'মুনতাসীর নামা'
লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:৫৬:৫৩ রাত
লেখাটি সোনার বাংলা ব্লগে লিখেছিলাম । টুডে ব্লগের পাঠকদের জন্য আবারও লেখাটি কিছুটা পরিবর্তন করে দিলাম । যদি ভাল লাগে তবে শেয়ার করার অনুরোধ রইল ।
মুনতাসীর মামুন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে এক পায়ে দাড়িয়ে এবং বর্তমানে তিনি ট্রাইবুনালে স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন । কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ ‘দৈনিক জনকন্ঠ’ পত্রিকায় লেখায় মনের অজান্তে প্রমাণ করে দিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ৭২-৭৫ সালে হয়ে গিয়েছে । যে বিচার ৭২-৭৫ সালে হয়ে গিয়েছে, সে বিচার বর্তমানে আবার কেন হবে ? বিচার কি দু’বার হয় ? ঐ সময় যাদের নামে কোন মামলা ছিল না, তাদেরকে নিয়ে ৪০ বছর পর নতুন মামলা দিয়ে বিচার করাটা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয় ? আজকের তরুণরা যদি ইতিহাস জানত, তবে বলত ৭২-৭৫ সালে যাদের বিরুদ্ধে কোন দোষ আবিষ্কার করা যায়নি ৪০ বছর পর দোষ আবিষ্কার হল কিসের ভিত্তিতে ?
যে কোন দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় । যেমন নুরেমবার্গ ট্রায়াল ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং ১৯৪৯ সালের ভিতর বিচার শেষ হয়ে গিয়েছিল । বিচারে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন কিন্তু পলাতক, তাদেরকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেখানেই শাস্তির বিধান কার্যকর করা হয়েছিল, হতে পারে এই শাস্তি কার্যকর হতে সময় লেগেছে বিচার শেষ হওয়ার ১০ বছর পরে বা আরও পরে । কিন্তু বিচার হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই । বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না । তার প্রমাণ করে দিলেন মুনতাসির মামুন দৈনিক জনকন্ঠ’ পত্রিকায় ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে কলাম লিখে । তিনি যা লিখেছেন তার সারমর্ম হল, ‘যারা সত্যিকারের যুদ্ধ অপরাধী, বিশেষকরে গণহত্যা করেছে, লুটতরাজ করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে তাদের ক্ষমা করা হয়নি । ১৯৭১-৭২ সালে পত্রিকা উল্টালে প্রায় প্রতিদিন চোখে পড়ে দালালদের বিচার এবং তাদের গ্রেফতারের এবং বিচারের খবর । দেখা যাবে অনেকের কারাদন্ড দেয়া হচ্ছে, এমনকি মৃত্যুদন্ড দেয়া হচ্ছে । সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪১ হাজার দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে, চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে ১৬ হাজারের বিরুদ্ধে, মুক্তি পেয়েছে ৫ হাজার, মামলা দায়ের করা হয়েছে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে । অপরাধীদের যাতে সুষ্ঠু বিচার হয়, সে জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও সে সময়ের নামকরা তরুণ ও প্রবীণ আইনজীবিদের যুক্ত করেছিলেন ।’ এতগুলো কথা লিখার পর মুনতাসীর মামুন এরপর লিখলেন , ‘যারা বলেন বঙ্গবন্ধু আলবদর ও খুনীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, তা কত নির্জলা মিথ্যা তার প্রমাণ হল দ্বিতীয় সংশোধনী । যেখানে বলা হয়েছে, অত্র আদেশের অনুকম্পা (ক্ষমা) ব্যক্তিদের প্রতি এবং অপরাধসমূহের প্রতি প্রযোজ্য হবে না -
(১) আলবদর বা আল শামস সংগঠনের সদস্য হইয়া যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বলিয়া কথিত ।
(২) রাজাকার কমান্ডার হইয়া যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বলিয়া কথিত ।
(৩) দালাল আমলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কর্মকর্তা হইয়া যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বা কথিত ।
(৪) মুক্তিযুদ্ধাদের তৎপরাতা বা সংগঠন দমনে বা পার্থিব সুবিধা আদায়ের মানসে যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বা কথিত ।
এ ছাড়াও বলা হয়েছিল যে, অবশ্য মুক্তির শর্ত হইবে যে, তাহারা উপরোক্ত আদেশের বাইরে বিচারযোগ্য এবং শাস্তিযোগ্য অন্যকোন অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় ।
১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় ।’ পাঠকগণ মুনতাসীর মামুনের উপরের কথাগুলো চিন্তা করুন । উপরের ‘মুনতাসীর নামা’ বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত সত্যগুলো বেড়িয়ে আসে -
(১) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ৭২-৭৫ সালে হয়ে গিয়েছে এবং অনেকেই শাস্তি প্রাপ্ত হয়েছে, এমনকি মৃত্যুদন্ডও হয়েছে ।
(২) দালাল আইনে যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়নি । বরং যারা সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের ক্ষমা করা হয়নি ।
(৩) সরকারি আদেশে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে নয় । তৎকালীন সরকার নির্বাহী আদেশে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করল কিন্তু তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন আদালতে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ বা অগ্নিসংযোগের কোন মামলা দায়ের করতে পারল না । তাহলে আজ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে এত মামলা আসল কিভাবে ? ৭২-৭৫ সালে কি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী সরকার ছিল ? জনগণ ঐ সময় কি ভয়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে নাই ? বা যারা মামলা দায়ের করেছে,তারা এখন ৪২ বছর পর বুঝতে পেরেছে, তাদের বাবা, মা, ভাই, বোন ৭১ সালে গোলাম আযমের হাতে শহীদ হয়েছেন ! তাছাড়া গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করাটা যে অবৈধ ছিল, তা বাংলাদেশের আদালত তাঁর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে দিল ।
(৪) বাংলার দরিদ্র সন্তানেরা যারা সামান্য মাসিক কয়টি টাকার বিনিময়ে পুরাতন রাষ্ট্রিয় কাঠামোর ভিতর টিকে থাকার জন্য রাজাকারে ভর্তি হল, তাদেরকে বিচার প্রক্রিয়ায় আনা হল এবং শাস্তি দেয়া হল কিন্তু যে সমস্ত থানা সার্কেল অফিসারসহ উচ্চ পদস্ত অফিসাররা যারা ‘রাজাকার’ এর নিয়োগ দিয়েছিল, তাদেরকে বিচারের প্রক্রিয়ায় আনা হয়নি । বরং এই অফিসাররা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সচিব হয়েছেন, যারা সাধারণের নিকট সি , এস , পি অফিসার নামে পরিচিত ।
এখন প্রশ্ন হল ৭২-৭৫ সালে বিচার হয়ে গেল, তাহলে আবার বিচার কেন ? তখন গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদি, আব্দুল কাদের মোল্লা, সালাহউদ্দিন কাদের সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত হলেন না কেন ? যদি তখন তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা থাকত এবং তা যদি শেষ না হত, তবে বর্তমানে কেন সে মামলা চালু করা হল না ? কেন নতুন করে মামলা চালু করা হল ? আর যারা মামলা চালু করল, তাদের বয়স ৭১ সালে ৪/৫ হতে ১৫/১৬ বছর ছিল । অর্থাৎ যারা এখন স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, ৭১ সালে তারা শিশু বা কিশোর ছিল । আর শিশু -কিশোরদের স্বাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ্বন্ড । প্রকৃত সত্য হল আজ যাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে তাদের উপর ৭২-৭৫ সালে কোন মামলাই ছিল না ।
৭১ এ যে মানবতা বিরোধী কাজ হয়েছে, অবশ্যই তার বিচার হতে হবে । আর এ বিচার ৭২ হতে ৭৫ এর মধ্যে বেশ ভালভাবেই হয়ে গিয়েছে । ৭২ হতে ৭৫ পর্যন্ত বিচার এর দুটি সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় । একটি হল প্রচলিত আইনে বিচার এবং অপরটি হল ব্যক্তিগত আইনে বিচার । তখন ব্যক্তিগত আইনে বিচার করে অসংখ্য শান্তিকমিটির সদস্য বা রাজাকার যারা ইসলামপন্থি ছিল তাদেরকে হত্যা করা হয় । কাদের সিদ্দিকীর মত ব্যক্তিও ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকায় জনসমক্ষে বিদেশী সাংবাদিকের সামনে ৪ জন পাকিস্তানপন্থিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন, যা সে সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচারিত হয়, বর্তমানে YOU TUBE এ দৃশ্যটি দেখতে পাবেন । (তথ্যসূত্রঃ ‘মূলধারা ৭১’ মঈদুল হাসান , পৃঃ ২২০ , আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল , ২য় খন্ড , পৃঃ ৫৮৭) । বাজারে রাজাকারদের দড়ি দিয়ে বেধে এবং লটকিয়ে হত্যা করা হয়, দৃশ্যটি দেখতে পাবেন “আত্মঘাতী রাজনীতি তিনকাল ” বইয়ের ২য় খন্ডে ।
প্রচলিত আইনেও বিচার করা হয়েছিল । বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারী কলাবরেটার্স আইন প্রণয়ন করেন । এ আইনে প্রায় ৩৭,০০০ লোক গ্রেফতার করা হয় । মাওলানা ভাসানী, অলি আহাদ এসমস্থ বিচারের তীব্র বিরোধীতা করেন । তারা বন্দীদের মুক্তি দাবী করেন ।এসব নেতারা দালাল আইন বাতিল করার জন্য শেখ মুজিবকে আল্টিমেটাম দেন । এ তথ্যগুলো পাবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার স্বামী জনাব ওয়াজেদ মিয়া লিখিত “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” বই এর ১৬৪ ও ১৬৫ পৃষ্ঠায় । পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর মাসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন । কিন্তু চারটি অপরাধ ক্ষমা করেননি । এগুলো হল হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠণ এবং অগ্নিসংযোজন । সাধারণ ক্ষমায় ৩৭,০০০ হতে প্রায় ২৬,০০০ ছাড়া পেলেন । কিন্তু উপরোক্ত চারটি অপরাধের জন্য ১১,০০০ আটকা পরলেন । ১৯৭৪ সালের ভিতরে ১১,০০০ হাজারের মধ্যে ২,৮৪৮ জনের বিচার কার্যক্রম শেষ করা হয় । প্রায় ২১০০ জন নির্দোষ প্রমাণিত হন । ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হন । (‘বাংলাদেশে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম’ মুনতাসীর মামুন , জয়ন্ত কুমার রায় , পৃঃ ৬২, দৈনিক সমকাল ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩)। এদের মধ্যে ৩ জনের ফাঁসীর আদেশ হয় । ২ জন পলাতক ছিলেন । কুষ্টিয়ার রাজাকার চিকন আলীর ফাঁসী কার্যকর হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু চিকন আলী হাইকোর্টে আপীল করলে মৃত্যুদ্বন্ড হ্রাস পেয়ে যাবজ্জীবন কারাদ্বন্ড হয় । পরে চিকন আলী ৮ বছর সাজা খাটার পর ক্ষমা পান এবং ২০০৩ সালে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন (দৈনিক সমকাল ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩) । এ বিচারে শহীদুল্লা কায়সারের হত্যা মামলায় জামায়াতের খালেক মজুমদারের কারদন্ড হয়েছিল । কিন্তু হাইকোর্টে আপিল করে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হোন । “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” বই এর ১৪৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ডাঃ মালিকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় ।”
উপরে তৎকালীন সময়ে কিছু শাস্তির উদাহরণ দিলাম । এভাবে আরও অনেকে শাস্তি পেয়েছেন । কিন্তু ৭২-৭৫ সালে শাস্তির তালিকায় কোন জামায়াত নেতার নাম ছিল না । তবে সে সময় সমস্ত মামলার সমাধান হয়নি । সমাধান হয়েছিল প্রায় ৩০০০ মামলা, যা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে । বাকী ৮,০০০ এর বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে থাকে এবং ১৯৭৫ সালে ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল হয়ে যায় । তাহলে এটিতো পরিষ্কার, ৭২ হতে ৭৫ এর মধ্যে ব্যক্তিগত বিচারে এবং প্রচলিত বিচারে রাজাকারদের হত্যা করা হয়েছে । সেখানে আজকের নিজামী, মুজাহি , সাঈদী, কাদের মোল্লা, সাকা চৌধূরী বেঁচে গেলেন কিভাবে ? কেন সে সময় তাদের বিরুদ্ধে একটিও মামলা দায়ের করা হল না ? শহীদুল্লাহ কায়সারের পরিবার স্বাধীনতার পর পরই খালেক মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারল, গভর্ণর মালিকের শাস্তি হল, গোলাম আযমের নাগরিকত্ব গেল, আর নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধূরীরা অসংখ্য লোকদেরকে হত্যা করল, কিন্তু এই অসংখ্য লোকদের পরিবার তাদের বিরুদ্ধে একটিও মামলা দায়ের করল না ! আর আরও মজার ব্যাপার হল নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধূরীরা ৭১ সালে অসংখ্য মানুষ মারল, ধর্ষণ করল কিন্তু তাদের নামে ৭২ হতে ৭৫ সাল পর্যন্ত কোন পত্রিকায় কোন প্রতিবেদন আসেনি এবং মামলা দায়ের করা হলো ২০০৯ সালে, এই ২০০৯ সালের আগ পর্যন্তও পত্রিকাগুলো শুধু রাজাকার বলল, কিন্তু কোন গণহত্যার প্রতিবেদন দিতে পারল না ! যদি সে সময় কেউ একটি মামলা দায়ের করত, তবে আজ নতুন করে মামলা আমলে নেয়ার প্রয়োজন ছিল না, পুরাতন মামলাকে জীবিত করলেই চলত । ১৯৭৬ সালের দিকে জিয়াউর রহমানের কারণে যে মামলাগুলো বন্ধ হয়ে (প্রকৃত পক্ষে মামলাগুলো কোন মেরিট ছিল না) গিয়েছিল, সেগুলো চালু করলে তো কারো কোন প্রশ্ন থাকত না । কিন্তু সমস্যা হল ঐ মামলাগুলোতে গোলাম আযম,নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, কাদের মোল্লা, সাকা চৌধূরী কারো নাম নেই । তাই ঐগুলো চালু করে নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কোন লাভ নেই ।
আজ ৪০ বছর পরের তরুণরা যে সময়টি দেখেনি, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও নাস্তিকতাবাদী বুদ্ধিজীবিদের মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডায় তারা বিশ্বাস করে ইসলামপন্থিরা মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল । আজ যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলছেন, তারা সামনে ব্যানার রেখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’, প্রকৃত পক্ষে এরা আদর্শের দিক হতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও নাস্তিকতাবাদী চিন্তার অনুসারী । মুনতাসীর-শাহরীয়ারদের নিয়ে চিন্তা করলেই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে । আজকে নতুন প্রজন্মকে এরা এমন ধারণা দিচ্ছেন, তৎকালীন পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলাই হল যুদ্ধাপরাধ ! আর এই মুনতাসীর-শাহরীয়াররা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেনি, বরং রাজধানী ঢাকায় বসে পাকিস্তান বাহিনী হতে সুবিধা নিয়েছে । আজ যারা পাকিস্তাতান নাম শুনলেই আঁৎকে উঠেন, তাদের কাছে প্রশ্ন হল ১৯৪৭ হতে ৭১ পর্যন্ত এ রাষ্ট্রের নাম কী ছিল ? ১৯৪৭ সালের পূর্বে কি পৃথিবীর মানচিত্রে ‘পাকিস্তান’ নামে কোন রাষ্ট্রের অস্থিত্ব ছিল ? বরং ১৯৪৭ সালে শেরে বাংলা, সোহরোয়ার্দী, আবুল হাশিম, নাজিম উদ্দিন, আকরাম খাঁ এবং তৎকালীন নতুন প্রজন্ম অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান , গোলাম আযমদের প্রচেষ্টায় পূর্ব বাংলা , পান্জাব , বেলুচিস্তান , সিন্ধু , উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান । সোজা কথা ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে যোগ দেয়নি । বরং তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল । বর্তমান প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়লে বুঝা যায়, তিনিসহ বাংলার জনগণ তখন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য কী পরিমাণ আত্মত্যাগ করেছিল । এই বইতে ২৩ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, হিন্দু বন্ধু ননীকুমার দাস এর থাকার ঘরে বসার কারণে ননীকুমারের কাকীমা তাকে (ননীকে) গালমন্দ করেন এবং ঘরটি পানি দিয়ে বারবার পরিষ্কার করেন । একই পৃষ্ঠায় লিখেছেন, হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারেও বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল । ৪৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ''অখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম । পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন ?'' বইটি সবাইকে পড়ার অনুরোধ করলাম । ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্য নতুন সংবিধার রচনার উদ্দেশ্যে । শুধু তাই নয় ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাত পর্যন্ত পাকিস্তানের নতুন সংবিধান কী হবে, তা নিয়ে আওয়ামিলীগের খসড়া পিপলস পার্টি এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খান মেনে নিবে বলে শেখ মুজিবের আশা ছিল । আশা ছিল বলেই শেখ মুজিবুর রহমান, ২৫ শে মার্চ রাত সাড়ে ১০ টার সময় ডঃ কামাল হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ‘পীরজাদার কোন ফোন এসেছে কিনা ?’ কিন্তু সমঝোতার পরিবর্তে সামরিক সরকার কর্তৃক সামরিক আইন জারী হলে প্রশ্ন আসে রাষ্ট্র ভাঙ্গার । তখন কেউ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করলেন এবং কেউ পুরাতন রাষ্ট্রিয় কাঠামো পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করলেন । এখন পুরাতন রাষ্ট্রিয় কাঠামো পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তবে পাঠকদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে একটু বিবেচনায় আনতে হবে -
(১) বিচারপ্রতি আব্দুস সাত্তার ৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন । নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের আনুগত্য না করে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে আসলে বাংলাদেশ জীবন বীমা কর্পোরেশনের পরিচালক মন্ডলীর চেয়ারম্যান (১৯৭৩-৭৪) এবং সংবাদ পত্র বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান (১৯৭৪-৭৫) হলেন । তখন আওয়ামিলীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়একজন পাকিস্তানপন্থীকে এসব পদে নিয়োগ দিলেন ? বিচারপ্রতি আব্দুস সাত্তার ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন মুনতাসীর, শাহরীয়াররা কোন প্রতিবাদ বা হরতাল করেছিলেন ? (তথ্যসূত্রঃ বাংলা পিডিয়া ) ।
(২) শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন । তিনি স্বাধীনতার মাত্র ৮ বছর পর ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি হয়েছিলেন । শুধু তাই নয় পাকিস্তান হতে আসার পর বাংলাদেশে যখন তিনি জেলে বন্দী ছিলেন, সে সময় তার পরিবারকে শেখ মুজিবুর রহমান ৩ হাজার টাকা মাসিক ভাতা দিতেন এবং পরে জেল হতে মুক্ত করে দেন । (তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো ২৬ শে মার্চ , ২০০৮) । সে সময়ের প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিল, তারা কেন এসব বিষয় নিয়ে সারা দেশে বিক্ষোভ -প্রতিবাদ করেন নাই ? শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রি হওয়ার কারণে সে সময়ের আওয়মিলীগের ৩৯ জন সংসদ সদস্য কেন সংসদ বর্জন করলেন না ?
(৩) পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থানকারী আব্দুস সবুর খান গোলাম আযমের চেয়েও বড় নেতা ছিলেন । ৭১ এর সামরিক সরকারের উপর তার প্রভাব খুব বেশি ছিল । কিন্তু তিনিও স্বাধীনতার মাত্র ৮ বছর পর ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বিরোধী দল 'মুসলিম লীগ' এর সদস্য হিসেবে একাই খুলনার ৩টি আসন হতে বিজয়ী হয়েছিলেন । (তথ্য সূত্রঃ বাংলাপিডিয়া) । পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থানকারী শান্তি কমিটির লোকেরা যদি এতই খারাপ হত, তবে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষকারী ১৯৭৯ সালের জনগণ সবুর খানকে কিভাবে ৩টি আসন হতে বিজয়ী করলেন ?
(৪) স্বাধীনতার মাত্র ৮ বছর পর ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামিলীগ পেল ৩৯টি আসন, নাস্তিকদের দল কম্যুনিষ্ট পার্টি কোন আসন পায়নি, অন্যদিকে ৭১ এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থানকারী মুসলিম ডেমোক্রেটিক দল ২০ টি আসন পেল কিভাবে ? তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষকারী ১৯৭৯ সালের জনগণ এদেরকে ৭১ এর ঘাতক মনে করেনি ?
(৫) মাওলানা ভাসানী, অলি আহাদ এর মত লোকেরা ৭২ হতে ৭৫ সাল পর্যন্ত ৭১ এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থানকারী লোকদের বিচারের তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন । তারা দালাল আইন বাতিলের দাবী তুলেছিলেন । যদি ইসলামপন্থিরা আজকের চিন্তাধারা অনুযায়ী ঘাতক হতেন, তাহলে আমাদেরকে এটা কি বিশ্বাস করতে হবে মাওলানা ভাসানী, অলি আহাদ ঘাতকদের পক্ষে ছিলেন ? আসলে তারা ভাল করেই জানতেন, ইসলামপন্থিরা ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রিয় কাঠামোয় বিশ্বাসী হলেও কোন ধরনের হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন না । তাদের ভারত বিরোধী চেতনাই বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে । অলি আহাদ তাঁর “জাতীয় রাজনীতি” বইয়ে স্বীকার করেছেন, শান্তি কমিটির সদস্যরা অনেক লোককে সেনাবাহিনীর হাত হতে বাঁচিয়েছে । এখানে তরুণ প্রজন্মের খটকা লাগে, তাহলে এত হত্যাকান্ড, যা শুনে এসেছি, তা করল কে ? এজন্য নেতাজী শুভাষ চন্দ্র বসুর নাতীন শর্মিলা বসুর বই “ডেড রেকনিং” পড়ার অনুরোধ করছি । অনলাইনে বইটি পাওয়া যাবে । এ ব্যাপরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রি তাজুল ইসলাম ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ BD NEWS 24 কে বলেন অফিসিয়াল গেজেট অনুযায়ী শহীদ মুক্তিযুদ্ধার সংখ্যা হল ২,৩৩৯ (দুই হাজার তিনশত ঊনচল্লিশ) জন ।
(৬) ৭২-৭৫ সালে বিচার করার পরও আবারও যদি ৪০ বছর পর বিচার করতে হয়, তবে ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের বিচার দিয়ে এ বিচার শুরু হল না কেন ? ১৪ ডিসেম্বর এর বুদ্ধিজীবিদের কাদের সিদ্দিকী (২৭/৯/২০১১ ইং তারিখে ‘দৈনিক আমার দেশ’) এবং শেখ মুজিবুর রহমান (‘মুক্তিযুদ্ধঃ আগে ও পরে ’ পৃঃ ১৬৩ , পান্না কায়সার) উভয়ই দালাল বলেছেন । তাহলে কি এদের বিচার এজন্য করা হয়নি যে, বিচার করলে প্রকৃত হত্যাকারী পাকিস্তানী আর্মি না ভারতের আর্মি না অন্য কেউ, তা বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকে ? এ ব্যাপারে বিশদ জানতে হলে আমার “বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড” পড়ার অনুরোধ রইল ।
(৭) মানবেন্দ্র লারমা, সন্তু লারমা ১৯৭৫ সাল হতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভেঙ্গে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করার জন্য অসংখ্য বাঙ্গালী নারী-পুরুষ-শিশুদের হত্যা করল । এরা পাবর্ত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করতে ব্যর্থ হয়ে তথাকথিত শান্তি চুক্তির মাধ্যমে দেশে ফিরে আসল । কিন্তু তাদের মাধ্যমে সংঘটিত হত্যাকান্ডের কোন বিচার হল না । অন্যদিকে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত না হয়ে পুরাতন রাষ্ট্রিয় কাঠামোয় থাকার অপরাধে ইসলামপন্থিদের ৪০ বছর পর মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে ।
সময়ের ব্যবধানে মিডিয়া শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে । এটা ঠিক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে শক্তি ছিল, কিন্তু ২০১৩ সালে কোন সচেতন ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী নয়, এমনকি যারা ৭১ এ বিরোধীতা করেছে তারাও, তবে নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর কথা ভিন্ন । কারণ এরা এখনও ৭১ নিয়ে কাঁদে, কিন্তু সীমান্তে ফেলানীর লাশ দেখে এরা কাঁদে না !
বিষয়: বিবিধ
৬৩৬৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন