২৮শে অক্টোবর এবং চশমা পরা এক যুবক
লিখেছেন লিখেছেন আবদুল্লাহ রাসেল ২৭ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:২৭:২৭ রাত
২৭শে অক্টোবর রাত ১১টা ১৫ মিনিট। আজ বিকেল থেকে নন্দিনীকে একবারও ফোন দেয়া হয়নি বাপ্পাদিত্যর। কোনো বন্ধু বা নেতা-কর্মীদের সাথেও আজ যোগাযোগ হয়নি। সারাদিন বাসায় একা সময় কাটছে। আকাশটাও আজ কেন যেন প্রতারনা করছে। কোথায় একটা ঝুম বৃষ্টি হবে, তা না। ঝির ঝির কুয়াশার মতো করে আকাশ থেকে পানি পড়ছে যেন। এটাকে কি বৃষ্টি বলে? রাবিশ। অন্যদিন এই সময়ে বন্ধুদের সাথে থাকা হয়, খুব মওজ-মাস্তি হয়। বন্ধুদের সাথে থাকলে এতোক্ষণে কয়েক প্যাগ গেলা হয়ে যেত। কিন্তু আজ মনটা এমন লাগছে কেন? পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভিন্ন প্রজাতির একটি জন্তু মনে হচ্ছে নিজেকে। যেন কারো সাথে মায়ার বাঁধন নেই, একা একদম একা। জীবনে অনেক নন্দিনীর সাথে রাত কাটানো হয়েছে, টিএসসিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত ধরে কত শত গল্প করা হয়েছে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে গড়িয়ে মধ্য রাত, তবেই নন্দিনীদের বিদায় দিয়েছে। ৬-৭ মাস আগে শাহবাগের রাস্তায় পরিচয় হওয়া নতুন নন্দিনীর সাথে কথা বলা হয়নি এমন কোন দিন নেই এমন কোন রাত নেই। শাহবাগে গগন বিদারী শ্লোগান হত, অন্যদিকে বাপ্পাদিত্য আর নন্দিনী রাস্তায় বসে ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়ামের আলোয় ভিজতো আর নন্দিনীর মেঘকালো চুল দেখতো। কত রাত যে এমন গেছে, শাহবাগের রাজপথে নেশায় বুঁদ হয়ে নন্দিনীর কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে বাপ্পাদিত্য। আবার সকালে লাকীর ‘তুই রাজাকার তুই রাজাকার’ শ্লোগানে জেগে উঠতো। ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ শ্লোগানে নেশা কাটত, ভোরের এমন কলিজা কাঁপানো শ্লোগানে এই বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্টার স্বপ্ন দেখত বাপ্পাদিত্য এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। কতই না রোমাঞ্চকর ছিল সেই দিনগুলি! অথচ আজ অনেকদিন শাহবাগে যাওয়া হয় না, গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দেয়া হয় না। ৫ই মে মৌলবাদী গোষ্টি হেফাজতের তাণ্ডবের কারনে ঘর থেকে একদম বের হয় না বললেই চলে। একা একা এই ঘরের এদিক সেদিক হেঁটে, ফেসবুক দাপড়িয়ে, বন্ধুদের সাথে রাতভর গিলে সময় কাটে বাপ্পাদিত্যর। কিন্তু অন্যদিনের তুলনায় আজ রাতটা একটু বিভীষিকাময় লাগছে কেন? না, কিছুই ভালো লাগছে না।
ফেসবুকে এখন একটু লগ-ইন করলে ভালো হয়, দেখি কে কি লিখেছে? কিন্তু ফেসবুকে লগ-ইন করা মাত্রই বিভীষিকার মাত্রা আরো বেড়ে গেল যেন। কে যেন একটি রক্তাক্ত ছবি আপলোড করেছে! ছেড়া পাঞ্জাবী আর বুক-মাথা সব রক্তে লাল হয়ে গেছে এমন এক লোকের ছবি। রক্ত মাখা শরীরে উঠে বসেছে, কিন্তু কতগুলো লোক তাকে চেরা বাঁশ দিয়ে খোঁচাচ্ছে। আবার পরক্ষণেই আরেকটি ছবি দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে, একজন লোক রাস্তায় পড়ে আছে, লোকটি সম্ভবত মৃত। সেই মৃত লোকটিকে একটি চশমা পরা যুবক লাথি মারছে। বাপ্পাদিত্যর সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। এমন বৃষ্টি শীতল রাতে হঠাৎ গরম লাগছে কেন? প্রেসার কি বেড়েছে? এই ছবিটা যে কোন শালা তুলল? এই ছবিটার জন্য রাস্তায় বের হওয়া যায় না। ২০০৬-এর ২৮শে অক্টোবরের পর একটা দিনও প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেয়া হয়নি। নন্দিনীদের সাথে লংড্রাইভে যাওয়া হয়নি, নিজের জন্মস্থান যশোরে যাওয়া হয়নি, এতো বড় বাংলাদেশ অথচ বাপ্পাদিত্যর জন্য বাংলাদেশটি একটি ১০ ফুট বাই ১০ ফুট বদ্ধ রুম যেন। মাঝখানে শাহবাগের কারনে কয়েকদিন রাজপথে অবস্থান করা গেছে, বসা গেছে, শোয়া গেছে, গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দেয়া গেছে, গরম বক্তৃতা দেয়া গেছে, বাপ্পাদিত্যর স্বপ্ন ছিল-সারাদেশে সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্টা করা যাবে, কিন্তু কোথায় কি? সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে এই ক’মাসে। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ, ঢাকা অবরোধ এবং জামায়াত-শিবিরের ঝটিকা মিছিলে বাপ্পাদিত্যর জীবনটা একদম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সামনে তো ভয়াবহ কলিযুগ অপেক্ষা করছে বাপ্পাদিত্যর জন্য। অচিরেই বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রতিষ্টা বা মৌলবাদী জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তো নেই-ই। উপরন্তু সামনের নির্বাচনে একটা সাইক্লোন হওয়ার অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে চারপাশে। সাইক্লোন হওয়া মানে মৌলবাদী জামায়াত-শিবির আবার ক্ষমতায় আসছে। তখন কি হবে? আওয়ামী লীগের ৫ বছরে যেখানে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়া হয়নি বাপ্পাদিত্যর, সেখানে জামায়াত-শিবির আসলে কি হবে? বাপ্পাদিত্যর শরীর থেকে দরদরিয়ে ঘাম বের হতে থাকে, এটা সেটা ভাবতে ভাবতেই মোবাইলটা হাতে তুলে নিল বাপ্পাদিত্য, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল আলম হানিফ ভাইকে একটা ফোন দেয়া যাক। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বাপ্পাদিত্যর রক্তচাপ যেন আরো বেড়ে গেল। স্ক্রিনে লেখাঃ রাত ১২টা, ২৮শে অক্টোবর ২০১৩।
বাপ্পাদিত্য দ্রুত ফোনবুকে গেল, হানিফ ভাইকে কল করতেই রিসিভ করলেন, ‘’হ্যালো স্লামালাইকুম হানিফ ভাই, কেমন আছেন?’ ‘এই তো আছি কোনরকম’ ‘হানিফ ভাই, একটা কথা বলার জন্য ফোন করসি’। ‘জী বল’। ‘ভাই, ইমরান, মারুফদেরকে যেভাবে বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিসেন, আমাকেও একটু ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ। আপনি তো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, আপনি চাইলেই পারবেন’। ‘ভাই, দুঃখের কথা আর কি বলব, আজকে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে’।
এই কথা শুনে প্রচণ্ড রকম একটা ধাক্কা খেল বাপ্পাদিত্য। ঘোর অমানিশার এক পাহাড় তার জীবনে যেন ভর করেছে। কাল ২৮শে অক্টোবর। এদিকে খুব দ্রুত বাইরে চলে যাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এখন কি হবে?
‘এখন কি হবে’ ভাবতেই ভাবতেই নিজের রুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল বাপ্পাদিত্য।
বিষয়: সাহিত্য
২০৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন