মদীনা সনদ

লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ১০ মে, ২০১৩, ০৮:৪৪:০১ রাত

মদীনা সনদ নিয়ে চলছে বিতর্ক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রি বলেছেন, তিনি মদীনা সনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করছেন। সাথে সাথে আওয়ামি বুদ্ধিজীবিরা বলা শুরু করলেন, মদীনা সনদ হলো ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী জামায়াত, হেফাজতসহ সমস্ত সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো ইসলামের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে। কারণ ইসলাম সাম্প্রদায়িকতা বিশ্বাস করে না, এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে, যার প্রমাণ হলো মদীনা সনদ। আওয়ামি বুদ্ধিজীবিদের এ সমস্ত কথা শোনে ইসলামপন্থি ভাইয়েরা পড়লেন বেশ বিপদে, মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, সত্যিই কি মদীনা সনদ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে ?

মদীনা সনদ ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে না বিপক্ষে সে বিতর্কে আপাতত না গিয়ে বলতে চাই, যদি প্রধানমন্ত্রি মদীনা সনদ এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তবে কোন মুসলিমের আপত্তি করার কথা নয় এবং দেশে জামায়াত বা হেফাজতের মত কোন সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থাকে না। এখন প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রি তার দাবী মত মদীনা সনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করছেন কি ? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে, আমাদের পুরো মদীনা সনদটি জানতে হবে। তাই আমি নীচে মদীনা সনদের ধারাগুলো তুলে ধরছি -

(১) মুসলিম রাষ্ট্রে অনুগত অমুসলিমের অধিকার সমানভাবে নিরাপদ। একজন নগন্যতম অমুসলিমকেও মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তাসহ আশ্রয় দেবে।

(২) ইহুদীদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে, সে আমাদের সমান অধিকার ও সাহায্য লাভ করবে।

(৩) ইসলামের স্বার্থে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হলে সেই যুদ্ধে মুসলমান কোন অমুসলমানের সাথে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে ছাড়া আপোষ-রফা করবে না।

(৪) মুমিনদের একজন অন্যজনকে হত্যা করতে পারবে শুধুমাত্র হত্যার বিনিময়ে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে।

(৫) মদীনার কোন মুশরিক কুরাইশ সম্প্রদায়ের কারো জানমালের রক্ষক বা জিম্মাদার হতে পারবে না, আর কোন মুমিনের ক্ষতি সাধনে তাকে প্রশ্রয় দেবে না।

(৬) ইহুদীর মধ্যে কেউ মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুমতি ছাড়া মদীনার বাইরে যেতে পারবে না।

(৭) মুমিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদীরা তাদের যুদ্ধের রসদ যোগানোতে অংশ নেবে।

(৮) মুসলমান ও ইহুদীরা নিজ নিজ দ্বীন পালন করবে। ইহুদীদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার তাদের প্রাণের মতই সম্মানার্হ।

(৯) মুসলমানরা তাদের ব্যয়ভার তারা নিজেরা বহন করবে এবং ইহুদীরা তাদের ব্যয়ভার তারা নিজেরা বহন করবে।

(১০) ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের মধ্যে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা ঝগড়া কলহ ঘটুক না কেন, তার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর শরণাপন্ন হতে হবে। (তথ্যসূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃঃ ১৪০-১৪৩, দ্বিতীয় প্রকাশ-১৯৯০)।

মদীনা সনদের উপরোক্ত ধারাগুলো দেখে এটি স্পষ্ট করে বলা যায়, ইসলাম ড্রাইভিং সিটে বসার জন্য এসেছে, যাত্রীদের সিটে বসার জন্য ইসলাম আসেনি। আর লক্ষণীয় বিষয় যে, রাসুলে পাক (সাঃ) এর নবুয়তী জীবনের ১৩টি বছর মক্কায় কেটেছে। কিন্তু সেখানে তিনি এ ধরনের সনদ প্রদান করেননি। কারণ মক্কাতে এ সনদ প্রদান করার মত রাজনৈতিক শক্তি মুসলমানদের হাতে ছিল না। কিন্তু জনসংখ্যার দিক হতে সংখ্যালঘু মুসলমানরা যখনই মদীনাতে প্রাধান্য বিস্তারের মত রাজনৈতিক শক্তি করায়ত্ত করতে সক্ষম হলো, তখনই মদীনা সনদের বিষয়টি আসে। এ বিষয়টি বর্তমানে ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ভাইদের বোঝতে হবে।

এখন কেউ যদি মদীনা সনদের ধারাগুলো দেখে বলেন, এটি ধর্মনিরপেক্ষ, তবে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। অনেকে মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা হলো প্রতিটি ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ যদি ধর্মনিরপেক্ষতার এ অর্থ করেন, তবে মদীনা সনদের ১নং ও ৮নং ধারা অনুযায়ী মদীনা সনদ ধর্মনিরপেক্ষ । কিন্তু বাস্তবিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে, 'প্রতিটি ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে', এটি বোঝায় না। বরং ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝায়, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে আইনের অনুসরণ করা হবে, তা কোন ধর্মের ভিত্তিতে হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার আইন নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন ধর্মকে অনুসরণ করবে না। স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ধর্মরিপেক্ষতার ভিত্তিতে শাসিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে 'আওয়ামিলীগ' ধর্মনিরপেক্ষতাকে লিখিতভাবে অনুসরণ করে এবং অপর রাজনৈতিক দল 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল' অলিখিতভাবে অনুসরণ করবে। ক্ষমতার পালাবদলে উভয় দলই একই আইন কাঠামোর ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করেছে। উভয় দলের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই, তা বোঝা যায় হেফাযতে ইসলামের ১৩ দফা সম্পর্কে উভয় দলের নেতাদের প্রায় একই ধরনের অবস্থান।

ধর্মনিরপেক্ষতা অনুযায়ী রাষ্ট্র যদি কোন ধর্মের আইনকে অনুসরণ না করে, তবে মুসলমানদের নিকট ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মহীনতা এবং একইসাথে হবে মদীনা সনদের লংঘন। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা চালু হলে, মুসলমানরা তাদের সামষ্টিক আইনগুলো অনুসরণ করতে পারবে না। যেমন ধরুন, মদীনা সনদের ৪নং ধারায় বলা হয়েছে, ' মুমিনদের একজন অন্যজনকে হত্যা করতে পারবে শুধুমাত্র হত্যার বিনিময়ে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে।' এর অর্থ হলো আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হত্যাকারীর শাস্তি হলো মৃত্যুদ্বন্ড অথবা অর্থের বিনিময়ে যদি নিহতের পরিবার ক্ষমা করে দেয়া । কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশের আইনে আছে, হত্যাকারীকে কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রিয় আইনে নিহত ব্যক্তির পরিবার ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ক্ষমা করার অধিকার পায় না, কিন্তু এ অধিকার স্বয়ং আল্লাহপাক তাকে দিয়েছেন, তবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তার এ অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এভাবে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে, মুসলমানদের সামষ্টিক আইন যা পবিত্র কোরআন এবং সুন্নাহয় রয়েছে, তা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রিয় আইনে নেই । যেমন কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী ডাকাতি-রাহাজনির অপরাধ, চুরির অপরাধ, ব্যভিচারের অপরাধ, মদ খাওয়ার অপরাধ, মুরতাদের অপরাধ, অর্থনীতিতে সুদ নিষিদ্ধকরণ, যাকাত প্রথার প্রচলন, ফসলের উষর চালু, গৃহপালিত পালিত পশুর যাকাত, জিযিয়া কর, ফাঈ, জমি এবং সম্পদের মালিকানার শর্ত, খনিজ সম্পদের বন্টন, উত্তরাধিকার আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন, বিবাহ আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন, বায়তুল মালের অর্থের বন্টন ইত্যাদি বিষয়গুলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রিয় আইনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মুসলমানরা প্রতিনিয়ত আল্লাহর আইনের বিপরীত আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু মদীনা সনদের ৮নং ধারায় বলা হচ্ছে যে, মুসলমানরা তাদের দ্বীন (জীবন বিধান/সংবিধান) পালন করবে। শুধু তাই নয়, ১০ নং ধারায় বলা হচ্ছে, 'ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের মধ্যে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা ঝগড়া কলহ ঘটুক না কেন, তার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর শরণাপন্ন হতে হবে' এই ধারাও লংঘিত হচ্ছে। আর যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তাদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা আল মায়েদাহ তে আল্লাহ বলেছেন-

"আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের, (সূরা আল মায়েদাহ ৪৪)।

"আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই যালেম, (সূরা আল মায়েদাহ ৪৫)।

"আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক, (সূরা আল মায়েদাহ ৪৭)।

কোরআনের এ আয়াতগুলো স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে, একটি মুসলিম রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে তৈরী রাষ্ট্রিয় আইনে আল্লাহর আইন অনুসরণ না করে নিজস্ব তৈরী করা আইন অনুসরণ করে, তবে সেই নীতি-নির্ধারণকারী মুসলমানরা আল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী কাফের, যালেম এবং ফাসেক হয়ে যাচ্ছে । তাহলে এটি আমরা কোন ধরনের সন্দেহ ছাড়াই বলতে পারি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মুসলমানদের জন্য ধর্মহীনতা। তবে এটা ঠিক, ধর্মনিরপেক্ষতা অন্য ধর্মের লোকদের জন্য ধর্মহীনতা বলা যায় না। কারণ অন্য ধর্মের লোকদের ধর্মীয় আইন ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের ধর্মীয় কোন সামষ্টিক আইন নেই। তাই মানবরচিত অর্থাৎ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ কোন আইন পাশ করলে, তাদের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। যদি ঐ সমস্ত ধর্মে অর্থনৈতিক, সামাজিক, ফৌজদারী ইত্যাদি সামষ্টিক আইন থাকত, তবে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতা অন্য ধর্মের জন্য সাংঘর্ষিক হত এবং তাদের নিকটও ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা হত ।

মদীনা সনদের ধারাগুলো রচিত হয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্রের একেবারে প্রাথমিক স্টেজে। ইসলামী রাষ্ট্র পচিালনায় কী ধরনের আইন হতে হবে, তা রাসুল (সাঃ) এর মদীনার জীবনের সূরাতে নাযিল হয়, যা মদীনা সনদের পর। সুদ নিষিদ্ধ, যাকাত বাধ্যতামূলক, মদ হারাম, উত্তরাধিকার আইন, বিবাহ আইন, ফৌজদারী আইন, ব্যবসার রীতি-নীতি, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, বিভিন্ন জাতির সাথে চুক্তির নীতি ইত্যাদি এসেছে মদীনা সনদের পর। তাই ইসলামকে শুধুমাত্র মদীনা সনদের ভিত্তিতে চিন্তা করলে হবে না। ইসলাম পরিপূর্ণতা পেয়েছে মুহাম্মদ (সাঃ) নবুয়তী জীবনের সমাপ্তির মাধ্যমে। তাই মুসলমানদের রাষ্ট্র পরিচালিত কিভাবে হবে, তা রাসুল (সাঃ) বলে গিয়েছেন বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন,"আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়ার কাজ আমি সম্পন্ন করেছি। আমি তোমাদের কাছে এমন জিনিষ রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনও বিপথগামী হবে না। প্রকাশ্য সুষ্পষ্ট জিনিষ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নাহ" (তথ্যসূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃঃ ৩৩১, দ্বিতীয় প্রকাশ-১৯৯০)। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতিবিদরা মুসলিম জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বলে, 'আমরা কোরআন-সুন্নাহর বিপরীত আইন পাশ করব না।' অর্থাৎ ভোটের সময় এরা ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। কারণ এখানে 'বিপরীত' শব্দের মধ্যে রয়েছে তাদের ধোঁকাবাজী। কিন্তু যারা বলে, 'আমরা কোরআন-সুন্নাহর আইন পাশ করব', তারা করে আদর্শ ভিত্তিক ধর্মীয় রাজনীতি। এরা ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে না, বরং ধর্মীয় আদর্শ অনুসরণ করে।

বিষয়: বিবিধ

২০৪৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File