য মানুষের জন্য গভীর করুণা অনুভব করি।
বিষয়: বিবিধ
২০৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন