গুয়ান্তানামোয় বন্দী এক ফিলিস্তিনীর করুণ কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন গাজী ফরিদ ২২ জুন, ২০১৩, ১২:২৭:৪৯ দুপুর
পশ্চিম তীরের একটি ছোট পল্লীতে জন্ম নেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ তাহা মাত্তান ১৯৭৯ সালে। বাবা-মা’র ১৫ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন কর্তব্যসচেতন ও কৌতূহলী স্বভাবের। পড়াশোনায় ও সাংসারিক ভরণপোষণে বাবা-মাকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েই কাটে মাত্তানের শৈশব।
দারিদ্র্য ও দারিদ্র্যজনিত নানা অশান্তির কারণে মাত্তানের বিদ্যার্জন সম্ভব ছিল না। ধর্মানুরাগী হয়ে ওঠেন তিনি। উপদ্রব অশান্তি পরিহার করে শান্তশিষ্ট জীবনবরণ করে নেন তিনি। তাবলীগী জামায়াতে যোগ দেন মাত্তান।
আধ্যাত্মিকতায় উজ্জীবিত তবলীগীরা ইসরাইল অথবা অন্য কোনো সরকার বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম এড়িয়ে চলতেন। নিরাশ ভবিষ্যতের সম্মুখীন পশ্চিম তীরের অন্যান্য কিশোরের মতো হতোদ্যম না হয়ে শত দুর্ভোগের মধ্যেও ঐকান্তিক অধ্যবসায়ে হাইস্কুলের পাঠ সাঙ্গ করেন রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতায় পশ্চিম তীরে জীনজীবন আরও সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় বিদ্যার্জনের চেষ্টায় নিবৃত্ত হয়ে রোজগারের জন্য একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজে যোগ দেন মাত্তান।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয় ২০০০ সালে। মাত্তান তখন ২১ বছর বয়সী। দেশজুড়ে সহিংসতা ও পারিবারিক দারিদ্র্র্য থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন মাত্তান।
যে সুস্থ সুন্দর জীবনের সন্ধানে স্বদেশ ত্যাগী হয়েছিলেন মাত্তান ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে সে সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যতের সাক্ষাৎ মাত্তান তো পানইনি, উপরন্তু অকল্পনীয় বিভীষিকায় দুঃখ যন্ত্রণার গ্রাসে পরিণত হতে হয় তাকে সেই দিনটি থেকে।
মাত্তান এসে উপস্থিত হন পাকিস্তানে রায়বিন্দয়ে। চার মাস কেটে যায় সেখানে। কিছু লোকের সঙ্গে সেখানে তার সাক্ষাৎ হয়। মাত্তানকে সঙ্গে নিয়ে তারা রওয়ানা হয় পশ্চিমে আফগানিস্তানের দিকে। পথে তারা যাত্রাবিরতি করে কোয়েটায়। সেখানে মসজিদে এক ভদ্রলোক মাত্তানকে আফগানিস্তানে যেতে নিষেধ করেন। বলেন মাত্তানের বয়স, অবয়ব ও দীর্ঘ শরীরে আফগান কর্তৃপক্ষের চোখে তাকে সন্দেহভাজনে পরিণত করবে এবং তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। মাত্তান রায়বিন্দে ফিরে আসতে মনস্ত করেন। মাত্তানের টাকা-পয়সা শেষ হয়ে যায়। এক লোক তাকে পরামর্শ দেয় কাছাকাছি ফয়সালাবাদে একটি গেস্টহাউসে কিছু আরব শিক্ষার্থীর বসবাস রয়েছে-ঐ আরবের লেখাপড়ায় এগিয়ে যাওয়ার মাত্তানের জন্য কোনো উপায় করে দিতে পারে।
মাত্তান গেস্টহাউসের দিকে এগোতে থাকেন। তার জীবনে ভয়াবহ মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনার সূচনা হয় এই সময়েই।
২০০২, ২৮ মার্চে গেস্টহাউসে মাত্তান যেদিন উপস্থিত, সেদিনই পাক নিরাপত্তা বাহিনী গেস্টহাউসে হানা দেয়। দীর্ঘদেহী উজ্জ্বল তরুণ মাত্তান প্রথম নজরেই রক্ষীদের সন্দেহের পাত্রে পরিণত হন। মাত্তানকে তারা ধরে নিয়ে যায়। তাকে পাক রক্ষীরা তুলে দেয় মার্কিনীদের হাতে। মাত্তানকে আটক রাখা হয় আফগানিস্তানে বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে।
এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গুয়ান্তানামোয়। নির্মম দুর্ভাগ্যচক্রে নিষ্পেশিত রয়েছেন মাত্তান গুয়ান্তানামোয়- সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত। নাশকতায় মাত্তানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ মার্কিনীরা তুলে ধরতে পারেনি।
আলকায়েদা বা তালেবানের মতো কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণও মার্কিনীদের হাতে নেই।
অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় বন্দীদের ওপর গুয়ান্তানামোয়। নিপীড়নের মাধ্যমে বন্দীদের বাধ্য করা হয় সহিংস অপরাধে তারা জড়িত ছিল- মিথ্যা অভিযোগ স্বীকার করে নিতে।
মার্কিন পরিচালিত সন্ত্রাস দমন যুদ্ধ চলাকালে এমন একটি সময় গেছে, যখন তরুণ বয়সী যে কোনো ফিলিস্তিনীকে পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা রক্ষীরা বিনাকারণে আটক করেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনী ও ইসরাইলী উভয় কর্তৃপক্ষ তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে যে, মাত্তানের আচরণে ও কর্মকা-ে সন্ত্রাসীর কোনো লক্ষণ কোনো সময়েই তারা খুঁজে পায়নি এবং মাত্তান সব সময় তাদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকেছে।
মাত্তান সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় সমস্ত তদন্ত ও বিশ্লেষণ শেষ করার পর ‘গুয়ান্তানামো রিভিউ টাস্ক ফোর্স’ সিদ্ধান্ত নেয়, অন্য কোনো দেশের কারাশিবিরে মাত্তানকে পাঠানোর। কিন্তু এ কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মার্কিন কংগ্রেস। মাত্তানকে অন্য দেশে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি। মাত্তান রয়ে গেছেন গুয়ান্তানামোয়।
বই ও পড়াশোনায় ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন মাত্তান। মনের মতো একটি সংসার গড়ার স্বপ্নও হয়তো তার ছিল। অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুর ও নিঃসঙ্গ কারাবাস হবে তার জীবনসঙ্গী- মাত্তান হয়তো কোনোদিন ভাবেননি। ১২ বছর আগে কারাগারে প্রবেশ করেন তিনি। তার নিজস্ব পারিবারিক লোকজনের সঙ্গ লাভের জন্যও নিজস্ব একটি সংসার শুরু করার জন্য বা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য মার্কিনীরা আজ যদি তাকে ছেড়েও দেয়, তবুও তো হারিয়ে যাওয়া এগারটি বছর কেউই তাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সূত্র : আল-জাজির
এই লেখাটি সংগ্রাম পত্রিক হতে নেয়া:http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=120024
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১২৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন