আমার চোখে ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

লিখেছেন লিখেছেন আবদুল্লাহ রাসেল ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৭:৪৯:৩৩ সন্ধ্যা

সেদিন সম্ভবত দুপুরে ক্লাস থেকে ফিরছিলাম। তখন তো আর ফেসবুক ইউজ করতাম না যে সব খবর তৎক্ষণাৎ পেয়ে যাব। আমি তখনো বাসায় পৌঁছায়নি, রাস্তায়। এক বন্ধু ফোন করে বলল, ‘ঢাকার অবস্থা দেখসস? বিডিআররা বিদ্রোহ করসে, ভেতরে সেনাবাহিনীর অফিসারদের আটকিয়ে রাখসে, অফিসাররা কেউ বেঁচে আছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না’। ওর এরকম কথা শুনে আমি তো পুরাই থ হয়ে গেলাম। এই বিংশ শতাব্দীতে এইসব বিদ্রোহ-টিদ্রোহ কি আদৌ সম্ভব? তাও আবার সেনাবাহিনীকে আটকে রেখে? অনেক উথালপাথাল চিন্তা করতে করতে বাসায় এলাম। দৌড়ে এসে টিভি অন করলাম।

শুরুতেই যেটা দেখলাম, পিলখানা গেইটে মিডিয়াকর্মীরা দাঁড়িয়ে আছে আর গেইটের ভেতর মুখ বাঁধা বিডিআর জওয়ানরা অস্ত্র উঁচিয়ে চিৎকার করে করে কথা বলছে। একটু টাশকি লাগলো মুন্নি সাহার কাণ্ডজ্ঞান দেখে। যেখানে সবাই উৎকণ্ঠিত সেনাবাহিনীর অফিসারদের জীবন নিয়ে, সেখানে মুন্নি সাহার অবস্থান কেন যেন বিডিআরের ঐসব মুখ বাঁধা জওয়ানদের পক্ষে। ‘ন্যায্য দাবীতে তারা আন্দোলন করছে’ ‘তাদের উপর জুলুম করা হয়েছে’ ‘তাদের অপারেশন ডাল-ভাতের টাকা মেরে দেয়া হয়েছে’ ইত্যাদি বলে মুন্নি সাহা এই বিদ্রোহের পক্ষে বারবার ক্যামেরার সামনে মুখ করে ‘প্রিয় দর্শক’ বলে লেকচার দিয়ে যাচ্ছিল। এরকম নিম্নস্তরের কমন সেন্স দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছিলাম।

আন্দোলন-বিদ্রোহ যা-ই বলি না কেন, প্রত্যেক মানুষ তার দাবীর পক্ষে কথা বলার অধিকার রাখে, কিন্তু তাই বলে হুট করে অস্ত্র দিয়ে ফায়ার করা শুরু করবে? ভেতরে তখন কী হচ্ছে এইসব কিছু জানি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমদের আসা যাওয়া দেখছি। ওদিকে ভেতর থেকে বারবার সাহায্য চাওয়া হচ্ছে, অথচ তখনো ভেতরের অফিসারদেরকে উদ্ধারের কোন চেষ্টা নেই। সেই সকাল থেকে বিদ্রোহ হচ্ছে, গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর এদিকে সাহারা খাতুনরা বারবার বলছে ভেতরে সবাই নাকি সেইফ আছে! কিন্তু দুপুর ৩টার পরে কামরাঙ্গী চরের ড্রেন দিয়ে যখন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পোশাক পরিহিত অবস্থায় একের পর এক লাশ হয়ে ভেসে আসতে দেখলাম, তখন আমার মনে হচ্ছিল না আমি স্বাধীন বাংলাদেশে আছি, মনে হচ্ছিল অন্য কোনো দেশ হয়তো এই দেশটার মালিক হয়ে গেছে, তাই সেনাবাহিনীর অফিসারদের মেরে শেষ করে দিচ্ছে।

কারণ পৃথিবীর কোন সভ্য স্বাধীন দেশে এভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ ড্রেনে ভেসে আসতে পারে না। এটা অসম্ভব, কস্মিণকালেও তা মেনে নেয়া যায় না। একটা জাতির সবচেয়ে গর্বের জায়গা হচ্ছে এই সেনাবাহিনী, সবচেয়ে আস্থার জায়গা। তাদের লাশ এভাবে ড্রেনে ভেসে আসা মানে দেশের কোটি কোটি মানুষকে মেরে ড্রেনে ভাসিয়ে দেয়া। সেদিন সেনাবাহিনীর অফিসারদের মেরে কেটে রক্তাক্ত করে ড্রেনে ভাসিয়ে দেয়ার স্পর্ধার কারণেই আজ যত্রতত্র তরুণদের লাশ পাওয়া যায়, তাও এক দেহে ৫০-৬০টা গুলির চিহ্ন সহ।

ড্রেনে সেনা অফিসারদের লাশ ভেসে আসছে, অপরদিকে তখনো নবনির্বাচিত সরকার খুনিদের সাথে ডিলিং এ ব্যস্ত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা তখনো পর্যন্ত ভেতরে সেনা ট্রুপসের মাধ্যমে খুনি জওয়ানদের বিরুদ্ধে একশানে যাওয়ার কোনো রা নেই। প্রধানমন্ত্রী তখন খুব দাওয়াত দিয়ে বিডিআরের খুনিদের গণভবনে ডেকে নিয়ে আলাপ করছেন, সমঝোতা করছেন। আর আজকে নির্বাচন নিয়ে সংলাপের কথা বললে উনি জিহ্বায় কামড় খান, মাইন্ড করেন। ‘নাশকতাকারীদের সাথে কোনো আলাপ নাই’ - হায়রে ঢঙ!!! এরপর ২৫শে ফেব্রুয়ারি গেছে, ততক্ষণে খুনিদেরকে মাফও করে দেয়া হয়েছে। ওহ ইন্টারেস্টিং নিউজটা তো বলি নাই, তখনো আমাদের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে যাচ্ছেন, ‘বিডিআর প্রধান মেজর শাকিল বেঁচে আছেন’। হায়রে রসিকতা!

মেজর শাকিলকে বিদ্রোহের প্রথম আধা ঘণ্টায় খুনিরা মেরে ফেলেছে, অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নানক, আজমরা এতবার ভেতরে আসা-যাওয়ার পরেও একবারও জানলেন না মেজর শাকিল সহ সিনিয়র অফিসাররা বেঁচে আছেন নাকি নাই!!! কী নির্মম রসিকতা!!! ২৬ তারিখ দুপুরে মেজর শাকিল সহ অনেকের গলিত লাশ গণকবর থেকে উদ্ধার করা হল। হ্যাঁ, গণকবর। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনা অফিসারদের লাশ গণকবর থেকে উদ্ধার হয়! টেলিভিশনে এই দৃশ্য দেখে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ কেঁদেছে। এটা কি আদৌ মেনে নেয়ার মতো? কীভাবে মেনে নিবে? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে মেরে কীভাবে গণকবর দেয়া হয়? শুধু তা-ই না, অনেকের লাশ আগুনেও পুড়ে ফেলেছে। কী নিষ্ঠুর! কী অমানবিক!

সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলাম, শুধু সেনা অফিসারদেরকে খুনিরা হত্যা করে নাই, মেজর শাকিলের স্ত্রীকেও অত্যন্ত নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি স্বর্ণালংকার লুট সহ পুরো বাড়ির জিনিসপত্র লন্ড-ভণ্ড করা হয়েছে। যেসব অফিসাররা বাথরুমে বা ঘরের কোণায়-কানায় লুকিয়ে ছিলেন, তাদেরকে পর্যন্ত সেখান থেকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ কেমন বিদ্রোহ!!! বিডিআর জওয়ানেরা অপারেশনে ডাল-ভাতের টাকা পায়নি বলে এভাবে নির্মম ভাবে তাদের অফিসারদের হত্যা করবে? ধরে নিলাম, সেনা অফিসাররা জওয়ানদের অর্থ লোপাট করেছে, কিন্তু তাই বলে তাদেরকে এভাবে মেরে ফেলা হবে? আর এটা আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে? কী আজিব দেশ!!!

যারা প্রচার করে, শুধুমাত্র অর্থের লোপাটের কারণে বিডিআর জওয়ানেরা মাস কিলিং চালিয়েছে, তাদেরকে আমি সবচেয়ে বড় কালপ্রিট মনে করি। আর যারা এই কথা বিশ্বাস করে তাদেরকে আমি লো লেভেলের গাধা মনে করি। বড় বড় যুদ্ধেও এতো অফিসাররা মারা যায় না, কিন্তু বেঘোরে আমাদের অফিসারকে মারা হয়েছে একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকে। আমি কী বুঝাতে চাইছি তা নিশ্চয় সবাই জানে, বোঝে। কী সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, কেমন সুদূরপ্রসারী তার বিস্তারিত বলার জন্য আমি এই পোস্ট দেয়নি। আমার কিছু ভোঁতা এবং অলস অনুভূতি প্রকাশের জন্যই এই লেখাটা লিখেছি। কারণ ২৫শে ফেব্রুয়ারি এরকম ভয়াবহ মাস কিলিংয়ের পরেও আমরা তরুণরা কিছুই করতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি। আসলে আমরাই বা কী করব যেখানে খোদ নিহত সেনা অফিসারদের সহকর্মী সেনাবাহিনীর সদস্যরাই কিছুই পারতে পারেননি।

আমরা শুধু দেখেছি, এই নির্মম ঘটনার পর ‘প্রধানমন্ত্রী সাহসিকতার সাথে এই ঘটনা মোকাবিলা করেছেন, তিনি সফল’ ইত্যাদি গাঁজাখুরি কথা বলে এক শ্রেণীর মিডিয়া ঘটনার নির্মমতা ঢাকার এবং আসল খুনিদের আড়াল করার জন্য একটা নির্লজ্জ প্রচারণা চালিয়েছে। আমরা শুধু দেখেছি, সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্লট, ফ্ল্যাট, বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আসলে অনেক কিছুই দেখেছি, দেখছি। যাক, আর কিছু বলতে চাই না। শুধু বলব, এই ঘটনা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আমরা ভুলি নাই, এই দেশের জনগণ ভুলে নাই। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২৫শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? অসম্ভব।

(আমি সবসময় সেনাবাহিনীর প্রতি এক ধরণের ফ্যাসিনেশন অনুভব করি, ছোটবেলায় সবসময় সেনাবাহিনীর সদস্য হতে চাইতাম, বড়বেলায় কেন সে চেষ্টা করিনি জানি না। তবে এতো এতো অফিসার নিহত হওয়ার পর আমি ২৬শে ফেব্রুয়ারি একটা কবিতা লিখেছিলাম, কবিতাটা আমার কোনো এক ডায়েরিতে হয়তো আছে। খুঁজে পেলে ছবি তুলে পোস্ট করব ইনশা আল্লাহ্‌)

বিষয়: বিবিধ

১৩৪১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

306112
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০৮:০৫
এ,এস,ওসমান লিখেছেন : বাঙ্গালি স্বজনপৃতি হতে পারে কিন্তু ভাই এর প্রতিশোধ নিতে কখনও ভুলে না। অপেক্ষায় আছি এর বদলা নেওয়ার।
306121
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ১১:১০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সত্য প্রকাশ আর প্রতিশোধ এর অপেক্ষায়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File