ইকামতে দ্বীন ও তৌহিদ প্রতিষ্ঠা
লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ২২ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:৫৩:৩০ দুপুর
ইসলামী চিন্তাধারা, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং কম্যুনিস্ট এই তিন চিন্তাধারার ব্যক্তির মধ্যে শেষোক্ত চিন্তাধারার ব্যক্তিদের মধ্যে একটি মিল হচ্ছে, তারা এক অপরের বিরুদ্ধে কথা বলছে না বা অপবাদ দিচ্ছে না, তাদের উভয়ের কমন টার্গেট হলো ইসলামী চিন্তাধারার ব্যক্তি । অন্যদিকে ইসলামী চিন্তাধারার ব্যক্তিরা একে অন্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন এবং অপরকে বিপথগামী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, অথচ তারাই মসজিদে অবস্থান করেন বেশি । ইসলাম যেখানে মুসলিমদের ঐক্য দাবী করে, সেখানে সমাজে পরিচিত এই ইসলামী চিন্তাবিদরা তাদের কথার মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে অনৈক্যের জাল বিস্তার করে যাচ্ছেন । সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, উপমহাদেশের আলেম শ্রেণিরা খুব সহজেই একটু ভিন্ন চিন্তাধারার আলেমকে কাফের ঘোষণা করছেন, অথচ কোন মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা কম্যুনিস্ট এর ব্যাপারে তারা নীরব, তারা কখনও বলেন না, ঐ দলগুলোকে মুসলিমদের ভোট দেয়া জায়েজ কিনা ?
বর্তমান সময়ে ইসলাম এক কঠিন পথ অতিক্রম করছে । পশ্চিমা শক্তি তাদের মিডিয়াসহ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ধরনের উপাদানগুলোকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে । তাদের লক্ষ্য হলো মুসলিমদের পারিবারিক জীবনে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে মুসলিমদের পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা । অন্যদিকে সমাজে পরিচিত ইসলামী ব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন খুটিনাটি মাসালা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ইসলামী শক্তিকে এমন একটি দূর্বলস্তরে নিয়ে যাচ্ছেন, যেখান হতে পাশ্চাত্য শক্তির মোকাবেলা করা-ত দূরের কথা, তারা নিজেরা যে কাফের নয়, তারা যে সঠিক পথে আছেন, এই উত্তর দিতে ব্যস্ত থাকেন । সমাজে এত বেশি ইসলামী ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে যে, এর মধ্যে কে যে প্রকৃত ইসলামী চিন্তাধারার অনুসারী, কার ভিতর আল্লাহর ভয় আছে, তা সাধারণ জনগণের খুঁজে বের করা কঠিন কাজ হয়ে গিয়েছে, কারণ এখানে সমস্ত ইসলামী ব্যক্তিত্ব লম্বা সফেদ দাড়ির অধিকারী । আর সাধারণ জনগোষ্ঠি আলেমরা বিভক্ত, আমরা যাব কোথায়, এ ধরনের সস্তা দোহাই দিয়ে পহেলা বৈশাখ, জন্মদিন, বিবাহদিন, ভালবাসা দিবস, পূজা অনুষ্ঠানসহ সব অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে দুনিয়ার জীবনের সমস্ত ভোগ-বিলাস আয়ত্ত করার প্রতিযোগীতায় নেমেছে । সমাজের এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আরও একটি শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা ইসলামকেও ভালবাসে, আবার পশ্চিমা নষ্ট সংস্কৃতিকেও ভালবাসে। তাই এরা পহেলা বৈশাখ, জন্মদিন, বিবাহদিন, ভালবাসা দিবস, পূজা ইত্যাদিকে একটি ইসলামিক লেবেল দেয়ার চেষ্টা করছেন । এরা সবকিছুকেই জায়েজ করার জন্য বসে আছেন ।
তাবলীগ জামায়াত, উপমহাদেশের মুসলিমদের খুবই পুরাতন একটি সংগঠন । সংগঠনটি মাটির নীচের এবং আকাশের উপরের ঘটনাবলী নিয়েই ব্যস্ত । কিন্তু মাটির উপরে কী হবে, তা নিয়ে সংগঠনটি একেবারেই নিশ্চুপ । ফলে মাটির উপরের মুসলিমরা নিশ্চিন্ত মনে সুদ খাচ্ছে, ঘুষ খাচ্ছে, আর ভরসা পাচ্ছে তাসবীহ টিপার মাধ্যমে যে পরিমাণ ছওয়াব হচ্ছে. তাতে জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যাবে । তবে সংগঠনটির একটি ভাল দিক হলো, অনেক মুসলিমকে যারা কোনদিন নামাজ পড়ত না, তাদেরকে মসজিদে নামাজে আনতে পেরেছে, কিন্তু ঐ মুসলিমকে এ কথা বলতে পারেনি যে, সুদ ভক্ষণ করলে জাহান্নাম নিশ্চিত । অভিযোগ আছে সংগঠনটি দূর্বল এবং জাল হাদীসের উপর আমল করে বেশি এবং মুসলিমদেরকে রাষ্ট্র পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখার বিষয়ে নিশ্চুপ থাকে এবং তাদের সংস্পর্ষে যারা থাকে, তারা ইকামতে দ্বীন অর্থাৎ রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীরব থাকেন অথবা বিরোধীতা করে থাকেন ।
তাবলীগ জামায়াত এর আলোচনা অনেকটা কিচ্ছা-কাহিনীর উপর নির্ভরশীল হওয়ায় এটি কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি, এটির কাজ চলছে একটি নির্দিষ্ট গন্ডির ভিতর। বর্তমান সময়ে আহলে হাদীস, যারা নিজেদেরকে সালাফী পরিচয় দিতে ভালবাসেন তারা সহীহ হাদীস অনুসরণ করায় কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন । তারা যে বক্তব্যগুলো রাখেন এবং যে হাদীসগুলোর রেফারেন্স দেন, তা তরুণরা বুখারী বা মুসলিম শরীফে পেয়ে যান । ফলে সালাফীরা তরুণ প্রজন্মের যারা ইসলামকে ভালবাসে, খুব সহজেই তাদের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে যাচ্ছেন । এই তরুণরা তাবলীগ জামায়াতকে পছন্দ করে না, অথচ সালাফীদের পছন্দ করে এবং নিজকে সালাফী পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে, যেখানে তাদের প্রকৃত ও আদি পরিচয় হচ্ছে মুসলিম । হয়ত একসময় দেখা যাবে, মুসলিম পরিচয় আর নেই, পরিচয় হয়ে গিয়েছে সালাফী । তখন হয়ত মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ) হারিয়ে যাবেন, নতুন করে বের করা হবে সালাফী জাতির পিতা ! হয়ত এমনও হতে পারে, একসময় বই বা জার্নালে লেখা হবে জনগোষ্ঠির মধ্যে মুসলিম ৬৫%, সালাফী ২৫%, শিয়া ১%, হিন্দু ৯% । সালাফীরা তাবলীগ জামায়াতকে পছন্দ করে না, অথচ তাবলীগ জামায়াত এবং বাংলাদেশের সালাফীদের একটি অপূর্ব মিল আছে, তা হলো রাষ্ট্র ক্ষমতা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা নাস্তিকদের জন্য, মুসলিমরা রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য চেষ্টা করবে না, তারা শুধু ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম পালন করবে । আর তাদের পার্থক্য হলো সালাফীরা আমল করে সহীহ হাদীসের মাধ্যমে এবং তাবলীগদের আমল হলো দূর্বল ও জাল হাদীসের দ্বারা ।
তাবলীগদের মতও বালাদেশের সালাফীরাও ইকামতে দ্বীন এর বিপক্ষে । তাদের বক্তব্য হলো ইকামতে দ্বীন নয়, তৌহিদ প্রতিষ্ঠা করা । তৌহিদ প্রতিষ্ঠা এবং ইকামতে দ্বীনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা আমার জানা নাই । ইকামতে দ্বীন হলেই তখন ১০০% তৌহিদ প্রতিষ্ঠা হবে । তৌহিদ বা আল্লাহর একত্ব শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠিত করলেই কী ১০০% তৌহিদ প্রতিষ্ঠিত হবে ? রাষ্ট্রে যদি তৌহিদ বা আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে কী ব্যক্তি জীবনে তৌহিদের প্রতিষ্ঠা সম্ভব ?
ইসলামে হত্যাকারীর শাস্তি হলো মৃত্যুদ্বন্ড বা রক্তপণ, জেনাকারীদের শাস্তি হলো মৃত্যুদ্বন্ড বা বেত্রাঘাত, চোরের শাস্তি হলো হাত কাটা । এই ধরনের অনেক আইন সরাসরি কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে বলা হয়েছে এবং সুরা মায়েদায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারা কাফের, তারা জালেম, তারা ফাসেক । এখন আপনি চিন্তা করুন, যদি আপনি সর্বক্ষেত্রে তৌহিদ প্রতিষ্ঠা করতে চান, তবে অবশ্যই রাষ্ট্র ক্ষমতা মুসলিমদের হাতে থাকতে হবে । অবশ্য এখানে মুসলিম বলতে প্রকৃত মুসলিমদের বুঝানো হয়েছে, মুসলিম নামধারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা নাস্তিকদের বুঝানো হয়নি । অতএব এটি স্পষ্ট ইকামতে দ্বীন ছাড়া আল্লাহর একত্ব বা তৌহিদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় ।
সুরা নিসাতে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ও নেতৃস্থানীয় লোকদের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে এবং শেষোক্ত আনুগত্যের সাথে শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, যদি তারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করে । সুরা নিসার এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয়, মুসলমানরা তাদের নেতা নির্বাচন (কেউ আবার তথাকথিত নির্বাচন বুঝবেন না) করবে, যা রাষ্ট্রের অপরিহার্যতার বিষয়টি তুলে ধরে । সালাফীদের মত অনুযায়ী ধরে নিলাম, আপনি নিজ জীবনে তৌহিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, অর্থাৎ আপনি নামাজ পড়েন সহীহ তরিকায়, ফিৎরা দেন, যাকাত দেন, হজ্জ্ব করেন এবং বুখারী-মুসলিমের হাদীস শোনেন। এখন আপনাকে বেঁচে থাকার জন্য রুজি রোজগার করতে হবে । আপনি একটি সুদি ব্যাংকে চাকুরি করেন। যেখানে আল্লাহ সুদ নিষিদ্ধ করেছেন, সেখানে আপনি লোকজনদের সুদে ঋণ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করছেন । বলুন-ত এখানে আপনি কী তৌহিদ বা আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন ? এখানে আপনি সারাদিন আল্লাহর নাফরমানি করলেন । ধরুন আপনি কর অফিসে চাকুরি করেন । আপনি সারাদিন মদের দোকান, পতিতালয়, এর লাইসেন্স নবায়ন করে ফি এবং তাদের আয় হতে প্রয়োজনীয় আয়কর বা ভ্যাট সংগ্রহ করলেন । বলুনত এখানে আপনি কী তৌহিদ প্রতিষ্ঠা করলেন । ধরুন আপনি একজন উকিল হলেন, তাহলে কোর্টে আপনি কী বলছেন ? বলছেন মাননীয় আদালত সারাবিশ্বে এখন মৃত্যুদ্বন্ড রহিত করছে, অতএব আমা মক্কেলকে আপনি মৃত্যুদ্বন্ড দিবেন না, অথচ আল্লাহ আইন প্রণয়ন করেছেন মৃত্যুদ্বন্ড বহাল রেখে । তাহলে আপনি কোর্টে কার একত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বক্তব্য রাখলেন ? আপনি যদি কোর্টে বিচারপতি নিযুক্ত হন, তাহলে আপনি আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে জনগণ কর্তৃক তৈরিকৃত আইনের ভিত্তিতে রায় দিবেন । এক্ষেত্রে আপনি আল্লাহর আইনের ঊর্ধ্বে জনগণের আইনকে স্থান দিয়ে আল্লাহর একত্বকে তুচ্ছ জ্ঞান করলেন, আপনি শিরকের চর্চা করলেন । আপনি যদি কোন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, তবে স্যাকুলার শিক্ষা এবং শিক্ষা সহায়ক কারিকুলামের সাথে যুক্ত থেকে শিক্ষার্থীদের মন-মগজ আল্লাহর তৌহিদ চিন্তা হতে দূরে রাখার সুব্যবস্থা করে আপনি মসজিদে আসবেন সহীহ হাদীস চর্চা করার জন্য !
সালাফীদের বক্তব্য হলো, রাষ্ট্র ক্ষমতা আল্লাহ দিবেন । মুসলমানরা যদি নিজ জীবনে তৌহিদ প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তবে তারা আল্লাহর পক্ষ হতে রাষ্ট্র ক্ষমতা পাবে । তাই রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য কোন চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই । সালাফীদের এই বক্তব্য আর উট ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা একই কথা । আপনি রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য কোন চেষ্টা করবেন না, আর আল্লাহ আপনাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দিয়ে দিবেন ? একজন মুসলিমের দায়িত্ব হলো, সে ঈমান এবং আমলের দিক হতে ভাল মুসলিম হতে হবে এবং তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায় করা । জমীনে যদি আল্লাহর হকুম প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে কীভাবে আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে ?
সালাফীদের বক্তব্য হলো, মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের বিরোধীতা করা হারাম । অবশ্যই মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না, কারণ এ সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) হাদীস আছে । তবে রাসুল (সাঃ) এক্ষেত্রে একটি শর্ত দিয়েছেন, তা হলো তারা যদি (রাষ্ট্র প্রধান) নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। এখানে নামাজ কায়েম এবং যাকাত আদায় করে কথার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। আপনারাই বলুন, রাসুল (সঃ) এর এই হাদীস মুসলিম নামধারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কী ? হাদীসের মুসলিম শব্দ এবং বর্তমান মুসলিম শব্দের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে । হাদীসের মুসলিম শব্দের অর্থ হলো যারা ইসলামের অনুগত, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারী, যারা রাষ্ট্রে ইসলামী শরীয়াহ এর বিধান বলবৎ রেখেছেন, আর বর্তমান মুসলিম এর অর্থ হলো, নামাজ পড়তেও পারে, আবার নাও পড়তে পারে, মদ তার স্বাভাবিক পানীয় হতে পারে, শরীয়াহ আইনের বিরোধীতা করে, কোরআন-সুন্নাহকে আইনের উৎস মনে করে না, জনগণকে সর্বময় ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে । কোরআন-সুন্নাহকে আইনের উৎস অস্বীকারকারী মুসলিম নামধারী শাসকদের রক্ষা করার জন্য সালাফীদের রাসুল (সাঃ) এই হাদীস ‘‘মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের বিরোধীতা করা যাবে না’’ বলার কী অর্থ হতে পারে, তা পাঠককেই বুঝে নিতে হবে । একবার চিন্তা করুন, সাহাবীদের সময় এমন কোন মুসলিম পাওয়া যাবে, যে নামাজ আদায় করে না, যে মদ পান করে, যে প্রকাশ্যে নাচ-গান, বেহায়াপনার অনুষ্ঠান চালু করে, যে আল্লাহর কুরআন এবং রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাহকে আইনের উৎস হিসাবে মানে না । চিন্তা করুন-ত এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে উমর (রাঃ) এর তরবারি কী সিদ্ধান্ত নিত ? এখন বুঝার চেষ্টা করুন, বর্তমান সময় বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে রক্ষা করার জন্য সালাফীরা রাসুল (সাঃ) এর হাদীসের কী ধরনের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন । তবে এটাও মনে রাখতে হবে কোন ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রাষ্ট্রের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করা হলো এক ধরনের ফিৎনা সৃষ্টি ।
সালাফীদের আরও একটি বিভ্রান্তি হলো, বায়াত বা শপথ একমাত্র রাষ্ট্র প্রধান নিবেন, অন্য কেউ নিতে পারবে না । অর্থাৎ কোন সংগঠনের আমাীর বায়াত বা শপথ নিতে পারেন না । এক্ষেত্রে যুক্তি হলো যদি ইসলামী রাষ্ট্র বিদ্যমান থাকে, তবে অবশ্যই বায়াত বা শপথ রাষ্ট্র প্রধান নেবেন, অন্য কেউ নিতে পারবেন না । কিন্তু যখন ইসলামী রাষ্ট্র থাকবে না, তখন মুসলিমরা যদি নিজেদের মধ্যে কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করে, যার উদ্দেশ্য হলো নিজেরা ইসলামকে অনুসরণ করবে এবং রাষ্ট্রিয়ভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে, তখন ঐ সংগঠনের মুসলিমরা তাদের নিযুক্ত আমীরের বায়াত বা শপথ নিতে বাধা কোথায় ? বায়াত যদি রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে নিতে হয় তবে আকাবার বায়াতের সময় রাসুল (সাঃ)-ত রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন না, অথচ মুসলিমরা তার কাছে বায়াত নিয়েছিলেন । আকাবার শপথ হতে পরিষ্কার, বায়াত বা শপথ নিতে হবে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কাছে, আর যখন রাষ্ট্র গঠিত হবে, তখন রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তি নেতৃস্থানীয় হতে পারেন না । কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের আগ পর্যন্ত সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নিকট বায়াত নেয়া যেতে পারে ।
বাংলাদেশের সালাফীদের কার্যক্রম দেখে মনে হয়, তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুসলিম নামধারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সাথে একটি চুক্তিতে এসেছেন, আমরা ব্যক্তি জীবনে ইসলাম নিয়ে থাকার চেষ্টা করব, আপনারা রাষ্ট্রিয় জীবনে থাকেন, আর আপনাদের ভালবাসায় আমাদের সিক্ত করবেন, কারণ মুসলিম যুবকদের ব্যক্তিগত সহীহ আমলের কথা বলে আমরা ঘুম পাড়িয়ে রাখতেছি, যাতে এরা আপনাদের অসুবিধায় ফেলতে না পারে ।
বাংলাদেশে সালাফীরা যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, তার জন্য শুধু সালাফীরা দায়ী নন । এর জন্য ইকামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার দাবীদার দলগুলোও দায়ী । তারা আর আগের মত ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুসরণ করছেন না । ব্যক্তিগত, ব্যবসা, সামাজিক জীবনে তাদের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ । ইকামতে দ্বীনের কথা বলে তারা গণতন্ত্রের অনুসারী, গণতন্ত্রের রক্ষাকারী, মডারেট মুসলিম ইত্যাদি পরিচয় দিতে ভালবাসেন। তারা শরীয়াহ আইনের কথা মুখে আনতে লজ্জা পান, বলেন কৌশল এর কারণে বলি নাই। স্যাকুলাররা যেভাবে চোর, ডাকাত, ভাল মানুষ সবার ভোট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়, ইকামতে দ্বীনের দাবীদাররাও ভাল মানুষ, চোর, ডাকাত, মাজার পুজারি, পীর পুজারি, শিরক ও বিদআতকারীদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় । মাজার পুজারি, পীর পুজারি, শিরক ও বিদআতকারীদের বিরুদ্ধে সালাফীরা যেভাবে সচেষ্ট, সেখানে ইকামতে দ্বীনের দাবীদাররা নিশ্চুপ, যদি ভোট কমে যায় ! এরা সমাজের শিরক, বিদআত দূর না করে ইকামতে দ্বীনের অলীক স্বপ্ন দেখেন । এরা তথাকথিত রাজনীতিবিদদের মত বক্তব্য দিতে পছন্দ করেন, পত্রিকায় কোন ভিতরের খবর আসলে সত্য হলেও অস্বীকার করেন, আবার মিথ্যা হলেও অস্বীকার করেন । রাজনৈতিক লম্বা বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে স্যাকুলারদের সাথে তাদের কোন পার্থক্য নাই ।
ব্রিটিশ আমলে একটা সময় ছিল, যখন একই ব্যক্তি মুসলিম লীগের সদস্য ছিল, আবার কংগ্রেসেরও সদস্য ছিল । প্রকৃত মুসলিম যারা ইসলামকে ভালবাসে, তাদেরকে ব্রিটিশ আমলের মত একই সাথে সালাফী, তাবলীগ জামায়াত এবং ইকামতে দ্বীন এর সদস্য হতে হবে । এদেশের তরুণ মুসলিম জনগোষ্ঠির আর নতুন দল করার প্রয়োজন নেই । কারণ ইসলামের নামে দলের সংখ্যা অসংখ্য হয়ে গিয়েছে । এই তরুণ মুসলিমরা তাবলীগের মধ্যে প্রবেশ করে বুখারী-মুসলিমসহ সহীহ হাদীস চর্চা করে তাবলীগকে যদি সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে সাজানো যায়, তবে সালাফী এবং তাবলীগের পার্থক্য দূর হয়ে যাবে । এই তরুণরা যদি সালাফীদের তৌহিদকে রাষ্ট্র পর্যন্ত কায়েমের দিকে নিয়ে যায় এবং ইকামতের দ্বীন দাবীদারদের তথাকথিত স্যাকুলার রাজনীতি হতে উদ্ধার করতে পারে, তবে সালাফী এবং ইকামতে দ্বীন দাবীদারদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না । তরুণদের নিকট অনুরোধ অন্ধভাবে কোন দলকে অনুসরণ না করা । যার সাথে যুক্ত আছেন, তার ঘাটতিগুলো দূর করার চেষ্টা করুন, আর দলের কোন চিন্তাবিদ অন্যদলের কোন চিন্তাবিদকে যখনই পথভ্রস্ট বলবেন, তখনই তাকে বাধা দিন, বলুন নিজেদের মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে মারামারি নয় ।
একজন ব্যক্তি তখনই ঈমানদার মুসলিম হবে, যখন সে তার জীবনে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলবে এবং রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে । রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই অধিকাংশ মুসলিমকে শিরকমুক্ত ও বিদয়াতমুক্ত হতে হবে । অধিকাংশ মুসলিমকে নামে মুসলিম, অর্থাৎ শিরককারী, বিদয়াতী রেখে তাদের ভোট নিয়ে যদি কোনদিনও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া যায়, তবে তা হবে কিছু সময়ের জন্য । ঐ শিরককারী, বিদয়াতী মুসলিমরাই আপনাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা হতে বের করে দিবে । একজন মুসলিমকে ইকামতের দ্বীনের জন্য কাজ করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য । আল্লাহ যদি মনে করেন এরা রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার উপযোগী তবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দিবেন, নতুবা না । মনে রাখতে হবে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রাপ্তির মাধ্যমে মুসলিমদের প্রকৃত সফলতা নয় । বরং ইকামতের দ্বীনের কাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জন করাটাই হলো এজন মুসলিমের প্রকৃত সফলতা।
বিষয়: বিবিধ
১২৮২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো। জাযাকাল্লাহ্ খইরান ওয়া বাররান।।
মন্তব্য করতে লগইন করুন