আমার পরিবারের জামাত হয়ে উঠার গল্প-১
লিখেছেন লিখেছেন আবু মাঈশা ০৮ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৭:৫৬:১৬ সকাল
প্রতি বছর পৌষ/মাঘ মাসে আমাদের গ্রামে বাৎসরিক মাহফিল হতো। ফুরফুরার গদ্দীনশীন পীর সাহেব আসতেন। আমার বয়স যখন ৫/৬ বছর তখন থেকে এই সময়টার সারা বৎসর অপেক্ষা করতাম। মাহফিল সময় ঘনিয়ে এলে টাকা জমানো শুরু করতাম। উদ্দেশ্য মাহফিলের পাশে চানাচুর মুড়ির দোকান দেয়া। মাহফিল সব সময় আমাদের জমির উপর হতো আর জমির পাশে যে রাস্তা ছিলো সেখানে আমরা গ্রামের সব ছেলেরা মিলে চানাচুর, মুড়ির মোয়া, জিলাপী, চা সহ বিভিন্ন আইটেম এর দোকান দিতাম। পীর সাহেবে আমাদের বৈঠক ঘরে থাকতেন তার আরো ৪/৫ খাস মুরিদান সহ। পীর সাহেবের সেবার দায়িত্ব সব সময় আমাদের ভাইদের উপরই পরতো। আসলে পীর সাহেবের পা টিপার জন্য অনেকেই লাইনে থাকতো কিন্তু পীর সাহেব সব সময় আমাদেরকেই পছন্দ করতেন। সেই যাই প্রতি বছর এই মাহফিল একটা পিকনিক পিকনিক ভাব নিয়ে আমাদের মাঝে আসতো। তখন আমাদের বাড়িতে গাড়ি আসতোনা। আমাদের গ্রাম থেকে একমেইল দুর নোয়াগাও থেকে আমরা সব নেংটা ছেলের দল বাশের বেতের আগায় লাল, নীল, সবুজ সহ ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের নিশান বানিয়ে পীর সাহেবকে এগিয়ে নিয়ে আসতাম। সাথে সাথে শ্লোগান দিতাম পীর সাহেবের আগমন...শুভেচ্ছা স্বাগতম, আল্লার ওলীর আগমন...শুভেচ্ছা স্বাগতম, নারায়ে তাকবির...আল্লাহু আকবার, নারায়ে রেসালাত...ইয়া রাসুলুল্লাহ। বয়স বাড়তে লাগলো আর দিন দিন পীর সাহেবের ওয়াজ মুখস্ত করতে লাগলাম। পীর সাহেব শেষরাতে ফজরের এক থেকে দেড় ঘন্টা আগে ওয়াজ শুরু করতেন। ওয়াজের মুল প্রতিবাদ্য বিষয় পীর সাহেবের দাদা হুজুরের (মরহুম আবু বকর রাঃ) জীবনের গল্প আর নসিহত। কিভাবে সারা বছর চলবেন, প্রতি নামাজের পর কি কি আমল করবেন, আরো কিছু অন্যান্য কিছু মাযেজা টাইপ কাহিনী। ক্লাস সেভেন এ পড়া অবস্থায় আমি গ্রাম ছাড়ি। সে পর্যন্ত পীর সাহেবের খুব খাস সেবক ছিলাম। পীর সাহেব আমাকে আদর করে ডাক্তার ডাকতেন। আমার মা বাবার ইচ্ছা ছিলো আমি ডাক্তার হবো আর সেকারনেই হয়তো পীর সাহেব আমাকে ডাক্তার ডেকে বাবা মা ভাইবোনদের অন্তর কে শান্তি দিতেন। এখানে বলে রাখা ভালো পীর সাহেবের ডাক্তার ডাকা মানে আমার পরিবারের সবাই বিশ্বাস করতেন যে আমার ডাক্তার হওয়া মোটামুটি শতভাগ নিশ্চিত। সে যাই হউক আমার আর ডাক্তার হয়ে উঠেনি। আমাদের পরিবারের বাপ চাচাদের দেখাদেখি আমরা ভাইয়েরা ও দিন দিন পীরের সহবত নেয়া শুরু করি। কিন্তু এক সময় আমাদের পরিবারের সবাই গ্রাম ছেড়ে চিটাগং এ স্থায়ী হই। সেখানে যেয়েও চিটাগং এর অনেক লোকাল পীরদের সাথে আমাদের যোগাযোগ থাকে। কারনটা এই ছিলো যে সবাই একই ফুরফুরার ছিলছিলার ছিলো। কিন্তু হঠাত করেই আমাদের পরিবারে তাবলীগের ছোয়া লাগে। আমার বড় ভাইয়ের খুব কাছের এক বন্ধুর নিয়মিত তদারকীতে এক সময় পরিবারের অনেকেই পীর সাহেবকে ভুলতে লাগে। আস্তে আস্তে প্রতিমাসে নিয়মিত তিনদিনের ডাক পড়তে শুরু করে। বড় ভাইয়ের কিছুটা বাড়াবাড়ির কারনে আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই কিছুটা বেকে বসি। কিন্তু ছোট হওয়ার কারনে আমাদের এই বেকে বসা কোন কাজে আসেনি। আমার মা আবার আমাদের পক্ষের লোক ছিলেন। আমরা ছোট তিন ভাই তখন শিবিরের সাথে কিছুটা আসা যাওয়া শুরু হয়েছে মাত্র। বড় ভাই যখন আমাদের কে তিনদিনের জন্য রেডি হতে বলতেন আমরা যেয়ে আম্মার পা টিপা শুরু করতাম। বড় ভাই কিছু বললে আম্মা বলতেন মায়ের পদতলে যেহেতু সন্তানের বেহেস্ত সুতরাং আমার ছেলের তিনদিনের দরকার নেই। সে যাই হউক এ নিয়ে আমার আর বড় ভাইয়ের মধ্যে লেগেই থাকতো। এক সময় মহসিন কলেজে ভর্তি হলাম। শিবিরেরে আরো কাছে আসার সূযোগ হলো। আমার মা এক সময় আমাদের পাড়ার দায়িত্বশীল আকবর ভাইকে ডেকে আমার ব্যাপারে নজর রাখার কথা বললেন পাশাপাশি যে কোন ছোট খাট প্রোগ্রামের ব্যাপারে সাহায্যের কথা ও বললেন। আমার মায়ের এই শিবির হয়ে উঠার পিছনে চট্রগ্রামের তাহের ভাইয়ের স্ত্রীর অনেক বড় ভূমিকা ছিলো। আমাদের বাসার পাশেই বি আই এ (চট্রগাম জামাত অফিস) ছিলো। আর আমাদের বাসার পাশে মহিলা জামাতের এক রোকন ছিলেন যিনি নিয়মিত আম্মার কাছে আসা যাওয়া করতেন। সেই সুবাদে আমাদের বাসায় মহিলা জামাতের নিয়মিত প্রোগ্রাম হতো। আমার মা সহ তিন ভাইয়ের স্ত্রীরা সবাই সেই প্রোগ্রাম বসতেন। ৯৭ সালের শুরুর দিকে পরিবার ব্যাবসায়িক সুবিধার্থে সবাই চিটাগং থেকে ঢাকায় চলে আসলেও আমরা ছোট তিনভাই চিটাগং এ থেকে যাই। আমি কলেজ শেষ করে ইসলামিক য়্যুনিভার্সিটিতে ভর্তি হই আর বাকি দুইভাই চিটাগং এর ব্যাবসা দেখার দায়িত্ব নেয়। আমার বড় ভাই তাবলিগ করার কারনে সব সময়ই আমাদের বিরোধিতা করতেন। কিন্তু একটা জিনিস পজেটিভ ছিলো তা হচ্ছে জামাতে ইসলামের অনেক নেতৃবৃন্দের প্রতি উনার অনেক শ্রদ্ধা ছিলো। কারনটা বি আই এ নিয়মিত জুম্মার খুতবা শুনা। এরই মধ্যে চিটাগং এ এইট মার্ডার হয়। আমার এক শিবিরের বড় ভাই বন্ধু শিমুল ভাই(এইট মার্ডার হওয়ার পর নতুন নাম) সেই মামলার আসামী হলে আমার বড় ভাইকে বলে কিছুদিন আমাদের ঢাকার বাসায় পালানোর ব্যাবস্থা করি। আমার বড়ভাই আমার শিবিরের ঐ বন্ধুকে নিয়মিত তাবলিগে নিয়ে যেতেন। উদ্দেশ্য ছিলো তাকে তাবলিগ বানিয়ে ছাড়া। আমি ও আমার বন্ধুকে বড় ভাইয়ের এলার্জির ব্যাপারে বলে আসি। শিমুল ভাইয়ের অসাধারন মেধার কাছে ভাই একটা সময় পরাজিত হয়। কাহিনীটা এরকম যে একবার একটা মাসআলা নিয়ে ভাই আর শিমুল ভাইয়ের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য দেখা দেয়। ভাই ঐ মাসআলা ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মুফতির কাছে গেলে সেখানে মুফতি ও সে ব্যাপারে একমত হয়না। অবশেষে লাইব্রেরীতে যেয়ে রেফারেন্স চেক করে দেখা যায় শিমুল ভাইয়েরটাই ঠিক ছিলো। সেই থেকে দিনে দিনে জামাত শিবিরের প্রতি বড় দুর্বলতা শুরু হয় যা এক সময় ভাইকে শপথের কর্মি হিসেবে গড়ে তুলে। এখন যদি ভাইকে তাবলিগের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয় ভাই বলে 'তাবলিগ হচ্ছে গ্রাম্য ডাক্তার যা মাঝে মাঝে ভুল প্রেসক্রিপশন দিয়ে রোগী মেরে ফেলে আর জামাত হচ্ছে এম বি বি এস ডাক্তার, যারা রোগীর রোগ অনূযায়ী প্রপার চিকিৎসা দিয়ে থাকে।' অনেকেই আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করে ভাই জামাতের সামনে আর কোন পরিবর্তন আছে কিনা! আমার ভাই সব সময় বলে আমি সব সময় বেস্ট খুজি তাই আজকে পর্যন্ত জামাতে ইসলাম আমার কাছে বেস্ট। কাল যদি তার চেয়ে ভালো কিছু অবশ্যাই বেছে নিবো। আর আমি ও তাই। আলহামদুলিল্লাহ আমরা সাত ভাই এক বোন সবসময় আদর্শিক দিক দিয়ে একমত। ভালো কিছুর অন্বষন সবসময়ই করি। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুক।
বিষয়: বিবিধ
১৯০৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমিও শৈশবে ভান্ডারী পীরের মুরীদ ছিলাম। (আল্লাহ ক্ষমা করুন) হক্ব চিনতে সুযোগ করে দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলবে এই বিচার , বাদ যাবে না চুনো পুটিও ।
কিন্তু হতভাগার মন্তব্যর জবাবটা একটু অভদ্র মনে হয়েছে, ওনি অনেক পুরানো মেধবী ব্লগার
ওনার কথা বলার ষ্টাইল এই রকমের। তাছাড়া তিনি তুই-তুকারি করেননি। আর ইসলামী আন্দোলনের ভাইয়েরা সবসময় সহনশীল ধর্যশীল এবং মন্দের মোকাবেলা ভাল দিয়েই করে । বিনীত
দ্বিতীয় পর্ব পড়েই এখানে এসেছি । ভুল বল্লে ক্ষমা করবেন। যাজাকাল্লাহ খায়ের
একবারেই শেষ করলেন। চালিয়ে যান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন