"স্মৃতির ভগ্নাংশ গুলো ও আমি"

লিখেছেন লিখেছেন জোবাইর চৌধুরী ১১ জুন, ২০১৩, ০৩:৩৪:২৪ দুপুর



"ফুল কুড়ানো ও মায়ের কোরান তেলাওয়াত"

পৌষ মাঘের কনকনে শীতের কাল। ভোর হবার আগেই রিনু আর আমি বেরিয়ে পড়তাম শিউলী কুড়াতে। মাঝে মাঝে এত ভোরে উঠে যেতাম বৈদ্যুতিক আলোয় নিজের ছায়া দেখে নিজেই আৎকে উঠতাম। কোন কোন দিন আবার এমনও হয়েছে ফুল কুড়িয়ে বাড়ী ফেরার পরেই শুনতাম ফজরের আজান। ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ি, আপন গন্ডিতেই ছিল আমাদের বিচরণ, তবুও আমরা ছিলাম নির্ভীক। ঢ়ালা ভর্তি শিউলী ফুল আর ফুলের সুবাসে যেন ভরে যেত আমাদের পুরো বাড়ী। বারান্দায় বসে আমরা যখন শিউলী ফুলের মালা গাঁথতাম, তখন পুবের আকাশ আলোকিত হয়ে দিনের আগমনের জানান দিত আর, বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসত আমার মায়ের মধুর সুরের কোরআন তেলাওয়াতের ধবনি "ফাবি আ্যঈ-য়া..লা..... ই রব্বিকা মাতুকাযজিবান"।

তখন ভাবতাম আমার মায়ের আরবীর দৌড় বুঝি ঐ "ফাবি আ্যঈ-য়া..লা..... ই রব্বিকা মাতুকাযজিবান"পর্যন্তই, তাই একই লাইন বার বার উচ্চারণ করত।আরো পরে এসে বুঝেছিলাম এটি পবিত্র কোরানের আর রহমান সুরা, যেটি আমার মা সেই সময় প্রায় প্রতি ভোরে তেলাওয়াত করতেন।

জীবনের এত গুলো বছর পার করে দিলাম, অনেক কিছুই আজ স্মৃতিতে ঝাপসা তবুও কেন জানি আমার মায়ের সেই মধুর সুরে কোরআন তেলাওয়াতের ধবনি এখনো আমার স্মৃতিতে অমলিন। যেন ভোর বেলা উঠে কান পাতলেই তা শুনতে পাব।

"পাড়া ও প্রিয় নাহার ভাবী"

আমাদের পাড়াটা ছিল নিত্য উৎসব মূখর। প্রতি বিকেলে পুকুর ঘাটে পাড়ার ছেলে মেয়েরা বসে আড্ডা দিতাম। একেক দিন একেক ধরনের খেলায় ডুবে যেতাম। কখন যে দুপুরটা বিকেলের কোল ঘেষে সন্ধ্যায় নেমে আসত টেরও পেতাম না, এভাবেই কাটত আমাদের দিনগুলো।সবাই অধীর অপেক্ষায় দিন গুনতাম ডিসেম্বরের, কেননা বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আয়োজন হত আমাদের পাড়ার বাৎসরিক পিকনিকের।পাড়ার ভাই বোনরা ঐ দিনটিকে স্বপ্নের দিন বানিয়ে চলে যেতাম ফরেষ্ট হিলে। সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাহাড়ের ঢালে ঢালে আনন্দ হৈ হুল্লোড় করে বিকেলে যখন বাডি ফিরতাম, তখনই শুরু হত পাড়ার ভাই বোন আর ভাবীদের নিয়ে কাদা বালি খেলা।



ভাবীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করতেন, তিনি হচ্ছে আমাদের সবার প্রিয় নাহার ভাবী, আয়োজনের পুরোটাই ওনাঁর অবদান। তখনও মনে হত এবং এখনো মনে করি আমাদের এই নাহার ভাবীটা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্টতম ভাবী। সময়ের স্বল্পতায় ছুঠিতে গেলে ইদানিং খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয়না ওনাঁর সাথে, তারপরও আল্লাহ রাব্বুলামিনের কাছে কায়োমনোবাক্যে সব সময় প্রার্থনা করি নাহার ভাবীর মত ভালো মানুষদের যাতে আল্লাহ সব সময় সুখে শান্তিতে রাখেন। স্যালুট্যাশনস ভাবী।

"গর্বের কালীপুর এজহারুল হক হাই স্কুল"

কালীপুর স্কুলেই ছাত্র হিসেবে এখনো গর্বে বুক ভরে যায়। স্কুল জীবনে গ্রামের বড় ভাইদের কলেজে আসা যাওয়ার দৃশ্য দেখে পুলকিত হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতাম, ইস!! কখন যে আমরা এভাবে কলেজে যেতে পারব। সময়ের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে গিয়ে হিসাব মিলিয়ে দেখি, কলেজের চাইতে ঐ স্কুল জীবনই ছিল অনেক বেশী আনন্দের। আজিজ স্যারের অংক, মোজাম্মেল স্যারের ইংরেজী বোঝানো কিংবা রাখল স্যারের বাংলা এবং ব্রজেন্দ্র স্যারের কৃষি ও নুরুল হুদা স্যারের আরবী সব কিছুই এখনো স্মৃতিতে উজ্জল। কঠিন ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে স্যারদের এখনো গভীর ভাবে অনুভব করি।

মধুময় সেই দিনগুলোতে পড়া লেখার জবাবদিহিতা সাথে সাথে ছিল বাৎসরিক স্পোর্টস ও সাংস্কৃতিক উৎসব,স্কুলের জোনাল ফুটবল তার উপর ছিল বাৎসরিক মঞ্চ নাটক। মঞ্চ নাটকে আমরা হাতেঘড়ি হয়েছিল "যৌতুক হল অভিশাপ" নাটকের অমলেশ চরিত্র দিয়ে। সামাজিক অনিয়ম দুর করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে প্রেমিকা "কবিতা"র প্রেম নিবেদন ফিরিয়ে দিয়ে যে করুন দৃশ্যের অবতারনা হয়েছিল তা মনে হলে এখনো লজ্জায় লাল হয়ে পড়ি। তারপর আব্দুল্লাহ আল মামুনের "এখনো কৃতদাশ" থেকে শুরু করে "চোখ থাকিতে অন্ধ" নাটকের বুড়ো পর্যন্ত। এই বুড়ো চরিত্রটি কখনো ভুলবার নয় কেননা, এই বুড়ো চরিত্রটি মঞ্চস্ত করতে গিয়েই আমি জীবনে প্রথম পান্জাবী নামক পোষাকটি পরা শুরু করেছিলাম।

পাপ্পু ভাই ও আমরা"

স্কুল জীবনের দুরন্তপনার জোয়ারকে অনেকটা স্নেহমাখা শাসন দিয়ে আগলে রেখেছিল আমাদের পাড়ার সবার প্রিয় পাপ্পু ভাই। যাঁর পুরো নাম হচ্ছে শহীদুল ইসলাম চৌধুরী। ছোট বেলায় যে পাপ্পু ভাইয়ের দুষ্টুমিতে নাকি পুরো পাড়া ছিল অতিষ্ট, বড় হয়ে আমরা তাঁকে পেয়েছিলাম সম্পুর্ন বিপরীত মেরুর এক মানুষ রুপে। অনেকটা তাঁরই তত্বাবধানেই চলত আমাদের দিনগুলো। সেই ভোর বেলায় উঠে নামাজ,ব্যয়াম, গোসল,সকালের পড়ালেখা এবং বিকালের খেলাধুলা সব সবকিছুই ছিল আমাদের পাপ্পু ভাইয়ের নজরদারিতে।

পাড়ার বাবা মায়েরা খুবই সন্তুষ্ট ছিল এই পাপ্পু ভাইয়ের উপর। শুধু বাবা মায়েরা কেন, এক সময় বুঝতে ও দেখতে পেলাম পুরো গ্রাম তাঁকে অন্য রকম স্নেহ ও সন্মানের চোখে দেখা শুরু করে দিল। নামাজ কালাম দোয়া দরুদের মধ্যেই যেন তাঁর জেগে উঠা এবং এই দোয়া কালামের মধ্যেই যেন তাঁর ঘুমিয়ে পড়া।ত্রিশের আশপাশ বয়সের এমন পরহেজগার যুবক এই জীবনে আর দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি। পরে এক সময় সেনা বাহিনীতে চাকুরী নিয়ে উঁনি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলেন।কয়েক মাস পর পর পাপ্পু ভাই গ্রামের বাড়ীতে আসলেও শহরে থেকে আমাদের খোঁজ খবর নিয়মিত রাখতেন, যেন পড়া লেখায় অমনোযোগী না হই। অন্য কারো কথা জানিনা আমি প্রায়শ পাপ্পু ভাইয়ের উপদেশ মাখানো চিঠি পেতাম।

কোন এক ঈদের দিনে সংবাদ পেলাম সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের সবার প্রিয় পাপ্পু ভাই পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। যেখান থেকে আর কেউ কখনো কোনদিন ফেরেনা।চলতে চলতে অনেক আপন জনকেও আমি হারিয়েছি কিন্তু,পাপ্পু ভাইকে হারানোর আক্ষেপ বুঝি কোন দিনও শেষ হবার নয়, শেষ হবে না। আল্লাহ তা"য়ালা ওনাঁকে জন্নাতুল ফেরদৌস কবুল করুন।

বিষয়: বিবিধ

১৬৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File