অগ্নি থেকে তেল, ভানুমতির খেল!

লিখেছেন লিখেছেন ভবের চর ১১ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:৪২:৫৭ দুপুর

গোলাম মাওলা রনিঃ

দি ট্র্যাভেল অব মার্কো পোলো এবং দি সিক্রেট হিস্ট্রি অব মোঙ্গল বই দুটি পাগলিনীর মতো খুঁজছিলেন ভানমুতি। অনেক কষ্টে তা জোগাড় হওয়ার পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া শুরু করলেন। উদ্দেশ্য শেষ আব্বাসীয় খিলাফতের মন্ত্রী ইবনে আল আলকামি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। সবাই জানে ভানমুতি সময় পেলেই অনেক পত্রিকা পড়েন। আবার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যান। কিন্তু কেউ কখনো বই পড়তে তাকে দেখেনি গত ছয়/সাত বছরের মধ্যে। কিন্তু হঠাৎ করেই ইতিহাসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ বই, তাও আবার ইংরেজিতে লেখা। পড়তে দেখে ভানুমতির অফিসের লোকজনের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কানাঘুষা চলতে থাকল আশপাশের মানুষজনের মধ্যে। সবারই প্রশ্ন, ভানুমতির হলোটা কি?

ইদানীংকালে ভানুমতি লক্ষ করছেন যে, লোকজন তাকে ঘৃণা করছে। পারতপক্ষে কেউ তার কাছে আসছে না। সুযোগ পেলে আড়ালে-আবডালে লোকজন টিটকারি মারছে। অথচ ক্ষমতা, পদ ও পদবি- সবই তার রয়েছে। রয়েছে অতীতের সুন্দর একটি ইতিহাস। '৭১ বছর বয়সের পরিপক্বতায় ভানুমতি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যে, এবার আর তার রক্ষা নেই। ঘরে-বাইরের সবাই যেন তাকে ঘৃণা করছে। এরই মধ্যে গত কয়েকদিন আগে তার মোবাইলে একটি এসএমএস আসে। প্রেরণকারী বলছে, তুইতো দলটা শেষ করে দিলি। তুই তোর নিয়োগকর্তাকে যেভাবে ধ্বংস করছিস সেভাবে ইবনে আল আলকামি তার মুনিব শেষ আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাসিম বিল্লাহকে সপরিবারে শেষ করে দিয়েছিল।

এসএমএসটি পাওয়ার পর ভানুমতির মাথা খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই তিনি আজন্ম বদমেজাজি মানুষ। কেবল বদমেজাজের জন্য জীবনে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি। এমনকি স্বামীর সঙ্গে সুখের একটি রাতও অতিবাহিত করতে পারেননি। মাঝেমধ্যে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হয় তার। কেন জীবনটি এমন হলো। ১৯৪২ সালের জুন মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি গণ্ডগ্রামে তার জন্ম। পরিবারের সবাই খুবই গরিব, তার বাবার চাকরিতে ছিল অঢেল ঘুষের টাকা। কিন্তু পরিবারে শান্তি ছিল না। রোগবালাই, ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। শৈশবে ভানুমতি যেমন মার খেত, তেমনি মার দিতও। আশপাশের দুষ্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে প্রায়ই শাল পাতার বিড়ি খেত। বিড়ি খাওয়ার অপরাধে প্রচণ্ড মার খেত। কিন্তু কোনো কিছুতেই অভ্যাসটি ছাড়তে পারেননি আজ অবধি। তাই এখনো বিড়ি টানেন। তবে বড়ই গোপনে। শৈশবে ভানুমতির নাম ছিল গোলনাহার। গোলাকৃতির মুখমণ্ডলের জন্য মুরবি্বরা এরূপ নামকরণ করেছিল। কিন্তু একটি বিশেষ ঘটনার জন্য শৈশবের নামটি পরিবর্তিত হয়ে ভানুমতি রূপ পায়। গোলনাহার ছোটবড় অনেকের সঙ্গেই মারামারি করত। কিন্তু মারামারিতে পেরে না উঠলে প্রতিপক্ষকে কষে কামড় বসিয়ে দিত। ওই গ্রামে ভানুমতি নামের এক পাগলী ছিল। সেও সবাইকে নির্বিচারে কামড়াত। গোলনাহারের মেয়েবেলার বন্ধুরা তাই তার কামড়ানোর অভ্যাসের জন্য নতুন নাম রাখল ভানুমতি। ভানুমতি অবশ্য তার এই কামড় দেওয়ার দক্ষতার জন্য মোটেই লজ্জিত নন। বরং গর্বিত। কামড় দিতে পারার জন্য এক রাতে তিনি প্রায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে এসেছিলেন। ঢাকা ক্লাব থেকে স্বামী ফিরেছেন মাতাল হয়ে। স্বামী সবসময় ভানুমতিকে জমের মতো ভয় পেতেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই বলতেন না বা করতেন না। এক ধরনের অব্যক্ত বেদনা নিয়ে চলতেন সবসময়। কিন্তু ঘটনার রাতে মাতাল হয়ে স্বামীরপ্রবর প্রবল বীরত্ব লাভ করলেন। প্রবল শক্তি নিয়ে ভানুমতিকে আক্রমণ করে বসলেন। মনে হচ্ছিল বোধ হয় মেরেই ফেলবেন। সেই রাতে আবার ভানুমতি সর্বশক্তি দিয়ে কামড় বসিয়ে দিলেন স্বামীর হাতে। আর যায় কোথায়। ওমাগো বলে বীর পুরুষ পিছুটান দিলেন।

ভানুমতি নিজের অতীত নিয়ে ভাবছিলেন আর ইবনে আল আলকামিকে খুঁজছিলেন। আব্বাসীয় খিলাফতকে শেষ করার জন্য ইতিহাস আলকামিকে দায়ী করে থাকে। তিনি মোঙ্গলবীর হালুকা খানকে ডেকে এনেছিলেন বাগদাদ আক্রমণের জন্য। সেটা অনেকদিন আগের কথা। ১২৫৮ সালের ২৯ জানুয়ারি দুই লাখ সৈন্য নিয়ে হালাকু খান বাগদাদ শহরের উপকণ্ঠে উপস্থিত হন। আলকামি খলিফার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মন্ত্রী। তার কথার বাইরে খলিফা একটি শব্দও উচ্চারণ করতেন না। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে শিয়া মতানুসারী মুসলিম। অন্যদিকে আব্বাসীয় খলিফারা ছিলেন সুন্নী। শুধু তাই নয়, খলিফারা তাদের সাড়ে চারশ বছরের রাজ্য শাসনের ইতিহাসে সবসময়ই রাষ্ট্রীয়ভাবে সুন্নী মতকে প্রাধান্য দিতেন এবং শিয়াদের নিমর্ূলের চেষ্টা করতেন। পাশর্্ববর্তী রাষ্ট্র ইরান ও মিসরে শিয়াদের প্রাধান্য ছিল এবং এ নিয়ে শত শত বছর ধরে বাগদাদের খলিফাদের সঙ্গে ইরানের বাদশাহ এবং মিসরের সুলতানদের বিরোধ লেগেই ছিল। বাগদাদের খলিফা ছিলেন একাধারে মুসলিম জাহানের ধর্মীয় ইমাম এবং একইসঙ্গে অধিকৃত সাম্রাজ্যের বাদশাহ। কাজেই পাশর্্ববর্তী রাজ্যগুলো শত চেষ্টা করেও বাগদাদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। এটুকু পড়ে ভানুমতি ভাবতে বসল আলকামির সঙ্গে তার কী কী মিল পাওয়া গেল। প্রথম মিল হলো_ তার আজীবনের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে সে মনেপ্রাণে সরে আসতে পারেননি। নিয়োগ কর্তার দল, দলীয় নীতির সঙ্গে বিরোধ তার অন্তরে পাথরের মতো দানা বেঁধে আছে। পরিস্থিতির কারণে দলটির সঙ্গে মিশে আছেন বটে কিন্তু ভালোবাসতে পারছেন না। দলীয় নেতাকর্মীদের ভানুমতি একদম দেখতে পারেন না। দলের মেধাবী তরুণ নেতৃত্বকে দলবিমুখ এবং একইভাবে দলীয় প্রধানের সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি এবং সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য তিনি আলকামির মতো দিনরাত তার নিয়োগকর্তার কান ভারি করছেন ছলে-বলে ও কৌশলে।

ভানুমতি আরও জানালেন_ আলকামি ঠিক তারই মতো পছন্দের লোকদের ইরান থেকে এনে গোপনে আরববাসী সাজিয়েছিলেন। তারপর তাদের মন্ত্রিসভা, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন। তারপর সুকৌশলে নিজের লোকদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য এবং খলিফার বংশের লোকজন এবং আত্দীয় পরিজনদের কলঙ্কিত করার জন্য মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি লক্ষ করলেন, খলিফা বিড়াল পছন্দ করেন। আলকামি সারা রাজ্য খুঁজে সুন্দর সুন্দর কয়েকটি বিড়াল জোগাড় করলেন। তিনি নিজে খলিফাকে নিয়ে দিনের উল্লেখযোগ্য কাজের সময়গুলোতে বিড়াল সেবায় ব্যস্ত থাকতেন। এই সময় তিনি ও খলিফা কারও সঙ্গে দেখা করতেন না। প্রহরীকে বলা হতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাষ্ট্রদূত সেনাপতি কিংবা মন্ত্রী এলে তাদের যেন বলা হয়, খলিফা এখন বিড়ালকে খাওয়াচ্ছেন। কিংবা বিড়ালকে পায়খানা করাচ্ছেন অথবা গোসল করিয়ে বিড়ালকে ঘুম পাড়াবেন। এর ফলে রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিল। লোকজন খলিফাকে বিড়ালের দুলাভাই বলে মস্করা করতে লাগল।

আলকামির প্রভাবে খলিফা আল মুতাসিম বিল্লাহ বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, তার সব নিকটাত্দীয়ই তার শত্রু। ফলে তিনি আত্দীয়-পরিজনকে রাজধানীর বাইরে নির্বাসন দিলেন। অনেককে কারারুদ্ধ করলেন। এরপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে শুরু করলেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। মিসর, ইরান, ট্রান্স অঙ্য়িানা, খোরাসান প্রভৃতি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ভাতৃত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। দেশীয় জমিদার, জায়গিরদার ও প্রদেশগুলোর গভর্নরদের একের পর এক লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মাধ্যমে খলিফার বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুললেন। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। চুপ করে থাকল সময়মতো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।

আলকামি এবার সেনাবাহিনীর ঐক্য এবং সার্বভৌমত্বে হাত দিলেন। দুই/তিন জন যোগ্য জেনারেলকে খলিফার দৃষ্টিতে সন্দেহভাজন বানিয়ে তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলির ব্যবস্থা করলেন। সেই স্থানে বসালেন সবচেয়ে অযোগ্য ও ভাঁড় প্রকৃতির লোকদের। ফলে সেনাবাহিনীতে দেখা দিল অসন্তোষ। বাগদাদে তখন দুই লাখ নিয়মিত রিজার্ভ সৈন্য ছিল। এই অসন্তেষের অসিলায় সেনাবাহিনীকে চারটি ব্রিগেডে ভাগ করে রাজধানীতে রাখলেন মাত্র ৫০ হাজার। বাকি তিনটি ব্রিগেড সাম্রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রেরণ করা হলো। ফলে ওইসব প্রদেশের প্রাদেশিক সেনাবাহিনী এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে শুরু হলো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। দেশে তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আলকামি খলিফাকে বোঝালেন কোনো সমস্যা নেই। আপনার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী মিসরের মামলুক সুলতানদের পাঁচ লাখ সৈন্য চাহিবামাত্র আপনার সেবায় উপস্থিত হবে। খলিফা বিশ্বাস করলেন এবং বিড়ালদের পরিচর্যায় আরও যত্নবান এবং আন্তরিক হয়ে বেশি সময় দিতে থাকলেন।

এর কিছুদিন পর রাজধানীর বাইরে পাঠানো ব্রিগেডগুলোর খরচ কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবর্তে প্রাদেশিক সরকারের ওপর অর্পণ করা হলো। খলিফাকে বুঝানো হলো এবার আপনার রাজকোষ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাবে। খলিফা মনের আনন্দে প্রতি রাতে তার বিড়ালগুলো নিয়ে টাইগ্রিস নদীতে নৌবিহারে বের হওয়া শুরু করলেন। আলকামি বুদ্ধি দিলেন, বিড়ালের ভাষা বোঝা সম্ভব ঠিক হজরত সোলেমান (আ.) এর মতো। এর জন্য ধ্যান করতে হবে। ধ্যানগুরু ভাড়া করে আনা হলো। খলিফা ধ্যানে বসলেন। বিড়ালের কথাবার্তা বোঝার ধ্যান। আলকামি মনে মনে খলিফার প্রতি এক ধরনের মমতা এবং করুণা অনুভব করতেন। ভাবতেন, মানুষ এত মোটা বুদ্ধির সহজ-সরল হয় কি করে! যে যা বলছে তাই করছেন! ফলে মাঝে মধ্যে এক ধরনের আত্দগ্লানিতে ভুগতেন। কিন্তু খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর পিতার কথা স্মরণ হওয়ামাত্র হিংসায় তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বাগদাদের সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে কেবলমাত্র শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে আলকামির পরিবার, আত্দীয়-স্বজন সেদিন নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। কিশোর আলকামি তৎকালীন খলিফা অর্থাৎ তার মুনিব মুতাসিম বিল্লাহ বাবাকে খুন করার উদ্দেশ্যে বাগদাদ আগমন করেন। এর আগে তিনি ইরানের আলামুতে অবস্থিত কুখ্যাত আত্দঘাতী গ্রুপের (অংংধংংরহং) সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়া আব্বাসীয় খেলাফতের প্রবল সশস্ত্র বিরোধী শক্তি ইরানের নিজারী গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে নিজের মনোভাবের কথা জানান। সবাই একবাক্যে আলকামিকে সমর্থন ও সব প্রকার সাহায্যের জন্য অঙ্গীকার করে। আলকামি বাগদাদ পদাপণ করেন।

এই পর্যন্ত পড়ে ভানুমতি এবার নিজের দিকে খেয়াল করেন। তার মালকিনের বাবার কথা স্মরণ করা মাত্র চোয়াল নিজের অজান্তে শক্ত হয়ে যায়। সেই সীমাহীন দুর্ভোগ আর কারা নির্যাতন। একবার তাকে প্রায় বিবস্র করে ফেলা হয়েছিল। এরপর একটি কেরোসিনের চুলায় ফুটানো হচ্ছিল ডিম। গরম ডিম দিয়ে তাকে নির্যাতন করা হবে। উফ্ আর স্মরণ করতে পারছেন না ভানমুতি। মেজাজ গরম হয়ে ওঠে। এরকম অবস্থায় তিনি সাধারণত টয়লেটে গিয়ে বসেন। প্রথমে বিড়ি ধরান। কখনো একটা কিংবা দুইটা। আবার ক্ষেত্রবিশেষে অনেকগুলো। এমনিতেই তার কোষ্ঠ কাঠিন্যের রোগ রয়েছে শৈশবকাল থেকে। ফলে সেই ৬/৭ বছর বয়স থেকেই টয়লেটে দীর্ঘ সময় কাটান। তখনকার দিনে আজকের মতো নিরাপদ টয়লেট ছিল না। সবই ছিল কাঁচা পায়খানা, গ্রামাঞ্চলে বলা হতো টট্রি। মাটি গর্ত করে সেখানে বাঁশ দিয়ে সাঁকোর মতো করা হতো। এরপর অবস্থা অনুযায়ী পাটখড়ি বা কলাপাতা দিয়ে জায়গাটি ঘেরাও করে প্রাকৃতিক কর্ম সারা হতো। ভানুমতি সেই সাঁকোর উপর বসে লক্ষ্য করতেন কিভাবে মানুষের মলের মধ্যে গুবরে পোকা জন্ম নেয় এবং নড়াচড়া করে। আজ ৩৩ বছর পর টয়লেটে গিয়ে তার সেই গুবরে পোকার কথা মনে হলো। শরীর ঘিন ঘিন করছিল। ফলে আচ্ছামতো ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে তিনি বের হলেন এবং পুনরায় আলকামির কাহিনী পড়তে শুরু করলেন।

বাগদাদে আসার পর তিনি অনেক চেষ্টা করেও শাহী প্রাসাদ কিংবা কোনো শাহী মজলিসের ধারে কাছেও ভিড়তে পারলেন না। এভাবে অনেকদিন চলল। কিন্তু তিনি হতোদম হলেন না। এরই মধ্যে তিনি জনৈক রাজপরিবারের সদস্যের অনুকম্পায় কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগে চাকরি নিলেন। অত্যন্ত নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি এমনভাবে কাজ শুরু করলেন যাতে করে তার সুনাম খালিফার দরবার পর্যন্ত যায়। হলোও তাই। খলিফা বহুমুখে আলকামির প্রশংসা শুনে একদিন প্রাসাদে দেখা করার নির্দেম দিলেন। নির্দিষ্ট দিনে আলকামি যখন প্রাসাদে উপস্থিত হলেন সেদিন ভোরেই খলিফা ইন্তেকাল করলেন। তার সারা জীবনের প্রতিজ্ঞা পূরণের স্বপ্ন ব্যর্থ হতে যাচ্ছে এই ক্রোধে তিনি চিৎকার করে বিলাপ শুরু করলেন। প্রচণ্ড বিলাপ। নিজের কোমরে লুকায়িত খঞ্জর রাগ করে নিজের বুকে বসিয়ে দিলেন। প্রহরীরা ছুটে এসে তাকে নিবৃত্ত করল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে সংজ্ঞা হারালেন।

আলকামির এই কাণ্ড মুহূর্তের মধ্যে শাহী প্রাসাদের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বিষয়টি উল্টো বুঝাল। ধারণা করল এই রাজকর্মচারীটি খলিফাকে অতিশয় ভালোবাসত। ফলে তার মৃত্যু সে মেনে নিতে পারেনি। তাই খলিফার মৃত্যু শোকে সে কান্নাকাটির একপর্যায়ে আত্দঘাতী হওয়ার চেষ্টা করে এবং সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। আলকামিকে শাহী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খলিফার আপনজন বিশ্বস্ত সবাই তাকে দেখতে আসেন। এমনকি শাহী হারেসের মহিলারাও তাকে দেখতে আসেন। ইতিমধ্যে তার সংজ্ঞা ফিরে আসে। উপস্থিত হাকিম, প্রহরী এবং সেবকদের কাছে তিনি তার বর্তমান অবস্থান, প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে সমস্যা ধারণা লাভ করেন। বুদ্ধিমান আলকামি বুঝতে পারেন প্রকৃতি তাকে স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেছে। এবার তিনি চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতোমধ্যে নতুন খলিফা হিসেবে আল মুতাসিম বিল্লাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এটি ছিল ১২৪২ খ্রিস্টাব্দ। শপথ গ্রহণের পরদিন নতুন খলিফা তার বাবার পরম ভক্তকে দেখার জন্য স্বশরীরে শাহী হাকিমখানায় (হাসপাতালে) আসেন। এরপর থেকে আলকামিকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

১২৪২ থেকে ১২৫৮ সাল অবধি সেটে ১৬ বছর আলকামি খলিফার সঙ্গে কাজ করেচেন। এর মধ্যে বহুবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পথ থেকে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু পরেননি। অবশেষে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। ইরানে যুদ্ধরত মোঙ্গলবীর হালাকু খানকে গোপনে আমন্ত্রণ জানালেন, বাগদাদ আক্রমণের জন্য। ইতোমধ্যে সফল কূটনীতির মাধ্যমে মোঙ্গল সম্রাট মঙ্গু দি গ্রেট এবং তার ভাই সেনাপতি হালাকু খানকে খলিফার বিরুদ্ধে মারাত্দকভাবে খেপিয়ে তুললেন। ১২৫৮ সালের ২৯ জানুয়ারি ২ লাখ সৈন্য নিয়ে বাগদাদ আক্রমণ করা হয়। রাজধানীতে তখন মাত্র ৫০ হাজার মুসলিম সৈন্য। আশপাশের এলাকা থেকে আরও সমপরিমাণ সৈন্য আনা হলো। কিন্তু কেউ যুদ্ধ করল না।

হালাকু খান প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক আবাসীয় বংশের ৩৭তম খলিফা মুতাসিম বিল্লাহকে কিংবা তার পরিবারকে অপমানিত করতে চাননি। কিন্তু আলকামির প্ররোচনায় তিনি নিজের অজান্তে বাগদাদ ধ্বংসের ফাঁদে পড়েন। আলকামি হালাকু খানকে জানান খলিফা তার সঙ্গে দেখা করতে চান। অন্যদিকে খলিফাকে অশ্বস্ত করেন যে তিনি যদি হালাকুর সঙ্গে দেখা করেন তবে হালাকু খান ক্ষমা করে ফিরে যাবেন। খলিফা এবারও তাকে বিশ্বাস করেন। তিনি পুত্রদের নিয়ে হালাকুর শিবিরে নিরস্ত্র ও প্রহরীহীন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে আসেন। চক্রান্ত মতে হালাকু সিংহাসনে আসীন ছিলেন। খলিফা ও তার সন্তানদের তাঁবুর কাছাকাছি নিয়ে প্রথমে পায়ের জুতা খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর পাগড়ি। তারা বাধ্য হন এই অপমান মেনে নিতে। সবশেষে হাতজোড় করে খলিফা ও তার সন্তানরা হালাকুর সামনে ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

খলিফার মৃত্যুদৃশ্য ছিল আরও মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক। ১২৫৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু হয়। তখন মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টানদের ৭ম ক্রসেড চলছিল। ঐক্যবদ্ধ মুসলিমরা খ্রিস্টান সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়ছিল প্যালেস্টাইন, আলেপ্লো ও সিরিয়াতে। সব মুসলিম বাহিনীর শ্রদ্ধার স্থান ছিল খিলাফতে বাগদাদ। তাই কোনো হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজরক্তের অপমান করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। হালাকু খান। আলকামি নতুন চাল চাললেন। কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইরানের তথ্য মতে, আলকামি খলিফার বিপুল রত্ন ভাণ্ডারের সন্ধান বলে দিলেন হালাকু খানকে। হালাকু শাহী প্রাসাদের রত্নভাণ্ডারের সঞ্চিত অর্থসম্পদ দেখে বেকুব হয়ে গেলেন। তিনি স্বর্ণপাত্রে স্বর্ণমুদ্রা এনে খলিফাকে হুকুম করলেন খাবার জন্য। খলিফা বললেন, এগুলো তো খাওয়া যায় না। ওরে নির্বোধ! এই সম্পদ সৈন্যদের পেছনে ব্যয় না করে আপনি সঞ্চয় করেছেন, কাজেই এর মধ্যে আপনি থাকুন। খলিফাকে রত্নভাণ্ডারে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। ১৮ ফেব্রুয়ারি সেখান থেকে খলিফার মৃত ও গলিত লাশ বের করা হলো।

ভানুমতি আলকামির ইতিহাস পড়লেন বটে কিন্তু কোনো ভাবান্তর হলো না মনের। বরং এক অদ্ভুত পৈশাচিক শক্তি অনুভব করে পুলকিত হলেন। আগে তার নামের সঙ্গে চমৎকার বিশেষণ ছিল। এখন লোকে বলে তেল! তাতে কি! লক্ষ্য অর্জনে তাকে এগিয়ে যেতেই হবে। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বিশ্বে তার আদর্শপুরুষ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ। যতদিন স্ট্যালিন জীবিত ছিলেন, ক্রুশ্চেভ তাকে বাবা বলে ডাকতেন। ছলে বলে কৌশলে স্ট্যালিনের মন জয় করে পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তার লাশ লেনিন গ্রাদ থেকে উঠিয়ে ভলগা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর রাশিয়ান পার্লামেন্ট ডুমাতে স্ট্যালিনের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করা ক্রুশ্চেভের বক্তব্যের কথা মনে হতেই আনন্দে ভরে উঠল ভানুমতির মন।

(কপি পেষ্ট)

বিষয়: রাজনীতি

১৫৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File