পরবাসী (সময়ের বাস্তব সাক্ষী এই গল্প)

লিখেছেন লিখেছেন হাসান কবীর ২৭ এপ্রিল, ২০১৪, ০৯:০২:৫২ সকাল

নান্দাইল চৌরাস্তা থেকে লোকাল বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। বাস ভর্তি যাত্রী। একেবারে আলুর বস্তার মত অবস্থা। একেতো চৈত্রে খরতাপের কারণে মানুষের গায়ের দুর্গন্ধ, তার উপর আবার বিড়ির বিদঘুটে গন্ধ। দুইয়ে মিলে করিমের দম বন্ধ হবার উপক্রম প্রায়। কিছু করার নেই, ‘যত গুড়, তত মিষ্টি’ ডাকের কথাটি মনে করে নিজেকে প্রবোধ দেয় সে।

কোথাও স্ট্যান্ডে, কোথাও বা ধান ক্ষেতের আইলের পাশে দাড় করিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করাতে করাতে বাসটি এক সময় ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে এসে থামে। অনেক যাত্রী নেমে পড়ে এখানে। এত ক্ষণে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে বলে বাসের মাঝামাঝি একটি সিট খালি পেয়ে চেঁপে বসেছে। মা সব সময় তাকে বলে দেয়- ‘বাসে উটলে প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে থাকবি। তবুও বাসের সামনের দিকে বা পিছনের দিকে বসবি না।’ বাসে উঠলেই তার মায়ের সেই কথাটি মনে পড়ে। সেই সাথে ভাবনার মায়াজালও তাকে পেয়ে বসে। হারিয়ে যায় ভাবনার সাগরে।

যত দূর মনে পড়ে, মা তাকে শিখিয়েছিল- ‘কখনো মিথ্যে বলবে না। মিথ্যের কাছে মাথা নত করবে না।’ মায়ের সেই প্রথম সবক সে আজো পালন করে চলেছে। ফলে বার বার বিপদে পড়েও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে।

মনে পড়ে স্কুলের প্রথম দিনের কথা। পাড়ার ছেলেদের সাথে সখের বশত স্কুলে গিয়েছিল। কারণ তাকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু স্কুলে গেছে শুনে সবাই খুব খুশি হলেও মূহুর্তেই তাদের সকল খুশি ম্লান হয়ে যায়। কারণ সে আর স্কুলে যাবে না। স্কুলের স্যার ছাত্র ভর্তির ফরম পূরণ করার সময় তার জন্ম তারিখ জিজ্ঞেস করেছিল। সে বলেছিল জানি না। উত্তরে স্যার তার একটি জন্ম তারিখ নির্ধারণ করে খাতায় লিখেছিল। বিষয়টি তার কাছে মিথ্যে দিয়ে জীবন শুরু করার মত মনে হল। সে মিথ্যে দিয়ে শিক্ষার মত একটি মহৎ কর্ম শুরু করতে চায় না। আর যাওয়া হয়নি স্কুলে।

ভর্তি হল গিয়ে কওমী মাদ্রাসায়। সেখানে তখন জন্ম দিনের ঝামেলা তাকে পোহাতে হয়নি। শুধু আনুমানিক বয়স লিখতে হয়েছিল। অজোপাড়া গাঁয়ের মাদ্রাসায় পাঞ্জম অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে এসে ভর্তি হল দেশের উল্লেখযোগ্য দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিশোরগঞ্জ সদরের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসায়। সেখান থেকে শরহে জামী অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে এসে ভৈরবের ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম এ ভর্তি হলো। সেখান উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে আশুগঞ্জের সোনারামপুর থেকে ফজিলত অর্থাৎ স্নাতক শেষ করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে তাকমীল অর্থাৎ মাস্টার্স শেষ করে।

ভাল ছাত্র হওয়ায় তাকমীল পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই এক মাদ্রাসায় চাকরি ঠিক হয়ে যায়। কারণ কওমী মাদ্রাসাগুলো চাকরির ক্ষেত্রে কোনো অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের সুযোগ নেই। এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে চারিত্রিক যোগ্যতাও বিচার করা হয়। এই দুই যোগ্যতায় যারা শ্রেষ্ঠ তারাই চাকরি পায়। অমুক তমুকের হুমকি-ধমকি, সুপারিশ বা টেবিলের নিচের কার্য দ্বারা এখানে চাকরি হয় না।

ভালই চলছিল চাকরি জীবন। সেই সুবহের সাদিকের পূর্বে উঠে ওজু এস্তেঞ্জা সেরে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে জামাতে ফজরের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে দিন লিপি শুরু হত। ফজরের পর থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত কিতাব মুতালার পর গোছল খাওয়া শেষ করে দশটায় দরসে উপস্থিত হয়ে তালীম দিত দুপুর পর্যন্ত। জোহর নামাজ পড়ে খাবার পর্ব শেষে আবার দরস চলত এক নাগাড়ে আসর পর্যন্ত। আসরের পর একটু বাহিরে বেড়ানোর পর মাদ্রাসায় এসে কিতাব মুতালায় বসে পড়ত। বড় মাদ্রাসা হলে মাগরিবের পরও ক্লাস করতে হত। কিন্তু ছোট মাদ্রাসা হওয়ায় সেই কষ্ট তাকে করতে হয়না। ফযীলত ও তাকমীল ক্লাশে বড় বড় কিতাব হওয়ায় সিলেবাস শেষ করার জন্য কোনো কোনো দিন ফজরের পর থেকে শুরু করে রাত বারোটা পর্যন্তও ক্লাস চলে। এখানে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ক্লাস আছে। তাই সকাল দশটা থেকে আসর পর্যন্তই ক্লাশ চলে। এশার নামাজ শেষে খাবারের পালা শেষে কিতাব পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়াই ছিল কওমী মাদ্রাসায় তার ছাত্র এবং শিক্ষক জীবনের দিনলিপি।

হাঠাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে প্রহসনের বিচার শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে। সরকারি মদদে একদল উদ্ভ্রান্ত যুবক যুবতী রাস্তায় নেমে আসে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন! করা কি রাষ্ট্রদোহীতা নয়? তাদের কাঁধে ভর করে একদল ইহুদীদের পা চাটা গোলাম বিভিন্ন ব্লগে ইসলাম বিদ্বেষী লেখা পোস্ট করতে থাকে। যা বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রাণে আঘাত হানে। ফলশ্রুতিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফী’র নেতৃত্বে ইসলাম বিদ্বেষীদের বিচারের দাবীতে ছয় এপ্রিল দুই হাজার তের ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ডাক আসে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরা যেন লংমার্চে শরীক হতে না পারে সেজন্য সরকারী অলিখিত নির্দেশে পরিবহন মালিকগণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় সারা দেশে। “বিপ্লব কি আর যায়গো রুখা

কামান-গোলা, বুলেট-বানে?” চিরা-মুড়ির পুটলি নিয়ে পায়ে হেঁটে সারা দেশ থেকে মুসল্লীদের ঢাকা অভিমুখে গণ যাত্রা পৃথিবী সেদিন প্রথম অবলোকন করেছিল। এমনই একটি কাফেলার সঙ্গী ছিল করিম।

ঢাকার মতিঝিলে বিশাল জনসভার জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারকে দোষী ব্লগারদের বিচারের অনুরোধ জানিয়ে মাস ব্যাপী বিশাল কর্মসূচী ঘোষণা করেন। প্রধান কর্মসূচী হলো দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে শানে রেসালত সম্মেলন। এক মাসের মধ্যে দোষীদের বিচারের আওতায় না আনা হলে পাঁচ মে ঢাকা অবরোধ। তাদের এ আন্দোলন শুধু মাত্র তাদের প্রিয় নবী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে কটাক্য কারীদের বিচারের দাবীতে। অন্য কোন রাজনৈতিক অভিপ্রায় তাদের ছিল না। অথচ যারা নিজেদেরকে রাসুল প্রেমিক বলে মুখে ফেনা তুলে তারা এই অপরাধীদের চক্রের ব্যাপারে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। আর যাদেরকে তারা রাসুলের দুশমন বলে অভিহিত করে তারাই সেই রাসুলকে গালিদাতা কুলাঙ্গারদের বিচারের দাবীতে আন্দোলন গিয়ে শহীদ হতে প্রস্তুত! কেমন রাসুল প্রেমিক তারা!

নাস্তিকদের মদদদাতা সরকার বিচারতো করেইনি, উপরন্তু ইসলাম দরদী সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’ কে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। মহানারী সমাবেশের নামে পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত মায়ের জাতিকে বিভিন্নভাবে উস্কানী দিয়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করেছে। মহাকাল রানা প্লাজাকে গ্রাস করার মধ্য দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাড়াচাড়া তথ্য নিয়ে দেশ বিদেশে মহা হৈ চৈ হয়েছে। তবুও শিখেনি সরকার।

পাঁচ মে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে কুরআন পুড়িয়ে দোষ দেওয়া হয়েছে হেফাজতের কর্মীদের উপর। কি আশ্চর্য যারা কুরআন রক্ষা করতে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত তারা নাকি কুরআন পুড়িয়েছে! শয়তানওতো এ কথা বিশ্বাস করবে না। কারণ সে জানে আদমকে সেজদা না করা ছিল তার প্রথম ভুল। আর যদি বিশ্বাস করে হেফাজত কর্মীরা কুরআন পুড়িয়েছে তাহলে এটা হবে তার দ্বিতীয় ভুল। অথচ বদরক্তবাহী সরকার বুঝল না।

সবশেষে ছয় মে ঢাকার শাপলা চত্বরে ঘুমন্ত আলেম সমাজকে হত্যার মধ্য দিয়ে সরকার তার পৈশাচিক রূপের ষোল কলার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী করিম। করিম সেদিন শাপলা চত্বরে অবস্থান করলেও মহান অধিপতি তাকে গ্রহণ করেনি। ফিরিয়ে দিয়েছে আগামী দিনের জন্য। ছয় মে’র এদেশের আলেম সমাজের মহাবিপর্যয়ের পর করিম ঘরানার কওমী মাদ্রাসাগুলো সংকটে পড়ে। অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কখন জানি সরকারী বাহিনীর বুলেট তার কলিজার টুকরা সন্তানের প্রাণ কেড়ে নেয়।

শত বিপর্যদের মধ্য দিয়েই ইসলাম আজো ধরার বুকে টিকে আছে। গ্রান্ডট্যাঙ্ক রোডের প্রতিটি গাছের শাখে ব্রিটিশ কর্তৃক ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত আলেমদের লাশের ইতিহাস করিমের জানা। তারা ধৈর্য হারা হয় না। আল্লাহ বলেছেন- ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।’

বার্ষিক পরীক্ষা শেষে রোজার ছুটির পর আবার কওমী মাদ্রাসাগুলোয় কুরআনের শব্দ বুলন্দ হতে থাকে। করিমের মাদ্রাসাও তার ব্যতিক্রম নয়। সব কিছুই নিয়মতান্ত্রিক চলছিল। হঠাৎ একদিন জেনারেটরের তেল পড়ে মাদ্রাসায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা না সাজানো নাটক বুঝার আগেই সরকারী বাহিনী এসে মাদ্রাসায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। মিডিয়ার সামনে তুলে ধরা হয় কতগুলো তরতাজা গ্রেনেড। এগুলো নাকি মাদ্রাসার আগুনে পুড়া কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। করিমের কিছুতেই বুঝে আসে না আগুনে গ্রেনেড তরতাজা থাকে কি করে? সবগুলো মিডিয়া খুব জোরে সোরে গ্রেনেড পাওয়ার ঘটনাটি প্রচার করলেও আগুনে কি করে গ্রেনেড তাজা থাকে সে প্রশ্নটি একটি বারের জন্যও তুলেনি। প্রশ্ন তোলা হয় না গ্রেনেড পেলেই কেন মাদ্রাসা বন্ধ করা হবে। ভার্সিটিগুলোতে প্রতিদিন অস্ত্রের মহড়া চলে, বোমা ফাঁটে, খুন হয়, ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এত অপকর্মের পরও যদি ভার্সিটি বন্ধ না হয় তবে কেন সামান্য অজুহাতে মাদ্রাসা বন্ধ হবে? প্রকৃতপক্ষেই যদি বোমা ফেটে থাকে তাহলে দোষীদেরকে বিচারের আওতায় আনার পরিবর্তে মাদ্রাসা বন্ধের পাঁয়তারা কেন? তবে কি সরকার এদেশ থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করতে চায়?

অন্যান্য শিক্ষকদের মত করিমকেও বাড়ি ফিরতে হয়। কদিন আর বাড়ি বসে থাকা যায়? সে যেখানে চাকরি করে সেখানেতো ছলে বলে কৌশলে লোকের পকেট খালি করার মত সুযোগ নেই। সেখানে যারা চাকরি করে তাদের অধিকাংশেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তাই করিম সিদ্ধান্ত নেয় কিছু একটা করবে।

খবরের কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন তার এই ঢাকা যাত্রা। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে অফিস করণিকের চাকরি। তারা সরাসরি সাক্ষাতকার চেয়েছে। করিম ভেতরে যেতেই পরীক্ষকদের একজন জিজ্ঞেস করল ঃ আপনার লেখাপড়া কতটুকু?

ঃ মাস্টার্স

ঃ দেখি আপনার সার্টিফিকেট?

করিম তার সনদের ফাইলটি এগিয়ে দেয়। দেখে তারা হাসবে না কাঁদবে তা বোধ হয় ভেবে পাচ্ছিলেন না। খুব অবাক হয়ে একজন প্রশ্ন করলেন ঃ এগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট?

ঃ কওমী মাদ্রাসার

ঃ কওমী মাদ্রাসা কি সরকার স্বীকৃত?

ঃ সরকার স্বীকৃত নয় বলে কি এটা শিক্ষা নয়? করিমের পাল্টা প্রশ্ন।

ঃ কিন্তু এই সার্টিফিকেট দিয়েতো চাকরি হয় না?

ঃ যদি ইংলিশ মিডিয়ামের সার্টিফিকেট দিয়ে বাংলাদেশে চাকরি হয়, তাহলে আরবি মাধ্যমের সার্টিফিকেট দিয়ে কেন হবে না?

আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই। প্রশ্ন কর্তার এমন উত্তরে করিম বুঝতে তার চাকরি হবার নয়। তাই সে কাল ক্ষেপন না করে বেবিয়ে পড়ে অফিস থেকে। হাঁটতে থাকে ফুটপাত ধরে। আর ভাবতে থাকে- যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে মা-বাবাকে খুন করতে পারে সে লেখাপড়াকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। আর যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানুষ মানুষ হয় সে শিক্ষাকে পরিকল্পিতভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা করিমের মত লোকেরা আজ নিজ দেশে পরবাসী।

বিষয়: বিবিধ

১৬২২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

213831
২৭ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:৪৭
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File