জনৈক ভারতীয় সাবেক মেজরের গপ্পো ও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি

লিখেছেন লিখেছেন তিতুমীর ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:২০:৩৫ সকাল

১৯৭১ সনে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার বিদেশী ৫৯ জন বিশিষ্ট ব্যাক্তি ও ২টি সংস্থা'কে সন্মান জানিয়ে পুরষ্কৃত করেন।

৫৯জন বিশিষ্ট ব্যাক্তির মধ্যে একজন হচ্ছেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তৎকালীন মেজর আশোক তারা।

মেজর তারা ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে কর্নেল হয়ে অবসরগ্রহন করেন।

তার উল্লেখিত পুরষ্কার পাওয়া উপলক্ষে 'গৌতম দত্ত' একটা নিবন্ধ লিখেছেন যা অনলাইন "India Today" পত্রিকায় ১লা জুলাই, ২০১২ তারিখে প্রকাশিত হয়।

নিবন্ধটা পড়তে যেয়ে প্রথম হোচট খেলাম, মেজর এখনও ১৯৭১ সনের ডিসেম্বরের শীতের সকালে একটা পরিবারের উন্মত্ত চীৎকার আজো শুনতে পান! ঐ পরিবারটাকে ১০ থেকে ১২ জন পাকিস্তানী সেনা আটকে রেখেছিলো আর তাদের উপর নির্দেশ ছিল পরিবারটাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার।

এরপর বলা হচ্ছে, পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পনের ১ দিন পর ১১ই ডিসেম্বর ঐ তরুন সেনা কর্মকর্তার উপর দায়িত্ব পরে শেখ মুজিবের পরিবারকে উদ্ধারের।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ঐ সময়ে মাত্র ঢাকা বিমানবন্দর দখল করেছে, আর তাকে বলা হয়েছিলো ধানমন্ডি মিশনে যাওয়ার জন্য।

তিনি মাত্র ৩ জন সেনা নিয়ে ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে জনতা তার পথরোধ করে। তারা মেজর'কে একটা বুলেটবিদ্ধ গাড়ীর ভেতরে একজন ড্রাইভারের মৃতদেহ দেখিয়ে সামনে না যাও্যার জন্য উপদেশ দেয়।

কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগে গঙ্গাসাগর যুদ্ধে জয়ী কর্মকর্তা জনতার কথা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যান।

পাকিস্তানী সৈন্যদের নিশানা উপেক্ষা করে নিজের মেশিগান সেকেন্ড-ইন-কমান্ড'কে দিয়ে নিজের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা উপেক্ষা করে তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের দিকে নিরস্ত্র অবস্থায় এগিয়ে যান।

আরো এগোলে গুলি করার ভয় দেখায় পাকিস্তানী সৈন্যরা। কিন্ত তিনি ছিলেন শান্ত। ঐ সময়ে বাসার ভেতর থেকে সাহায্যের জন্য পরিবারটির মরিয়া চীৎকার শুনতে পেলেন ।

ভাঙ্গা হিন্দী ও পাঞ্জাবীতে তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পনের জন্য নির্দেশ দিলেন! তাদের জন্য আর কোনো পথ খোলা ছিলো না, যেহেতু এর আগেই আত্মসমর্পন করেছে!!!

পাকিস্তানী সৈন্যরা তার একটা কথাও বিশ্বাস করলো না, কারণ তারা তাদের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো সংবাদ পায় নাই। তারা ভেবেছিলো যুদ্ধ তখনো চলছে!

"আমি তাদের বললাম, ঢাকা'র পতন না হলে একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা তোমাদের সামনে নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

ঠিক ঐ সময়ে কিছু ভারতীয় হেলিকপ্টার আকাশে উড়ে যাচ্ছিলো, আশোক সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করে আশোক বললেন, ঢাকা এখন নয়াদিল্লীর নিয়ন্ত্রনে। তিনি সৈন্যদের এই বলেও আশ্বস্ত করলেন যে, আত্মসমর্পন করলে তাদেরকে পরিবার সহ দেশে নিরাপদে ফিরতে দেওয়া হবে।

অবশেষে সৈন্যরা নত হলো। শেখ মুজিব পরিবারের লোকেরা একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। বেগম মুজিব তাকে বললেন যে, আশোক তার ছেলের মত। তিনি আশোক'কে শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত না হয়ে ফেরা পর্যন্ত্য থেকে যেতে বললেন!

আশোক শেষ পর্যন্ত্য ১৯৭২ সনের জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।

কিছু প্রশ্ন জাগে উপরের কলমা পড়ে:

১) পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পন করেছিলো ১০ই ডিসেম্বর, এটা ঢাকা বিজয়ী আশোক কোথায় পেলেন?

২) ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকা বিমানবন্দর দখল করেছিলো ১০ই ডিসেম্বর কিন্তু ১১ই ডিসেম্বরেও ঢাকার ধানমন্ডি পাকিস্তানী সৈন্য দ্বারা অবরুদ্ধ!

৩) মাত্র ৩ জন সৈন্য নিয়ে মেজর আশোক ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডিতে অবরুদ্ধ এলাকায় চলে গেলন!

৪) শেখ মুজিবের পরিবারকে বন্দী করে রেখেছিলো ১০~১২ জন পাকিস্তানী সেনা, সেখানে কোনো কর্মকর্তাও ছিলো না। তাদের দলবল আত্মসমর্পন করলেও তারা কিছুই জানতো না! তবে তাদের খাওয়া আসতো কোথা থেকে?

৫) যুদ্ধ চলছে। ঢাকা শহরে ভারতীয় সেনা, আর পাকিস্তানী সৈন্যরা দূর থেকে দেখেও তাদের কিছুই বললো না। বরং কাছে এসে কথা বলতে দিলো!

৬) ঢাকা শহরে জনগন রাস্তায় বেরোয় ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে। এর আগে মানেকশ' পাকিস্তানী সৈন্যদের আল্টিমেটাম দেন এই বলে যে, তারা আত্মসমর্পন না করলে ঢাকা'কে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে। এরপরই পাকিস্তানী শিবিরের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। ১৬ তারিখ সকাল থেকে তারা ছিল প্রকৃতপক্ষে নিষ্ক্রিয়। দুপুর থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাদের আস্তানা ত্যাগ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রওনা হয়।

৭) শেখ মুজিবের পরিবার বাসার ভিতর থেকে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন, আর বাইরে বহুদুর থেকে আশোক তা শুনতে পাচ্ছিলেন!

৮) ১০~১২ জন পাকিস্তানী সেনা শেখ মুজিবের পুরা পরিবার'কে বন্দী করে রেখেছে, মুক্তি বাহিনীর কেউ কোথায় নেই। ঢাকা বিমানবন্দর দখলের একদিন পরে ভারতীয় সেনাদের খবর হলো তাদের মুক্ত করার!

৯) ১০ তারিখে ঢাকা বিমানবন্দর দখল হয়ে থাকলে ১৪ তারিখে বুদ্ধিজীবি হত্যা হলো কেমন করে? ওগুলো কি মেজর আশোক'দেরই করা?

ওনার কাহিনী অনেকটা ভারতীয় ছায়াছবির আদলে, হয়তো নিজেকে শাহরুখ মনে করে গপ্পো'টা তৈরী করেছেন!

এভাবেই কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হতে থাকবে?

বিষয়: বিবিধ

১৩৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File