কে এই উইলিয়াম গোমেজ?
লিখেছেন লিখেছেন হতভাগা ০৮ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:৫৬:০৩ দুপুর
ঢাকা: কখনো নিজেকে পরিচয় দেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে, কখনো আত্মপ্রকাশ করেন নাম পরিচয়হীন অখ্যাত ‘আন্তর্জাতিক’ সংবাদপত্রের করেসপন্ডেন্ট হিসেবে। আবার কখনো নিজেকে দাবি করেন মানবাধিকার কর্মী হিসেবেও, যিনি কিনা নির্যাতন ও হুমকির মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
অনলাইনের সর্বত্র ভেসে বেড়ানো বহুরূপী ওই ব্যক্তির নাম উইলিয়াম নিকোলাস গোমেজ। তবে তার অস্তিত্ব অনুভূত হয় কেবল অনলাইনেই।
সম্প্রতি প্রায় সবগুলো সামাজিক গণমাধ্যমেই বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। বিশেষ করে টুইটারে প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে হত্যার হুমকি দিয়ে হয়েছেন পত্রপত্রিকার শিরোনাম।
২৮ বছর বয়সী এই তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচার চান, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আজমকে মনে করেন শান্তির দূত ও প্রকৃত নেতা। তার লেখালেখির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্নীতির নানা খবরাখবর।
গত ৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও অফিসিয়াল ফ্যানপেজে একটি টুইটের স্ক্রিনশট আপলোড করেন।
এর আগের দিন, অর্থাৎ ৩ আগস্ট @Wmicholasgomes আইডি থেকে করা
ওই টুইটে জয়কে ট্যাগ করে লেখা হয়, ‘তোমার মাকে প্রস্তুতি নিতে বলো। যাওয়ার সময় হয়েছে। তিনি এখন থেকে প্রতিদিন তোমার জন্য রান্না করবেন। আশা করি তোমার নানুর মতোই তার পরিণতি হবে।’ গোমেজের ৪৭ জন ফলোয়ার এটি রিটুইট করেন এবং ৪৭ জন ‘ফেভারিট’ করেন। কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করলেও অনেকে আবার গোমেজকে ‘সাহসী ব্যক্তিত্ব’ বলেও প্রশংসা করেন।
আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত গোমেজ জয়কে ট্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে আরো বেশকিছু টুইট করেন। ৪ আগস্ট দুপুর ১টা ৫৭ মিনিটে করা টুইটে তিনি লেখেন, ‘সময় এসেছে বাংলাদেশের শেখ মুজিবর ও হাসিনার মতো স্বৈরশাসকের বিচার করার। পরিবারতন্ত্রের ইতি ঘটবে।’
এরপর পরদিনের টুইটে গোমেজ বলেন, ‘গোলাম আজম নয়, শেখ মুজিবকে যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা উচিত। তিনিই অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছেন। আজম তো শান্তির দূত।’
জয় যখন ৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় টুইটের মাধ্যমে গোমেজের হুমকির কথা প্রকাশ করে দেন, তার জবাবে গোমেজ রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে আবার টুইট করেন, ‘আশ্চর্য! টুইটের ফলে তুমি (জয়) ভয় পেয়েছো? কিন্তু তোমার মা হেফাজতে ইসলামের নির্দোষ মানুষদের হত্যা করেছেন। তাদের পরিবারের কেমন লেগেছিল? সেগুলো ছিলো বুলেট।’
এরপর তিনি এ ধরনের টুইট করা বন্ধ করেন। তবে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গোমেজকে এখনও সক্রিয় দেখাচ্ছে, যদিও সেখানে তিনি টুইটগুলো আর রিপোস্ট করেননি।
জয় এরপর তার ফেসবুক পোস্টে গোমেজের হুমকির স্ক্রিনশট দিয়ে উল্লেখ করেন, ‘নিচের টুইটটি সরাসরি আমাকে পাঠিয়েছে উইলিয়াম গোমেজ নামের এক ব্যক্তি। সে নিজেকে একজন মানবাধিকার কর্মী বলে দাবি করে এবং খুব সক্রিয়ভাবেই সে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ ছড়িয়ে থাকে। আজকে সে আমাকে উদ্দেশ্যে করে একটি টুইট বার্তার মাধ্যমে আমার মা এবং পরিবারকে তেমনভাবে খুন হবার আশা প্রকাশ করেছে যেমনভাবে আমার পরিবারকে ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হয়েছিলো। এতে প্রমাণ হয় মানবাধিকারে সে কোনভাবেই বিশ্বাসী নয়, উপরন্তু আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানোর লক্ষ্যে এর বেশ ধারণ করেছে। বাস্তবে সে একজন সন্ত্রাসী।’
সমস্ত বিষয়টি তীব্র আলোড়ন তুলে সামাজিক মিডিয়াসহ সব গণমাধ্যমে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান সাধারণ ফেসবুক-টুইটার ইউজার, ব্লগাররাও। এর পরদিন প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার নির্দেশ দিলেও এ ঘটনার কোনো সর্বশেষ আপডেট পাওয়া যায়নি।
বহুরূপী গোমেজ:
শুধু বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে নয়, সম্প্রতি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও গোলাম আজমকে দেওয়া আদালতের সাজার বিরুদ্ধেও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন গোমেজ। বাঁশের কেল্লার মতো কিছু জামায়াতপন্থী ফেসবুক পেজের পোস্ট নিয়মিত টুইট করেছেন তিনি। এছাড়া ছাত্রশিবির ফেসবুক পেজও তিনি ফলো করেন এবং সেখান থেকে রিটুইট করেন।
টুইটারে দেওয়া তথ্যমতে, গোমেজ একজন মানবাধিকার কর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি নিজেকে একজন ‘ইন্টারফেইথ অ্যাক্টিভিস্ট ও ফেয়ার ট্রেড অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবে।
ফেসবুকের নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- বাংলাদেশি সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও লেখক উইলিয়াম নিকোলাস গোমেজের জন্ম ঢাকায়, ১৯৮৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর।
তার ফেসবুক প্রোফাইলের কাভার ফটোতে গোলাম আজমকে হাত নাড়তে দেখা যায়। এছাড়া তিনি শেখ মুজিবের ১৯৭৫ সালের একটি ফটো পোস্ট করেছেন, যার নিচে লিখেছেন। ‘শেখ মুজিবর রহমান, ফ্যাসিবাদী শাসক... খুনি, ফ্যাসিস্ট মুজিবকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি আমি।’ সেখানে তিনি নিজের ফোন নম্বর (+৮৮০১৯৭৪৪৪০৬৬৬) ও ইমেইল আইডিও () দিয়েছেন।
ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া তথ্যানুসারে, গোমেজ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগনভিত্তিক একটি অনলাইন পত্রিকা সালেমনিউজডটকমের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। ওই পত্রিকায় তার ব্যাপারে বলা হয়েছে- উইলিয়াম গোমেজের চোখে বিশ্ব। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তিনি সক্রিয়।
গত বছর গোমেজ ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কের সেন্টার ফর অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান রাইট্সের ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। ২০০৯ সালে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ওপেনডেমোক্রেসি নামে একটি আন্তর্জাতিক ব্লগসাইটের মতে, তিনি এশিয়ান হিউম্যান রাইট্স কমিশনেও কাজ করেছেন।
পেশাদারদের জন্য সামাজিক গণমাধ্যম লিঙ্কড ইনে দেওয়া তথ্যমতে, গোমেজ ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান পত্রিকার বাংলাদেশ সংবাদদাতা ছিলেন। তার ফেসবুক পেজে বলা আছে, তিনি ইতালিভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এশিয়ানিউজে ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। সে সময় তিনি প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট অব বাংলাদেশ স্বীকৃত ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ছিলেন বলেও দাবি করেছেন। এছাড়া ২০০৭ সালে ক্রিশ্চিয়ান ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (সিডিএ) প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত এর নির্বাহী পরিচালক ছিলেন।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হাফিংটন পোস্টের ব্লগেও লেখালেখি করেন। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ব্লগ, মাইনিউজডটইন, মুক্তমনাতে লিখতেন। তার লেখালেখির সংকলন রয়েছে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট williamnicholasgomes.com-এ। গোমেজের ফেসবুক পেজে তার কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া আছে, যাতে বলা হয়েছে তিনি সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের অধিকারসহ নানা জাতীয় পর্যায়ে কাজ করেছেন।
এছাড়া ২০০৭ সালে তিনি ‘রহস্য’ নামে একটি শর্টফিল্মের মাধ্যমে চিত্রনির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুসলিম ও খ্রিস্টান পরিবারের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিয়ের ফলে তৈরি হওয়া নানা জটিলতা এর প্রতিপাদ্য বিষয়। গোমেজের আরো দুটি শর্টফিল্মের নাম ‘আল্লাহর নামে হত্যা’ ও ‘অজানা গন্তব্য’। এ দুটিরই মূল বিষয় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে চলমান বৈষম্য।
এসব শর্টফিল্ম তৈরির কারণে বাংলাদেশের বেশ কিছু গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে তার ডাক পড়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। মুসলিম থেকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় গ্রুপ তাকে অব্যাহত হুমকিও দিয়েছে। র্যাবের ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ বিরুদ্ধে তিনি একজন সক্রিয় আন্দোলনকারী দাবি করে র্যাবকে ভেঙে দেওয়া দাবি করে আসছেন সামাজিক মিডিয়ায়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় ব্রিটেনে জামায়াতের আইনি পরামর্শক টবি ক্যাডম্যানকে যখন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দেশে প্রবেশে বাধা দিয়েছিল, তখন গোমেজ প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের নিয়মকানুন মেনে বিচারকার্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন।
সুত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বিষয়: বিবিধ
১২৮৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন