স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি কারা ?

লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ০৪ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৫৯:১৪ রাত

বলা হয়ে থাকে, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবির স্বাধীনতা বিরোধী দল ? কিন্তু আমার বুঝের মধ্যে আসে না, এরা কিভাবে স্বাধীনতা বিরোধী দল হল ? স্বাধীনতা বিরোধী হওয়ার মাপকাঠিটি কী ? অনেকে বলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করাটাই হল মাপকাঠি । যতদূর জানি ইসলামী ছাত্র শিবির ১৯৭৭ সালে জন্মলাভ করেছে ? তাহলে এরা কিভাবে স্বাধীনতা বিরোধী হল ? ১৯৭১ এবং ১৯৭৭ সাল কোনটি আগে এবং কোনটি পরে, তা পাঠকরা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন ।

এখন জামায়াতের বিষয়টি চলে আসে । এদের জন্ম হলো ১৯৪১ সালে । তাহলে দল হিসেবে জামায়াত ১৯৭১ সাল দেখেছে । এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম কবে হয়েছে ? এর উত্তর হল ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয় । তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বরের পূর্বে আমরা কোন রাষ্ট্রের নাগরিক ছিলাম ? নিঃসন্দেহে পাকিস্তান । জামায়াতে ইসলামী, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোয় বিশ্বাসী ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত । কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বরের পর তারা পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করা বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় । তাই দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী কিভাবে স্বাধীনতা বিরোধী দল হলো ? যদি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর জামায়াত ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রকে স্বীকার না করত, তবে বলা যেত, জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল । কেউ দেখাতে পারবেন, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে জামায়াত কোন বিবৃতি দিয়েছে ? এটি কেউ দেখাতেই পারবেন না । যা দেখাতে পারবেন, তা হলো ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হতে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল । এখন প্রশ্ন হল, ২৬শে মার্চ হতে ১৬ই ডিসেম্বর এই ৮মাস ২০ দিন সময় বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল কিনা ? রাষ্ট্র বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে এই সময়টিতে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত ছিল না । কারণ স্বাধীন রাষ্ট্র হতে হলে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকতে হবে, যা ছিল পাকিস্তানের অধীনে । তাই ঐ সময় অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তান সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা বিদ্যমান ছিল । তাই বলা যায়, ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনুগত থাকাটা রাষ্ট্র বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে কোন অন্যায় কাজ নয় । কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বরের পর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ অস্বীকার করার অর্থ হল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন না করা । যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন করতে পারেননি, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ময়মনসিংহের জনাব নুরুল আমীন, সুনামগন্জের জনাব শাহেদ আলী, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায়সহ অনেকেই । এরা সবাই পাকিস্তানে চলে যান । জনাব নুরুল আমীন ৭১ এর পর পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, জনাব শাহেদ আলী মন্ত্রি হয়েছিলেন । মুনির চৌধূরী এবং কবির চৌধূরীর ভাই মেজর কাইয়ুম চৌধূরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে পাকিস্তানে থেকে যান । অনেক সাধারণ বাঙ্গালী ৭১ এর পর পাকিস্তানে থেকে যান, কারণ তারা পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার বাস্তবতা মেনে নিতে পারেননি । কিন্তু জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলগুলো ১৬ই ডিসেম্বরের পর বাস্তবতা মেনে নেয় । তাই কোনভাবেই জামায়াত স্বাধীনতা বিরোধী দল নয় ।

কেউ যদি বলেন, ২৬শে মার্চের ঘোষণা হতে বাংলাদেশ স্বাধীন, তাই ২৬শে মার্চের পর জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীতা করেছে । যদি ২৬শে মার্চের ঘোষণার পর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়, (রাষ্ট্র বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে স্বাধীন নয়) তবে ঐ সময় যারা পাকিস্তান সরকারের চাকুরি করেছেন, তারা সবাই বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করে পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন । অতএব ২৬শে মার্চ হতে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা পাকিস্তান সরকারের চাকুরি করেছেন, যেমন আদালতের বিচারক এবং কর্মচারীরা, অফিসের কমকর্তা-কর্মচারীরা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী, যারা ঐ সময়ে পাকিস্তান সরকারকে কর দিয়েছেন, সেই সাধারণ জনগণসহ সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন । এমনকি বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রির স্বামী ওয়াজেদ মিয়া তার লিখিত বই “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” এ স্বীকার করেছেন, তিনি পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকুরি করেছেন এবং মাসিক বেতন নিয়েছেন । এই দৃষ্টিকোণ হতে বলা যায়, সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ সাধারণ জনগণের মত , অফিস-আদালতের কর্মচারীদের মত স্বাধীনতা বিরোধী ছিল ।

ধরুন ২৬শে মার্চ ২০১৩ সালে কোন একজন মেজর এর নিকট হতে ঘোষণা এল “আজ চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হল।” এক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধীন চট্টগ্রাম জেলার অধিবাসী হিসেবে আপনি কী সিদ্ধান্ত নিবেন ? যদি আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হন, তবে ঐ মেজরের ঘোষণার কোন মূল্য আপনার কাছে নেই, বরং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনি বাংলাদেশের অখন্ডত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করবেন । আর চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে আপনি যদি বাংলাদেশ হতে চট্টগ্রাম আলাদা করতে চান, তবে আপনি ঐ মেজরের ঘোষণার সাথে একমত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হবেন । এক্ষেত্রে আপনি যদি ১ম পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তবে আপনি হবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, কিন্তু ২য় পদ্ধতি গ্রহণ করলে আপনি হবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি । বাস্তবতা হল ১ম পদ্ধতিতে মানুষের সংখ্যা বেশি হয় এবং ২য় পদ্ধতিতে কম হয় । কিন্তু ২য় পদ্ধতির লোকেরা যদি জয়লাভ করে, তবে পৃথিবীতে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হবে এবং নতুন রাষ্ট্রে ২য় পদ্ধতির সমর্থনকারীরা পাবে জাতীয় বীরের মর্যাদা । কিন্তু ২য় পদ্ধতির লোকেরা জয়লাভের পর যদি ১ম পদ্ধতির সমর্থনকারীদের হত্যা করা শুরু করে, তবে তাদেরকে জাতীয় বীর বলার জন্য কোন লোক দেশে বেঁচে থাকবে না । এই উদাহরণের আলোকে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়ার নিকট হতে স্বাধীনতার ঘোষণাকে বিবেচনা করলে, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আজকের বিতর্ক যে অহেতুক, তা আশাকরি সচেতন পাঠকরা স্বীকার করবেন । এটি শুধু একটি জাতিকে বিবক্ত করতে পারে, অন্য কিছু নয় ।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর হতে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল দুটি গোষ্ঠি । একটি হল মানবেন্দ্র লারমা এবং সন্তু লারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি বাহিনী’, যারা বাংলাদেশ ভেঙ্গে পাবর্ত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন করতে চেয়েছিল । ‘শান্তি বাহিনী’ অসংখ্য বাঙ্গালীর রক্ত ঝরিয়েছিল, রক্ত ঝরিয়েছিল অনেক সেনা কমকর্তার । সেই ‘শান্তি বাহিনী’ ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামি সরকারের ক্ষমা গ্রহণ করে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র ত্যাগ করেছে । কিন্তু এই ‘শান্তি বাহিনী’ যে অসংখ্য বাঙ্গালী হত্যা করেছিল , তার বিচার কোন নাস্তিক, ধর্মরিপেক্ষতাবাদী বুদ্ধিজীবিরা চায়নি । ২য় গোষ্ঠি হলো ‘বঙ্গভূমি’ আন্দোলনকারীরা, এরা বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সীমান্তবর্তী হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ আন্দোলন করে যাচ্ছে । এই স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়েও কারো কোন মাথা-ব্যাথা নেই । সবার মাথা-ব্যাথ্যা শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামী নিয়ে, অথচ দলটি সবসময় রাষ্ট্রের আনুগত্য করে চলছে ।

দুটি গোষ্ঠির কথা বললাম, যারা সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে, কারণ স্বাধীনতার বিরোধীতার প্রশ্ন আসে স্বাধীনতার পর, স্বাধীনতার পূর্বে নয় । কিন্তু কেউ দেখাতে পারবেন না যে, জামায়াত এভাবে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে । অবশ্য কেউ বলতে পারেন, পরোক্ষ ভাবে জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীত করে । এখন যারা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার বিরোধীতা করে , তা বোঝার মাপকঠিটি কী ? আমার মতে মাপকাঠিগুলো হতে পারে-

(১) সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করার পরও যদি কেউ নিরব থাকে, তবে বুঝতে হবে সে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয় ।

(২) তারকাটায় ফেলানীর লাশ দেখে যার হৃদয়ে কান্না আসে না, অবশ্যই সে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয় ।

(৩) ভারতের বি,এস,এফ কর্তৃক বাংলাদেশের ভূমি দখলের প্রতিবাদ যারা করতে পারে না, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয় ।

(৪) ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের নদীর উপর বাধ দিয়ে পানি আটকানোর প্রতিবাদ যারা করতে পারে না, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয় ।

(৫) যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় একজনও অন্য ধর্মের লোক মারা যায়নি, সে বাংলাদেশে যারা সাম্প্রদায়িকতা আবিষ্কার করেন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয় ।

(৬) যারা শাহরিয়ার কবীর, মুনতাসির মামুন, ডঃ জাফর ইকবালের মত চরিত্রের লোকদের পছন্দ করে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয় ।

পাঠকরা আপনারাই বিবেচনা করুন, বর্তমানে কারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ?

বিষয়: বিবিধ

১৫৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File