তিন বিঘা করিডোর ।

লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১০:৪৭:৫৪ সকাল

আজকের লেখাটা লিখব তিন বিঘা করিডোর নিয়ে । তিন বিঘা করিডোর নিয়ে অনেকের কাছেই ধুম্রজাল রয়েছে । অনেকেই এর বিশ্লেষণ সঠিকভাবে করেননি । বিশ্লেষণের মধ্যে কিছু সত্য ইচ্ছে করেই হোক অথবা অনিচ্ছাকৃত হউক গোপন রাখা হয়েছিল । আর ছিল দোষারোপের প্রবণতা । যেমন এ ব্যাপারে অনেকেই বলে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়ে দেন । বক্তব্যটি অর্ধ সত্য । যে কোন বিষয়ের সঠিক ইতিহাস জানার অধিকার সবারই রয়েছে ।

তিন বিঘা করিডোরের সাথে রয়েছে দক্ষিণ বেরুবাড়ী এবং দহগ্রাম - আঙ্গরপোতার ইতিহাস । ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় রেডক্লিফের সীমানা অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের একটি অংশ এবং আসামের কিছু অংশ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) গঠিত হয় । রেডক্লিফ জলপাইগুড়ি জেলাকে (বাংলাদেশের উত্তর অংশে) ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত করে দেন । এর মধ্যে কিছু থানা পূর্ব পাকিস্তানে এবং কিছু থানা ভারতে দেয়া হয় । থানাগুলোর সীমানা দিয়ে দুটি দেশের সীমানা নির্ধারিত হয় । কিন্তু রেডক্লিফের বর্ণনায় বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং ১২ এর কোন ব্যাখ্যা আসেনি । বেরুবাড়ী ভারতের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায় । ৪৭ এর পর সীমানা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় পাকিস্তান বেরুবাড়ী সহ বিভিন্ন সীমানা নিয়ে ডিসপুট দেয় । একই সাথে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে ছিটমহল (Enclave) নিয়ে ছিল সমস্যা । ছিটমহল (Enclave) হল রাষ্ট্রের এমন একটি অংশ যা অপর রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে । যেমন দহগ্রাম - আঙ্গরপোতা হল পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিটমহল , যা ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত । এসমস্ত ছিটমহলে সরাসরি কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় এর জনগণ ক্রমান্বয়ে বিদেশী রাষ্ট্রের সংস্কৃতি , শিক্ষা , পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঐ রাষ্ট্রের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় । তাই ছিটমহলগুলোর উপর সার্বভৌমত্ব ভবিষ্যতে দূর্বল হয়ে যায় । এ ধরনের ছিটমহল বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) হচ্ছে ৯২ টি , যা ভারতের মধ্যে রয়েছে এবং এর আয়তন হল ৪৯.৭ বর্গ কিলোমিটার । অন্যদিকে বাংলাদেশের ভিতর ভারতের ছিটমহল হল ১০৬ টি , যার আয়তন হল ৬৯.৬ বর্গ কিলোমিটার ।

১৯৫৮ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রি জওহার লাল নেহুরের মধ্যে সীমানা নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । চুক্তিটির হেড লাইন ছিল No . 2552. AGREEMENT BETWEEN PAKISTAN AND INDIA ON BORDER DISPUTES. SIGNED AT NEW DELHI, ON 10 SEPTEMBER 1958” এই চুক্তির ১০ নং ধারয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় , “(10) Exchange of old Cooch Behar enclaves in Pakistan and Pakistan enclaves in India without claim to compensation for extra area going to Pakistan,is agreed to." অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ছিটমহলগুলো বিনিময় হয়ে যাবে এবং পাকিস্তান যে অতিরিক্ত ১৯.৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পাবে , তার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দাবী করা হবে না । এই চুক্তির মাধ্যমে অন্যান্য ছিটমহলের মত দহগ্রাম - আঙ্গরপোতা ভারতের সার্বভৌমত্বে চলে যায় এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বে চলে আসে ভারতের ১০৬ টি ছিট মহল , যার আয়তন হল ৬৯.৬ বর্গ কিলোমিটার । চুক্তির ৩নং ধারায় সিদ্ধান্ত হয় বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নিয়ে । এক্ষেত্রে বলা হয় “This will be so divided as to give half the area to Pakistan, the other half adjacent to India being retained by India." অর্থাৎ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন সমান দুটি অংশে বিভক্ত হবে এবং একটি অংশ পাকিস্তান পাবে । এই অর্ধ অংশের সাথে কুচবিহারের ৪টি ছিটমহলও পাকিস্তান পাবে । এ চুক্তির ফলে ২২.৫৮ বর্গ কিলোমিটারের বেরুবাড়ীর অর্ধেক ১১.২৯ বর্গ কিলোমিটার এবং ৪টি ছিটমহল ৬.৮৪ বর্গ কিলোমিটার সহ মোট ১৮.১৩ বর্গ কিলোমিটার পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় ।

ভারত ও পাকিস্তানের এ চুক্তিকে বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকার সংবিধানের যে ৯ম সংশোধনী করে তা চ্যালেন্জ করে ভারতের কোর্টে রীট পিটিশন দায়ের করা হয় এবং ১৯৭১ সালের ২৯ শে মার্চ কোর্টের রায় সংশোধনীর পক্ষে গেলে চুক্তি বাস্তবায়নে আর কোন সমস্যা থাকে না । ১৯৫৮ সালের উপরোক্ত চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই লাভবান হয়েছিল । কিন্তু ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হল , তখন ভারত কৌশলে ১৯৫৮ সালের চুক্তির আংশিক পরিবর্তন করে । অবিশ্বাস্য হলে সত্য যে , তখন ধর্মনিরপেক্ষ ভারত সরকার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে চুক্তির আংশিক পরিবর্তন এর গুরুত্ব বাংলাদেশ সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল । এক্ষেত্রে ভারত সরকারের বক্তব্য ছিল ১১.২৯ বর্গ কিলোমিটারের দক্ষিণ বেরুবাড়ী এবং ৬.৮৪ বর্গ কিলোমিটারের ৪ছিট মহল বাংলাদেশ পেয়েছে , ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী ৯০% হল হিন্দু জনগণ । আবার ভারত যে দহগ্রাম - আঙ্গরপোতা পেয়েছে তার ৮০% এর বেশি হল মুসলিম জনগণ । অতএব দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৮.৬৮ বর্গ কিলোমিটারের দহগ্রাম - আঙ্গরপোতা পুনরায় বাংলাদেশের অংশ হয়ে যাবে এবং বেরুবাড়ী ও ৪টি ছিটমহল পুনরায় ভারতের অংশ হয়ে যাবে । ভারতের এ প্রস্তাবটি ছিল ১৯৫৮ সালের নুন - নেহেরুর চুক্তির মূল স্পিরিটের বাইরে । কারণ ছিটমহগুলোর সাথে সরাসরি কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় ১৯৫৮ সালের চুক্তিতে পাকিস্তান তার অংশে অবস্থিত ভারতের ছিটমহল এবং ভারত তার অংশ অবস্থিত পাকিস্তানের ছিটমহলের সার্বভৌমত্ব পেয়ে যায় , যা ইতিপূর্বে চুক্তির ১০ নং ধারায় আলোচনা করা হয়েছে । এখন ভারতের নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী দহগ্রাম - আঙ্গরপোতা বাংলাদেশের মালিকানায় চলে আসলেও সরাসরি যোগাযোগের অভাবে এর উপর বাংলাদেশের মূলত কোন সার্বভৌমত্ব থাকবে না ।

ভারতের কৌশলের কাছে বাংলাদেশ পরাস্ত হয় এবং ১৯৭৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশ বেরুবাড়ী ও ৪টি ছিটমহল ভারতকে দিয়ে দেয় এবং পুনরায় দহগ্রাম - আঙ্গরপোতা ভারত হতে গ্রহণ করে । এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার , আমাদের অনেকেই এমনভাবে বলেন যে , “শেখ মুজিব ভারতকে বেরুবাড়ী দিয়ে দেন । ” আসলে বক্তব্যটি অর্ধ সত্য । বরং সত্য হল তিনি বেরুবাড়ীকে দহগ্রাম - আঙ্গরপোতার সাথে বিনিময় করেছেন । উপরোক্ত চুক্তিতে আরও একটি সিদ্ধান্ত হয় , দহগ্রাম - আঙ্গরপোতার সাথে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশকে একটি তিন বিঘা করিডোর (১৭৮মিটার * ৮৫ মিটার ) লীজ দেয়া হবে । চতুর ভারত সরকার চুক্তি করে বেরুবাড়ী নিয়ে যায় কিন্তু কোর্টে মামলার মাধ্যমে তিন বিঘা লীজ প্রদানের বিষয়টিকে বন্ধ রাখে । ফলে বাংলাদেশ চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত দহগ্রাম - আঙ্গরপোতার সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে পারে না এবং স্বাভাবিক ভাবেই দহগ্রাম - আঙ্গরপোতার মানুষ শিক্ষা , স্বাস্থ্য , সংস্কৃতি , যোগাযোগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভারতের উপর নির্ভর হয়ে পড়ে ।

তিন বিঘা করিডোর লীজ হিসেবে না পেলে দহগ্রাম এবং আঙ্গরপোতার সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ সম্ভব হবে না । ১৯৭৪ সালে চুক্তি হওয়ার পর লীজ নিয়ে ভারত সরকার কালক্ষেপন করতে থাকে । শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসে লীজের ধারা নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি হয় । কিন্তু কুচলিবাড়ী , ধপারহাট ও মেখলিগন্জ এর জনগণ লীজ দেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করল (যার ভিতরে ভারত সরকারের ইন্ধন ছিল ) । তারা কুচলিবাড়ী সংগ্রাম কমিটি ও তিনবিঘা সংগ্রাম কমিটি নামক দুটি সংগঠন তৈরী করে লীজের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলল এবং একই সাথে কোর্টে রীট করল । কোর্টে তাদের বক্তব্য ছিল এ লীজের ফলে তিন বিঘার উপর ভারত সরকারের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে , বাংলাদেশ হতে অবৈধ Migration হবে , বাংলাদেশের সৈন্য , অস্ত্র ইত্যাদি এ পথে চলবে , যা তাদের জনজীবনে হুমকি সৃষ্টি করবে । শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালে কোর্টের রায়ের মাধ্যমে তিনবিঘা করিডোরের একটি সমাধান আসে । কিন্তু সমাধানটি বাংলাদেশের জন্য খুব ভাল হয়নি । শুধুমাত্র দিনের বেলায় এবং প্রতি ২য় ঘণ্টায় করিডোর খোলা থাকবে । অর্থাৎ দিনের বেলায় দহগ্রাম - আঙ্গরপোতার সাথে বাংলাদেশের মূল অংশের ১ ঘণ্টা পরপর যোগাযোগ থাকবে কিন্তু রাতের বেলায় কোন সুযোগ থাকবে না । করিডোরের চারটি কর্ণারে ভারতের ফ্লাগ থাকবে । এ ব্যবস্থাগুলো করা হয়েছে তিন বিঘার উপর ভারতের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব রয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য । কিন্তু আজ আমরা ভারতকে ২৪ ঘণ্টার জন্য বেনাপোল হতে আখাউরা হয়ে ভারতে , বেনাপোল হতে তামাবিল হয়ে ভারতে যাওয়ার করিডোর দিচ্ছি । সারা দেশটাকে আমরা করিডোর দিতে রাজী । কিন্তু ভারত আমাদেরকে মাত্র তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টার জন্য দিতে রাজী নয় , দিনের আলোয় ১২ ঘণ্টা দিতেও রাজী নয় বরং দিনের আলোয় ১ ঘণ্টা পর পর দিতে রাজী । কারণ হিসেবে ভারতীয়দের যুক্তি হল সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হবে , অবৈধ Migration হবে , চোরাকারবারী বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি । কিন্তু সারা দেশটাকে করিডোর দিলে আমাদের কী হবে ? আমাদের কি সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হবে না ? অবৈধ Migration হবে না ? চোরাকারবারী বৃদ্ধি পাবে না ?

তথ্য সূত্রঃ

(1) India Bangladesh Relatioship Documents .

(2) 110 – Cooch Behar: The Mother of All Enclave Complexes .

(3) Agreement on border disputes (with joint communiqué).Signed at New Delhi, on 10 September 1958 .

বিষয়: বিবিধ

৪৮৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File