‘একাত্তরের দিনগুলি’ - জাহানারা ইমাম একটি পর্যালোচনা ।
লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ০২ আগস্ট, ২০১৪, ০২:২৪:৪৭ রাত
“রুমি একটি সিগারেট ধরিয়ে বলল, আম্মা ডক্কে তোমার মনে আছে ?” (‘একাত্তরের দিনগুলি’ ৩৪ মুদ্রণ, পৃঃ১৪৮) । “ফেরার পথে এক কার্টন ৫৫৫ সিগারেট কিনে নিলাম পাড়ার রশীদের দোকান হতে” (পৃঃ ১৫৫) । ২০ বছর বয়সী রুমি হলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পুত্র । পুত্র মায়ের সামনে সিগারেট খাচ্ছে এবং মা পুত্রের জন্য সিগারেট ক্রয় করছেন, কী সুন্দর বাঙ্গালী সংস্কৃতি ! বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক-বাহক, গণ আদালতের প্রবক্তা, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের শহীদ জননী হিসাবে পরিচিত জাহানারা ইমাম এর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বেশ মনযোগ সহকারে পড়লাম । এর আগে একজন কাছের মানুষকে পড়তে বললাম । পড়ার পর তাকে বললাম, তিনি কোন গড়মিল পেয়েছেন কিনা ? উত্তর আসল, তেমন কিছু পাননি । আমি বললাম, আমি ত অনেক কিছু পেয়েছি । যখন বিভিন্ন গড়মিলগুলো (বর্তমান চিন্তাধারার সাথে তুলনা করলে) তুলে ধরলাম, তখন তিনি বললেন, আসলেও ত ঠিক, এত সূক্ষভাবে চিন্তা করিনি । সত্যি বলতে কী জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুনদের লেখা যদি একটু মন দিয়ে পড়েন, তবে দেখবেন অনেক সত্য আপনার চোখে সামনে ধরা পড়বে । এ সত্যগুলো ইসলামপন্থি লোকদের লেখায় সবসময়ই প্রকাশ পায় । কিন্তু আমার লেখাগুলো থাকে নতুন প্রজেন্মর তরুণদের জন্য, তাই আমি ইসলামপন্থিদের লেখা হতে তথ্যগুলো না এনে এসমস্ত নাস্তিক বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী লোকদের লেখা হতে তথ্যগুলো আনি । কারণ ইসলামপন্থিদের লেখা হতে তথ্যগুলো আনলে অনেকে বলতে পারেন, ‘উনারা তো এগুলোই বলবেনই ।’
লেখা শুরু করেছি, ‘শহীদ জননী হিসাবে পরিচিত জাহানারা ইমাম’ দিয়ে । সারা বই পড়ে মনে হলো, ‘৭১ এ অনেক মা সন্তান হারা হয়েছেন, অনেকেই একাধিক সন্তান হারিয়েছেন, সেখানে তারা শহীদ জননী না হয়ে জাহানারা ইমাম শহীদ জননী হলেন কিভাবে ? সমাজের উচু স্তরে অবস্থান করে, ভোগ বিলাসে মত্ত থেকে ড্রয়িং রূমে ৭১ সম্পর্কে আলোচনা করে এবং কম বয়সের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে মারা যাওয়া সন্তানের জন্য তিনি হয়ে গেলেন শহীদ জননী ! আর রণাঙ্গনে যে সন্তানেরা সম্মুখ সমরে মারা গেল, তাদের মায়েরা কি শহীদ জননীর আনুষ্ঠানিক উপাধী পাবেন না ? উত্তর হলো না । কারণ ঐ জননীরা সুবিধাবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত নন, তারা ইসলামপন্থি দলগুলো বিরুদ্ধে নয়, তারা ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, তারা কার্ল মার্কস, লেনিন, মাওসেতুং এ বিশ্বাসী নালায়েক সন্তান জন্ম দেননি । যদি কোন মা এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতেন, তবে শাহরিয়ার কবির এবং মুনতাসীর মামুনের মত সরাসরি ইসলাম বিদ্বেষী লোকদের মাধ্যমে শহীদ জননী উপাধি পেতেন এবং তা নাস্তিক-ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের নিয়ন্ত্রাধীন মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেত । এখন একাত্তরের দিনগুলি বইটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি -
“আজ বিকেলে (১মার্চ, ৭১) রুমী ক্রিকেট খেলা দেখে তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসবে হ্যামবার্গার খাওয়ানোর জন্য । গোসল শেষে বারোটার দিকে বেরোলাম (জাহানারা ইমাম) জিন্না এভিনিউয়ের পূর্ণিমা স্ন্যাক থেকে ডিনার-রোল কিনে আনার জন্য ।” ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি শুরু হয়েছে উপরোক্ত কথামালা দিয়ে । জাহানারা ইমামরা নিজেদের সন্তানদের হ্যামবার্গার, ডিনার-রোল খাওয়ান, আর সভা-সেমিনারের সাহায্যে পান্তা-ইলিশের মাধ্যমে বাঙ্গালী সংস্কৃতির নাম দিয়ে সুকৌশলে অপসংস্কৃতি ঢুকিয়ে বাংলার যুব সমাজের ধর্মীয় অনুভুুতি হ্রাসের চেষ্টা করে যাচ্ছেন । জাহানারা ইমামরা ভাল করেই জানেন, ধর্মীয় অনুভূতি হ্রাস করতে পারলেই এদেশে কার্ল মার্কস, লেনিন, মাওসেতুং, চে গুয়েভাদের জীবিত করা যাবে । আমি বলব, এ ব্যাপরে তারা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে । ১৯৪৭ সাল হতে তাদের অবিরাম প্রচেষ্টার ফলে তারা প্রথম দিকে গোপনে, পরে পরোক্ষভাবে এবং বর্তমানে প্রকাশে আল্লাহ এবং রাসুল (সাঃ) সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য করতে পেরেছে । সম্প্রতি ব্লগার রাজীব, আরিফসহ অনেকেই হচ্ছে এর উদাহরণ ।
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ এবং নাস্তিক বুদ্ধিজীবিরা ৭১ কে যেভাবে চিত্রিত করেছেন, তা থেকে তরুণ সমাজের মনে একটি চিত্রই ভেসে আসে ভয়াবহ রক্তাক্ত অবস্থা, যেখানে জনজীবন বিপর্যস্ত । কিন্তু জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি বিশ্লেষণ করলে তৎকালীন সময়ে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা ধরা পড়লেও খুব খারাপ কোন অবস্থা বুঝায় না । বিশেষকরে ঢাকাকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে । উনার বই এ যা ধরা পড়েছে, তা হলো সামরিক সরকারের দমন-পীড়ন । আর এই দমন-পীড়ন হতে আজও এ দেশের মানুষের মুক্তি হয়নি । বই পড়ে যা দেখলাম, তা হলো জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফ সাহেব নিয়মিত অফিস করতেন এবং রিফ্রেশমেন্টের জন্য ঢাকা ক্লাবে আড্ডা দিতেন বা টেনিস খেলতেন (৪৮, ১০৬, ১২৮ পৃঃ ) । ২৫ শে মার্চের রাত্রিতে যে ভয়াবহ ঘটনা বলা হয়, সে ঘটনার পরও শরীফ সাহেবের ২৮ শে মার্চ ঢাকা ক্লাবে যাওয়ার অর্থ হলো, হয় ২৫ শে মার্চের ঘটনা বাড়িয়ে বলা হয় অথবা ২৫ শে মার্চের ঘটনা সমাজের উচু স্তরের শরীফ সাহেবদের স্পর্শ করেনি, এটি শুধু তাদের নিকট চায়ের টেবিলের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল । ২৯শে মার্চ জাহানারা ইমাম তার ছেলে রুমীর (যে ছেলের কারণে তিনি শহীদ জননী) জন্মদিনে পোলাও, কোর্মা, চানার হালুয়া, সালাদ এর ব্যব্স্থা করেন এবং ছোট ছেলে জামী খেয়ে দেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল, “ভাইয়ার জন্মদিনে খাওয়াটা ভালো হলো ’ (৫০পৃঃ) । ২৫ শে মার্চের ঘটনার পর ২৮ শে মার্চ শরীফ সাহেবের ঢাকা ক্লাবে যাওয়া এবং ২৯ শে মার্চ জাহানারা ইমামের পোলাও-কোর্মা তৈরী করা থেকে তরুণ সমাজের অনেক কিছু বুঝার আছে, যদি তারা অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে তা ভাবে ।
‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ের কোথাও শেখ মুজিবুর রহমান বা জিয়াউর রহমান বা জিয়াউর রহমান হতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে, এ ধরনের কোন বক্তব্য নেই । মুক্তিযুদ্ধ কি শুরু হলো, কার নেতৃত্বে হচ্ছে এ সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই । বরং স্বাধীকার এবং স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্ট করা হয়েছে । জাহানারা ইমাম স্বয়ং বলছেন, স্বাধিকারের কথা উঠেছে, নির্বাচিত জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে কিন্তু স্বাধীন বাংলার কথা কখন উঠল ? জাহানারা ইমামের ছেলের বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামিলীগের উগ্র জাতীয়তাবাদী (লক্ষণীয় বিষয়, বলা হচ্ছে ‘ উগ্র জাতীয়তাবাদী) ছাত্রদের পক্ষ হতে শেখ সাহেবকে চাপ দেয়া হচ্ছে এবং এ ব্যাপরে শেখ সাহেব খুশী নন । ৭ই মার্চের বক্তব্য সম্পর্কে রুমীর মন্তব্য হলো, শেখ নিরাশ করেছে (কারণ রুমি স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে অবগত) । তাদের নিরাশ হওয়ার কারণ হলো, ১৭ই মার্চ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ সাহেব নিজ দেশের সমস্যাকে স্বাধীনতার সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত না করে রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন (১৬, ১৭, ২২, ২৪, ২৯ পৃঃ) ।
সারা মার্চ মাস পর্যন্ত রুমির চেহারায় যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ছিল । কিন্তু ২৫ শে মার্চ রাত ১২টার দিকে গুলীর শব্দ শুনেই রুমি এক লাফ দিয়েই ছাদ হতে স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে আনল, কার্ল মার্কস এঙ্গেলস, মাওসেতুং এর বইগুলো বাড়ী হতে বিদায় দিলো (৩৮,৩৯ পৃঃ)। সত্যি গুলীর শব্দেই এক লাফেই যারা স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে ফেললো, আর তারাই শেখ সাহেবকে দোষারোপ করছে, কেন তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন না ?
জাহানারা ইমামের বাড়ীর দক্ষিণ দিকের মাঠ পেরিয়ে ইকবাল হল, মোহসীন হল এবং আরো কয়েকটি হল এবং ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার । কিন্তু ২৫শে মার্চে হলগুলোতে আক্রমণে হতাহতদের ব্যাপারে জাহানারা ইমাম কোন তথ্য দিতে পারেননি । বরং ২৬ শে মার্চ সকালে তার বাসায় আশ্রয় নেয়া পরিচিত ছাত্র কামাল বলল, মোহসীন হল আক্রমণ হয়নি, আক্রমণ হয়েছে ইকবাল হল (৪১পৃঃ) । সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাই শরৎ বসুর নাতিন শর্মীলা বোস তার ‘ডেড রেকনিং’ বইযে লিখেছেন ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে সারা বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মচারী যারা শহীদ হয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুযায়ী তাদের সংখ্যা হলো ১৪৯ জন । আবার প্রচলিত তথ্য হলো ২৫শে মার্চ হাজারে হাজারে শহীদ হয়েছেন । কিন্তু ওয়াজেদ মিয়া এর বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা এবং বাংলাদেশ’ বইটি প্রচলিত তথ্যকেও সমর্থন করে না । শহীদের সংখ্যা নিয়ে এই বিতর্ক শেষ করতে পারে সরকারের একটি মাত্র উদ্যোগ । আর তা হলো যদি সরকার আদমশুমারীর মত শহীদদের নাম লিপিবদ্ধ করে ।
৭১ এ ঢাকার প্রকৃত অবস্থা কী ছিল ? জাহানারা ইমামের পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন ডাঃ এ. কে. খান, তার পোস্টিং ছিল রাজশাহীতে । ২ জুলাই ঢাকায় এসে বলেন, “আমরা তো প্রথম ভেবেছিলাম ঢাকায় কিছু নেই । সব ভেঙ্গেচুরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মিসমার করে দিয়েছে । কোনদিক থেকে কোন খবর পাওয়ার উপায় নেই । শুধু ইন্ডিয়ান রেডিও, বিবিসি, রেডিও অস্ট্রেলিয়া আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর। ঢাকার সঠিক খবর পেতে অনেকদিন লেগেছে (১২২ পৃঃ) ।” অপর পরিচিত ব্যক্তি দেশের বাড়ী হতে আগত মাসুম ২৪ জুলাই এসে বলল, “আমরা তো ২৬শে মার্চই আকাশবাণী, বি.বি.সি, ভয়েস আমেরিকা শুনে ভেবেছিলাম ঢাকা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে” (১৩৮পৃঃ)। ডাক্তার এবং মাসুমের কথা প্রমাণ দেয় আকাশবাণী, বি.বি.সি, ভয়েস আমেরিকার খবর এবং বাস্তবতার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে । এ সম্পর্কে তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘বাংলাদেশের জন্ম’ বই এর ১০৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, নোয়াখালী হতে আগত একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্ষত দেখে বিস্মিত হন । তারা মনে করেছিলেন ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাটির সাথে মিশে গেছে । সত্যি বলতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল, তা হিন্দু এবং ইহুদী নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো এত বেশি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বর্ণনা করেছিল যে, সেই বর্ণনা যখন তরুণ সমাজের সামনে আসে, তখন তরুণ সমাজ তৎকালীন সময়ে অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থক ইসলামপন্থি দলগুলোকে ঘৃণার চোখে দেখে । কিন্তু এই তরুণরা কখনও চিন্তা করে না যে, বাংলার প্রতিটি গ্রামে ১জন করে মারা গেলে মোট মৃতের সংখ্যা হবে ৬৮ হাজার, কিন্তু তা কিভাবে ৩০ লক্ষ হলো । যদি এখনও যে কেউ তার আশ-পাশের গ্রামের দিকে তাকান, তবে মৃতের সংখ্যা গ্রাম প্রতি একজনও পাবে না । ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতি ইউনিয়নে ৩ হতে ৪ জন । যে কেউ বিষয়টি যাচাই করে নিতে পারেন ।
৭১ এ সাধারণ মানুষের অবস্থা কী ছিল ? বইটির ১২৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ১৫ই জুলাই এস.এস.সি পরীক্ষা শুরু হয় । বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েরা যাতে পরীক্ষা না দেয়, সেজন্য বলা হলো কেন্দ্রে বোমা মারা হবে । ফলে পরীক্ষার্থী ছেলে-মেয়েদের বাবা-মায়ের মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা । এ ব্যাপারে পাকিস্তানী মেজর সিদ্দিক সালিক বলেন, “বাক-বিনিময় হচ্ছিল একজন সৈনিক ও একজন বৃদ্ধ বেসামরিক বাঙ্গালীর মধ্যে । বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে কোন খবর দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করল । অন্যদিকে সহযোগীতা না করার কারণে সৈনিকেরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিল । ---বাঙ্গালীটি আমাকে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, আমি কী করব ? কিছুক্ষণ আগেও তারা (মুক্তি) এখানে ছিল । যদি তাদের কারো সম্পর্কে কোন কিছু বলি তাহলে তারা আমাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দিয়ে গেছে । এখন আপনারা আমাকে একটি ভয়াবহ পরিণতির মুখে দাঁড় করিয়েছেন । আমি যদি তাদের সম্পর্কে কোন কিছু না বলি, আপনারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন ।” (নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃঃ ৯৯,১০০) । জাহানারা ইমাম এবং পাকিস্তানী মেজর উভয়ই সাধারণ মানুষ সম্পর্কে একই চিত্র একেছন, তা হলো সাধারণ মানুষ ছিল উভয় সংকটে ।
‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়ে পাকিস্তান আর্মিকে বড়ই বর্বর এবং গণহত্যাকারী বলে মনে হয় । তবে বইতে যে কাহিনীগুলো বর্ণনা করা হয়েছে, তা শুনেছি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, আবার কোনগুলো গুজবের মধ্যে সীমাবদ্ধ । রুমীর ঘটনা সম্পর্কে শর্মীলা বোস যে প্রশ্ন উঠিয়েছেন, তা সঠিক বলেই মনে হয়েছে । কারণ শর্মীলা বোসের মতে রুমী বাড়ীর পাহারাদার পুলিশ হত্যা করার কারণে পাকিস্তান আর্মি গ্রেপ্তার করবে, এটিই স্বাভাবিক । যে কোন দেশের বাহিনী এ কাজটি করবে । কিন্তু রুমির সাথে যাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে তো পাকিস্তান আর্মি ছেড়ে দিয়েছে । পাকিস্তান আর্মি যদি নির্বিচারে গণহত্যা করত, তবে গ্রেপ্তারকৃত সবাইকে রুমীর মত ভাগ্য বরণ করতে হত । উল্লেখ্য যে, গ্রেপ্তারকৃত কারো কারো বাসা হতে অস্ত্র উদ্ধার হলেও তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়, কারণ তারা সরাসরি হত্যার সাথে জড়িত ছিল না । যেমন আলতাফ মাহমুদের বাসা হতে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল এবং আর্মি তার লিস্ট অনুযায়ী আলভী কে জানতে চাইলে, আলভী নিজেকে আবুল বারাক বলায় আলভী বেঁচে যায় (১৯০পৃঃ) । পাকিস্তান আর্মি যে টার্গেট ভিত্তিক গ্রেপ্তার এবং হত্যা করেছিল, তার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া যায় বইয়ের ১৩০ পৃষ্ঠায় । ডাক্তার এ কে খানের ছোট ছেলে খোকন এবং তার খালা মণ্জু এনায়েতপূর হতে ঢাকায় লঞ্চে আসার পথে কী ঘটেছে, তা জাহানারা ইমামের কাছে বর্ণনা করেন, “বুঝলেন আপা, সিরাজগন্জ ঘাট ছাড়ার পর হঠাৎ একটা আর্মি ভরা স্টিমার আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়ে আসতে আসতে চিৎকার দিয়ে লঞ্চ থামাতে বলে । আমরা তো ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু । আর বুঝি কারো কোন রক্ষা নেই । কিন্তু ওরা শুধু একজন লোককেই খুঁজছিল । সে হলো সিরাজগন্জ কওমী জুট মিলের এক ইন্জিনিয়ার । তাকেই ধরে নিয়ে গেল । অন্য যাত্রীদের কাউকে কিছু বলল না ।” জাহানারা ইমামের বই একটু ভালো করে পড়লে শোনা কথা এবং গুজবকে বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সামনে আনলে দেখা যায় যে, পাকিস্তান আর্মি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পায়নি, পরবর্তীতে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে । তবে কিছু সংখ্যক আর্মি অফিসার নির্বিচারে সাধারণ লোক হত্যা করেছে, সেটাও ঐতিহাসিক ভাবে সত্য । কিন্তু তা ব্যাপক হারে ছিল না । এ সম্পর্কে চমৎকার তথ্য শর্মীলা বোস তার ‘ডেড রেকনিং’ বইতে দিয়েছেন, তথাকথিত বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরা বইটির জন্য শর্মীলা বোসকে গালাগালিই করেছেন, তারা বইটি বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে বাধা দিতে পেরেছেন, কিন্তু তার তথ্যগুলো চ্যালেন্জ করতে পারেননি ।
‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে, স্বাধীনতার ১৪ বছর পর । ১৯৭১ সালে জাহানারা ইমাম এবং শরীফ সাহেবেরা নির্বিঘ্নে চাকরি করে পোলাও-কোর্মা খেয়েছেন, আর ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেছেন ঢাকায় থেকে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধাদের সহায়তা করেছেন । বইটি পড়লে বুঝা যায়, এখানে অনেক অতিরন্জিত তথ্য দেয়া আছে । যেমন বলা হয়েছে, ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে ৩০ লক্ষ লোক জমায়েত হয়েছিল । তখন (৭১) ঢাকায় কতজন লোক বাস করত ? পুরো ৭১ সাল জাহানারা ইমাম পাকিস্তান রেডিওতে প্রোগ্রাম করেছেন এবং তার স্বামী শরীফ সাহেব চাকুরি করেছেন এবং ঢাকা ক্লাবে টেনিস খেলেছেন । রেডিওতে প্রোগ্রাম ব্যাপারে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সামরিক জান্তার চাপে তিনি পাকিস্তান রেডিওতে প্রোগ্রাম করেছেন । একই ব্যাখ্যা ৭৫ সালে মুজিব হত্যার পর তার রক্তের দাগ শুকানোর আগেই শপথ নিয়ে মন্ত্রি হওয়া আওয়ামিলীগ নেতারা ৯০ সালের পর ব্যাখ্যা দেন । সব দোষ সামরিক জান্তার ! কিন্তু জাহানারা ইমামের বই বলে দেয়, সামরিক জান্তারা জাহানারা ইমামের সাথে কোন আলাপই করেনি । বরং রেডিও হতে আসা নুরুন্নবী খানের অনুরোধে তিনি স্বাধীনভাবে ‘গুজবে কান দিবেন না’ নামক কথিকাটি পরিচালনা করবেন বলে বেছে নেন (৬২ পৃঃ) । উল্লেখ্য যে, জাহানারা ইমামের বইতেই উল্লেখ আছে, তখন বিভিন্ন গুজব, যেমন সামরিক বাহিনী কর্তৃক দেশের মানুষের সমস্ত রক্ত নিয়ে মৃতদেহ ফেলা দেয়া, উর্দু নাম ব্যবহার করা, বিভিন্ন জনের মৃত্যু সংবাদ ইত্যাদি যা মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করেছিল । জাহানারা ইমাম নুরন্নবী খানকে বলেছিলেন, তিনি স্বাধীনভাবে কথিকা বেছে নিবেন । আর তিনি বেছে নিলেন, ‘গুজবে কান দিবেন না’, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেন গুজবে কান না দিয়ে সরকারের উপর যাতে বিশ্বাস রাখে । অন্যদিকে আর একটি মিথ্যা তথ্য তিনি যোগ করলেন, তার স্বামী শরীফ সাহেবের দেশ প্রেম দেখাতে । ৩ জুলাই জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফ সাহেবের কাছে খবর আসল যে, খালেদ মোশারফ চেয়েছেন বাংলাদেশের সকল ব্রীজ-কার্লভাটের তালিকা । আর এ সেকশনের সাথে শরীফ সাহেবের কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এবং সেকশনের দায়িত্বে একজন অবাঙ্গালী অফিসার থাকার পরও শরীফ সাহেব সারা বাংলাদেশের ব্রীজ-কার্লভার্টের সমস্ত ম্যাপ, তথ্য, ফাইল ইত্যাদি মাত্র ৪ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ৭জুলাই এর মধ্যে তৈরি করে ফেলেন (১২৩, ১২৫ পৃঃ), যা স্বাভাবিক সময়ে তৈরী করতে কম পক্ষে ১ মাস লাগার কথা । তাছাড়া সে সময় এ সমস্ত তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে বের করা সম্ভব নয় ।
লেখার পরিসর বড় হয়ে যাচ্ছে । তাই আর কথা না বাড়িয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি হতে আর একটি তথ্য দেব, যা থেকে অনুমান করা যাবে ২৬শে মার্চের পর মানুষ কোন ধুম্রজালের মধ্যে ছিল । বইটরি ৬০ পৃষ্ঠায় ১০ এপ্রিল এর কথাবলী (জাহানারা ইমামের কথা) হচ্ছে, “স্বাধীন বাংলা বেতারের বরাত দিয়ে আকাশবাণী যত খবর বলে, সব বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না । ওদের কিছু কিছু খবর ভুল প্রমাণিত হয়েছে । নীলিমা আপা, সুফিয়া আপার মৃত্যু সংবাদ ভুল ছিল । ঢাকার পতন, ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ, টিক্কা খানের মৃত্যু সবকটা খবরই ভুল ছিল । ---- আজ সকালে খাবার টেবিলে সবাইকে বললাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সত্যি সত্যি আছে, না আকাশবাণীর বানানো মিথ - তা বের করতেই হবে ।” ৭১ শেষ হলো, বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্র হলো, কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস কী আকাশবাণীর ইতিহাস দিয়ে রচিত হবে, না প্রকৃত যা ঘটেছে, তার মাধ্যমে রচিত হবে ? সঠিক ইতিহাস রচিত হলে বিভিন্ন জনের ভাগে দোষ-গুণ জমা হবে, কারো মর্যাদা হয়ত একটু বাড়বে, কারো হয়ত একটু কমবে কিন্তু বিদ্বেষের মাত্রাটা শূন্যের স্তরে আনা সম্ভব হবে, জাতি হয়ত এ সময়ে এসে আর দ্বিধাবিভক্ত হত না ।
বিষয়: বিবিধ
৯৪৬৫ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন