আমি সর্বান্তকরণে নাগরিক হতে অনিচ্ছুক...
লিখেছেন লিখেছেন যাররিনের বাবা ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১০:৩৬:১৩ রাত
এই দেশে আজ আমি একজন "অ-নাগরিক"।
হাত পা চোখ মুখ আর সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সুষম হলেও নাগরিকতার যোগ্যতায় আমি পিছিয়ে। মন এবং মস্তিষ্কে একটি নীতিকে ধারণ করার অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায়, সংগত কারণেই নাগরিক সুবিধাদি আর অধিকারে আমার কোন দাবী করার জায়গা নেই, প্রাপ্তির খাতা শুন্য।
একজন "অ-নাগরিক" হতে হলে বেশ কিছু "অ-যোগ্যতা" লাগে। তার সবক'টি হয়তো পুরোমাত্রায় বিদ্যমান নেই আমার মধ্যে, তবুও যেটুকু আছে, "অ-নাগরিক" হতে সেটুকু যথেষ্ট। আমি হয়েছিও। প্রতিনিয়ত আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য অনেকের বুদ্ধি, মেধা, মনীষা এমনকি অর্থও এক বিপুল বিক্রমে, কর্মশ্রমে নিয়োজিত...
পিতৃমাতৃ পরিচয়ে ধুলোমাটি কাদার গন্ধ ছিলো, এ বদ্বীপের ঐতিহ্যের সাথে একটি নাড়ির যোগ ছিলো। তাদের বাসস্হানের সমুখের পুকুরটি হতে অজু করে হেঁটে যেতে যেতে, সন্ধ্যার অন্ধকারে বাঁশ ঝাড়টুকুর জোনাকি গোণার চেষ্টা করেছি অনভ্যস্ত শহুরে চোখে। মসজিদে ঢোকার মুখে, ডানদিকের হলদে টাংস্টেন বাতির আলোয় আবছা আঁধারিতে শুয়ে আছেন আমার পিতামহ। তার কালো শীর্ণ অবয়ব, সফেদ দাড়ি আর টুপি মাথায় হেঁটে চলা স্মৃতি ছাপিয়ে শৈশবের আকর্ষণ টর্চটুকুর আলো মনে জ্বলে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস সম্বল করে ঢুকে যাই মসজিদে, নামাজের সারি বাঁধা হচ্ছে- এই গাঙ্গেয় বেলাভূমিতে আজ এটি অ-নাগরিকতার প্রথম ধাপ।
সকালের রোদটুকু চোখের উপরে পড়ে উত্তাপ ছড়ায় শৈশবে। চোখ খুললেই আরামের ঘুমের জড়তায় ঝাপসা হতে ক্রমশ দৃশ্যমান হয়েছে বাবার রিহালের উপরে দুষ্টুমি করে পেন্সিলে আঁকা একটি অজানা চতুষ্পদ প্রাণী'র অবয়ব। কানে ভেসে এসেছে দুলে দুলে পড়া কুরআনের 'সেকালে অবোধ্য' সুরেলা পংক্তিমালা। জানালায় মিঠে করে দুলে ওঠা নারকেলের পাতা, চারতালার শহুরে কোয়ার্টারের থেকে তাকিয়ে থাকা সামনের রাস্তা, ছাত্রদের হল আর হাতে খাতা নিয়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে চলাচল, সজীব প্রাণবন্ত হাসি খুশীতে উজ্জল। কানে এসেছে সুর করে আয়াতের অর্থ মুখস্হ করার প্রয়াস, মাঝে মাঝে অকস্মাৎ থেমে যাওয়া আর ছোট ছোট কাগজে টুকে নেয়া, অবকাশে ফের দেখে ঝালাই করে নেয়ার একটা প্রচেষ্টা। আজও, সেই ভল্যুমটুকু সযতনে রাখা বুকশেলফে কিংবা টেবিলে- খুললেই চোখে পড়ে ফ্লুরোসেন্ট মার্কারের দাগে সজল আয়াতের পর আয়াত, এমনকি শৈশবের স্মৃতি থেকে আওড়াই সে আয়াতগুলো- অ-নাগরিকতার পথে অনেকদুর এগিয়েছি...
সদ্য কেনা টুপি আর পাঞ্জাবী তখনো ব্যাগে, প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বাবা নিয়ে এসেছেন মাদ্রাসায়। জোহরের নামাজের আজানের সাথে সাথে একদল ছেলে, টুপি পাঞ্জাবী পরে মসজিদের দিকে আসতে শুরু করলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কৌতুহল মিশ্রিত চাউনির কথা আজ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তারপর কখন যে তাদের একজন হয়ে উঠলাম, অজান্তে এবং মনে প্রাণে, শুধু মাঝে মাঝে "হুজুর" ডাকটি টং করে ঝংকার দিয়ে যেতো, মস্তিষ্কের নিউরনে, হোক তা অপরিপক্ক কিংবা অব্যবহৃত, শ্রেণী বিন্যাসের উপর নীচতলা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ- তবুও খুব সহজেই ধরা পড়তে বিদ্রুপ, শ্লেষ আর বিরাগের মিশেল। অ-নাগরিকতা তখন বেড়ে ওঠায় এবং পরিবেশ প্রতিবেশকে চেনায় নিত্যসংগী।
তারপর ক্রমশঃ শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দ্বারে পদার্পন। কিভাবে কিভাবে প্রকৌশলের মাঝে খুঁজে ফেরা নান্দনিকতার মিশেল। হারিয়ে মিলে মিশে যেতে যেতেও সুতোর ব্যবধানে হারিয়ে না যাওয়া- আশৈশবের লালিত সাদা কালোর ভেদরেখা বুঝিবা ধুসর রংয়ের জটিল বিন্যাসে প্রায় হারায়। মুখের উপর আর নীচের যৌবনচিহ্নের দড়ি টানাটানিতে যখন শেষকালে নীচের ধারাই বিজয়ী রইলো- তখন অ-নাগরিকতা আমার অস্হি মজ্জায়, পোশাকে আর সুরতে...
আজন্ম এ বদ্বীপে বেড়ে উঠেও তাই আজ আমি নাগরিকতার যোগ্যতায় পিছিয়ে। সুতরাং, একজন অ-নাগরিকের জীবন, সম্মান এবং সম্পদ যতটুকু সস্তা হতে পারে, আমার জীবন, সম্মান এবং সম্পদ ঠিক ততটুকুই সস্তা। জনপ্রিয় নাগরিকের ভীড়ে বিপরীত পথ ও মতে চলার স্বাধীনতা পিষ্ট। অ-নাগরিক বলে আমাকে গুলি করা যায়, চোখ তুলে নেয়া যায়, গুম খুন বৈধ। মামলা মোকাদ্দমায় ফেলে চৌদ্দশিকের ভাত খাওয়ানো রীতিমত নাগরিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, জবাই করে নাশতা করাটা নিত্যদিনের নরমাংসভূকদের পবিত্র চেতনা।
যা কিছু ঐতিহ্যের, যা কিছু শাশ্বত, যা কিছু পবিত্র- তাকে নবজাগরণের পায়ের নীচে চূর্ণ করাই হলো আজ নাগরিকতা। সুতরাং আমি সর্বান্তকরণে নাগরিক হতে অনিচ্ছুক...
বিষয়: বিবিধ
১২৭৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন