আপনি কী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে ?
লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ১০ মার্চ, ২০১৩, ১২:১২:৩২ রাত
টক্ শোতে ডানপন্থি বা ইসলামপন্থিদের প্রশ্ন করা হয়, আপনি কী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে ? সাথে সাথে উনাদের বেলুন চুপষে যায়, বলা শুরু করেন, আমরা বিচারের পক্ষপাতী, তবে সুষ্ঠু বিচারের পক্ষপাতী । সোজা কথা, আওয়ামীপন্থিদের এ প্রশ্নে ডানপন্থি এবং ইসলামপন্থিরা ডিফেন্সে চলে যান । কিন্তু উনারা একবারও জোর গলায় বলতে পারেন না যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি এবং যাদের কারণে হাতছাড়া করেছি, তাদের বিচার করা উচিত । কারণ ইতিহাস বলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৫ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে । কিন্তু তৎকালীন মুজিব সরকার জনগণের কোন ম্যান্ডেট না নিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে চুক্তি করে ১৯৫জন যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দেন । সে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রি ডঃ কামাল হোসেন । ডঃ কামাল হোসেন এখনও বেঁচে আছেন । তাই ডঃ কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করে জানতে হবে, কেন তৎকালীন মুজিব সরকার যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিলেন ? যেহেতু আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তাই তাদের বিচার আর সম্ভব নয় । তাছাড়া তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই । তবে তাদেরকে যারা ছেড়ে দিয়েছে, তাদের বিচার করা যেতে পারে । বিশেষকরে যারা প্রতিদিন জাতির কলংক মোচার ডুগডুগি বাজান, তাদের উচিত এ দাবী করা , যারা ১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে ।
এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো যুদ্ধাপরাধী নয় , কিন্তু সে সময় হত্যা , ধর্ষণ , লুন্ঠন , অগ্নিসংযোজন করেছেন তাদের বিচার হওয়া উচিত কিনা ? এ প্রশ্নের উত্তর হল, আপনি সভ্য জগতের বাসিন্দা না অসভ্য জগতের বাসিন্দা ? যদি সভ্য জগতের বাসিন্দা হোন , তবে আমাদের প্রশ্ন হলো , এক বিচার কতবার করবেন ? কোন অপরাধের বিচার কি বনভোজনের মত ? বনভোজন যেমন প্রায় প্রতি বছরই করে, মানবতাবিরোধী একই বিচার কি প্রতি বছর করতে হবে ? এই বিচার ত ৭২-৭৫ সালে হয়ে গিয়েছে । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো , যাদের ৪২ বছর পূর্বে বাবা , ভাই মারা গেল, তারা সেই সময় বাবা , ভাইয়ের বিচারের জন্য মামলা দায়ের করলেন না কেন ? নাকি যাদের বাবা , ভাই মারা গেছে , তা তাদের অনুভূতিতে আসতে ৪২ বছর সময় লেগেছে ! আর যদি বলেন, সে সময় মামলা দায়ের করার পরিস্থিতি ছিল না , তাহলে বলতে হবে, ৭২-৭৫ সালে কি রাজাকার সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল ? এ প্রশ্নে উত্তর রাম-বামেরা কি দেবেন ?
আমি আবারও বলছি ৭২-৭৫ সালে বাংলাদেশে ৭১ এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়ে গেছে । তাই আর কোন বিচার হওয়ার প্রশ্নই উঠে না । আমরা যারা বিচারের স্বচ্ছতার কথা বলি , সেটা আমাদের বলা উচিত নয় । কারণ আমাদের বলা উচিত, ‘এক বিচার দুইবার হতে পারে না ।’ আবার বলছি , ‘এক বিচার দুইবার হতে পারে না ।’ সরকার ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারী কলাবরেটার্স আইন প্রণয়ন করেন । এ আইনে প্রায় ৩৭,০০০ লোক গ্রেফতার করা হয় । মাওলানা ভাসানী , অলি আহাদ এসমস্ত বিচারের তীব্র বিরোধীতা করেন । তারা বন্দীদের মুক্তি দাবী করেন । দালাল আইন বাতিল করার জন্য শেখ মুজিবকে আল্টিমেটাম দেন । এ তথ্যগুলো পাবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার স্বামী জনাব ওয়াজেদ মিয়া লিখিত “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” বই এর ১৬৪ ও ১৬৫ পৃষ্ঠায় । পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর মাসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন । কিন্তু চারটি অপরাধ ক্ষমা করেননি । এগুলো হল হত্যা , ধর্ষণ , লুন্ঠণ এবং অগ্নিসংযোজন । সাধারণ ক্ষমায় ৩৭,০০০ হতে প্রায় ২৬,০০০ ছাড়া পেলেন । কিন্তু উপরোক্ত চারটি অপরাধের জন্য ১১,০০০ আটকা পরলেন । ১৯৭৪ সালের ভিতরে ১১,০০০ হাজারের মধ্যে ২,৮৪৮ জনের বিচার কার্যক্রম শেষ করা হয় । প্রায় ২১০০ জন নির্দোষ প্রমাণিত হন । ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হন । (‘বাংলাদেশে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম’ মুনতাসীর মামুন , জয়ন্ত কুমার রায় , পৃঃ ৬২)।৩ জনের ফাঁসীর আদেশ হয় । ২ জন পলাতক ছিলেন । খুলনার রাজাকার চিকন আলীর ফাঁসী কার্যকর হয় । এ বিচারে শহীদুল্লা কায়সারের হত্যা মামলায় জামায়াতের খালেক মজুমদারের কারদন্ড হয়েছিল । কিন্তু হাইকোর্টে আপিল করে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হোন । “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” বই এর ১৪৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ডাঃ মালিকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় ।” বাকী ৮,০০০ এর বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে থাকে এবং প্রেসিডেন্ট সায়েম এর এক আদেশে ১৯৭৫ সালে ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল হয়ে যায় । তবে যে সমস্ত মামলা কোর্টে চলছিল, তা বাতিল হযনি । বরং কোন মামলার রায় ৭৬, ৭৭ সালেও হয়েছিল । তাহলে এটিতো পরিষ্কার , ৭২ হতে ৭৫ এর মধ্যে ব্যক্তিগত বিচারে এবং প্রচলিত বিচারে রাজাকারদের হত্যা করা হয়েছে । সেখানে আজকের নিজামী , মুজাহিদ , সাঈদী , কাদের মোল্লা , সাকা চৌধূরী বেঁচে গেলেন কিভাবে ? কেন সে সময় তাদের বিরুদ্ধে একটিও মামলা দায়ের করা হল না ? শহীদুল্লাহ কায়সারের পরিবার স্বাধীনতার পর পরই খালেক মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারল , গভর্ণর মালিকের শাস্তি হল , গোলাম আযমের নাগরিকত্ব গেল , আর নিজামী , মুজাহিদ , সাঈদী , সাকা চৌধূরীরা অসংখ্য লোকদেরকে হত্যা করল , কিন্তু এই অসংখ্য লোকদের পরিবার তাদের বিরুদ্ধে একটিও মামলা দায়ের করল না ! যদি সে সময় কেউ একটি মামলা দায়ের করত , তবে আজ নতুন করে মামলা আমলে নেয়ার প্রয়োজন ছিল না , পুরাতন মামলাকে জীবিত করলেই চলত । প্রেসিডেন্ট সায়েমের কারণে যে মামলাগুলো বন্ধ হয়ে (প্রকৃত পক্ষে মামলাগুলো কোন মেরিট ছিল না) গিয়েছিল , সেগুলো চালু করলে তো কারো কোন প্রশ্নথাকত না । কিন্তু সমস্যা হল ঐ মামলাগুলোতে গোলাম আযম ,নিজামী , মুজাহিদ , সাঈদী , সাকা চৌধূরী, কাদের মোল্লা, আবুলকালাম আযাদ কারো নাম নেই । তাই ঐগুলো চালু করে নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কোন লাভ নেই । তাই বলছি , যে বিচার একবার হয়ে গেছে, সেই বিচার যদি আবার করা হয়, তবে যারা করবে , তারা মানবতা বিরোধী অপরাধ করছে ।
আমার শেষ কথা হলো , যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোন সুযোগ বর্তমানে নেই , তবে এ দেশের যারা অপরাধ করেছেন , তাদের বিচার হয়ে গিয়েছে । এখন যা হতে পারে, তা হলো ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে ছেড়ে দেয়া জীবিত অপরাধী ডঃ কামাল হোসেনসহ ৭২-৭৫ সালের সরকারে যারা ছিলেন , তাদের বিচার হতে পারে । আর ১৯৫ জন সৈন্যকে ছেড়ে দেয়া তৎকালীন ৭২-৭৫ সালের সরকারের বিচারের মাধ্যমে জাতির কলংক দূর হতে পারে ।
বিষয়: বিবিধ
১৪৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন