বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড ।

লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ২১ জুলাই, ২০১৩, ০৮:০৮:৫৫ রাত

প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর আমরা বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবস পালন করি এবং দাবী করি বুদ্ধিজীবি হত্যাকারীদের বিচার । আর সবার কাছে হত্যাকারীরাও চিহ্নিত । এরা হলো পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের সহযোগী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী এবং জামায়াতে ইসলামী দলগুলোর নেতা- কর্মীরা । তবে পাকিস্তানী সৈন্যরা আর দেশে নেই, মুসলিম লীগ এবং নেজামে ইসলামীর অস্তিত্ত্ব তেমন একটি নেই, আছে শুধু জামায়াতে ইসলাম । তাই পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের সহযোগী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীর সব দায়-দায়িত্ব পড়েছে জামায়াতে ইসলামের উপর । এখন জামায়াতে ইসলামের নেতাদের বিচার করতে পারলে পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের সহযোগী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীরও বিচার হয়ে যাবে । বিচার করে জামায়াতে ইসলামীকে পাপমুক্ত করতে পারলে সাথে সাথে পাপমুক্ত হয়ে যাবে পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের সহযোগী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীও । সমস্যা হল এক গোলাম আযম ছাড়া সে সময়ের জামায়াতের মূল নেতারাও বেঁচে নেই । আর গোলাম আযমকেও জেলে নেয়ার মতও অবস্থা নেই , বেচারা এমনিতেই বৃদ্ধ মানুষ । তাই সে সময়ের ছোট নেতা বা পরে যারা দলে এসেছে তাদেরকে নিয়ে বিচার করলেই পূর্বতনদের পাপমুক্তি হবে বলে আশা করা যায় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাপকে একেবারে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার জন্য গোলাম আজম সাহেবকে জেলে নেয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে ৯০ বছরের জেল দেয়া হয়েছে, যার বর্ণনা বিচারের অনেক আগেই বিচারপতি স্কাইপিতে আলোচনা করেছেন ।

বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে বর্তমানে যারা তরুণ, তারা খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখেন ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবিদের এবং তাঁদের হত্যা করার জন্য ততধিক ঘৃণার চেখে দেখেন পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের । কিন্তু তাঁদের সে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার প্রতি বড় ধরনের আঘাত আনলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীরউত্তম) । আর তিনি অতি উচু মাপের মুক্তিযুদ্ধা হওয়ার কারণে, তাঁর কথার প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই । তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব পাবে কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য, নব্য গজিয়ে উঠা কোন মুক্তিযুদ্ধ প্রেমিকের নয় ।

২৭/৯/২০১১ ইং তারিখে ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকায় জনাব কাদের সিদ্দিকী লেখলেন , “১৩ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত যারা ঢাকায় থেকে পাকিস্তানিদের সেবা-যত্ন করে ১৪ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে হানাদারদের হাতে জীবন দিয়ে সবাই শহীদ বুদ্ধিজীবি হয়ে গেছেন, এটাত তেমন ব্যাপার । শহীদ বুদ্ধিজীবিদের যদি এতই বুদ্ধি থাকত তাহলে ঢাকায় থাকলেন কেন ? পাকিস্তানিদের বেতন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেন বুদ্ধিজীবিরা । ডিসেম্বর মাসেও পাকিস্তান সরকারের বেতন নিলেন কেন ? --- আর ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর রাজাকার , আলবদর এবং পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে যারা ঢাকায় নিহত হয়েছেন তারা দালাল বুদ্ধিজীবি ।” ১৪ই ডিসেম্বর এর শহীদ বুদ্ধিজীবিদের দালাল বুদ্ধিজীবি বলায় স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা বড় ধরনের আঘাত পাবে । এ আঘাত এতই খারাপ হতে পারে যে , তারা বর্তমানে যাদেরকে শ্রদ্ধার আসনে এবং যাদেরকে ঘৃণার আসনে বসিয়েছে, সে আসনগুলো সন্দেহপূর্ণ , সংশয়পূর্ণ হয়ে যাবে । তারা সমস্যায় উপনীত হবে কোনটি সঠিক ? আর এ জন্য জনাব কাদের সিদ্দিকীই দায়ী । কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর কেন তিনি এ কথাগুলো বললেন ? কথাগুলো যদি ৪০ বছর পূর্ব হতেই বলতেন, তবে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম বুঝতে পারত কারা দালাল এবং কারা দালাল ছিল না ? জনাব কাদের সিদ্দিকী ৪০ বছর পর মাত্র একটি সত্য উচ্চারণ করলেন । তাঁর ভিতরে আরও অনেক সত্য লুকিয়ে আছে, যা প্রবীণরা জানেন কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা জানেন না । জনাব কাদের সিদ্দিকী কি দেরীতে হলেও সে সত্যগুলো প্রকাশ করবেন ? যেহেতু জনাব কাদের সিদ্দিকী একটি কঠিন সত্য প্রকাশ করেছেন, সেহেতু তাঁর পথ ধরে আমি কিছু সত্য তুলে ধরব, যা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য ।

ডঃ আহমদ শরীফ ছিলেন নাস্তিক । ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তান আর্মি তাঁকে খুঁজছিল । ডঃ আহমদ শরীফ ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা ইব্রাহীম হোসেনের খুবই পরিচিত । ইব্রাহীম হোসেন নেজামে ইসলামীর নেতা মওলবী ফরিদ আহমদের সাথে ডঃ আহমদ শরীফের ব্যাপারে যোগাযোগ করেন । মওলবী ফরিদ আহমদ পাক আর্মির সাথে যোগাযোগ করে ডঃ সাহেবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে নিয়ে গেলেন । সেখানে প্রফেসর মুনির চৌধূরী , ডঃ কাজী দীন মোহাম্মদ ও ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম বসা ছিলেন । তখন তাঁরা নিয়মিত ইউনিভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করতেন এবং ক্লাস নিতেন । (তথ্য সূত্রঃ আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল , ২য় খন্ড , পৃঃ ৫৭৮, ৫৭৯) । এ ঘটনা পরিষ্কার করে দেয় যে, ডঃ আহমদ শরীফ, মুনির চৌধূরী, নীলিমা ইব্রাহীম পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য করে এবং বিবৃতি দিয়েও স্বাধীনতার পর রাজাকার হননি, কিন্তু ইসলামী দলগুলোকে এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী হওয়ায় সারাজীবন রাজাকারের সিল নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে । এমনকি চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় এবং বুদ্ধ নেতা বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো এবং তাদের অনুসারীরা পাকিস্তানের পক্ষে থেকেও আজ কিন্তু তাদেরকে ইসলামী দলগুলোর মত রাজাকার শব্দ শুনতে হচ্ছে না ।

অধ্যাপক মুনির চৌধূরী, অধ্যাপক কবির চৌধূরী, শমশের চৌধূরী এবং কর্ণেল কাইয়ুম চৌধূরী ছিলেন পরস্পর ভাই । এদের মধ্যে কর্ণেল কাইয়ুম চৌধূরী অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন বলে তিনি স্বাধীনতার পর আর বাংলাদেশে আসেননি, বরং পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে থেকে যান । আর অধ্যাপক মুনির চৌধূরী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস করাতেন, যা পূর্বে বলা হয়েছে এবং অধ্যাপক কবির চৌধূরী বাংলা একাডেমির ডিজি ছিলেন । দু’ভাই মিলে (মুনির ও কবীর চৌধূরী) অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতিও দিয়েছেন । এব্যাপারে জনাব কাদের সিদ্দিকী ৪/১০/২০১১ তারিখে লেখেন , “পাকিস্তানের পক্ষে ঢাকার বুদ্ধিজীবিদের একত্রিশ জনের স্বাক্ষর । এক নম্বরে অধ্যাপক মুনির চৌধূরী । ------- জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধূরীর নামও ছিল । কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় চৌধূরী বাংলা একাডেমির ডিজি ছিলেন ।” কিন্তু আজ মুনির চৌধূরী , কবির চৌধূরী সম্মানিত কিন্তু ইসলামী দলগুলোর নেতারা সম্মানিত নয় । কেন এ দ্বৈত নীতি ? প্রকৃতপক্ষে সম্মান বা অসম্মান এর বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার কারণে নয় । ইসলামী দলগুলোর নেতারা যদি দল হতে ‘ইসলাম’ বাদ দিতেন , তবে হয়ত ‘রাজাকার’ শব্দের হাত হতে রক্ষা পেতেন ।

এখানে আরও একটি বিষয় হল ১৪ই ডিসেম্বর নিহত বুদ্ধিজীবিদের জনাব কাদের সিদ্দিকী দালাল বলেছেন । নিহত ব্যক্তিদের এভাবে দালাল বলাটা কতটুকু সঠিক হয়েছে ? আজ যদি বাংলাদেশ ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকে এবং যারা বাংলাদেশ এর অখন্ডতায় বিশ্বাসী হবেন, তারা কি দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবেন ? উত্তর যদি না হয়, তবে কিভাবে যারা অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা দালাল হবেন ? অবশ্য জনাব কাদের সিদ্দিকী ভীষণভাবে রাজাকারদের অপছন্দ করতেন । অপছন্দ করতেন বলেই ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর একটি জন সমাবেশে চারজন অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসীকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করেন । (তথ্যসূত্রঃ ‘মূলধারা ৭১’ পৃঃ ২২০ , আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল , ২য় খন্ড , পৃঃ ৫৮৭) । যে কেউ You Tube এ গেলে ১৯৭১ এর এ দৃশ্য দেখতে পারবেন ।

অধ্যাপক মুনীর চৌধূরী, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ অনেক বুদ্ধিজীবি ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ হন । বড়ই আশ্চর্যের বিষয় হলো ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক বুদ্ধিজীবিরা এ হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন ইসলামপন্থি দলগুলোর উপর । কিন্তু প্রশ্ন হল ইসলামী দলগুলো এ কাজ করবে কেন ? অনেক বুদ্ধিজীবি পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করলেন কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবিরা না পালিয়ে পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন , কাজ করেছেন এবং ইসলামী দলগুলোও একই কাজ করেছে । তবে ইসলামী দলগুলো যাদের সাথে নয় মাস কাজ করেছে , তাদেরকে কেন হত্যা করবে ?

প্রচলিত কথা হলো, বুদ্ধিজীবিদের ধরে আনা হয় এবং ১৪ই ডিসেম্বর হত্যা করা হয় । এক্ষেত্রে অধ্যাপক মুনীর চৌধূরীকে ধরে আনা হলো, কেন তাঁর ভাই কবীর চৌধূরীকে ধরে আনা হল না ? মুনীর চৌধূরীকে ধরে আনার পর তাঁর অপর ভাই পাকিস্তান আর্মির কর্ণেল কাইয়ুম চৌধূরী আর্মিকে একটি ফোন করলেই তো মুনীর চৌধূরী বেঁচে যেতেন । কারণ অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী কর্ণেল কাইয়ুম চৌধূরী পাকিস্তান আর্মিতে প্রভাবশালী ছিলেন । তাছাড়া সে সময় ক্যাপ্টেন নাসের বারীর সাথে মুনীর চৌধূরীর পারিবারিক সম্পর্ক ছিল । মুনির চৌধূরীর ভাই শমশের চৌধূরী ক্যাপ্টেন বারীকে নিয়ে স্মৃতি কথামূলক নিবন্ধ ‘মাই ফ্রেন্ড ক্যাপ্টেন নাসের বারী’ লিখেন । এ থেকেই চৌধূরী পরিবারের সাথে পাকিস্তান আর্মির যে মধুর সম্পর্ক ছিল , তা বুঝা যায় । তাই এটা বিশ্বাস করা কঠিন মুনীর চৌধূরী পাক আর্মির হাতে নিহত হয়েছেন । তাহলে কি অধ্যাপক মুনীর চৌধূরীকে এমন কোন শ্রেণী হত্যা করেছে , যারা হচ্ছে পাক বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার -আলবদরের বিপরীত শক্তি ? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর বড়ই জটিল । আর এ জন্যই প্রয়োজন ছিল ‘বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের’ তদন্ত এবং বিচার । কিন্তু বড়ই দূভার্গ্য আমাদের, এ দেশে ইসলামী দলগুলোর জন্ম হয়েছে সমস্ত পাপ ঘাড়ে নেয়ার জন্য এবং তাদের ঘাড়ে সব পাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমরা দায়িত্ব শেষ করেছি, কিন্তু ৪০ বছরেও ‘বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের’ তদন্ত এবং বিচার করলাম না ।

১৪ই ডিসেম্বর আর একজন পরিচিত বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সার শহীদ হলেন । তাঁর খোঁজ নিতে গিয়ে ছোট ভাই জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি নিখোঁজ হন । এগুলোরও দায়-দায়িত্ব ইসলামি দলগুলোর উপর পরেছে । যেহেতু বর্তমানে অন্য কোন ইসলামী দল শক্তিশালী পজিশনে নেই সেহেতু জামায়াতকে এককভাবে ঘাতকের দায়িত্ব নিতে হয়েছে । কিন্তু প্রশ্ন হল ইসলামী দলগুলো বা জামায়াত কেন এ কাজ করবে ? কারণ যারা মারা গিয়েছেন, তাদের সাথে জামায়াতের একটি বিষয়ে মিল আছে । তা হল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিদের নিকট তারা উভয়ই দালাল । অবশ্য কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কাদের সিদ্দিকী বললেন বলেই কি সবাই দালাল হয়ে গেলেন ? প্রশ্নটি অত্যন্ত যৌক্তিক । তাই দেখতে হবে, অন্য কেউ কিছু বলেছেন কিনা ? এ ব্যাপারে আমি বলব, অন্য কেউ কিছু বলেছেন কিনা, তা না দেখে এটা দেখা সবচেয়ে ভাল হবে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের সম্পর্কে কী মনে করতেন ? শহীদুল্লাহ কায়সা , জহির রায়হান শহীদ হওয়ার পর তাদের বড় বোন নাফিসা কবীর শহীদ বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকারীদের বিচারের দাবীতে একটি পরিষদ গঠন করেন । এ পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট বিচারের দাবীতে গেলে তিনি কী মন্তব্য করেছেন, তা আওয়ামিলীগের ১৯৯৬ সালের নির্বাচিত এম, পি পান্না কায়সার (শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী ) তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধঃ আগে ও পরে ’ বইয়ের ১৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “অনেকে ত দালালী করে মরেছে ।” শেখ সাহেব বুদ্ধিজীবিদের দালাল বলায়, সেসময় ক্ষতিগ্রস্ত বুদ্ধিজীবি পরিবার তার প্রতিবাদ করেছিল, যার বর্ণনা এ বইতে আছে । শেখ মুজিবুর রহমান দালাল বললেন, কাদের সিদ্দিকীও দালাল বললেন , এরপরও তাঁরা দালাল হিসেবে পরিচিত হলেন না, কিন্তু একই কাজ করে ইসলামী দলগুলো হলো দালাল ।

বুদ্ধিজীবিদের দালাল বলা হলো । কিন্তু তাঁরা ত মানুষ ছিলেন । তাহলে কেন তাঁদের বিনাবিচারে মরতে হল ? যদি বিচার করে মারা হত, তাহলে কারো কোন দুঃখবোধ থাকত না । তাঁদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলো, কিন্তু কোন তদন্ত কমিটিও গঠন করা হলো না ? কেন করা হলো না ? কারণ একটাই । যদি করা হত, তাহলে এ হত্যার দায়-দায়িত্ব ইসলামী দলগুলো বিশেষকরে জামায়াতের উপর চাপানো যেত না, এমনকি সম্ভবত পাক বাহিনীও রেহাই পেত । এ ব্যাপারে মুনির চৌধূরীর ঘটনাটি আলোচনা হয়েছে । জহির রায়হানের ঘটনাটি আলোচনা করলে সচেতন পাঠক বিষয়টি বুঝতে পারবেন । এ ঘটনাটির তথ্যগুলো বিভিন্ন বইগুলোতে আছে । আমি এত বইয়ের উদাহরণ না দিয়ে শুধুমাত্র তাঁদের পারিবারিক উৎস হতে তথ্য দেব । এজন্য জহির রায়হানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী পান্না কায়সারের ‘মুক্তিযুদ্ধঃ আগে ও পরে ’ বইটি বেছে নিয়েছি । যদিও পরিবারটি তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা হতে মনে করে হত্যাকান্ডের সাথে রাজাকার -আলবদর জড়িত, কিন্তু তাঁদের প্রদত্ব তথ্য বা বর্ণনাগুলো অন্য কথা বলে । যেমন ১৫৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “৩০শে জানুয়ারি (১৯৭২) সকাল । একটা ফোন এল । ফোনটা আমার (পান্না কায়সার) ঘরে ছিল বলে আমি ধরলাম । ----মেজদাকে (জহির রায়হান) ডেকে দিলাম । কথা শেষ করে আমার পাশে এসে দাঁড়াল । তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে । ----কে ফোন করেছে ? ভাবী , বড়দার (শহীদুল্লাহ কায়সার) খোঁজ পাওয়া গেছে । মীরপুরের ১২ নম্বর সেকশনে একটি বাড়ীতে বন্দী হয়ে আছে । আমি এখনই বের হব । বিকালের মধ্যে বড়দাকে নিয়ে আসব । ” কথোপকথন হতে পরিষ্কার যে, ফোনটা কোন অপরিচিত জায়গা হতে আসেনি বরং এসেছিল পরিচিত জায়গা হতে, তাই জহির রায়হান সংবাদটি বিশ্বাস করে উৎফুল্ল হয়েছিলেন । অতএব এটা পরিষ্কার যে, রাজাকার -আলবদররা জহির রায়হানকে ডেকে নিয়ে যায়নি । এরপর ১৫৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল । কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না । ----মীরপুর আর্মি চেকপোস্টের নাম্বার যোগাড় করে ফোন করলাম সেখানে । কর্তব্যরত অফিসারের সঙ্গে কথা বলতেই উনি বললেন - জহির রায়হান ভিতরে আছেন । আপনারা কোন চিন্তা করবেন না ।” অতএব এই বর্ণনা হতে একেবারে ১০০% নিশ্চিত হওয়া গেল যে, জহির রায়হান আর্মির তত্ত্বাবধানে ছিলেন । আর সে সময় ভারতীয় আর্মিরা ছিল । এরপর একই পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে , “যারা বাসা থেকে ওর সঙ্গে গিয়েছিল তারা (শাহরিয়ার কবীরও ছিলেন) সবাই ফিরে এল সন্ধ্যার পরে । ----বাসা থেকে যারা গিয়েছিল তারা মেজদার সঙ্গে ভেতরে যাবার অনুমতি পায়নি । চেকপোস্টে ওদের বসে থাকতে হয়েছে । সারাদির সেখানে বসে থেকে ভেতর থেকে কোন খবর আসছে না দেখে ওরা ফিরে এসেছে ।” এ থেকে বুঝা গেল যে , এলাকটি সংরক্ষিত এলাকা । সবাই প্রবেশ করতে পারে না । এরপর বলা হয়েছে , “বারবার ফোনে চেষ্টা করে রাত প্রায় এগারোটার দিকে ফোনে পাওয়া গেল । কর্তব্যরত অফিসার অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাল মীরপুর ১২ নাম্বারে সেকশনে বিহারীদের সঙ্গে সরাসরি গুলি বিনিময় হয়েছে । তাতে কিছু পুলিশ অফিসারসহ জহির রায়হানও নিখোঁজ ।” সচেতন পাঠক কর্তব্যরত অফিসারের বক্তব্য কি বিশ্বাস করা যায় ? যদি বিশ্বাস করতে হয় , তবে বলতে হবে বর্তমানে ক্রসফায়ারের যে কাহিনী RAB বর্ণনা করে, তা অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে । ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এর পর রাজাকার -আলবদর তাদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছিল । তারা সাধারণ বাঙ্গালীদের মধ্যে মিশতে পেরেছিল । বিহারীদের অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে নাজুক । এরা বেচেঁ ছিল রেডক্রস এবং কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় । সারা ঢাকা ভারতীয় আর্মি, মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে । তাহলে কিভাবে নিরস্ত্র বিহারীরা ভারতীয় আর্মির উপস্থিতিতে কিছু পুলিশ অফিসারসহ জহির রায়হানকে নিয়ে গেল ? আর নিখোঁজ পুলিশ অফিসারদের নামই বা কি ছিল ? সত্যিই যদি ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি বিহারীরা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব জহির রায়হানকে হত্যা করে থাকে, তবে সে সময় বাঙ্গালী জনগণের ক্ষোভ হতে মীরপুরের একজনও বিহারী রক্ষা পেত না ।

জহির রায়হান কেন হত্যার শিকার হলেন ? এ ব্যাপারে ১৫৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে , “মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, সাংবাদিক সম্মেলনে মেজদা বলেছিল, ‘সময় এলে সবার মুখোশ খুলে দেব ।’ - এ কথাই কি ওর জন্য কাল হয়ে গেল ? ” এখানে জহির রায়হান কাদের মুখোশ খুলার কথা বলেছেন ? নিঃসন্দেহে জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী দলগুলোর নেতাদের নয় । কারণ যুদ্ধে পরাজিত শক্তি নিন্দিত, ধিকৃত হয় । পরাজিতরা তাদের সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলে । এ মর্যাদা চলে যায় বিজয়ীদের নিকট । ইতিমধ্যে পরাজিত শক্তির উপর ৩০ লক্ষ লোক হত্যা, বুদ্ধিজীবি হত্যা, আড়াই লক্ষ নারী ধর্ষণ এবং সম্পদ লুণ্ঠনের দামী দামী অভিযোগ প্রমাণ ছাড়াই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে । তাই প্রাক্তন গভর্ণর মুনেম খাঁন, মওলভী ফরিদ আহমদ এর মত নেতাসহ অনেক অখন্ড পাকিস্তান বিশ্বাসীদেরকে পথে-ঘাটে মরতে হয়েছে । কারণ এরা মানুষ নয়, এরা ঘাতক । তাই ঘাতকদের মুখোশ খুলার প্রয়োজন পড়ে না । মুখোশ ত তাদেরই খোলা হয়, যারা মর্যদার অধিকারী হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তার অধিকারী নয় । যদি এ বিশ্লেষণ সঠিক হয়, তবে যারা মর্যদার অধিকারী হয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না বিপক্ষের শক্তির ? আর এ মুখোশধারী ব্যক্তিরাই জহির রায়হানকে হত্যা করেছিল । অবশ্য পান্না কায়সার ১৫৯ পৃষ্ঠায় মুখোশধারীদের পরিচয় পরিষ্কার করেছেন । তিনি বলেছেন , “দু-তিন দিন পর দেখা গেল মেজদার মরিস অক্সফোর্ড গাড়িটা মুক্তিযুদ্ধার কিছু ছেলে চালাচ্ছে । হাইকোর্টের কাছে এদেরকে গাড়িটাসহ ধরাও হল । ওরা বলেছিল গাড়িটা নাকি ওরা মিরপুরের কোন এক জায়গায় পেয়েছিল । কিন্তু গাড়িটা আর ফেরত পাওয়া যায়নি ।” সচেতন পাঠক, এরপরও কি বলতে হবে , বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের সাথে এ দেশের ইসলামীদলগুলো জড়িত ছিল ?

৭১ এর ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবিদের কারা হত্যা করেছিল ? যেহেতু কোন তদন্ত হয়নি সেহেতু অনেকগুলো বিষয়ের উপর সন্দেহ থাকতে পারে । প্রথম সন্দেহ হলো পাক বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার -আলবদর । এ ব্যাপারে সে সময়ের পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর বই ‘বাংলাদেশের জন্ম’ এর ১৯৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন , “১০ই ডিসেম্বর সূর্যাস্তের সময় ঢাকার কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ আমাকে তার ধানমন্ডির পিলখানাস্থ অফিসে আসতে বললেন । ----তিনি আমাকে বললেন, বিরাট সংখ্যক বুদ্ধিজীবি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার জন্য একটি আদেশ তিনি পেয়েছেন । আমি বললাম কেন কী জন্য ? এটা এ ধরনের কাজ করার সময় নয় । জামশেদ বললেন কথাটি নিয়াজীকে (সেনা প্রধান) বলবেন । ---- নিয়াজী আমার মতামত জানতে চাইলেন । আমি বললাম এখন সেই সময় নেই । ---দয়া করে আর কাউকে গ্রেফতার করবেন না । তিনি সম্মত হলেন । ---- সম্ভবত তাদেরকে এমন কোথাও বন্দী করা হয়েছিল, যার প্রহারায় নিয়োজিত ছিল মুজাহিদরা । আত্মসমর্পণের পর কোর বা ঢাকা গ্যারিসনে কমান্ডাররা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং তারা (মুজাহিদ বাহিনী) মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল । ---পাকিস্তান আর্মিকে দুর্নাম দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী কিংবা ইন্ডিয়ান আর্মিও বন্দী ব্যক্তিদের হত্যা করে থাকতে পারে । ” যদি ফরমান আলীর বক্তব্য সঠিক হয়, তবে বলা যায় যে, বুদ্ধিজীবিদের হত্যা পাকিস্তান আর্মি বা মুজাহিদরা করে নাই । বরং এ সমস্ত বুদ্ধিজীবিরা নয় মাস পাকিস্তান আর্মির সহযোগীতায় থাকায় মুক্তিবাহিনীর ক্রুদ্ধ সদস্যরা তাদেরকে হত্যা করতে পারে বা বামধারার বুদ্ধিজীবিদের ধ্বংসের জন্য ভারতীয় আর্মিও হত্যা করতে পারে । কিন্তু ফরমান আলীর বক্তব্য সঠিক হবে এমন নিশ্চয়তা কোথায় ? তিনিতো নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইবেন এবং এটাই স্বাভাবিক । প্রশ্ন হলো কেন বুদ্ধিজীবিদের ধরে আনা হলো ? এখন ‘ এ ধরনের কাজ করার সময় নয়’ বলতে তিনি (ফরমান আলী) কী বুঝানোর চেষ্টা করেছেন ? এর অর্থ এটিও হতে পারে , ‘এরা নয় মাস আমাদেরকে সহায়তা করলে কী হবে, প্রকৃতপক্ষে এরাই তরুণ ছাত্রদেরকে পাকিস্তান বিরোধী বানিয়েছে । অতএব যাওয়ার আগে এদেরকে শেষ করে যাওয়াটাই ভাল ।’ আবার এমন অর্থও হতে পারে, ‘শহরের অবস্থা নাজুক, যে কোন সময় মুক্তিবাহিনীর হাতে এরা মারা যেতে পারে, এবং দোষ আমাদের উপরে যাবে, অতএব নিরাপত্তার জন্য এদেরকে গ্রেফতার করা হলো । কিন্তু এখনও এ কাজের সময় হয়নি ।’ যদি যুদ্ধবন্দী রাও ফরমান আলী, জেনারেল জামশেদ, জেনারেল নিয়াজীকে এ সমস্ত ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত, তবে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসত । বড়ই দূর্ভাগ্য আমাদের যে, ৭১এর পর পাকিস্তান, সেখানে থেকে যাওয়া বাঙ্গালী বিচারপতি হামুদুর রহমানের মাধ্যমে ১৪ই ডিসেম্বর হত্যাকান্ডের তদন্ত করে জেনারেলদের নির্দোষ ঘোষণা করে, কিন্তু আমরা কোন এক অদৃশ্য শক্তির বলে তদন্তের ব্যবস্থা করতে পারলাম না ।

১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবস বলা হয় । কিন্তু এ সমস্ত বুদ্ধিজীবিদের ১৪ই ডিসেম্বর হত্যা করা হয়েছে এর কোন প্রমাণ নেই । যেহেতু তাঁদের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ১৮ই ডিসেম্বর সকালে পাওয়া গিয়েছে, সেহেতু ধরে নেয়া যেতে পারে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা ১৭ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে হয়েছে । যেহেতু পাকিস্তান বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে আত্মসমর্পণ করেছে সেহেতু বিকেল হতেই ঢাকার নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী ও কাদেরীয়া বাহিনীর হাতে চলে যায় । তাই ১৭ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকার-আলবদর দিয়ে হত্যাকান্ড কতটুকু সম্ভব, তা ভেবে দেখবার বিষয় । তাছাড়া ৯ই ডিসেম্বর হতে বুঝা যাচ্ছে যে, পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে এবং এ ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে, এ পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে জেনেভা কনভেনশন লংঘনের দায়ে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার এতবড় ঝুঁকি পাক বাহিনীর জেনারেলরা কেন নেবেন ? যদি বলা যেত, জেনারেলদের পালিয়ে যাওয়ার অনেক পথ ছিল, তাহলে হয়ত বলা যেত পালানোর আগে তারা তাদের আক্রোশ মিটিয়েছে । কিন্তু অবরুদ্ধ জেনারেলদের পালানোর কোন সুযোগ ছিল না । তারা জানত জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তারা নিরাপত্তা পাবে, সেখানে জেনেভা কনভেনশেন লংঘন করে নিজেদেরকে কেন ঝুঁকির মধ্যে তারা ফেলবে ? আর সত্যিই যদি জেনারেলরা বুদ্ধিজীবি হত্যার নির্দেশ দিতেন, তবে কেন পাকিস্তানের চির শত্রু ভারত তা প্রমাণ করে বিশ্বদরবারে পাকিস্তানের ভাবমূর্তিকে একেবারে নষ্ট করে দিল না কেন ?

১৩ই ডিসেম্বর ভারত গভর্ণর হাউসে বোমা বর্ষণ করায় গর্ভণর মালিক তার মন্ত্রিসভা নিয়ে পদত্যাগ করেন এবং সবাই নিরপেক্ষ জোন ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন । রাজাকার-আলবদররা যখন দেখল তাদের নেতারা জান বাঁচানোর জন্য নিরপেক্ষ জোনে আশ্রয় নিয়েছেন এবং পরাজয় সুনিশ্চিত, তখন তারাও রাজধানী ঢাকা ছেড়ে জান-বাঁচানোর জন্য আত্মগোপন করে । তাহলে রাজাকার -আলবদররা কিভাবে ১৭ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে পারে ?

মুক্তিবাহিনী বা মুজিব বাহিনীও বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে পারে । কারণ যারা হত্যার শিকার হয়েছেন, তারা নয় মাস পাকিস্তান সরকারের বেতন-ভাতা নিয়েছেন, এমনকি পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতিও দিয়েছেন এবং এদের অনেকেও বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধাও পেয়েছেন । তাই মুক্তিবাহিনী বা মুজিব বাহিনীর সদস্যদের বুদ্ধিজীবিদের প্রতি আক্রোশ থাকতে পারে । যেমন তারা হত্যা করেছিল প্রাক্তন গভর্ণর মোনায়েম খান, মওলভী ফরিদ আহমদসহ অনেককে । তবে এখানে একটি মৌলিক পার্থক্য হলো, মোনায়েম খান, মওলভী ফরিদ আহমদ এরা মনে-প্রাণে অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই মনে-প্রাণে অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন না, তারা স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে আগ্রহী ছিলেন না । তাহলে মুক্তিবাহিনী বা মুজিব বাহিনী তাদেরকে হত্যা করবে কেন ? তবে এটা ঠিক, যে সমস্ত বুদ্ধিজীবি শহীদ হয়েছেন, তারা বামধারার ছিলেন । আমাদের মুক্তিবাহিনীতে সাধারণ শ্রেণীর লোকেরা ছাড়াও বামধারার ছাত্র ও তরুণরা ছিল । অবশ্যই ছাত্রলীগের ছেলেরাও মুক্তিবাহিনীতে ছিল । প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রি ছিলেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ । তাজউদ্দিনও বামধারার লোক ছিলেন । বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এবং নেতৃত্ব বামধারার হাতে চলে আসলে পশ্চিবঙ্গের বাম সরকারের সাথে বাংলাদেশের বামদের মিলন ভারতের জাতীয় স্বার্থের অনকূল হবে না মনে করে ভারতের কংগ্রেস সরকার শুধুমাত্র ছাত্রলীগের মাধ্যমে মুজিব বাহিনী গঠন করে । কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এবং শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে অস্ত্র থাকলে ক্ষমতা বামদের হাতে চলে যাবার সম্ভাবনা বেশি ছিল । তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর বিকল্প মুজিব বাহিনী তৈরি করে নতুন স্বাধীন দেশে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারলে ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সহজ হবে । ভারতের এ কূট-কৌশলের কারণে মুজিব বাহিনীর সাথে প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিবাহিনীর সংঘাত দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল । এমনকি মুজিব বাহিনী কর্তৃক এক ব্যক্তিকে পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রি তাজউদ্দিনকে হত্যা করার জন্য । (স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামিলীগের ভূমিকা, পৃঃ ২৪৭, মূলধারা, পৃঃ ১৩৩ ) । অতএব অসম্ভব কিছু নয় শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী থাকার কারণে স্বাধীনতার পর তাজউদ্দিনের হাত যাতে শক্তিশালী না হয়, সে জন্য মুজিব বাহিনী কর্তৃক এ সমস্ত বামধারার বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হতে পারে । তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও সন্দেহের বাইরে নন । কারণ ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম এর ভাষ্যমতে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা অধ্যাপক মুনির চৌধূরীকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছিল । (তথ্যসূত্রঃ আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল , ২য় খন্ড , পৃঃ ৫৬৮) ।

বুদ্ধিজীবিদের হত্যার পিছনে ভারতীয় গোয়েন্দ সংস্থা RAW ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা বেশি । কারণ ভারতের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস সরকার কোনভাবেই চাইবে না স্বাধীন বাংলাদেশে বামধারার সরকার প্রতিষ্ঠিত হউক । ফরমান আলী বলেছেন , “পাকিস্তান আর্মিকে দুর্নাম দেয়ার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান আর্মিও বন্দী ব্যক্তিদের হত্যা করে থাকতে পারে ।” অসম্ভব কিছু নয়, বক্তব্যটি সঠিক হতে পারে । কারণ ৭১ এ ভারতীয় বাহিনী পাক বাহিনীকে বদনাম দেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে বাঙ্গালী হত্যা করেছিল । এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকার কর্তৃক গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক এস আর মীর্জা বলেছেন , “আমি (এস আর মীর্জা) সীমান্ত অতিক্রম করে প্রথমে ইসলামপূরে তাদের সঙ্গেই ছিলাম । ---আমার ছোট ভাইয়ও আমার সঙ্গেই সীমান্ত অতিক্রম করেছিল । সে ওখানেই ছিল । ---দেখলাম যে তারা খুবই ক্ষুদ্ধ হয়েছে । জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে ? ওরা দুজন বলল যে , একজন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের অধীনে তাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাদের নাকি কতগুলো নিরীহ মানুষকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয় । অথচ ঐ লোকগুলো পাকিস্তানীদের সঙ্গে ছিল না বা বাংলাদেশ বিরোধী কোন কাজও করেনি । ওই ক্যাপ্টেনের নির্দেশে লোকগুলোকে হত্যা করা হয় । এবং একই সঙ্গে লুটতরাজও চালানো হয় । যে কারণে আমার ভাই এবং তার বন্ধুটি ক্ষুদ্ধ । তারা জানালো , বাংলাদেশের নিরীহ লোকদের মারার জন্য তারা যুদ্ধে আসেনি । সে কারণে তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে এসেছে । এ ঘটনা জুন মানুষের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে ঘটে ।” (‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ পৃঃ ৪৪) । যেহেতু প্রবাসী সরকার কর্তৃক গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক এস আর মীর্জা সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ভারতীয়রা বাঙ্গালী হত্যা করেছিল, সেহেতু ১৭ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না । কারণ সে সময় সারা ঢাকা শহর ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল ।

বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের বিচার নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিকতাবাদী বুদ্ধিজীবিরা । এই বুদ্ধিজীবিরাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন ১৪ই ডিসেম্বর হল বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবস । কিন্তু রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের লাশ পাওয়া গিয়েছে ১৮ই ডিসেম্বর । ( তথ্যসূত্রঃ ‘মূলধারা’ , মঈদুল হাসান , পৃঃ ২১৯) । অর্থাৎ বুদ্ধিজীবিরা মারা গিয়েছেন ১৭ই ডিসেম্বর দিনে বা দিবাগত রাতে । যে সমস্ত বুদ্ধিজীবি ১৭ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে মৃত্যুবরণ করেছেন, কেন তাদের মৃত্যুদিন ৩দিন এগিয়ে আনা হল ? এটা কি এজন্যই যে, ১৬ই ডিসেম্বর হতে ঢাকায় পাক বাহিনী ও রাজাকারদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না ? বরং নিয়ন্ত্রণ ছিল ভারতীয় বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, কাদেরীয়া বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর হাতে । ১৬ই ডিসেম্বর পাক বাহিনী হলো বন্দী এবং আরও আগে ১০ই ডিসেম্বর হতে রাজাকাররা পলায়ন শুরু করে দেয় । এসমস্ত বুদ্ধিজীবিরা বিচারের চাইতে বরং বেশি পছন্দ করেন হত্যার দায়-দায়িত্ব কীভাবে ইসলামপন্থিদের ঘাড়ে চাপানো যায় । ৭২ হতে ৭৫ , ৯৬ হতে ২০০১ এবং বর্তমানে এ সমস্ত বুদ্ধিজীবিদের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় থকা অবস্থায় তারা সরকারিভাবে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেনি । তারা গোলাম আযমের জন্য গণআদালত গঠন করেছিলেন । কিন্তু ইয়াহইয়া, ভুট্টো, টিক্কা খান, ফরমান আলী বা নিয়াজীদের জন্য কোন গণআদালত গঠন করেননি । তারা গোলাম আযমের প্রতীকি বিচার করতে চাইছিলেন কিন্তু প্রতীকি বিচার করেনি তাদের, যারা ঐ সময় মূল দায়িত্বে ছিল । তারা কখনও ভারতীয় আর্মিদের লুন্ঠন ও হত্যাকান্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেননি । কারণ তারা সত্য উদঘাটনের চেয়ে বেশি পছন্দ করেন ইসলামী দলগুলোকে দোষারপ করা যাতে তরুণ সমাজ ঘৃণায় তাদের কাছে না যায় । তারা চাননা বুদ্ধিজীবি হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসুক । লেখাটা শেষ করার আগে আবার বলব, বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের রহস্য বেরিয়ে আসবে দুটি প্রশ্নের উত্তর জানা গেলে । প্রথমটি হল জেনারেল নিয়াজী কেন বুদ্ধিজীবিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন ? দ্বিতীয়টি হলো ১৬ই ডিসেম্বরের পর ভারতীয় আর্মি, মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ঢাকা থাকার পর কীভাবে ১৮ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবিদের লাশ পাওয়া গেল ?

বিষয়: বিবিধ

৩৪২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File