রাজাকার দেলোয়ার সিকদারের অপরাধ বর্তালো দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওপর আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির আদেশ

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ শামীম হোসাইন ০১ মার্চ, ২০১৩, ০৯:১৩:১০ রাত



শহীদুল ইসলাম : কথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেমে দ্বীন মোফাসসিরে কুরআন ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তার বিরুদ্ধে আনীত ২০টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করে ২টি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। বাকি ৬টি অভিযোগে পৃথক কোন শাস্তি দেয়া হয়নি। বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে শুরু করে ১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত দীর্ঘ ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট ধরে ১২০ পৃষ্ঠার রায়ের সারাংশ (সামারি) ৫৬ পৃষ্ঠা পড়ে শুনান ট্রাইব্যুনালের ৩ বিচারক। রায়ের মূল দন্ডাদেশের অংশ পড়ে শুনান ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, মাঝের অংশ পড়ে শুনান বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং প্রথম অংশ পড়ে শুনান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ২০টি অভিযোগের মধ্যে ৮ নং এবং ১০ নম্বর অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ৮নং অভিযোগটি ছিল এই যে ১৯৭১ সালের ৮ মে বেলা ৩টার দিকে মাওলানা সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা চিথলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে লুট করে এবং ৫টি ঘরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয়। এ সময় ইব্রাহিম ওরফে কুট্টি ও মফিজ উদ্দিন পসারীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদেরকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলের উপরে সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান সেনারা কুট্টিকে গুলী করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয় এবং মফিজকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। মৃত্যুদন্ড হওয়া অপর অভিযোগ হলো (১০ নং চার্জ) ১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দু পাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে গুলী করে হত্যা করা হয়। এই মামলার রায় প্রদানকালে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের জবানবন্দীকেই ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। ৬নং সাক্ষী মানিক পসারী এবং অপর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী মফিজ উদ্দিন আসামীর নাম দেলোয়ার সিকদার ওরফে দেলু সিকদার বলেছেন। সরকার পক্ষের অন্যান্য সাক্ষীরাও রাজাকার দেলোয়ার সিকদারের অপরাধের কথাই বলেছেন যা রেকর্ডকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণে রয়েছে। সেই রাজাকার দেলোয়ার সিকদারের অপরাধ বর্তালো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উপর এবং ফাঁসির দন্ড হলো তার। রায় ঘোষণার শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, আমরা মোফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার করছি না, দুই দুইবারের সংসদ সদস্য মাওলানা সাঈদীর বিচার করছি না বা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার করছি না, আমরা বিচার করছি ১৯৭১ সালের ৩০ বছরের এক বিবাহিত যুবকের যে কোন পরিচিত ব্যক্তি ছিল না। অতি সাধারণ একজন মানুষ ছিল। কিন্তু আরবী-উর্দু ভালো জানার কারণে পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে কথোকপথনের সূত্র ধরে তিনি কমান্ডার হয়ে যান। পিরোজপুরের নানা অপরাধমূলক ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এই রায়ের মাধ্যমে শাহবাগে দীর্ঘ ২২ দিন ধরে অবস্থানকারী আন্দোলনরতদের বিজয় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তারা নিজেরাও ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়ায় একথা জানিয়েছেন। কেউ কেউ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একথাও বলেছেন যে, শাহবাগের আন্দোলন না হলে এই রায় পাওয়া যেত না।

মাওলানা সাঈদীর মামলার রায় উপলক্ষে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনস্থ ট্রাইব্যুনাল এবং তার আশপাশের এলাকাসহ রাজধানী ঢাকা শহরে নেয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বঙ্গবাজার থেকে শুরু মৎস্য ভবন এবং পল্টন থেকে হাইকোর্ট মোড় পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ এবং সাদা পোশাকধারী আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সদস্যরা। ট্রাইব্যুনাল কমপ্লেক্সে ঢুকতেও বেশ কড়াকড়ি করা হয়। তবে শাহবাগের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও পৃষ্ঠপোষকরা বিপুল সংখ্যায় প্রবেশ করেন ট্রাইব্যুনালে যাদের পাস দেয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ছিলেন উদার। সেই সাথে বিভিন্ন সংবাদপত্র, সংবাদ মাধ্যম ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক ও দর্শনার্থী মিলিয়ে গতকাল ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে ছিল উপচে পড়া ভীড়। সকাল সাড়ে ১০টার পরিবর্তে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে এজলাসে বসেন ৩ বিচারক। শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সূচনা বক্তব্য রাখার পর রায় পড়া শুরু হয় ১১টা ২০ মিনিট থেকে। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে রায়ের ৫৬ পৃষ্ঠার সামারী পড়া শেষ হয়।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়ে ২০টি চার্জের মধ্যে ৮ ও ১০ নং চার্জে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আরো ৬টি অভিযোগ সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঐ ৬টি অভিযোগে কোন পৃথক শাস্তি দেয়া হয়নি উপরোক্ত ২টি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়ার কারণে। এই ৬টি হলো চার্জ নং ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯। ৬নং অভিযোগে ১৯৭১ সালের ৭ মে পারেরহাট বাজারে আওয়ামী লীগ, হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের বাড়ীঘর দোকান মাওলানা সাঈদীর চিনিয়ে দেয়া মতে পাকিস্তান আর্মিরা লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা মাখন সাহার দোকান থেকে ২২ সের স্বর্ণ ও রূপা লুট করে। ৭নং অভিযোগে শহীদুল ইসলাম খান সেলিমের বাড়ীতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। সেটাও সাঈদী পাক সেনাদের চিনিয়ে দেয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১১নং চার্জে টেংরাখালী গ্রামে মাহবুবুল আলম হাওলাদারের (মামলার বাদী) বাড়ীতে লুটপাট এবং তার ভাইকে নির্যাতন করা। ১৪ নং চার্জে হোগলাবুনিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ১ জনকে ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে। ১৬ নং চার্জে পারের হাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার ৩ বোনকে পাক আর্মিদের ক্যাম্পে ৩ দিন আটকে রেখে ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে। ১৯ নং চার্জে এক থেকে দেড়শজন হিন্দুকে জোরপূর্বক হিন্দু থেকে মুসলমান বানানোর কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য ২০১০ সালের ২৯ জুন ঢাকার শহীদবাগস্থ নিজবাড়ী থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে দেশবরেণ্য এই আলেমকে। দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতন করে আওয়ামী লীগ সরকার। একে একে ১৭টি মামলায় জড়ানোর পর তার বিরুদ্ধে দেয়া হয় ১৯৭১ সালের কথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলা। দীর্ঘ ১ বছরের তদন্তের পর ১১/৭/১১ তারিখে তার বিরুদ্ধে ১৯ দফা ফর্মাল চার্জ দাখিল করা হয়। সেখান থেকে তার বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করে আদেশ দেয়া হয় ৩ অক্টোবর ২০১১ তারিখে। এই ২০টি অভিযোগ প্রমাণ করতে সরকার পক্ষ তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৮ জন সাক্ষী হাজির করে। অপরদিকে আসামীপক্ষে তার ছেলে মাসুদ সাঈদীসহ ১৭ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। প্রথম দফায় গত বছরের ৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়। পরে বেলজিয়াম প্রবাসী জিয়াউদ্দিনের সাথে স্কাইপি কথোপকথনের কেলেংকারী ফাঁস হয়ে পড়লে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি ফজলে কবিরকে চেয়ারম্যান করে ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করা হয়। নতুন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পুনরায় চূড়ান্ত আর্গুমেন্ট শেষ হয় গত ২৯ জানুয়ারী। ঠিক এক মাসের মাথায় গতকাল এই রায় হলো এমন সময় যখন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে চলছে আন্দোলন। ২ বছর ৮ মাস বন্দীদশায় থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী হারিয়েছেন তার মাকে। তারপর গত বছর ১৩ জুন ট্রাইব্যুনালে বাবার মামলার মিথ্যা সাক্ষ্য দেখতে দেখতে হার্ট ফেইল করে মারা যান মাওলানা সাঈদীর বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী। এরপর তার নিজেরও হার্ট এ্যাটাক হলে তার হৃৎপিন্ডে আরো তিনটি রিং পড়ানো হয়। বিশ্ব বরেণ্য এই আলেমে দ্বীন যিনি পবিত্র কুরআনের তাফসীরসহ অর্ধশতাধিক বই লিখেছেন ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ওপর, তাকে আওয়ামী লীগ গঠিত ট্রাইব্যুনাল দিয়েছে ফাঁসির আদেশ। তার কুরআনের তাফসীর মাহফিলে লাখ লাখ লোকের সমাগম হতো। বহু অমুসলিম তার হাতে মুসলমান হয়েছে। তিনি সাধারণ মানুষকে তাফসীরের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলন তথা প্রকৃত ইসলামের পথে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

গতকালের রায় ঘোষণার সময় হরতালের কারণে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের কোন সিনিয়র আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। এডভোকেট আসাদ উদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক, সোহাগ, সাজ্জাদ, আনোয়ারসহ কয়েকজন জুনিয়র আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন তার পক্ষে। অন্যদিকে সরকার পক্ষে ছিলেন এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম, চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, অতিরিক্ত এটর্নী জেনারেল এম কে রহমান। প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীসহ অন্যান্য প্রসিকিউটর ও বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী।

রায় উপলক্ষে মাওলানা সাঈদীকে গতকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয় সকালে ১০ টার আগেই। হাজতখানায় প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থানের পর রায় ঘোষণার সামান্য পূর্বে ১১টা ৭ মিনিটে তাকে এজলাসকক্ষে উঠানো হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার রায় ঘোষণার সময়ে মাওলানা সাঈদীকে একটুও বিমর্ষ দেখা যায়নি। তিনি শান্ত ছিলেন। অধিকাংশ সময়ই কুরআন অধ্যয়ন করেন। রায় পড়া শেষ হলে তিনি আদালতকে সম্বোধন করে কথা বলা শুরু করলে উপস্থিত সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও শাহবাগীরা তাকে রাজাকার বলে চিৎকার ও ধমক দেয় এবং তীব্র হৈচৈ করে। ফলে তড়িঘড়ি করে তাকে নীচে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। হাজতখানায় তিনি জোহরের নামাজ আদায়ের পর তাকে পুনরায় কারাগারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

- See more at: http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=110503#sthash.Brt7JI0V.dpuf

বিষয়: বিবিধ

১২৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File