ক্ষুদ্র ঋণ এবং কিছু কথা ।
লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৭:৩৩:১৬ সন্ধ্যা
বিত্তহীন লোকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের কথা আজ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে । বিশেষকরে তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা আলোচিত হচ্ছে । এক্ষেত্রে ডঃ ইউনুসের মাধ্যমে দারিদ্রতা দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণের বিষয়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পায় । বিভিন্ন সংস্থাগুলো ৮০ এর দশক হতে তাদের ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম শুরু করে । এখন প্রশ্ন হলো তাদের এ কার্যক্রম দারিদ্র বিমোচনে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে , তা নিয়ে বিতর্ক আছে ।
আজকে অনেকে প্রশ্ন তুলেন , সত্যি কি N.G.O দের ক্ষুদ্র ঋণ দ্বারা দরিদ্র জনসাধারণ উপকৃত হতে পেরেছে ? আমরা যদি ঋণ বিতরণের ব্যবস্থাপনার দিকে লক্ষ্য রাখি , তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় , বর্তমান N.G.O রা হচ্ছে রবীন্দ্র যুগের কাবুলিওয়ালাদের মত । কাবুলিওয়ালারা ঋণ দেয় সুদ পাওযার জন্য । বর্তমানে N.G.O প্রতিষ্ঠানগুলো সেই কাবুলিওয়ালা , বেপারী , মহাজনদের স্থান দখল করেছে । যদিও তারা বলে থাকে , গ্রামীণ জনগণকে উৎপাদনশীল খাতে নিয়োগের মাধ্যমে তারা আর্থসামজিক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে । কিন্তু ভেবে দেখলে এটা সহজে বলা যায় , তারা কোন উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রদান করে না ।
গ্রামীণ ব্যাংক , আশা , ব্র্যাক , প্রশিকা বা যে কোন N.G.O প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণের দিকে আপনি নজর দিন । তারা মহিলাদেরকে বা পুরুষদের কোন গ্রুপ ছাড়া ঋণ প্রদান করে না । ৫ জন বা ৭জন বা ৮জনের গ্রুপ তৈরী করতে হয় ঋণ পাওয়ার জন্য । যদি কোন ব্যক্তি পালিয়ে যায় বা মারা যায় , তবে গ্রুপের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সে ঋণ পরিশোধ করবে । অর্থাৎ N.G.O দের কোণ ঋণ মার যাওয়ার সম্ভাবনা নেই । এজন্যই N.G.O দের ঋণ পাওয়ার জন্য অন্যান্য ব্যাংকের মত জামানত দেয়ার প্রয়োজন নেই । এক্ষেত্রে গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরা হল সম্মিলিতভাবে এক অন্যের জামানত । অতএব এটা বলা যায় যে , ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়ার জন্য N.G.O দের কোন জামানত দিতে হয় না , বক্তব্যটি মোটেই ঠিক নয় বরং গ্রুপের প্রতিটি সদস্য সম্মিলিতভাবে একে অন্যের জামানত ।
এরপর মনে করেন একজন সদস্য ৫০০০ টাকা ঋণ পেল , যেখানে সুদের হার ১৫%। অর্থাৎ এ ঋণ সম্পূর্ণ ১ বছর হাতে রেখে পরিশোধ করলে তাকে সুদ হিসেবে বছরে ৭৫০ টাকা পরিশোধ করতে হবে । কিন্তু ঋণ দেয়ার সময় বাধ্যতামূলক সঞ্চয় হিসেবে ৫০০ টাকা কেটে নিল । ফলে ঋণ গ্রহীতা পেল ৪৫০০ টাকা । কিন্তু তাকে সুদ দিতে হচ্ছে ৭৫০ টাকা । ফলে ৪৫০০ টাকার ভিত্তিতে ৭৫০ টাকা সুদ দেয়ার কারণে সুদের ১৫% হতে বেড়ে ১৬.৬৭% হয় । আবার ঋণ নেয়ার পরবর্তী সপ্তাহে ১ম কিস্তি পরিশোধ করতে হয় । এভাবে ৫২টি কিস্তি পরিশোধ করতে হয় , যেখানে সুদ ও আসলে প্রতি কিস্তির টাকার পরিমাণ হল ১১১ টাকার মত । কিন্তু গাণিতিক নিয়মে ১৫% সুদ দিতে হলে পুরো ৫০০০ টাকা ১ বছর ঋণ গ্রহীতার হাতে থাকতে হবে । কিন্তু ২৬ কিস্তি দেয়ার পর তার কাছে ঋণের টাকা থাকার পরিমাণ অর্ধেকে চলে আসে , কিন্তু সুদ দিতে হয় পুরো ৫০০০ টাকার উপর । তাই N.G.O দের বাস্তব সুদের হার ১৫% হতে অনেক বেশি হয় । অর্থাৎ সুদের হারের দিক হতে N.G.O রা হল কাবুলিওয়ালাদের নতুন রূপ ।
উপরের আলোচনায় দেখা যায় , ঋণ গ্রহণের পর ১ সপ্তাহ পর পর কিস্তি পরিশোধ করতে হয় । যদি ১ সপ্তাহ পর পর কিস্তি পরিশোধ করতে হয় , তবে কিভাবে পুরো ৫০০০ (প্রকৃতপক্ষে ৪৫০০ ) টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা যাবে ? এক্ষেত্রে এ টাকার একটি অংশ কিস্তি পরিশোধের জন্য রেখে দিতে হয় । তাহলে দেখা গেল যে , ঋণ গ্রহীতরা ঋণের টাকা কোন উৎপাদনশীল খাতে লাগাতে পারে না । বরং এ টাকা ব্যবহৃত হয় ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বা ক্ষুদ্র ব্যবসা খাতে । যদি ক্ষুদ্র ঋণের অর্থ উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ হত , তবে তা গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটি পরিবর্তন আনতে পারত । কিন্তু N.G.O দের ঋণ ব্যবস্থাপনার কারণে তা উৎপাদন খাতে কাজে না লেগে বরং ব্যবসা খাতে কাজে লাগে । ব্যবসা খাতের অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে । কিন্তু আমাদের দারিদ্রতা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ । আমাদের উৎপাদন খাত হতে ব্যবসাখাতে পূজি বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েছি , যা ঋণ গ্রহীতার আর্থিক আয়ের বৃদ্ধিকে শোষণ করে নিয়েছে । একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে । একজন দরিদ্র ব্যক্তি ৫০০০ টাকা ঋণ নিয়ে ফেরি ব্যবসা (সব্জি বা মাছ বা অন্যকিছু )শুরু করল । যেহেতু ফেরি ব্যবসার মাধ্যমে পণেরে প্রাপ্যতা সহজলভ্য করে তুলে সেহেতু চাহিদার পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায় । উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ ব্যতীত এ ধরনের চাহিদা বৃদ্ধি পণ্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ঘটায় । ফলে N.G.O কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক আয়ের যে বৃদ্ধি ঘটে , তার একটি অংশ মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যায় এবং অপর অংশ নিঃশেষ হয় সুদ প্রদানের মাধ্যমে । এখন প্রশ্ন হল , দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক আয়ের বৃদ্ধির পেছনে N.G.O দের ভূমিকা কতটুকু ? গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে , সেখানে মহিলারা ধানের কলে বা ক্ষুদ্র কারখানায় , পুরুষরা একই পেশায় বা অনেকে রিক্সা চালিয়ে আয় উপার্জন করে । গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধানের কল বা ক্ষুদ্র কারখানা হওয়ার পিছনে কারণ হল প্রতিটি সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে অবকাঠামোর উন্নয়ন , গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুত পৌঁছে যাওয়া ইত্যাদি । আর এ সমস্থ কার্যক্রমের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে , তার মাধ্যমে সৃষ্ট আয়ের একটি অংশ N.G.O রা সুদের মাধ্যমে নিজেদের পকেটে নিয়ে যাচ্ছে । যদি গ্রামে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ না হত , তবে এক গ্রাম হতে আরেক গ্রামে মানুষ পায়ে হেটে যেত , রিক্সায় যেত না । কিন্তু রাস্তা-ঘাট হওয়ায় রিক্সা চলে এবং যে রিক্সা চালায় সে প্রতি সপ্তায় ১৩০ টাকার মত কিস্তি N.G.O দের প্রদান করছে । পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ঋণ নিলে সে কিস্তির পরিমাণ আরও বেশি হবে । অর্থাৎ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের সুফল সুবিধাবাদী N.G.Oরা কিস্তির মাধ্যমে দরিদ্র লোকদের নিকট হতে নিয়ে যাচ্ছে । যদি সরকারের কাজের মাধ্যমে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ না হত বা বিদ্যুত না আসত তবে N.G.O রা এসমস্ত দরিদ্র লোকদের ঋণ প্রদান করত না , কারণ তা পরিশোধের কোন সুযোগ থাকত না । পূর্বে দরিদ্র জনগণের ঋণের পরিমাণ কম ছিল । এখন তারা গ্রামীণ ব্যাংক হতে ঋণ নিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করে আশা হতে ঋণ নিয়ে , আশার ঋণ পরিশোধ করে ব্র্যাক হতে ঋণ নিয়ে , ব্র্যাকের ঋণ পরিশোধ করে প্রশিকা হতে ঋণ নিয়ে , প্রশিকার ঋণ পরিশোধ করে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছে যাওয়া কণ্যা সন্তানের নামে নতুন ঋণ নিয়ে । এরা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধের জন্য এবং রাতের বেলায় একটু সুখ করে ঋণের টাকায় কেনা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখে । ঋণের টাকায় মেয়ের জামাইকে যৌতুক দিল , বিয়ের পর শুরু হল কঠোর পরিশ্রম , যৌতুকের টাকা সুদসহ পরিশোধ করা । N.G.O দের আগমণে যৌতুকের (যেমন খাট , টেবিল চেয়ার , সাইকেল , ) পরিমাণ বেড়ে গেল , কারণ ছেলেপক্ষ বলে ঋণ নিয়ে যৌতুক দিয়ে দাও । আজ গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণের প্রায় সবাই ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ । আমাদের দরিদ্র জনসাধারণের মাথাপিছু আয়ের একটি অংশ N.G.O দের পকেটে চলে যায় । তাই সরকারকে নজর দিতে হবে তার উন্নয়নমূলক কাজের সুফল যাতে দরিদ্র জনসাধারণ ভোগ করতে পারে । আর এজন্য N.G.O দের কার্যক্রম সরকারকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । এক্ষেত্রে ডঃ ইউনুস কোন সমস্যা নয় , বরং সমস্যা হল তার ক্ষুদ্র ঋণের বেড়াজাল । ডঃ ইউনুসের মত পূজিপতিরা জানেন দরিদ্র লোকদের বড় অংকের ঋণ প্রদান করলে ঋণের টাকা ফেরত আসবে না । এক্ষেত্রে তাদেরকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে তা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা সুদ সহ ১০০% হলে , ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প একটি লাভজনক প্রকল্প হবে । তাই ডঃ ইউনুস সমস্যা নয় , সমস্যা হল গ্রামীণ ব্যাংক , আশা , প্রশিকা , ব্র্যাক ইত্যাদি সংস্থার কার্যক্রম ।
বিষয়: বিবিধ
৪৬১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন