বিয়ের আংটি
লিখেছেন লিখেছেন মোঃজুলফিকার আলী ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪, ১২:২৩:০৮ দুপুর
সকাল বেলার হৈ চৈ শব্দ শুনে জেগে উঠলাম। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। সারাক্ষণ জমজমাট অনেক লোকের সমাগম। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। এটা বর-কণের মহা মিলনের শুভয়ারন্ন নয়কি? সেটা রাতের বেলায় লোকের আনাগোনা সরগরম দেখে ঢের টের পাওয়া গেছে। এবার এক টুকরো ঘুমতে পারলে অন্তত বাঁচা যায়। ’যাক বাবা বিয়ের আংটি‘ কথাটা কানে শুনলেও ঘুমের ঘোরে তখন অনুমেয় হয়নি। তবে শুনেছি হাতে বিয়ের আংটিটা ছিল-।গোল্লায় যাক ওসব। অর্ধেক রাত জাগিয়ে থেকে এখন অবশ্য চোখের পাতা উল্টাতে পারিনে । তাই ওসব নিয়ে কান খাড়া করতে চাইনা। একটু ভাল করে গুমিয়ে নিয়েই তবে উঠবো। শত ডাকলেও আমি আর জাগবো না। এমন পণ করে আবার লেপমুড়া দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
হাসান সেদিন বলেছিল ‘তুই বিয়ের রাতে এতটুকু ঘুমুতে পারবে না। বেশী ঘুমলে জাগতেই হবে দেখ। না জাগিয়ে ছাড়বে না তোমার কুটুম্ব।
আমি অবশ্য তাকে বলেছিলাম, দেখিস আমি সেদিন ঘুমুবোই। কেউ আমার ঘুমকে রহিত করতে পারবে না। সানজিদা আমার স্ত্রী। গেল রাতে যার সাথে বিয়ে। খুব তড়িঘড়ি করে হয়ে গেল। কেননা আমার তেমন ছুটি নিয়ে আসা হয়নি। তাছাড়া এসে যে বিয়ে করব তাও পরিকল্পনা মাথায় ছিল না। এসেই ঘটক ফাঁদে আটকে গেলাম। অবশ্য বিয়ের কাবিনে স্বাক্ষর করার সময় নামটি জেনে নিয়েছি। ভালই বলা যায়। এতপর রাত এলো। বাসর ঘরে সে এবং আমি। তার হাতের ছোঁয়ায় ব্যাকুল হলো প্রাণ। মায়ের দেয়া আংটিটি পরিয়ে দিলাম। ও আমাকে বলল- তুমি আমি কেমন আজ একত্রে। কি বিস্ময় তাইনা। তোমাকে নিয়ে অনেক গভীরে তলিয়ে যেতে চাই। যাবে তুমি! আমি তখন রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিরুদ্দেশ যাত্রার এক ছত্র ছেড়ে দিলাম- আর কত দূরে নিয়ে যাবে হে সুন্দরী, কোন পাড়ে ভিড়বে তোমার সোনার তরী, আমি যতই সুধাই ওগো সুহাসিনী, তুমি হাসো শুধু মধুর হাসিনী। ও আমাকে বলল- সুহাসিনী নয় বিদেশিনী বলেছিল। তুমি তো আমার সুহাসিনী। তাই বলেছি। আমাকে ও আদর করে আলতো একটি চুমু বসিয়ে দিল। কাঁত হয়ে আমাকে শুইয়ে দিল নিজেও শুয়েছিল পাশে। তারপর কত কথা। কত ইতিহাস। দূরে পেঁচা ডাকার শব্দ হলো। গাছেরা নিশঝুম নৈঃশব্দের তাড়না থেকে কেমন যেন নড়েচড়ে উঠল। বনের বন্যেরাও তাই। বাগানের আলো আঁধারি ছায়ায় কুয়াশায় বিভোর হলো রাত্রি। তারপর আসি আসি করে একটু একটু ঘুম এলো।
কতদিন ঢাকা শহরে থেকেছি। কখনও বিয়ে করবো এ চিন্তা মাথায় ছিল না। সরাক্ষণ কাজে মশগুল থাকতাম। অনেক দিন পর বাড়ি এলাম। মা বিয়ে করার জন্য সেকি তদবির কান্নাকাটি। শেষান্তর মত না দিয়ে পারলাম না। একেই বলে মা। ছেলের মানসিকতা বুঝতে দেরী হয় না।
তবে ঘটক রমিজকে বলেছিলাম- মেয়ে নামাজ পড়ে কিনা? সে যা বলল তাতে আক্কেল গুরুম। একেবারে চিরাচরিত ব্যাখ্যা। দেখ সুজন একবার এক ঘটক ছেলে মেয়ের বিয়ে ঠিকঠাক করে ফেলল। ঘটক মেয়ের বাড়ি আসলো। মেয়ের বাবা বলল- সবই তো বুঝলাম। ছেলে এ বিয়েতে রাজি হবে তো। ঘটক তখন তড়িঘড়ি করে কি বলবে... তখন কৌশল করে বলল- বলেন কি বিয়াই- ছেলেতো এক পায়ে খাঁড়া। আসলে মেয়ের বাবা জানতো না যে ছেলে খোড়া। মেয়ের বাবাতো শুনে খুব খুশি বোবা মেয়েরে জন্য এত সুন্দর প্রস্তাব। এরপরে ছেলের বাবার কাছে গেলে ছেলের বাবা মেয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলল- মেয়েতো দেখেছেন বেয়াই... মাশআল্লাহ যেমন রূপ সুন্দর.. মেয়ে যেন তো একখান... কোন কথাই নাই...দেখতে শুনতে ভাল। ছেলের বাবাতো খোড়া ছেলের সাথে এত সুন্দর মেয়ে পাবে, আনন্দ আর ধরে না। পরে বিয়ে হয়ে গেল। দেখা গেল ছেলে ছিল খোড়া আর মেয়ে ছিল বোবা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল রমিজ ঘটক, দেখ সুজন এমন সব অবান্তর প্রশ্ন করে যখন কিছু একটা না বললেই নয়। ধর্ম কর্ম যার যার ব্যাপার। এ নিয়ে গভীরে প্রবেশের কোন পথ কারো জানা নেই। তাই আমরা অনেক সময় মেয়ে নামাজ পড়ে কিনা বললে বলি মেয়ের ঘরে জায়নামাজ বিছানো আছে। আর যদি ছেলের কথা জিজ্ঞেস করে তখন বলে ফেলি বাড়ির দরজায় মসজিদ আছে। এখন অবশ্য এসব নিয়ে তেমন একটা বাত বিচার হয় না বা তেমন কথা হয় না। এগুলো এখন একদম সেকেলে। আল্লাহ যখন যা করেন ভালর জন্যই করেন.. তা মেনে নেয়াই উত্তম। আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না।
বাড়ির অবস্থা দেখে কেমন যেন নতুন নতুন লাগে। মা আগে ভাগেই বাবার দেয়া আংটিটি কদিন হলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে এনেছে স্বণর্কারের দোকান থেকে। দশ আনা তিন রত্তি। মায়ের অনুভূতি এতদিনেও বুঝতে পারিনি। আজ তার আনন্দ দেখে পৃথিবী আলোকিত । মায়ের আনন্দ দেখে আমার মনেও পুলক লেগেছে। জীবনের ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায় যখন আনন্দ ভর করে তখন সাথর্কতার মোড়ক খুলে দেয়। মায়ের আনন্দে বাড়িটি একেবারে রঙিন বনে যায়। কোথাও কোন খুত আছে কিনা এখন সে নিজেই ধরতে পারে। খুঁজতে থাকে আরেক চঞ্চলতার পরশমণি। তাই সবাইকে নিয়ে এক হৈ হোল্লড়ের মাতম চলে যেন। এখন যেন তার হাতে কোন সময নেই ভাব। তাই করিমন চাচী একটু রঙ্গ করে বলল- ভাবীজান দেহি কোন জিরাইন্না সময় পাও না। এত কাম করলে তো মস্কিলে পড়বা।
মা তখন করিমন চাচীরে কইল- যহন সুজনের বউ আইব্য, তহন তো বইয়্যা কাটাইতে অইব্যে দেখবা।
বিয়ের দিন দশ পনের জনের ছোট এক জোট নিয়ে বিয়ে বাড়িতে এসেছি। বিয়ে বাড়িতেই গায়ে হলুদ দিতে হলো। মা অনেক আগে থেকেই সানজিদাকে পছন্দ করে রেখেছে। ওর নাম যে সানজিজা আমার জানা ছিল না। বাড়ির পাশেই বাড়ি। বেশী দূরের পার্টি নয়। মাঝে মধ্যে এ বাড়িতেও আসতো সানজিদা। তখন মা তাকে একটু বেশিই খাতির করতো, পরে অবশ্য জেনেছি। গায়ে হলুদের গ্রাম্য গানে মুখরিত করে মহিলার দল গায়ে হলুদের আসর বসিয়েছে। সেখানে অনেক লোকের উপস্থিতি। জীবনের প্রথম অনুভূতি। সানজিদাকেও হলুদ বরণে সাজিয়ে ছিল গ্রাম্য মহিলারা। তারপর বিয়ে হয়ে গেল। সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে রাতেই চলে গেল মেহমানের দল।
সেদিন এতটাই ঘুমিয়েছিলাম। আমার শ্বাশুরি আম্মা আমাকে অনেক টানা হেচড়া করছে। আমি ঘুমের ঘোরে অচেতন। শেষাবদি শ্বাশুড়ী আম্মা আমাকে টেনে হেচঁড়ে তুলল। এক পর্যায় শঙ্কা ফিরে এলো।তখন আমার কিছুটা হুশ বোধ করলাম। দেখলাম শ্বাশুড়ীর হাতে একটা চিরকুট। আমার দিকে চেয়ে সজোরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিল। কাগজটি ধরিয়ে দিল। আমি হতভম্বের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। তার কানাকড়িও বুঝলাম না। কাগজটি হাতে পেয়ে খুলে পড়তে লাগলাম।
প্রিয়তম স্বামী,
তুমি যখন পত্রখানা পড়বে... তখন আমি অনেক দূরে। নক্ষত্ররা যেখানে বাসা বাঁধে তার চেয়েও ঢের দূর সীমানায়। নিয়তির পরিহাস তোমাকে আমাকে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এর জন্য আমি কাউকে দায়ী করছি না। না তুমি না আমি। এমনকি আমার বাবা মা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব কেউই দায়ী নয়। আমার প্রজ্ঞা আমাকে প্রতিনিয়ত স্বাধীনচেতা হিসাবে দেখতে চায়। আমার বিবেক আমার মেধা এ পৃথিবীর কোন কিছুকে স্পর্শ বা আকর্ষণ করেনি বা করতে পারেনি। আমি আমার স্বত্তার সাথে সংগ্রাম করেই চলেছিলাম। আমি যা চেয়েছি তারচেয়েও ঢের বেশী পেয়েছি। ঐশ্বর্যের বিভোরে নিত্যদিন আবর্তিত হয়েছি। স্নেহ মমতা ভালবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু আমার ভেতর এক বিপন্ন বিস্ময় মোচড় দেয়..কেন যেন আনমনা কাটে দিন। দুঃখ কষ্ট আমাকে কখনও স্পর্শ করেনি কখন। যেম্নি আজ তোমার কাছে এতটা পেয়েছি। হৃদয় আলিঙ্গণে বেঁধেছি স্বপ্নের বাসর। তবেই ধন্য হয়েছি আমি, ধন্যবাদ জানাই পৃথিবীর মালিক যিনি। যিনি আমাকে তার সত্বাকে অপূর্ণ রাখেননি। তবু কেন যেন অসীমের আকাংখা। আমার জিঘাংসা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে আমাকে কুয়াশা চাদরে আবৃত রাখে দিনমান। আমি তার পশ্চাতে ছুটি। তুমি এসেছো একান্ত অতিথি আপ্যায়নে। তোমাকে ছোট করার খেয়াল আমার নেই। তুমি মহান। আমার কৃতকার্যের চালিকা শক্তি। তা না হলে আমার জীবন অতৃপ্ততায় নিমজ্জিত হতো। তোমার অপার স্নেহের পরশে আমি আমার সজ্ঞানকে চালিত করেছি। আজ আর কারো প্রতি আমার ক্ষোভ নেই...মোহ নেই... দুঃখ নেই। সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে উঠে এসেছি। হে প্রিয়তম স্বামী, যাবার বেলায় এতটুকু তোমাকে বলতে চাই। তোমার হাতের ষ্পর্শে তোমার দেয়া বিয়ের আংটিটি খুলে নিও, খুলে নিও গয়নাগুলোও। তোমার হাতের সংস্পর্শ পেলে আমি অমীয় সূধার তৃষায় তৃপ্ত হবো। তুমিও প্রতিনিয়ত আমায় মনের গহীনে স্মৃতিটুকু লালন করে রাখবে। আমার সমাধীর কোণে অশত্থ বৃক্ষের ডাল পুতে দিও। তবেই আমি গাছের ছায়ায় তোমার হাতের সংষ্পর্শটুকু পাব। ভাল থেকো খুব ভাল থেকো...সালাম পৃথিবী তোমাকে সালাম, তোমাদের সবাইকে সালাম। ইতি তোমার নববধু।
আমি উদ্বেলিত হয়ে দৌড়ে বারান্দায় ছুটে গেলাম। তেমনি চোখ তার, ঠোঁট তার। হাতে মেহেদীর রং লেগে আছে। তেমনি আলতা রাঙা পা। যে হাতে ছুঁয়েছিল, অনুভব করেছিলাম অমীয় প্রশান্তি। আমার চিৎকার দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু বাকরুদ্ধ এক বিসর্জনের ক্রিয়া অনুভব করলাম। কেমন সেই নিথর দেহ পড়ে আছে টেবিলের পরে। আমার চোখের জলে ভাসালাম বুকের পিঞ্জর। সেদিকে খেয়াল দেয়ার অবকাশ নেই... চেয়ে দেখি শুধু ব্যথার সাগরের নীলমণি শুয়ে আছে বালুকাবেলায় । বাড়িতে কেবল কান্নার রোল। যেন চারিদিক আর্তনাতের ধ্বনিত শব্দ বিদগ্ধ হৃদয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে স্বাপ্নিক প্রহর।
আমি তার হাত ছুয়েছিলাম। আমার হৃদয় তন্ত্রীটা মোচড় দিয়ে চিৎকার করে উঠল। একি করলে প্রিয়তমা? আমি তো চাইনে... আমি তো চাইনে। তার হাত ধরে চুপিচুপি বললাম... কেন? কেন? এমন হলো। যেন আমার বুকের পাঁজর শেকল বাঁধার নোঙ্গরের কাঁটা বিদল। আমি তার হাত ধরে বসে রইলাম।
পুলিশ এলো। আমাকে হাতকড়া পরালো। তখনও কোন বোধ শক্তি কাজ করছে না। সমস্ত শরীর অসাড়। আমিও যেন এক মৃতের যাত্রায় সোয়ারী। পুলিশ ভ্যানে দু'জনকে তুলল। আমি শুধু নিষ্পলক তাকিযে রইলাম। আর বারবার মনে মধ্যে উত্থিত হতে থাকল জীবনান্দ দাশের সেই কবিতার চরণদ্বয়-শোনা গেল লাশকাটা ঘরে, নিয়ে গেছে তারে; কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে, যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হ’লো তার সাধ।
বিষয়: বিয়ের গল্প
২৪৩৬ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তার মতো একজন সুন্দর লেখিকা যখন বললো তখন সত্যি আমিও না পড়ে পাড়লাম না। শেষে দেখলাম সত্যিই অদ্ভুদ সমাপ্তি!!!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন