একই সাথে রোজা রাখা এবং ঈদ করা !
লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ০৫ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:৩৫:৪৬ রাত
সারা বিশ্বে একই সাথে রোজা রাখা ও ঈদ করা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে । অবশ্য এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিম হাজারো বছর ধরে মুসলিমদের ইজমা অনুযায়ী যার যার অঞ্চলের চাঁদ দেখে রোজা রাখা ও ঈদ করার উপর আমল করে যাচ্ছেন । তবে শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে কোনটি সঠিক ? এ বিষয়টি নিয়েই আজকের এই লেখা ।
প্রকৃত সত্য হল, চাঁদ দেখে রোজা রাখা এবং চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গা অর্থাৎ ঈদ করা । আর যেহেতু পৃথিবীর সমস্ত এলাকায় একই সাথে বা সময়ে চাঁদ উঠে না সেহেতু একই সাথে বা সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র রোজা রাখা বা ঈদ করা সম্ভব নয় । যদি এটা কেউ বলতে পারেন, পৃথিবীর সমস্ত এলাকায় একই সাথে বা সময়ে চাঁদ উঠে তবে অবশ্যই মেনে নেয়া যেতে পারে একই সাথে বা সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র রোজা রাখা বা ঈদ করা সম্ভব ।
মুসলিমদের মধ্যে কোন সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান হল কুরআন ও সুন্নাহ । কুরআন ও সুন্নাহ বলে দেয় সমস্যার সমাধান । আর যেহেতু রাসুলে পাক (সঃ) এর সাহাবীরা (রাঃ) কুরআন-সুন্নাহর মানদ্বন্ডে উত্তির্ণ সেহেতু তাদের ইজমা আমাদের নিকট শরীয়াহ আইনের দলিল হিসেবে গণ্য হবে । তাদের ইজমাকে অস্বীকার করে নিজেদের মনমত ব্যাখ্যা কোন মুসলিমদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয় । তাই আমার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সীমাবদ্ধ থাকবে কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীদের আমলের উপর ভিত্তি করে ।
প্রথমে আমি দলিল আনব হাদীস হতে । প্রশ্ন উঠতে পারে কুরআন হতে প্রথমে কেন আনলাম না । এর কারণ হল, যারা একই দিনে রোজা ও ঈদে বিশ্বাসী, তারা হাদীসের একটি শব্দের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন । তাই আলোচনাটা রাসুলে পাক (সঃ) এর হাদীস হতে শুরু করলাম -
(১ম হাদীস) ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, আমি রসুলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা (রমযানের) চাঁদ দেখলে রোজা রাখ আর (শাওয়ালের) চাঁদ দেখে ইফতার কর (রোজা ভাঙ্গ / ঈদ কর) । আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে (ত্রিশ দিন) হিসেব কর । (বুখারী , মুসলিম ) । এই হাদীসের বক্তব্য অসংখ্য বর্ণনাকারীর মাধ্যমে এসেছে । তাই এটি মুতাওয়াতি হাদীস এবং মুতাওয়াতি হাদীস সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই । অতএব এটি নিশ্চিত হল যে, চাঁদ দেখে রোজা রাখতে হবে এবং চাঁদ দেখে ঈদ করতে হবে । সেই ১৪০০ বছর পূর্ব হতে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মুসলিম যার যার এলাকায় চাঁদ দেখে রোজা রেখেছেন এবং ঈদ করেছেন । কিন্তু খুবই অল্প সংখ্যক মুসলিম চিন্তাবিদ মনে করেন, পৃথিবীর সর্বত্র একই সাথে রোজা রাখা এবং ঈদ করা যায় । এক্ষেত্রে তারা হাদীসের “তোমরা” শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন , এটি দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমকে বুঝানো হয়েছে, কোন অঞ্চলের বা এলাকার মুসলিমকে বুঝানো হয়নি । ফলে পৃথিবীর কোন অঞ্চলের মুসলিমরা চাঁদ দেখলে, তা পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য হবে অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বত্র একই সাথে রোজা রাখতে হবে এবং ঈদ করতে হবে । এ বক্তব্যটি মেনে নেয়া যেত যদি পৃথিবীর সর্বত্র একই সাথে চাঁদ উঠে । কিন্তু সূর্যোদয় যেভাবে পৃথিবীর সর্বত্র একইসাথে হয় না তেমনি চাঁদের উদয় সর্বত্র একই সাথে হয় না । বরং চাঁদের উদয় প্রথমে পৃথিবীর পশ্চিম অংশে হয় এবং পরে ক্রমান্বয়ে তা পূর্ব দিকের দিকে ধাবিত হয় । যেমন মরোক্কর অধিবাসীরা যেদিন ১ম চাঁদ দেখবে তার ২ বা ৩ দিন পর বাংলাদেশে ১ম চাঁদ দেখা যাবে । তাহলে মরোক্কর মানুষের চাঁদ দেখা আর বাংলাদেশের মানুষের চাঁদ দেখা একই সময়ে হল ? যদি এরকম হত যে, পৃথিবীর সর্বত্র একই সময়ে চাঁদ উঠে, তবে বলা যেত যে, মরোক্কয় যেদিন ১ম চাঁদ দেখা গিয়েছে, সেদিন বাংলাদেশেও চাঁদ দেখা যাবে, যদি দেখা না যায় তবে ধরে নিতে হবে যে, আকাশ পরিষ্কার না থাকার কারণে তা দেখা যায়নি । অতএব মরোক্কর চাঁদ দেখা বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের চাঁদ দেখা হয়ে যাবে । সুতরাং একইসাথে রোজা রাখতে ও ঈদ করতে বাধা নেই । কিন্তু বাস্তব সত্য হল পৃথিবীর সর্বত্র একই সময়ে চাঁদ উঠে না । আর আকাশের যে প্রান্তে চাঁদ উঠে সেখান হতে ৪৮০ মাইলের ভিতরে তার বিস্তৃতি ঘটে অর্থাৎ ৪৮০ মাইলের ভিতরে পূর্ব দিকের কোন দেশ সে চাঁদ দেখতে পারবে । সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মরোক্কর আকাশে নতুন চাঁদের সৃষ্টি হলেও হাজার হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশের আকাশে বা মরোক্কর আকাশ হতে ৪৮০ মাইল দূরবর্তী পূর্ব দিকের দেশের আকাশে নতুন চাঁদের সৃষ্টি হয়নি । তাহলে মরোক্কর চাঁদ দেখা বাংলাদেশের উপরে কেন বর্তাবে ? বরং প্রকৃত সত্য হল, মরোক্কর মুসলিমরা তাদের নতুন চাঁদ দেখে রোজা রাখবে এবং ঈদ করবে এবং বাংলাদেশের মুসলিমরা তাদের নতুন চাঁদ দেখে রোজা রাখবে এবং ঈদ করবে । অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বত্র একই সাথে রোজা রাখা এবং ঈদ করা শরীয়তের নীতির বাইরে । এখানে “তোমরা” বলতে অবশ্যই অতীত, বর্তমান এবং কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলিমকে বুঝানো হয়েছে । আবার “তোমরা” শব্দের সাথে যোগ হয়েছে “চাঁদ দেখলে” শব্দ দুটি । এই শব্দ দুটি (“চাঁদ দেখলে”) যোগ হওয়ার পর “তোমরা” শব্দের সাথে শর্ত আরোপিত হয়েছে । মনে করুন বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ১০০ জন মুসলিম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে । অতএব এখানে “তোমরা” বলতে ১০০ জন মুসলিমকে বুঝানো হয়েছে । এই ১০০ জন মুসলিমের মধ্যে ২০ জন মুসলিম পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান করে, যাদের আকাশে চাঁদ দেখা দিল । এখন “তোমরা চাঁদ দেখলে” বলতে এই ২০ জন মুসলিমকে বুঝানো হয়েছে, বাকী ৮০ জনকে বুঝানো হয়নি, কারণ তাদের আকাশে আরও ১ বা ২ দিন পর নতুন চাঁদ দেখা দিবে । এভাবেই “চাঁদ দেখলে” শব্দ দুটি যোগ হয়ে “তোমরা” শব্দটির অর্থ সংকুচিত হয়েছে । আরও একটি উদাহরণ দিচ্ছি, কোন সেনা প্রধান তাঁর ১৫০০ সৈনিককে আদেশ করলেন দুপুরের খাওয়ার সাথে সাথে তোমরা আমার অফিসে চলে আসবে । এখানে তোমরা বলতে ১৫০০ সৈনিককে বুঝানো হয়েছে । ধরি ঐ সেনা সদরে প্রতি ব্যাচে ৫০০ সৈনিক খেতে পারে । এখন ১ম ব্যাচের ৫০০ সৈনিক তাদের খানা শেষ করেই সেনা প্রধানের অফিসের দিকে রওয়ানা দিল এবং বাকী ১০০০ সৈনিককে বলল ‘চল সেনা প্রধানের অফিসে’ ? ১ম ব্যাচের ৫০০ সৈনিকের এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে কি আমাদের খাওয়ার সাথে সাথে তোমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছে ? যদি মরোক্কর বা সৌদি আরবের চাঁদ দেখা বাংলাদেশের চাঁদ দেখা হয়ে যায়, তবে অবশ্যই ৫০০ সৈনিকের খাওয়ার সাথে সাথে ১০০০ সৈনিকের খাওয়া হয়ে গিয়েছে ধরে নিতে হবে । আসলে এটা কোন যুক্তির মধ্যে পড়ে কি ?
(২য় হাদীস) উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত , তিনি বলেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যখন রাত আসে দিন শেষ হয়ে যায় এবং সূর্য ডুবে যায় তখনই রোজাদার ব্যক্তি ইফতার করবে । ” (মুসলিম , মিশকাত) । এখানে রাসূল (সাঃ) রোজাদার বলতে কোন এলাকার রোজাদারকে বোঝান নাই, তিনি সমস্ত পৃথিবীর রোজাদারকে বুঝিয়েছেন । এখন বাংলাদেশের মানুষ সূর্যাস্ত দেখল, তাই তারা ইফতারের সিদ্ধান্ত নিল । এখন কি এটা বলা যাবে, বাংলাদেশের মানুষ যখন সূর্যাস্ত দেখেছে , তখন অবশ্যই মরোক্ক বা সৌদি আরবের লোকদের ইফতার করতে হবে ? যদি এটা বলা না যায়, তবে আমরা কিভাবে বলব মরোক্ক বা সৌদি আরবের আকাশে চাঁদ দেখা দিলে বাংলাদেশের মানুষ রোজা রাখবে বা ঈদ করবে ? অতএব আমরা বলতে পারি যারা সমস্ত পৃথিবীতে একই সাথে রোজা রাখা বা ঈদ করার কথা বলছেন, তারা “তোমরা” শব্দের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন । বরং “তোমরা” শব্দটির অর্থ “চাঁদ দেখা” বা “সূর্য ডুবার” সাথে যোগ হয়ে সংকুচিত হয়েছে, যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে ।
(৩য় হাদীসঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন , নবী করিম (সাঃ) এর নিকট এক বেদুইন আসিয়া বলিল আমি চাঁদ অর্থাৎ রমযানের চাঁদ দেখিয়াছি । হুযুর (সাঃ) তাহাকে জিজ্ঞাস করিলেন , তুমি কি এই স্বাক্ষ্য দাও যে , আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই ? সে বলিল , হ্যাঁ । পুনরায় হুযুর (সাঃ) জিজ্ঞাস করিলেন, তুমি কি স্বাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল? সে বলিল হ্যাঁ । হুযুর (সাঃ) বলিলেন, হে বেলাল লোকদের মধ্যে ঘোষণা করিয়া দাও, তাহারা যেন (কাল) রোযা রাখে । (তিরমিযি, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ, নাসায়ী )
(৪র্থ হাদীসঃ কুরাইব (রঃ) থেকে বর্ণিত , হারিসের কন্যা উম্মুল ফযল তাকে সিরিয়ায় মু’আবিয়ার (রাঃ) নিকট পাঠালেন । ----আমি জুমআর রাতে রমযানের চাঁদ দেখতে পেলাম । অতঃপর মাসের শেষের দিকে আমি মদীনায় ফিরে এলাম । আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) রোযা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কখন চাঁদ দেখেছ ? আমি বললাম আমিতো জুমআর রাতেই চাঁদ দেখেছি । তিনি পুনরায় জিজ্ঞাস করিলেন, তুমি নিজেই কি তা দেখেছো ? আমি বললাম, হ্যাঁ, অন্যান্য লোকরাও দেখেছে এবং তারা রোযা রেখেছে । এমনকি মু’আবিয়া (রাঃ) রোযা রেখেছেন । তিনি বললেন, আমরা তো শনিবার(পাঠকদের সুবিধার জন্য আরবী বারের পরিবর্তে শনিবার শব্দটি লেখা হয়েছে) রাতে চাঁদ দেখেছি, আমরা ত্রিশটি রোযা রাখব অথবা এর আগে যদি চাঁদ দেখতে পাই তাহলে তখন ইফতার (রোজা ভাঙ্গা বা ঈদ করা) করব । আমি বললাম, আপনি কি মু’আবিয়া (রাঃ) চাঁদ দেখা ও রোজা রাখাকে যথেষ্ট মনে করেন না ? তিনি (ইবনে আব্ববাস(রাঃ)) বললেন, না, রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে এভাবেই (চাঁদ দেখে রোজা রাখা ও ইফতার করা) নির্দেশ দিয়েছেন । (মুসলিম, তিরমিযি, আবুদাউদ, নাসায়ী)
যারা একই দিনে রোযা রাখা এবং ঈদ করার পক্ষে তারা উপরের ৩য় হাদীসকে দলিল হিসেবে পেশ করেন । তাদের মতে ৩য় হাদীস হতে বুঝা যায় যে, রাসুল (সাঃ) এবং তার সাহাবীরা রমযানের চাঁদ দেখেননি । অন্য এলাকার একজন বেদুইনের স্বাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁরা রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেন । সুতরাং নিজ এলাকায় চাঁদ না উঠলেও অন্য কোন এলাকায় চাঁদ উঠলে রোযা রাখা যাবে । আবার ৪র্থ হাদীসটি তাদের বক্তব্যের বিপরীত হওয়ার কারণে তারা যুক্তি দেখান যে, এটি ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ব্যক্তিগত ইজতিহাদ এবং তা রাসুল (সাঃ) এর ১ম হাদীসের বিপরীত হওয়ার কারণে বাতিলযোগ্য । আবার তাদের অনেকে বলেছেন, ১জন স্বাক্ষী হওয়ায় ইবনে আব্বাস (রাঃ) কুরাইব (রঃ) এর বক্তব্য গ্রহণ করেননি । যদি ২জন স্বাক্ষী থাকত, তবে ইবনে আব্বাস (রাঃ) সিরিয়ার সাথে মিল করে রোজা রাখতেন এবং ঈদ করতেন ।
কিন্তু আমরা যারা একই সাথে রোজা রাখা বা ঈদ করার পক্ষে নই, তারা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, উপরের দুটি হাদীস মিলিয়ে পড়লে প্রমাণ হয় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা যার যার চাঁদ দেখে রোযা রাখতে হবে এবং ঈদ করতে হবে । এটা ঠিক, ৩য় হাদীস হতে বুঝা যায় যে, রাসুল (সাঃ) এবং তার সাহাবীরা রমযানের চাঁদ দেখেননি । অন্য এলাকার একজন বেদুইনের স্বাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁরা রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেন । এখন একজন বেদুইন পায়ে হেটে বা উটে চড়ে, এমনকি ঘোড়ায় চড়ে রাতের কয়েক ঘণ্টায় কতটুকু পথ অতিক্রম করতে পারে ? রাসুল (সাঃ) এর নিকট এটা পরিষ্কার ছিল যে, বেদুইন যে দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছে তাতে সে যে জায়গায় চাঁদ দেখেছে, তা মদীনার জন্য প্রযোজ্য হবে । যেমন চ্ট্টগ্রামে চাঁদ দেখা গেল না , কিন্তু নোয়াখালীতে চাঁদ দেখা গেলে ধরে নেয়া যেতে পারে যে, চট্টগ্রামেও চাঁদ আছে কিন্তু মেঘ বা অন্য কোন কারণে দেখা যায়নি । আর এখানে রাসুল (সাঃ) ১ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন । এটা হতে বুঝা যায় যে, সে সময় মদীনার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল । আর এটাও আমরা জানি যে, যেখানে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তা হতে ৫ মাইল দূরে আকাশ পরিষ্কার থাকতে পারে । আর যেহেতু বেদুইন রাতেই খবর দিয়েছে, সেহেতু সে মদীনা হতে খুব বেশি দূরে ছিল না । ৩য় হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে আব্বাস (রাঃ) । যদি বেদুইন খুবই দূর হতে আসত (যা ঐ সময়ের বাস্তবতায় সম্ভব নয় ), যেখানে চাঁদ উঠলে মদীনার চাঁদ উঠার কোন সম্ভাবনা থাকে না, তাহলে ইবনে আব্বাস (রাঃ) অবশ্যই ৪র্থ হাদীসে সিরিয়ার সাথে মিল রেখে রোজা রাখতেন (১টি রোযা কাযা আদায়) এবং ঈদ করতেন ।
এখানে ৩য় হাদীসের বর্ণনাকারী হলেন ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং ৪র্থ হাদীসে সিদ্ধান্তকারী ছিলেন ইবনে আব্বাস (রাঃ), উভয়ই একই ব্যক্তি । ৩য় হাদীস বলে দেয়, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) দেখেছেন রাসুল (সাঃ) রমযানের চাঁদের ব্যাপারে একজন বেদুইনের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন । তাহলে তিনি কেন একজন তাবেয়ী কুরাইব (রঃ) এর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করবেন না ? তাছাড়া ৪র্থ হাদীসের বক্তব্য লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে, তিনি কুরাইব (রঃ) বক্তব্যকে বিশ্বাস করেছিলেন । অতএব যারা বলেন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) একজন স্বাক্ষী হওয়ায় কুরাইব (রঃ) এর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেননি, তাদের এ বক্তব্য ঠিক নয় । ৪র্থ হাদীসকে যারা ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ব্যক্তিগত ইজতেহাদ বলেছেন, তাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান নাই বললেই চলে । ৪র্থ হাদীসে পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে যে , “ আমরা তো শনিবার রাতে চাঁদ দেখেছ , আমরা ত্রিশটি রোযা রাখব অথবা এর আগে যদি চাঁদ দেখতে পাই তাহলে তখন ইফতার (রোজা ভাঙ্গা বা ঈদ করা) করব । আমি বললাম, আপনি কি মু’আবিয়া (রাঃ) চাঁদ দেখা ও রোজা রাখাকে যথেষ্ট মনে করেন না ? তিনি বললেন, না, রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে এভাবেই (চাঁদ দেখে রোজা রাখা ও ইফতার করা) নির্দেশ দিয়েছেন ।” অর্থাৎ এটি ইজতেহাদ নয় বরং রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ । এই হাদীস আমাদেরকে বলে দেয় যে, পৃথিবীর সর্বত্র একইসাথে রোযা রাখা বা ঈদ করা সম্ভব নয় । হাদীসটি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে , যা হল ইবনে আব্বাস (রাঃ) সিরিয়ার চাঁদ দেখাকে মদীনার জন্য কোন গুরুত্ব দেননি । সে সময় মদীনায় কোন সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর মতের বিরোধীতা করেননি । আবার সিরিয়ার চাঁদ দেখার খবর শোনার পরও ইবনে আব্বাস (রাঃ) ১টি রোজা (১ম রোযা) কাযা আদায় করেননি এবং সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক রেখে ঈদ করেননি, তা যদি শরীয়তের নীতির বাইরে হত, তাহলে মু’আবিয়া (রাঃ) যিনি খুব বড় একজন ফকীহ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন, তিনি কেন পরবর্তীতে ইবেনে আব্বাস (রাঃ) এর নিকট এর কৈফিয়ত চাইলেন না ? যেহেতু তৎকালীন সমস্ত জীবিত সাহাবারা ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বক্তব্যের বিরোধীতা করেননি, তাই এটি নিঃসন্দেহে ধরা যেতে পারে যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর সিদ্ধান্ত রাসুল (সাঃ) এর নীতি অনুযায়ী হয়েছে । অতএব আমরা বলতে পারি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় যার যার চাঁদ দেখে রোজা রাখবেন এবং ঈদ করবেন, এটি রাসুল (সাঃ) সুন্নাহ এবং সাহাবীদের ইজমা ।
পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর পানাহার করতে থাকো যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয় । তখন এসব কাজ ত্যাগ করে রাত পর্যন্ত নিজের রোযা পূর্ণ কর । ” এখন মরোক্ক বা সৌদি আরবের চাঁদ দেখা যদি বাংলাদেশের চাঁদ দেখা হয়, তবে এ আয়াত হতে আমরা বলতে পারি কি বাংলাদেশে যখন রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হবে তখন বাংলাদেশের মত মরোক্ক বা সৌদি আরবের সেহরীর সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে ? অথচ মরোক্ক বা সৌদি আরবে তখনও রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হতে অনেক দেরী আছে । যদি উত্তর না হয়, তবে আমরা বলব মরোক্ক বা সৌদি আরবের চাঁদ দেখা হলেও তা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয় ।
পবিত্র কুরআন শরীফে উল্লেখ আছে, “অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন সিয়াম (রোযা) পালন করে ।” (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) । কুরআনের এ আয়াত সকল বির্তকের অবসান করেছে । এখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে” অর্থাৎ বিশ্বের সকল মুসলিম একই সময়ে এ মাসে প্রবেশ করে না । যেমন পশ্চিম দিগন্তের মরোক্কর অধিবাসীরা বাংলাদেশের কমপক্ষে ২ দিন পূর্বে রমযান মাসে প্রবেশ করে, তাই তারা বাংলাদেশের ২ দিন পূর্বে রোযা রাখবে। আবার বাংলাদেশের মুসলিম মরোক্কর ২দিন পর রমযান মাস পায়, তাই বাংলাদেশ মরোক্কর ২দিন পর রোযা রাখবে । এ আয়াতের এই ব্যাখ্যাই মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমীন (রঃ), মওলানা মুহাম্মদ মুশাহিদ (রঃ), আব্দুল হামিদ ফাইজিসহ অনেকেই দিয়েছেন ।
বর্তমান সময়ে একটি বিভ্রান্তি হল প্রযুক্তির ভিত্তিতে ইবাদাতের বিভিন্ন কার্যগুলো নির্ধারণ করা । আমাদের একটি বিষয়ে বুঝে নিতে হবে যে, ইসলামের ইবাদাতগুলো প্রযুক্তি নির্ভর নয় । তবে এটা ঠিক যে, প্রযুক্তি ইবাদাত পালনকে সহজ করে দিয়েছে । যেমন ইসলাম বলেছে, সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত ফযর নামাজের সময় থাকে । ইসলামের এ সিদ্ধান্ত প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত নয় । কারণ সূর্যোদয় খালি চোখে প্রত্যক্ষ করা যায় । এখন বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে আমরা জানতে পারলাম ভোর ৫ টার সময় সূর্যোদয় হয় । অতএব ফযরের নামাজ ভোর ৫ টার পূর্বে পড়ে নিতে হবে । এভাবে প্রযুক্তি ইবাদাত পালকে সহজ করে দিয়েছে । কিন্তু ইসলামের মৌলিক বিধান হল, ‘ সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত ফযর নামাজের সময় থাকে ।’ প্রযুক্তি এই মৌলিক বিধান পরিবর্তন করতে পারে না । একইভাবে কুরআন-হাদীস অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে , ‘চাঁদ দেখে রোযা রাখতে হবে এবং চাঁদ দেখে ঈদ করতে হবে ।’ অর্থাৎ ইসলামের মৌলিক বিধান হল ‘চাঁদ দেখা’ এবং হাদীসের ‘রূইয়াত’ শব্দ বলে দেয় চাঁদ চর্ম চোখে দেখতে হবে । প্রযুক্তি এ মৌলিক বিধানকে পরিবর্তন করতে পারে না । প্রযুক্তি আমাদেরকে এতটুকু বলতে পারে যে, কোন এলাকায় চাঁদ দেখা গেলে, তা হতে ৪৮০ মাইলের ভিতরে ঐ চাঁদ দেখা যাবে । অতএব আমরা এতটুকু সিদ্ধন্ত নিতে পারি যে, কোন এলাকায় চাঁদ দেখা গেলে, তা ঐ এলাকা হতে ৪৮০ মাইলের ভিতরে প্রযোজ্য হবে, যার ব্যাপারে অধিকাংশ আলেমরা একমত । কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরের পশ্চিম দিগন্তের মরোক্কর বা সৌদি আরবের বা অন্য কোন দেশের লোকজনের ‘চাঁদ দেখা’ কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের ‘চাঁদ দেখা’ হবে, যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ উঠতে আরও ২ বা ১ দিন সময় লাগবে । এজন্যই আল্লাহপাক বলেছেন , “অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন সিয়াম (রোযা) পালন করে ।” (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) ।
ধরে নেয়া হল যে, প্রযুক্তির সহায়তায় পৃথিবীর সর্বত্র একই সাথে রোযা রাখা এবং ঈদ করা হবে । ফলে মরোক্কয় চাঁদ উঠার খবর প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে গেল । ফলে মরোক্ক সোমবার সন্ধ্যা বেলায় চাঁদ দেখলে বাংলাদেশও মরোক্কর মত মঙ্গলবার হতে রোযা রাখা শুরু করল । কিন্তু যখন প্রযুক্তি ছিল না, তখন বাংলাদেশের জনগণ বুধবার বা বৃহস্পতিবার হতে রোযা রেখেছিল । তাহলে কি আমরা বলতে পারি, যখন প্রযুক্তি ছিল না তখন বাংলাদেশের জনগণ প্রতিটি রমযান মাসের ১ বা ২ দিন (আলোচ্য উদাহরণে মঙ্গলবার, বুধবার) রোযা রাখেনি ! আবার ঈদের দিন রোযা রাখা হয়েছিল ! প্রযুক্তি আসার পর আমরা এ ভুল হতে রেহাই পেলাম !
মরোক্ক বাংলাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত এবং সময়ের পার্থক্য ৬ ঘণ্টা । মরোক্ক যদি তাদের সন্ধ্যা ৭টা ঘটিকায় চাঁদ দেখে, তবে এ সংবাদ বাংলাদেশে আসবে রাত ১ঘটিকায় এবং জাপানে আসবে ভোর রাত ৪ঘটিকায় । এখন প্রশ্ন হল রাত ১ঘটিকায় চাঁদ দেখার খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার কিভাবে তার সমগ্র জনগোষ্ঠিকে জানাবে তোমরা সেহরী খেয়ে রোযা রাখ ? এতে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ সেহরী খাওয়া হতে বঞ্চিত হবে এবং অনেকেই ভোরে পানাহার করে বেরোজদার হবে । আবার জাপানের মুসলিম জনগোষ্ঠির সেহরীর শেষ সীমা ভোর ৪টা হলে তারা নিশ্চিতভাবেই বেরোযদার হবে, চাঁদ দেখার খবর না জানার কারণে । আবার একইসাথে বাংলাদেশ ও জাপানের মুসলিমদের রমযানের রাতের সালাত (তারাবীহ) আদায় হবেনা । মরোক্ক বা পশ্চিমের দেশগুলো প্রতিটি রমযান মাসে পুরো রাত্রি রাতের সালাত (তারাবীহ) আদায় করতে পারল, সেখানে বাংলাদেশ, জাপানসহ পূর্বের অনেক দেশ রমযান মাসের ১ম রাতের সালাত (তারাবীহ) আদায় হতে বঞ্চিত হল । এতে কী বাংলাদেশ, জাপানসহ পূর্বের দেশগুলো কিছু অতিরিক্ত সওয়াব হতে বঞ্চিত হল না ? যারা পৃথিবীর কোন এক যায়গায় চাঁদ দেখলে সর্বত্র রোযা রাখা বা ঈদ করার কথা বলেন, তাদের কাছে এ সব প্রশ্নের উত্তর কী হবে ? যাদের ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে জানা আছে, তারা ভাল করেই জানেন ইসলাম কোন কিছু কঠিন করে না, সহজ করে দেয় । ২য় খলীফা হযরত উমর (রাঃ) এর সময় ডাক বিভাগ চালু হয় । কিন্তু ২য় খলীফা হতে কারো সময় এটা শোনা যায়নি যে , তারা দূরবর্তী কোন অঞ্চলের চাঁদ দেখা গিয়েছে কিনা, তা জানার জন্য কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা ? যদি পদক্ষেপ নিতেন তবে মদিনার পশ্চিমে কোন এলাকায় মদীনার ১ দিন পূর্বে চাঁদ দেখা গিলে তাঁরা ১ দিনের রোযা কাযা করতেন । কিন্তু এ ধরনের নজির ইসলামের ইতিহাসে নেই । অর্থাৎ ১৪০০ বছর ধরে মুসলমানদের মধ্যে ইজমা হয়ে গেছে, যার যার চাঁদ দেখে রোযা রাখবে এবং ঈদ করবে ।
ইসলামের ইবাদাতগুলো প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় তা আগেই বলেছি । সালাতের সময়গুলো সূর্যের অবস্থানের উপর নির্ভর করে দেয়া হয়েছে । আবার রোযা রাখার বিষয় চন্দ্র ও সূর্যের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে । সূর্যের সহায়তায় সুবহে সাদিক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা রাখা হয় । প্রশ্ন হল চন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত করা হল কেন ? কারণ হল রমযান মাসকে শনাক্ত করার জন্য । সূর্যের মাধ্যমে কোন মাসকে শনাক্ত করা যায় না । মনে করুন, আপনি জানুয়ারি মাসের তারিখ ভুলে গেলেন । তাহলে জানুয়ারি মাস কোন দিন শেষ হবে, তা আপনি নির্ধারণ করতে পারবেন না । কিন্তু ইসলামের মাসগুলো চন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত । তাই একজন মূর্খ ব্যক্তি শাবান মাসের কোন্ তারিখ তা না জানলেও নতুন চাঁদ দেখে রমযান মাস নির্ধারণ করতে পারে । আবার রমযান মাসের শেষে চাঁদ দেখে শাওয়াল মাস নির্ধারণ করতে পারবে । অতএব কোন মুসলিম, সে যদি দারুল কুফরে বা দারুল হরবে অবস্থান করে, অথবা এমন এলাকায় বসবাস করে যেখানে দ্রুত সংবাদ পৌঁছার কোন ব্যবস্থা নেই, সে তাঁর এলাকার চাঁদ দেখে রমযান মাস শনাক্ত করতে পারবে এবং রোযা রাখতে পারবে । এব্যাপারে তাবেয়ী আবুল বাখতারী (রঃ) বলেন, “একবার আমরা ওমরা করার জন্য বাহির হইলাম । যখন আমরা বাতনে নাখলা নামক স্থানে অবতীর্ণ হইলাম সকলে মিলিয়া চাঁদ দেখিতে লাগিলাম । লোকের মধ্যে কেহ বলিল, ইহা তিন দিনের চাঁদ আর কেহ বলিল ২ দিনের চাঁদ । পরে আমরা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর সহিত সাক্ষাত করিলাম এবং বলিলাম, আমরা রমযানের চাঁদ দেখিয়াছি । কিন্তু লোকের মধ্যে কেহ বলে, উহা তিন দিনের চাঁদ আর কেহ বলিল ২ দিনের চাঁদ । তিনি বলিলেন তোমরা কোন রাতে চাঁদ দেখিয়াছ ? আমরা বলিলাম অমুক রাতে । তখন তিনি বলিলেন রাসুল (সঃ) তারিখ ধরিতেন যে রাত্রিতে (চাঁদ) দেখিতেন । সুতরাং উহা সেই রাত্রিরই চাঁদ যে রাত্রে তোমরা দেখিয়াছ ।” (মুসলিম, মিশকাত) এই হাদীস হতে স্পষ্ট যে রাতে চাঁদ উঠবে, সে রাত হতে নতুন মাসের তারিখ গণনা করতে হবে । এক্ষেত্রে এক এলাকার চাঁদ অন্য এলাকার জন্য প্রযোজ্য নয় । যদি প্রযোজ্য হত, তবে ইবনে আব্বাস (রাঃ) তার নিজ এলাকার চাঁদ কবে উঠেছে, সে প্রসঙ্গটি আনতেন । কিন্তু তিনি তা না করে বরং জানতে চেয়েছেন, তোমরা কোন রাত্রে চাঁদ দেখেছ ? আজ যারা এক এলাকার চাঁদ অন্য এলাকায় প্রযোজ্য বলছেন, তারা কি রাসুল (সঃ) এর সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে অধিক বিজ্ঞ ?
যারা এক এলাকার চাঁদ অন্য এলাকায় প্রযোজ্য বলছেন, এরা সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোযা রাখেন এবং ঈদ করেন । যদি এক এলাকার চাঁদ অন্য এলাকায় প্রযোজ্য ধরে নিতে হয়, তবে কেন সৌদি আরবের চাঁদ দেখে রোযা রাখা হবে এবং ঈদ করা হবে ? কারণ সৌদি আরবের চেয়ে আরও পশ্চিমে অবস্থিত মরোক্ক সৌদি আরবের ১দিন পূর্বে চাঁদ দেখে বা দেখতে পারে । তাহলে সৌদি আরবকে অনুসরণ করতে হবে মরোক্ককে । যদি সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোযা রাখা বা ঈদ করার প্রয়োজন হত, তবে রাসুল (সঃ) “চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গ (ঈদ কর ) বলতেন না ।” তিনি বলতেন “ হেযায /মক্কা/মদীনার চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং হেযায /মক্কা/মদীনার চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গ (ঈদ কর ) । এটা কি তিনি বলেছেন ? সোজা কথা কুরআন-সুন্নাহ, সাহাবীদের ইজমা বলে দেয় পৃথিবীর সর্বত্র একসাথে রোযা রাখা সম্ভব নয় এবং ঈদ করাও সম্ভব নয় ।
কেউ কেউ বলেন,সারা বিশ্বে একসাথে রোযা রাখলে এবং ঈদ করলে মুসলিম বিশ্বে ঐক্য স্থাপিত হবে ? এসমস্ত জ্ঞান পাপীদের জানা উচিত মুসলিমদের ঐক্য নির্ভর করে ইসলামী বিধি-বিধান পালনের উপর, একইসাথে পালন করার উপর নয় । এরপরও তাদেরকে আমরা আহ্বান জানাই আপনারা আপনাদের উর্বর মস্তিষ্কের মাধ্যমে নির্ধারণ করুন কিভাবে পৃথিবীর সকল মুসলিম একই সাথে ফজরের সালাত সহ অন্যান্য সালাত, জুম’আর সালাত আদায় করতে পারে ? যদি এই সালাতগুলো একইসাথে পালনের কোন সুযোগ না থাকে, তবে আপনাদের ঐক্য এর যুক্তি কী হবে ? শুধু কি একইসাথে রোজা এবং ঈদ করলে ঐক্য হয়ে যাবে ?
কেউ কেউ যুক্তি দেখান, বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানে ছিল, তখন কিভাবে উভয় অঞ্চলে একই সাথে রোযা রাখা এবং ঈদ করা হয়েছিল ? আমার প্রশ্ন হল স্বৈর শাসক আইউব খানের সিদ্ধান্ত কি ইসলামী শরীয়ার উৎস ? তাছাড়া সে সময় মুফতী শফী (রঃ), মাওলানা মুশাহিদ (রঃ) সহ অসংখ্য আলেম এর চরম বিরোধীতা করেছিলেন ।
সারা বিশ্বে একসাথে রোযা রাখা এবং ঈদ করার পক্ষের লোকদের আরও একটি যুক্তি হল, যদি ২৭(বা অন্য কোন দিন) রমযান কদরের রাত্রি হয়, তবে সবাই কীভাবে কদরের রাত্রি পাবে ? আমার প্রশ্ন হল সারা বিশ্বে একসাথে রোযা রাখলে সবাই কি একই সময়ে কদরের রাত্রি পাবে ? ধরি মরোক্কয় ২৬ রোজা রাখার পর কদরের রাত্রি শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায় এবং ৯ ঘণ্টা পরের জাপানে কদরের রাত্রি শুরু হবে ভোর ৪টায় (একই সময় বিবেচনা করলে) । অর্থাৎ জাপানের মুসলিমরা কদরের রাত্রি হতে বঞ্চিত হল । কারণ জাপানে ৪টায় রাত্রি শেষ বা শেষ হওয়ারে নিকটবর্তী হয় । আবার যদি ধরে নেয়া হয় জাপান প্রথমে ২৬ রমযান শেষ করে সন্ধ্যা ৭টায় কদরের রাত্রিতে পৌঁছে গেল এবং ভোর ৪টায় তাদের কদরের রাত্রি শেষ হবে । এক্ষেত্রে ৯ ঘণ্টা পিছনের মরোক্কয় যখন সন্ধ্যা ৭টা হবে, তখন জাপান ভোর ৪টায় পৌঁছে যাবে । ফলে এক্ষেত্রে মরোক্ক কদরের রাত্রি হতে বঞ্চিত হবে । সবাই কীভাবে কদরের রাত্রি পাবে চিন্তা করতে গিয়ে আপনাদের হিসেবে জাপান অথবা মরোক্ক কদরের রাত্রি হতে বঞ্চিত হল ! প্রকৃত কথা হল, আল্লাহ দিন এবং দুনিয়ার দিন কি একই ? কদরের রাত্রি সবাই কীভবে পাবে, তা আল্লাহই ভাল জানেন । সবকিছুই যে আমাদের জানতে হবে বা আমরা এর ব্যাখ্যা পেয়ে যাব, তা আমরা কীভাবে বলতে পারি ? এমনও হতে পারে চাঁদের বয়স ২৬ দিন শেষ হলে কদরের রাত্রিতে পৌঁছা যায় । অতএব কোন এলাকার চাঁদের বয়স যখন ২৭ দিন হবে, তখন ঐ এলাকা কদরের রাত্রিতে পৌঁছে যাবে । যেমন মরোক্কয় চাঁদের বয়স ২৭দিন হলে মরোক্ক কদরের রাত্রিতে পৌঁছে যাবে তেমনি বাংলাদেশে চাঁদের বয়স ২৭ দিন হলে বাংলাদেশও কদরের রাত্রিতে পৌঁছে যাবে । প্রকৃত সত্য আল্লাহই ভাল জানেন ।
আমার শেষ কথা হল, যেখানে কুরআন-সুন্নাহ এবং সাহাবীদের ইজমা রয়েছে এবং ১৪০০ বছর ধরে মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত যার যার এলাকায় চাঁদ দেখে রোযা রাখবে এবং ঈদ করবে, সেখানে পৃথিবীর সর্বত্র একই সাথে রোযা রাখা এবং ঈদ করা বিতর্ক দিয়ে মুসলিমদের মধ্যে আরও একটি বিভেদ বাড়ানোর কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি ? আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ বুঝার তৌফিক দিন।
বিষয়: বিবিধ
৪৯৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন