আমার পরিবারের জামাত হয়ে উঠার গল্প-২

লিখেছেন লিখেছেন আবু মাঈশা ০৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৬:৫১:৩৩ সকাল

পীর সাহেব ফজরের আগে আখেরী মোনাজাত শেষ করে হুজরা খানায় ফিরতেন আর আমার ডিউটি তখন শুরু হতো। ফজরের জামাতের আগে পর্যন্ত আমি উনার পা টিপতাম। এর জন্য আমার পরিবার খুব গর্ব করতো যে আমার মাঝে নিশ্চয়ই কিছু আছে যা পীর সাহেব দেখতে পেয়েছেন যার জন্য এই অল্প বয়সেই পীরের সুনজর আমার উপর পরেছে। পীর সাহেব খাটের ঘুমাতেন। তার ভক্তকুলরা মাটিতে খড়ের উপর চাঁদর বিছিয়ে বিশাল আকারে বিছানা করা হতো সেখানে থাকতেন। তাদের মধ্যে দু একজনের সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। বিশেষ করে মোশারফ হুসেন যশোরী সাহেব যিনি পীর সাহেবের তাবিজ এবং টাকা পয়সা রাখার কাজ করতেন তার সাথে আমাদের খুবই সম্পর্ক ছিলো। এই সম্পর্ক থাকার পিছনে একটা বিশেষ কারন ছিলো। পীর সাহেবের আগমনের পর পরই তার তাবিজের রেট আমাদের সাথে শেয়ার করা হতো। ভোর বেলা ফজরের নামাজের পর পীর সাহেব হালকা নিদ্রায় যেতেন। সেই সময়ে আমরা হুজরা খানার পাশে খোলা উঠোনে টেবিল বসিয়ে রাখতাম। গ্রামের আবার বৃদ্ধা বনিতা সবাই শিশি/বোতল ভরে তেল আর পানি সেই টেবিলে রাখতেন। যার একান্ত দায়িত্ব আমি নিজে পালন করতাম। সূর্য উঠার কিছু পর পীর সাহেব ঘুম থেকে উঠে কুসুম গরম পানিতে অযু করতেন যা আমি আগেই রেডি করে রাখতাম। অযু শেষ করে তিনি দু রাকাত নামাজ পড়তেন। ততক্ষনে আমাদের ঘরের আশে পাশে তাবিজ আর পানি পরা নেয়ার জন্য লোকে লোকারন্য হয়ে যেতো। নামাজ শেষ করে পীর সাহেব দোয়া পরে টেবিলে রাখা তেল আর পানিতে তিনবার ফু দিতেন। সবাই সারিবদ্ধ ভাবে সেই বোতল নিয়ে যেতেন আর যে যা পারতেন হাদিয়া দিতেন। যারা তাবিজ নিতেন তারা পীর সাহেব কে তাদের সমস্যার কথা বলতেন। পীর সাহেব তাবিজ দেয়ার জন্য যশোরী সাহেবকে বলতেন। তাবিজের হাদিয়া সব সময় একটা নিদৃষ্ট টাকার সাথে চার আনা যোগ থাকতো। যেমন ১৮ টাকা চার আনা, ৪১ টাকা চার আনা ইত্যাদি। জটিল সমস্যার জন্য টাকার পরিমান একটু বেশী ধার্য করা হতো। তাবিজ পরা, পানি পরা আর মানূষকে ফু দেয়ার কাজ হলে পীর সাহেবের জন্য সকালের নাস্তা যা খুবই স্পেশাল ছিলো রেডি হতো। সকালের নাস্তায় সাধারনত কচি লাউ দিয়ে মোরগের গোস্ত আর রুটি পীর সাহেবের খুব পছন্দ ছিলো। আমাদের বাড়ীর মা চাচিরা সবাই পীর সাহেবের খাবারের মেনু জানতেন। পীর সাহেবের নাস্তা শেষে নাস্তার প্লেটের যে অংশটুকু বাকী থাকতো তা খাওয়ার জন্য অনেকেই ইচ্ছা পোষন করতেন। বেশীর ভাগ সময় আমরা খুব কাছের চামচারাই তা খেতাম। তখন বিশ্বাস করতাম এটা খেলে শরীরের সব রোগ ভালো হয়ে যাবে। শত হলেও পীরের মূখের জুটা! সে যাই হউক পীর সাহেব মাঝে মধ্যে দু এক দুদিন বেশী থাকতেন আর এর মধ্যে গ্রামের সব মোড়লদের বাড়িতে বিশেষ সফর দিতেন। প্রতিটি দাওয়াতে খুব ভালো মায়নে মিলার পাশাপাশি খাওয়া দাওয়া খুবই ভালো হতো। আমি খুব দুষ্ট থাকার কারনে আমার মা আমার ভাইদের মারফত পীর সাহেবের কাছে বিশেষ তাবিজ দেয়ার জন্য বলে পাঠাতেন। সেই তাবিজের জন্য পীর সাহেব কিংবা তার মুরিদানরা কখনোই হাদিয়া নিতেন না। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমার গলায় আর ডান হাতে সব সময় তাবিজ থাকতো।

বড় হওয়ার পর পীর সাহেব কে দেখেছি তাবলীগ আর জামাত শিবিরের বিরুদ্ধে খুব বিশেদাগার করতে। বলতেন 'বাবাগো ইসলামে রাজনীতি নেই গো, ওরা ওহাবী ওদের ধারে কাছে ও যেয়োনা।' একবার মাহফিল শেষ করে যাওয়ার আগে খুব মেজাজ খারাপ করেই বলতে দেখেছি ' বড় ভাই শেষ হয়ে গেছে, উনার সব আমল শেষ হয়ে গেছে, ফুরফুরায় উনার আর কোন স্থান নেই, আল্লার ওলীদের সাথে বেয়াদবী করে কেউ ফুরফুরায় থাকতে পারেনা। উল্লেখ্য পীর সাহেবের বড় চাচার বড় ছেলে আব্দুল কাহহার সিদ্দীকি যিনি মীরপুর দারুস সালামের পীর বলে খ্যাত ছিলেন তিনি জীবনের শেষ বেলায় জামাতে ইসলামের পক্ষে অনেক কাজ করে গেছেন। এবং ফুরফুরার এই তথাকথিত ছিলছিলার অনেক সমালোচনা করে গেছেন। আমরা ঢাকায় আসার পর উনার সাথে আমাদের পরিবারের খুব ভালো সম্পর্ক হয়।

আমার চতুর্থ ভাইকে পীর সাহেব তার এক পীরের মেয়েকে বিয়ে করিয়েছেন যিনি পুরান ঢাকায় এক স্কুলের নামকরা শিক্ষক। ভাইয়ের এই শশুরের জোরাজোরির কারনে এক সময় ঢাকায় মাদারটেক আমাদের বাসায় সিদ্দিকিয়া খানকা শরীফ প্রতিষ্টা করা হয়। যেখানে প্রতি শুক্রবারে হালকায়ে জিকির হতো। ঢাকার বিভিন্ন যায়গা থেকে পীর সাহেবের মুরিদরা সে হালকায়ে জিকিরে অংশ গ্রহন করতেন।

এই সত্য কথা গুলি আমি নিজ দায়িত্বে লিখার মাধ্যমে আমি আমাদের সমাজের এই ভ্রান্ত ধারনা পূর্ন প্রথা গুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। তাতে কেই আঘাত পেয়ে থাকলে আমার কিছুই করার নেই। তবে এই সকল বিদআতের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ আমরা আজ জামাতে ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের চোখকে খুলে দিয়েছেন নয়তো আজকে প্রকৃত দ্বীনের বুঝ থেকে অনেক দুরে থাকতাম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার দ্বীকে সঠিকভাবে বুঝার এবং মানার তাওফিক দিন।

বিষয়: বিবিধ

১৬৭৬ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

299911
০৯ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:০৫
আকবার১ লিখেছেন : দারুন লেখা,আমারও গলায় আর ডান হাতে সব সময় তাবিজ থাকতো। এস,এস,সি পর্যন্ত। তারপর ভূয়া তাবিজ ফেলে দিয়েছি।
299919
০৯ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১১:৪৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগল।
ফুরফুরার প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু জামায়াতে উলামা এ ইসলাম এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
299923
০৯ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:৫৭
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আমীন।
299993
১০ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৩:১২
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : সব তো বুঝলাম, এবার বলেন আপনি কার বাবা হলেন Thinking Happy
১০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৬:০৯
242830
আবু মাঈশা লিখেছেন : Happy Happy হলে তো শিরনী পাবেন।
১০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৭:২৬
242832
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : নাম তো বলছে 'মাইশার বাবা' Tongue
২০ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১২:২৮
243360
আবু মাঈশা লিখেছেন : হা হা আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইয়ের মেয়ের নাম। সে আমাকে বাবা বলে ডাকে। Happy Happy
২০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৫:৪৪
243389
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File