গণতন্ত্র ও ইসলাম ।

লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ১৩ জুলাই, ২০১৩, ১২:৫৫:২৩ রাত

গণতন্ত্র ও ইসলাম নিয়ে বিতর্ক চলছে। কেউ বলছেন গণতন্ত্র ও ইসলাম সাংঘর্ষিক নয়, আবার কেউ বলছেন এটি সাংঘর্ষিক। যারা সাংঘর্ষিক নয় বলছেন, তাদের কিছু অংশ গণতন্ত্রকে মনে করেন শুধুমাত্র একটি নির্বাচন পদ্ধতি, যেখানে সরকার পরিচালনার জন্য জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। যারা গণতন্ত্রকে নিজেদের মনমত সংজ্ঞায়িত করেন, তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ইসলাম কি শুধুমাত্র নামাজ-রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তখন তারা কী বলবেন ? তখন ত কোরআন হতে উদ্ধৃতি দিয়ে বলবেন, ইসলাম শুধুমাত্র নামাজ-রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের ব্যাখ্যা যদি কোরআন এবং হাদীস হতে দিতে হয়, তবে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা নিজ মনমত না দিয়ে তার সংজ্ঞার আলোকে দিতে হবে এবং দেখতে হবে, এটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা ?

গণতন্ত্র শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো Democracy।Democracy শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ Demokratia হতে, যার অর্থ হলো জনগণের শাসন।Demokratia শব্দটির উৎপত্তি হলো Demos যার অর্থ হলো জনগণ এবং Kratia যার অর্থ হলো ক্ষমতা । গণতন্ত্র শব্দটির উৎপত্তি হতে এটি পরিষ্কার যে, এর অর্থ হলো জনগণের শাসন বা জনগণের ক্ষমতা। এখানে Democracy শব্দের উৎপত্তি এবং অর্থ সম্পর্কে আমি যা লিখেছি, তা সম্পর্কে কেউ দ্বিমত করলে, আমি সবিনয় অনুরোধ করব, যে কোন Dictionary দেখে নিতে। এখন আমার প্রশ্ন হলো যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা কি মনে করেন গণতন্ত্রের উপরোক্ত সংজ্ঞা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা ? আপনারা কি বিশ্বাস করেন শাসন ক্ষমতা আল্লাহর নয়, বরং জনগণের ? যদি এগুলো বিশ্বাস না করেন, তবে গণতন্ত্র এবং ইসলাম সাংঘর্ষিক নয়, তা আপনারা কিভাবে বলেন ? অনেকে মনে করেন আদর্শ বিচ্যুত ইসলামী আন্দোলনের কিছু নেতারা তাদের পশ্চিমা মুরুব্বিদের খুশী করার জন্য এসব কথা বলে যাচ্ছেন এবং সংগঠনের শিক্ষা-প্রশিক্ষণে এমন ব্যবস্থাপনা রেখেছেন, যাতে নতুন প্রজন্মের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা গণতন্ত্র এবং ইসলামের মধ্যকার পার্থক্য ধরতে না পারেন। এ সমস্ত তরুণদের সামনে আমি বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক, জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম এর 'গণতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র' বই এর তৃতীয় প্রকাশ, এপ্রিল ১৯৮৮ এর ১৪ পৃষ্ঠায় লিখা তুলে ধরব যেখানে তিনি লিখেছেন, "রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র , অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে তৌহিদের সমন্বয় সাধনের যদি চেষ্টা কেউ করে তাহলে ব্যর্থতাই তার একমাত্র প্রাপ্য হবে।"

গণতন্ত্র ব্যবস্থাপনায় জনগণ তার ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন আইন-বিধি রচনা করে। জনগণ যদি মনে করে, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের আশা-আকাঙ্খা বা প্রত্যাশা পূরণ করছে না, তখন তারা পরবর্তী নির্বাচনে তাদের নতুন প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধির লক্ষ্য হলো জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন করা, এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রশ্নই উঠে না। যেমন ধরুন, যে এলাকায় নিষিদ্ধ পল্লী রয়েছে এবং সেখানকার জনগণের অবাধ যৌন চাহিদা এই নিষিদ্ধ পল্লীর মাধ্যমে মেটানো হয় এবং ভোটের রাজনীতিতে এই নিষিদ্ধ পল্লীর ভোটার এবং তাদের শুভাকাঙ্খীদের সংখ্যা বেশি, সেখানে তারাই নির্বাচিত হবেন যারা নিষিদ্ধ পল্লীর ভোটার এবং তাদের শুভাকাঙ্খীদের বিরুদ্ধে যাবেন না। এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র। এখানে জনগণের প্রত্যাশাকে কোন আদর্শ বা নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে বিচার করা হয় না। এজন্যই বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক Plato বলেছেন, রাষ্ট্রের আদর্শ বিচ্যুতির তৃতীয় পর্যায় হলো গণতন্ত্র। তিনি আরও বলেছেন, গণতান্ত্রিক শাসনে ব্যক্তির উগ্র স্বাধীনতা লিপ্সা সারা দেশকে অন্তর্দ্বন্দ্ব কলহ-বিবাদে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলে।

যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, তাই এখানে কোন স্থায়ী আদর্শ নেই। এখানে জনগণ যা চায়, তাই হলো আদর্শ। ১৯৩৯ সালে আমেরিকার জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আইনের পরিবর্তন করে মদ্যপান বৈধ ঘোষণা করে। কিন্তু ইসলাম হলো একটি স্থায়ী আদর্শ। এখানে আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় সর্বময় ক্ষমতার উৎস জনগণ তা বৈধ করতে পারে না। সোজা কথা হলো যারা গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তারা মনে করেন মদ্যপান বৈধ হবে না নিষিদ্ধ হবে, তা নির্ধারণ করবে জনগণ এবং যারা ইসলামে বিশ্বাসী তারা মনে করেন এটি করার দায়িত্ব হলো আল্লাহর। অর্থাৎ উভয় দলের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি হতে নিজেদের সঠিক মনে করেন।

আল্লাহপাকের কোরআন বিশ্লেষণের জন্য যেমন রাসুল (সাঃ) হাদীস প্রয়োজন, তেমনি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্ক হলো ধর্মনিরপেক্ষতার। গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তি হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, এখানে কোন ধরনের আদর্শবাদের স্থান নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করা হবে না। যেমন ধরুন বাংলাদেশের আইন সভা পাশ করল, আজ হতে বাংলাদেশে মদ্যপান বৈধ এবং যে কোন দোকানে মদ বিক্রয় করা যাবে। এব্যাপারে একজন মুসলিম ব্যক্তি ক্ষুদ্ধ হয়ে আদালতে গেল এবং বলল যে, এ আইনের ফলে তার ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে, কারণ তার ধর্মে মদ নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে আদালত বলবে, আপনি নিজে মদ পান না করলে চলবে, কিন্তু আইনটি অবৈধ ঘোষণা করা যাবে না। কারণ রাষ্ট্রের জনগণের প্রতিনিধিরা এ আইনটি রচনা করেছে। আপনি যদি বলেন, রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণ মুসলিম, তারা বিশ্বাস করে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আল্লাহর উপর, যেহেতু আল্লাহ মদ নিষিদ্ধ করেছেন, তাই মুসলিম দেশে আইনটি বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আদালত বলবে, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় আইন রচনা করার ক্ষমতা আল্লাহর নয়, বরং জনগণের প্রতিনিধিদের এবং ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের বলে দেয় রাষ্ট্রিয় আইনের ক্ষেত্রে জনগণের ধর্মীয় পরিচয়ের কোন গুরুত্ব নেই। এজন্যই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিম পরিচয়বহনকারী রমণীর স্বামী হলো মুশরিক ব্যক্তি বা আহলে কিতাব, যার সাথে ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ সম্পূর্ণরূপে হারাম কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা বৈধ।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন ''Government is of the people, by the people, for the people .” অর্থাৎ সরকার জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। কথাটি খুবই সুন্দর এবং বর্তমানে একটি সরকারকে তখনই গণতান্ত্রিক সরকার বলা যাবে, যদি সরকার এই তিনটি গুণাবলীর অধিকারী হয়। কিন্তু এই অতি সুন্দর কথাটি ইসলামী দর্শনের বিপরীত। কারণ আব্রাহাম লিংকনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে একজন গণিতের ছাত্র অতি সহজেই বলে দিতে পারবে, এখানে জনগণ স্বাধীন চলক এবং সরকার হলো অধীন চলক। অর্থাৎ সরকার চলবে জনগণের মর্জি মোতাবেক। জনগণের পছন্দই সরকার বাস্তবায়ন করবে। ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্রমাগতই নীতি-নৈতিকতা, আইন-বিধি ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে। এক সময় যা সমাজের জন্য অনীষ্ট মনে করা হত, পরবর্তী সময় তা কল্যাণকর মনে হয় । যেমন বর্তমান ইউরোপ-আমেরিকায় মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে কথা উঠছে, বলা হচ্ছে এটি মানবতাবিরোধী। কোন কোন দেশে আইন করে মৃত্যুদন্ডের নিয়ম বাতিল করা হয়েছে, কারণ বর্তমান জনগোষ্ঠি বর্তমানে এই আইনটি রাখতে চায় না, তাই আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞানুযায়ী জনগণের সরকার এই আইনটি বাতিল করেছে। আব্রাহাম লিংকনের এই বক্তব্য কোরআন এর সূরা আশ শূরা এর ১৫ নং আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা, তা পাঠকরা যাচাই করবেন। আয়াতটি হলো, "তোমাকে (রাসুলকে) যেভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে সেভাবেই তুমি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থেকো, ওদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না, তুমি বলে দাও, আল্লাহ তাআলা কিতাবে যা কিছু অবতীর্ণ করেন না কেন, আমি তার উপর ঈমান আনি, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করি, আল্লাহ তাআলা আমাদের মালিক এবং তোমাদেরও মালিক।" আয়াতটি স্পষ্ট করে বলে দেয়, জনগণের খেয়াল-খুশী মত আইন হবে না, আইন হবে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী।

আমরা দেখেছি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ হলো স্বাধীন চলক এবং সরকার হলো অধীন চলক। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে জনগণ হলো অধীন চলক এবং মহান আল্লাহপাক হলেন স্বাধীন চলক। আপনি যদি কোরআন অধ্যয়ন করেন তবে দেখবেন রাসুল (সাঃ) এর মক্কী জীবনের সুরাগুলোতে কোন আইন-বিধি প্রদান করা হয়নি। বরং সৃষ্টি কৌশল আলোচনা করা হয়েছে, আলোচনা করা হয়েছে অতীত ইতিহাস, আলোচনা করা হয়েছে আল্লাহপাকের একত্ব এর পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি এবং আহ্বান জানানো হয়েছে আল্লাহকে ইলাহ বলে স্বীকার করে নেয়ার। যারা এগুলো বিশ্বাস করেছে, তারা "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ (ইলাহ শব্দের অর্থ হলো সৃষ্টিকর্তা, আইন প্রণেতা, রিজিকদাতা ইত্যাদি) নেই বলে ইসলামে দাখিল হয়েছে। ইসলামে দাখিল হওয়ার সাথে সাথে তাদের আদর্শ হলো আল্লাহ এবং রাসুল (সাঃ) এর আদেশ বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়া এবং তা অনুসরণ করা। অর্থাৎ ইসলামে দাখিল হওয়ার সাথে সাথেই একজন মুসলিম গণিতের ভাষায় অধীন চলকে পরিণত হয়। তাকে দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায় করতে হয়, রমযান মাসে রোজা রাখতে হয়, সম্পদের ২.৫% যাকাত দিতে হয়, প্রয়োজনীয় পরিমাণ সম্পদ থাকলে হজ্জ্ব করতে হয়, সুদী ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পারবে না এবং চাকুরীও করতে পারবে না, বিবাহ বহির্ভূত যৌন সংগম করতে পারবে না, মুসলিম মহিলারা অন্য ধর্মের লোকদের বিয়ে করতে পারবে না, মুসলিম পুরুষরা কোন মুশরিক মহিলাকে বিবাহ করতে পারবে না, বিবাহ, সম্পদ বণ্টন ইত্যাদি আল্লাহর আইন অনুযায়ী করতে হবে ইত্যাদি। আবার হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড, যা আল্লাহপাক কোরআনে নির্ধারণ করেছেন, তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত তা পরিবর্তন করার কোন সুযোগ নেই। ইসলামী রাষ্ট্রে মৃত্যুদন্ড বিরোধী আইনের কোন ধরনের ক্যাম্পেইন করা যাবে না।

গণতন্ত্রের আরও বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্যক্তির সমান অধিকার ও স্বাধীনতা স্বীকৃত এবং মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন নিজেকে মুসলিম হিসেবে ঘোষণা করবে, তখন তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। সে স্বাধীনতা পাবে ততটুকুই যতটুকু কোরআন তাকে স্বাধীনতা দিবে, সে মতপ্রকাশ করবে ততটুকুই যতটুকু কোরআন তাকে দিবে। কেউ যদি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে ইসলাম প্রদত্ত এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত অধিকার বিশ্বাস না করেন, বরং মনে করেন অবাধ অধিকার ইসলাম প্রদান করেছে, তবে আমি বলব তাসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার বা সালমান রুশদীকে সমালোচনা করার অধিকার তাদের নেই। কেউ যদি মনে করেন, গণতন্ত্রের মত ইসলামেও সবার সমান অধিকার দেয়া হয়েছে, তাদেরকে আমি বলব, তাহলে কি আপনারা ইসলামের উত্তরাধিকার আইন অস্বীকার করে নারী ও পুরুষকে সমান সম্পদ প্রদান করবেন ? ইসলামী আইনে আদালতে বিচার করার জন্য যে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন, সেই বিচারপতি মুসলিম না অমুসলিম হবে তার মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করবেন কি ? যদি বলেন পার্থক্য সৃষ্টি করবেন, তবে বলব এখানে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো কিভাবে ? আমি আগেই বলেছি, গণতন্ত্রের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পর্ক রয়েছে, তাই আদালতের বিচার আইন কোন ধর্মের ভিত্তিতে হবে না বলে সেখানে বিচারপতি হওয়ার সবার সমান অধিকার থাকে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারপতি আপনি মুসলিম দিলেন না অমুসলিম দিলেন, এটি নিয়ে কোন চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ইসলামী আদালতের বিচারপতি অবশ্যই একজন মুসলিম হতে হবে। সোজা কথা হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা, সেখানে কোন আদর্শ নেই, তাই যে কোন আদর্শের লোকের অধিকার সে রাষ্ট্রে সমান হয় (তাত্ত্বিকভাবে বাস্তবে নয়, কারণ বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ চিন্তাধারার লোকদের শাসন চলে।)। অন্যদিকে একটি আদর্শিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে ঐ আদর্শের লোকেরা নিয়োগ পাবে, যাতে তারা তাদের আদর্শিক রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে পারে। এই আদর্শিক রাষ্ট্রে সব ধরনের আদর্শের লোকদের সমান অধিকার থাকে না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে ভাবে পূঁজিবাদী চিন্তার অধিকারী লোকদের অধিকার কম থাকবে তেমনি ইসলামী রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের লোকদের অধিকার কম থাকে। এটিই বাস্তবতা। গণতন্ত্রের সমান অধিকার একটি তাত্ত্বিক কথা, বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। যেমন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রে মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের লোকেরা কি সমান অধিকার ভোগ করে ? আশাকরি গুজরাটে মুসলিম নিধন, বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা, ইন্দিরা গান্ধি হত্যার পর সারা ভারতব্যাপী শিখ নিধন ইত্যাদি ঘটনা গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র তোলে ধরে। ইংল্যান্ডে একজন ক্যাথলিক কি প্রটেস্টান এর সমান অধিকার পায় ? রাজপরিবারের কেউ ক্যাথলিক হলে সে কি ইংল্যান্ডের রাজা হতে পারবে ? খাতা-কলমে যাই লেখা থাকুক না কেন, আমেরিকাতে কি একজন কালো ও সাদা সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে ? আমেরিকাতে যে দল ক্ষমতায় যায়, সে দল তার দলের লোকদের নিয়ে নতুনভাবে প্রশাসন সাজায়। সেখানে কি অন্য দলের লোকদের অধিকার খর্ব হয় না ? সেখানে এজন মুসলিম কি সবসময় সন্দেহভাজনের তালিকায় থাকেন না ? গণতন্ত্রের ঐতিহ্য এবং চর্চ্চা যেখানে সবচেয়ে বেশি হয় সেই ইংল্যন্ডের প্রধানমন্ত্রি জন মেজর বলেছিলেন, "ইউরোপের বুকে কোন মুসলিম রাষ্ট্র সহ্য করা হবে না।" কথাটি কিন্তু মূখ ফস্কে বেরিয়ে এসেছিল ।আসলে আধুনিক সভ্যতা হলো, যা বিশ্বাস করা হয় তা বলা হয় না, আবার যা বিশ্বাস করা হয় না, তা বলা হয়। কিন্তু ইসলাম এ ধরনের চাতুরীর আশ্রয় নেয় না, যা বলে স্পষ্ট করে বলে। তাই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের তথাকথিত কৌশলের নামে কোন কিছু গোপন রাখা ঠিক নয়। ইসলাম যা বলে, উচিত হলো তা স্পষ্ট করে বলে দেয়া ।

কোরআনের আয়াত হলো "তোমরা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর"(সূরা আশ শূরা ৩৮নং আয়াত)। কোরআনের এই আয়াতকে কিছু সংখ্যক লোক গণতন্ত্রের পক্ষের আয়াত বলে জোর করে চাপিয়ে দেন। আপনারা যদি লক্ষ্য করেন, তবে দেখবেন আয়াতে 'পরামর্শের' কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো 'পরামর্শ' আপনি কার সাথে করবেন ? আপনার যদি পা ভেঙ্গে যায়, তবে আপনি কার পরামর্শ নিবেন ? একজন প্রকৌশলীর, না একজন ভূতত্ত্ববিদের, না একজন সচিবের, না এজন শ্রমিকের, না একজন ডাক্তারের ? জ্ঞান এবং বুদ্ধি বলে, আপনি একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। তাহলে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কিভাবে করতে হবে, তার পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে ইসলামী পন্ডিতদের নিকট হতে। এখানে সবার অবাধ প্রবেশ নেই, গণতন্ত্রের মত এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বিভিন্ন পেশাজীবি, শ্রমিক সবার ভোট সমান নয়। গণতন্ত্র হলো মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। এখানে যে ভোট বেশি পায়, তার মতামত প্রতিফলিত হয়। মনে করুন ইসলামী রাষ্ট্রের পরামর্শ সভায় ৫ জনের মধ্যে ১জন হলেন নাস্তিক, ১জন হলেন ধর্মনিরপেক্ষ, ১জন হলেন জাতীয়তাবাদী এবং বাকী ২জন হলেন ঈমানদার মুসলিম। ৫ জনের মধ্যে নাস্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী বললেন রাষ্ট্রে মদের ব্যবসা এবং মদ খাওয়া বৈধ এবং বাকী ২জন ঈমানদার মুসলিম বললেন মদের ব্যবসা এবং মদ খাওয়া অবৈধ। এখন বলুনতো ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা কী করবেন ? তিনি যদি একজন গণতান্ত্রিক হন, তবে দেশে মদের ব্যবসা এবং মদ খাওয়া বৈধ বলে আইন পাশ করবেন, কিন্তু তিনি যদি একজন ঈমানদার মুসলিম হন, তবে দেশে মদের ব্যবসা এবং মদ খাওয়া অবৈধ বলে আইন পাশ করবেন এবং একই সাথে পরামর্শ সভা হতে নাস্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাতীয়তাবাদীকে বাদ দিবেন। যদি উদাহরণটি আপনারা পছন্দ করেন, তবে বলতে হবে ইসলামী রাষ্ট্রের পরামর্শ সভায় শুধুমাত্র ইসলামী পন্ডিত থাকতে হবে অর্থাৎ এখানে সবার প্রবেশাধিকার সমান নয় এবং অনেক সময় সংখ্যায় কম লোকদের পরামর্শ সঠিক অর্থাৎ শরীয়াহ ভিত্তিক হতে পারে। আশাকরি উদাহরণ হতে পরামর্শ এবং গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করা যাবে। এ উদাহরণ হতে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ইসলামী রাষ্ট্রে পরামর্শ সভায় নাস্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাতীয়তাবাদীদের কোন স্থান নেই। তাহলে আপনি এটি কিভাবে বলবেন, ইসলামে গণতন্ত্রেরমত সব ধরনের চিন্তাধারার লোকদের সমান অধিকার রয়েছে ? গণতন্ত্র সব ধরনের চিন্তাধারার লোকদের সমান অধিকার এর কথা বললেও, বাস্তবে তা কখনও কার্যকর হয় না। গণতান্ত্রিক সমাজে নাস্তিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের ক্ষেত্রে যে আচরণ করে, সেই আচরণই বলে দেয়, সমান অধিকার কেউ কারে দেয় না। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সেবীরা মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামী দলগুলোর সাথে কী ধরনের আচরণ করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন অন্যকোন আদর্শের স্থান সেখানে ছিল না, ঠিক একইভাবে গণতান্ত্রিক পূঁজিবাদী সমাজেও বামপন্থিদের অধিকার ছিল না এবং এ সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো শীতল যুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে উৎখাত করার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল। অন্যদিকে ইসলাম সমান অধিকার দেয় না, কিন্তু যতটুকু অধিকার দেয়, সেই অধিকার সরকারের পক্ষ হতে নিশ্চিত করে, যা ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়।

এখন স্বাভাবিক ভাবে একটি প্রশ্ন আসে, যদি গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের বিরোধ থাকে, তবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আপনি ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা কিভাবে করবেন ? এর সোজা উত্তর হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তাকে কাজে লাগিয়ে কাজ করতে হবে। একইভাবে আপনার রাষ্ট্র যদি সমাজতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক বা সামরিক একনায়ক হয়, তবে সেখানকার পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রেখে আপনাকে কাজ করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি মানবরচিত পথ। এ সমস্ত মানবরচিত বিভিন্ন পথের মধ্যে গণতন্ত্র হলো তুলনামূলক কম খারাপ একটি পথ। তাই ইসলামী আন্দোলন সফল করার জন্য রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামো গণতান্ত্রিক হলে ভাল হয়। কিন্তু কেউ যদি বলেন, গণতন্ত্র আমাদের আদর্শ, আমরা একটি গণতান্ত্রিক দল এবং মনে-প্রাণে তা বিশ্বাস করে, তাহলে সে দল আর ইসলামী দল নয় বরং একটি কুফরী দলে পরিণত হবে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি পদ্ধতি হলো নির্বাচন পদ্ধতি। নির্বাচন পদ্ধতিতে কম বা বেশি সদস্য নিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভার সদস্য হওয়া বৈধ না অবৈধ, এর বিতর্ক আমি করব না। কারণ যেখানে বলা হয়, জনগণ সর্বময় ক্ষমতার উৎস এবং জনগণের প্রতিনিধি যে কোন আইন পাশ করার ক্ষমতা রাখে জনগণের সন্তুষ্টি স্বাপেক্ষে, সেখানে আইনসভার সদস্য হওয়া কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে ?

বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইনসভায় গিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেতে হবে। কিন্তু এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। কারণ বর্তমান গণতন্ত্রের সাথে যে, শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পর্ক আছে, তা নয়, বরং পূঁজিবাদেরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। তাই পূঁজিপতিরা তাদের প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের মতাদর্শ প্রচার করবে এবং তারা যা চায়, মিডিয়ার মাধ্যমে প্রভাবিত করে জনগণকে তা চাইতে বাধ্য করে। এখন একটি ইসলামী দলকে তার আদর্শ প্রচার করার জন্য অবশ্যই তাকে মিডিয়ার জগতে প্রবেশ করতে হবে। আর মিডিয়ার জগতে প্রবেশ করতে হলে আপনার প্রয়োজন বিপুল সংখ্যক পূঁজিপতির সমর্থন। এ সমস্ত পূঁজিপতির সমর্থন আদায় করতে গিয়ে ইসলামী দলটি তার চরিত্র হারিয়ে একটি পূঁজিবাদী মুসলিম জাতীয়তাবাদী দলে পরিণত হতে পারে। কারণ যে সমস্ত পূঁজিপতিরা ইসলামকে ভাল পায়, তারাই ইসলামী দলগুলোর ব্যানারে আসতে পারে। কিন্তু এ সমস্ত পূঁজিপতিরা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সবসময় উঠা-বসা করার কারণে তাদের চিস্তা-ধারা, সংস্কৃতিতে পশ্চিমা ভাবধারার প্রভাব পড়ে। ফলে এ সমস্ত মুসলিম জাতীয়তাবাদী পুঁজিপতিদের অর্থায়নে ইসলামী দলগুলোর যে মিডিয়া গড়ে উঠে সেই মিডিয়া দর্শক আকর্ষণের জন্য প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ মিডিয়ার মতো আচরণ করে। কারণ আপনার মিডিয়া যদি নাচ, গান, অশ্লীল বিজ্ঞাপন, সিনেমা না রাখে, তবে দর্শক তা দেখবে না, আর দর্শক আপনার মিডিয়াতে প্রবেশ না করলে আপনি কিভাবে আপনার মত প্রচার করবেন ? আর ধরে নিলাম ২/১টি মান সম্পন্ন মিডিয়া ইসলামী দলগুলো করল, কিন্তু তার বিপরীতে থাকে অসংখ্য মিডিয়া, যার প্রচারে থাকে অশ্লীলতা। আশা করি লাক্স সুন্দরী, চ্যানেল আই সুন্দরী, বিভিন্ন নাচ-গানের প্রতিযোগীতায় আইডল হওয়ার জন্য সবার কাছে এস,এম,এস প্রত্যাশা করা, বিশ্ব সুন্দরী হওয়ার জন্য দোয়া চাওয়া, ভ্যালেন্টাইন দিবস ইত্যাদি আমাদের তরুণদের কিভাবে প্রভাবিত করেছে, তা ভেবে দেখা দরকার। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে ইসলামী দলগুলো তাদের মিডিয়ার মাধ্যমে যদি ৫ জনের কাছে যেতে পারে, তবে ধর্মনিরপেক্ষ মিডিয়াগুলো ৫০জন তরুণের মন-মগজ নষ্ট করতে পারবে। আবার ইসলামী দলগুলো তাদের মিডিয়ার মাধ্যমে যে ৫ জনের কাছে গিয়েছে, তাদের চিন্তাধারায় পূঁজিবাদী ইসলামী মিডিয়ার কিছু প্রভাব থেকে যায়। আজকের বাংলাদেশে তরুণ সমাজের মধ্যে নাস্তিকদের সংখ্যা কত, তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে ২৫ বছর পূর্বে এদের কোন ধরনের অবস্থানই ছিল না, কিন্তু আজ এদের সংখ্যা একেবারেই কম নয় ? এদেরকে কারা নাস্তিক বানিয়েছে ? নিঃসন্দেহে আমাদের বুদ্ধিজীবি সমাজ এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো। বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ার মালিক, মিডিয়া কর্মী এবং তাদের বুদ্ধিজীবিদের আদর্শ বিবেচনায় আনলে বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে। এখন ধরে নিলাম, এতকিছুর পরও একটি ইসলামী দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে আইনসভায় গেল। তারা কি রাষ্ট্রের ইসলামী রূপ দিতে পারবে ? এজন্য বর্তমান সময়ে তুরস্কের দিকে তাকান। তারা কি রাষ্ট্রের ইসলামী রূপ দিতে পেরেছে ? ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও যদি রাষ্ট্রে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা না যায়, তবে তুরস্কের ইসলামী দল এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর মধ্যে কি খুব বেশি গুণগত পার্থক্য আছে ? প্রশ্ন হলো তুরস্কে কেন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন হলো না ? এর কারণ হলো তুরস্কের ইসলামী দল জনগণকে সরাসরি ইসলামী আদর্শের কথা না বলে বস্তুগত বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছে এবং সে সাথে মাথার উপর আছে ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী। তুরস্ক যদি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করতে চায়, তবে তা প্রতিহত করার জন্য রয়েছে পাশ্চাত্য ঘেষা তুরস্কের সেনাবাহিনী। আলজেরিয়ায় ইসলামী দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়েও ক্ষমতায় আসতে পারে নাই, তাদের সেনাবাহিনীর কারণে। একইভাবে মিশরে ব্রাদার হুডের পতন হয়েছে সেনাবাহিনীর কারণে। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন আরব দেশে শরীয়াহ আইন বলবৎ আছে রাজতন্ত্রের কারণে, গণতন্ত্রের জন্য নয়। অন্যদিকে ইরানে ইসলামী রাষ্ট্র হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সেখানেও সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিল, কিন্তু জনগণ রাজপথে তা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিলে সেনাবাহিনী পিছিয়ে যায় এবং ইরান ইসলামী রাষ্ট্রে (শিয়া আইন সম্পর্কে আমাদের বিরোধ থাকতে পারে) পরিণত হয়। এখন যদি মিশরের ব্রাদার হুডের সমর্থকরা আন্দোলনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে হঠিয়ে পুনরায় ক্ষমতা দখল করতে পারে, তবে দেখবেন মিশর খুবই দ্রুত ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তাই এটি মনে করা স্বাভাবিক, যারা মনে করেন নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে ইসলাম কায়েম করবেন, তাদের মনে রাখা উচিত তাদের সে প্রচেষ্টাকে বন্ধ করার জন্য পাশ্চাত্য আপনার দেশে তার মতাদর্শ অনুযায়ী সেনাবাহিনী লালন-পালন করছে। পাশ্চাত্য আপনার দেশের সেনাবাহিনীতে জাতিসংঘের মিশনের অংশগ্রহণের সুযোগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ? মুসলিম দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ভারত, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে হওয়ার কারণে সেখানে অফিসারদের মগজ ধোলাই দেয়া হয় এবং সুকৌশলে নারী ও মদের উপর নির্ভরশীল করা হয়। ফলে পাশ্চাত্যের গড়া এরূপ একটি মহান বাহিনী যথাসময়ে তুরস্ক, মিশর, আলজেরিয়ার মত ব্যবস্থা নিবে, যদি সে দেশে ইসলাম কায়েমের সম্ভাবনা দেখা দেয়। ১/১১তে জাতিসংঘের চিঠি (পরবর্তীতে স্বাক্ষর জাল করা ভূয়া চিঠি হিসেবে প্রমাণিত) বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে নিজ দেশের প্রেসিডেন্টর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সুযোগ দিয়েছে।

তাই এটি পরিষ্কার যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ইসলাম কায়েম করতে চান, বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের উদাহরণ হতে তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করা সম্ভব নয়। বরং ইসলাম কায়েক করতে হলে এমন একটি শক্তিশালী আদর্শিক জনশক্তি থাকতে হবে, যে জনশক্তি জিহাদের মাধ্যমে প্রতিহত করবে সেই শক্তিকে যারা একেবারে শেষ পর্যায়ে শক্তি নিয়ে মাঠ নামবে ইসলামকে প্রতিহত করার জন্য। ইরানে বিপ্লবের সময় দেখা গেল যে, ইসলামী জনশক্তি সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সামনে দাড়িয়ে গেল, সেনা বাহিনীও বোঝতে পারল, তারা আর কতলোক মারবে এবং মারতে গিয়ে তাদেরকেও মরতে হবে। ফলে সেনাবাহিনী আর বিরুদ্ধে দাড়াল না এবং ইরান ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হলো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যেতে হলে জনগণের ভোট লাগে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে পুলিশ বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, সেনাবাহিনী ইত্যাদি শক্তির প্রয়োজন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনী আপনার বিরুদ্ধে গেলে আপনাকে ক্ষমতা হতে নেমে যেতে হবে, যার অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে, নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামী দল ক্ষমতায় গেল, কিন্তু যুগ যুগ ধরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের গড়ে তোলা পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট পুলিশ বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, সেনাবাহিনী কি সেই ইসলামী দলের পক্ষে হয়ে কাজ করবে ?

আমরা যদি বলি রাসুল (সাঃ) আমাদের নিকট আদর্শ এবং তাঁর কর্মপন্থা আমাদের নিকট অনুসরণীয়, তাহলে আমাদের দেখতে হবে তিনি কোন পন্থায় ইসলামকে রাষ্ট্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ? মক্কার জীবনে আমরা দেখেছি, তিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রকাশ করেছেন এবং মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং সেই দাওয়াতী কার্যক্রম মদিনা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। মদীনাতে আওয়াস এবং খাজরাজ গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলে রাসুল (সাঃ) মদীনাতে হিজরত করেন এবং সেখানে ছোট্ট মদীনা রাষ্ট্র কায়েম করেন, যা ছিল ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক ছিল। যদি বর্তমান গণতন্ত্রের ভোটের রাজনীতির দিক হতে বিবেচনা করেন এবং মদীনায় যদি ভোটের ব্যবস্থা করা হত, তবে এটা নিশ্চিত থাকা যেতে পারত যে, মদীনায় কখনও ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারত না, কারণ সেখানে মুসলিমদের চেয়ে অমুসলিমদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সে সময় মদীনায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের ইসলামী রাষ্ট্রকে কেউ চ্যালেন্জ করতে পারে নাই, কারণ সংখ্যালঘু মুসলিমদের ভিতরে ছিল আওয়াস ও খাজরাজ গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকেরা, যারা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এরপরও মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, সে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছিল ভোটের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু মুসলিম জনশক্তি তাদের জিহাদী চেতনার মাধ্যমে।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাসুল (সাঃ) আদর্শ আমাদের এই কর্মপন্থা বলে দেয় যে, আপনার সাথে একদল ঈমানদার মুসলিম থাকতে হবে, যারা গণঅভ্যুত্থানের সময় জিহাদী চেতনার প্রকাশ ঘটাবে। আর যদি আপনি নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপনার জিহাদী চেতনার এ সমস্ত ঈমানদার লোক প্রয়োজন হবে, যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আল্লাহ আমার রব, রাসুল(সাঃ) আমার আদর্শ, কোরআন আমার সংবিধান এবং জান্নাত আমার ঠিকানা। কারণ সাধারণ জনগণ আপনাকে ভোট দিলেও রাজপথে জিহাদ করার জন্য খুবই কম সংখ্যক লোক পাওয়া যাবে, যদি আপনি তাদেরকে ইসলামের আলোকে তৈরী না করেন। আর আপনি যদি বলেন, ইসলামী দল হিসেবে আমার উদ্দেশ্য হলো সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, মানবাধিকার সংরক্ষণ (এগুলো হলো পাশ্চাত্যের বুলি), তাহলে আমি বলব, আপনি যাদের নৈকট্য প্রত্যাশা করেন, দলে ইসলাম থাকার কারণে তারা কখনও আপনার কাছে আসবে না এবং আপনার এমন একটি কর্মী বাহিনী গড়ে উঠবে, যারা মুখে ইসলামের কথা বলবে এবং দাবী আদায়ের জন্য ঘোষণা ছাড়াই সাধারণ জনগণের গাড়ীতে আগুন দিবে, দোকান ভাংচূড়সহ ইত্যাদি কাজ করবে।

বিষয়: বিবিধ

৫১৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File