মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাসের বই! এবং নতুন প্রজন্মের ভাবনা?
লিখেছেন লিখেছেন সত্যানুসন্ধানী ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১২:৪৪:১৬ রাত
আমি নুতন কোন ইতিহাস রচনা করছি না! মনোজগতের কাল্পনিক ভাবাবেগের সন্নিবেশ ঘটিয়ে গল্প-উপন্যাস অনেকেই হয়তো রচনা করতে পারেন কিন্তু ইতিহাস রচনা!? আরেকটু শুদ্ধ করে যদি বলি, ইতিহাস কি আসলে রচনা করার বিষয় না কি ঘটনার প্রবাহেই ইতিহাসের সৃষ্টি? ৯১ থেকে ৯৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশনা জগতের আনাচে-কানাচে আমার নিয়মিত বিচরণ ছিল। এখনো মাঝে-মধ্যে বিচরণ করতে হয়। তখনকার বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে সর্বশেষ অভিজ্ঞতার সমাকলনে বর্তমান সময়ের লেখক/প্রকাশকের সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও আমাদের নতুন প্রজন্মের ভাবনার বিষয়ে আমার এ লেখনী প্রচেষ্টা।
১৯৯৩ সালে এরকম এক প্রকাশককে দেখেছি, তিনি যে লেখকের নাম দিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, সে লেখক জানেনই না, তিনি বই লিখেছেন! প্রকাশিত বই লাইব্রেরীতে দেখার পর লেখক, একদিন প্রকাশককে রাস্তায় রিক্সা দাঁড় করিয়ে বললেন, আপনার সাথে আমার পরিচয় আছে ভালো কথা। তাই বলে আমাকে না জানিয়েই আমার নামে বই ছেপে বাজারজাত করলেন এটাতো ঠিক হলো না। তখন প্রকাশক লেখকের নিকট হাত জোড় করলেন। বুঝলাম ঐ বই এর কোথায় কি লিখা হয়েছে লেখক জানেনই না! সব প্রকাশক এরকমটি নয় কিন্তু অনেকের মাঝে কেউ কেউ যে এরকম আছে তা যে সত্যি তা আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি।
শ’খানেক বছর আগেও মিথ্যা ইতিহাসের বই রচনা হতো বলে আমার জানা নেই। তবে এখন অনেক মিথ্যা রচনা তৈরী হয়। বই আকারে প্রকাশিতও হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এখন সারা পৃথিবীতেই মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে বিভ্রান্তি চড়ানো হচ্ছে। আজকের মুসলিম উম্মাহ যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সে জন্যে ইহুদী-খৃষ্টানচক্র বিভিন্ন NGO এর মাধ্যমেও এসব কাজ করছে। মুসলিম নামধারী কিছু ব্যক্তিদেরকে বড় অংকের অর্থ দিয়ে জঙ্গী-গোষ্ঠী তৈরী করাচ্ছে। কাড়ি কাড়ি অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ইসলাম বিদ্বেষী জ্ঞানপাপীদের দিয়ে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ব্যবহার করে তারা এসব কাজ করছে। কোন একটি মিথ্যাকে যদি ক্রমাগত দুই যুগ প্রচারণা চালানো যায় তবে নতুন প্রজন্মের কাছে সে মিথ্যাটি সত্য হিসাবেই প্রতিভাত হতে থাকবে। এটি কালো প্রচারণার একটি প্রধান কৌশল! শুধু মুসলিম উম্মাহ বিষয়েই নয়; উল্লেখিত চক্রের অর্থনৈতিক স্বার্থও নিহিত রয়েছে ষড়যন্ত্রে। বাংলাদেশীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এগিয়ে গেলে তাদের উপর বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমে যাবে। সে জন্যে সেসব চক্র বিভিন্ন ইস্যূতে বাংলাদেশের মানুষের মানষিকতাকে শুধু বহুবিভক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি! বিভিন্ন মাধ্যমে নৈতিকতার স্খলন ঘটিয়ে লোভী মানষিকতার চরম পর্যায়ে অবনীত করেছে। আর এই লোভী মানষিকতাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যেই অর্থের বিনিময়ে এখন মিথ্যা ইতিহাস রচনা করানো হচ্ছে! লোভের কাছে হার মেনে নিজের দেশের স্বার্থও জলাঞ্জলি দিচ্ছে অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবি!
আজকে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বই রচনা করছেন; তারা কিভাবে করছেন তা অবশ্যই নতুন প্রজন্মকে ভেবে দেখা দরকার। ঘটনার ৪০ বছর পরে, ৪০ বছর আগের ইতিহাস লিখতে হয়! এটি শুধু হাস্যকরই নয় জাতির জন্যে হতাশা ব্যঞ্জকও বটে! উনারা ৩৯ বছর আগে লিখেননি কেন? ৩৮ বছর আগে লিখেননি কেন? কেনইবা লিখেননি ৩৭ বছর আগে? কোন্ অপশক্তি তাদেরকে বাঁধা দিয়েছিল তখন লিখতে?
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জাতির নিকট তুলে ধরা কোন একজন নয় শুধু, দশ/বিশজন লেখকের পক্ষেও সম্ভব নয়। যৌক্তিকভাবে বলা যায়, পিরোজপুরের অধিবাসী বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, পিরোজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়ীয়েছেন সে রকম একজন সত্, নীতিবান ও দক্ষ সাংবাদিক বা মুক্তিযোদ্ধা, তত্কালীন পিরোজপুরের সার্বিক অবস্থার যতটুকু সঠিক তথ্য বিবরণ জাতিকে জানাতে পারবেন; সেই একই সময়ে সুনামগঞ্জে অবস্থানকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা বা সাংবাদিক সত্, নীতিবান ও দক্ষ হলেও পিরোজপুরের ব্যাপারে ততটুকু সঠিক তথ্য বিবরণ জাতিকে তিনি জানাতে পারবেন না। এ শুধু অবস্থানগত কারণের জন্যে নয়; তত্কালীন সময়ের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আজকের দিনের মতো এতো উন্নত এবং সহজলভ্য ছিলনা সেটিও এর একটি প্রধান কারণ। প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম কিংবা শহরের মহল্লায় বেঁচে থাকা এক বা একাধিক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে যদি যার যার চাক্ষুষ ঘটনা প্রবাহগুলোর বর্ণনার লিখিত সন্নিবেশ ঘটানো যেত তবেই সেটা হতো সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। থানা ভিত্তিক সুচিপত্রের মাধ্যমে প্রতিটি পাড়া-মহল্লা, গ্রাম কিংবা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাক্ষরিত দলিলগুলোই হতো ইতিহাসের পাতা।
আমি মুক্তিযুদ্ধের কিছু কিছু ইতিহাস পড়েছি এবং আরো পড়ছি। শুধু তাই নয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলেই তত্কালীন সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন সে রকম একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সাথেও আমার আলাপ হয়েছে। এখানে একটি কথা বলে রাখা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমাদের অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা যুদ্ধে শহীদ হননি তাঁদের নিকট থেকে জেনেছি, আমাদের চৌ-গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্রাগার ছিল আমাদের গ্রামের বাড়ীর কাছারী (মাটির তৈরী) ঘরটি। আমাদের গরীবি হালতে যখন যতটুকু খাবার রান্না করা সম্ভব হয়েছিল ততটুকুন দিয়েই কাছারী ঘরের সেই অস্রাগারের নির্ঘুম ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আমার মা/চাচারা খাবার সরবরাহ করেছিলেন।
তাঁদের নিকট থেকে আরো জেনেছি, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধাই তাদের সকল অস্র সরকারের নিকট জমা দেননি কিংবা দিলেও যার করায়ত্তে ৩টি ছিল তিনি ২টি বা ১টি জমা দিয়েছিলেন? আজকের প্রজন্ম যদি এ প্রশ্ন করে, যারা তখন অস্র জমা দেননি তাদের সততা ও নৈতিকতা কেমন ছিল? কি উদ্দেশ্যেইবা তারা সেগুলো রেখে দিয়েছিলেন? নুতন প্রজন্ম কি এর সঠিক উত্তরটি পাবে? স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা; অভাব ও দূর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছিল। পাশের বাড়ীর সাথে সীমানা বিরোধ, বাপ-চাচাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসাবে ভাগ-বন্টন নিয়ে বিরোধ কিংবা পাশের গ্রামের কারো সাথে ব্যক্তিগত পূর্ব শত্রুতার জের ইত্যাদী বিষয়গুলোও উল্লেখিত অভাব ও দূর্ভিক্ষের সাথে ধীরে ধীরে একীভূত হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ৭২, ৭৩ ও পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাংক লুট হয়েছিল, গ্রামে-গঞ্জের অনেক বাড়ীতে ডাকাতি হয়েছিল, খুন-গুমও হয়েছিল অনেক মানুষ এবং এমনকি একজন গাজী মুক্তিযোদ্ধার হাতে আরেকজন গাজী মুক্তিযোদ্ধাও এসব কারণে খুন হয়েছিলো।
৭১ সালের গাজী মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই বিগত ৪০ বছরে মৃত্যূরবণ করেছেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধা আমৃত্যূ নিজেকে নীতি-নৈতিকতায় ও সততায় ধরে রেখেছিলেন তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সালাম কিন্তু যেসব গাজী মুক্তিযোদ্ধারা ৭২ সাল থেকে উল্লেখিত বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত হয়ে গ্যাছেন, অস্রসহ ধরা পড়েছেন তাদের প্রতি কারো অন্তর থেকে কিভাবে শ্রদ্ধা বা সালাম উৎসরিত হবে? নুতন প্রজন্মের নিকট তারাতো লোভী, অপকর্মকারী বা দূর্নীতিগ্রস্থ বলেই বিবেচিত হবে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর কোন সৎ লেখক যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে এরূপ লোভী, দূর্নীতিগ্রস্থ তথা সততা থেকে বিচ্যূত কোন জীবিত মুক্তিযোদ্ধার নিকট উপস্থিত হন তবে এ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অপকর্মগুলোকে ঢেকে কিংবা অন্যের ঘাঁড়ে দোষ চাপিয়েই মিথ্যা ইতিহাসের প্রচারণায় সামিল হবে। এভাবেই সঠিক ইতিহাস বিকৃত হয়ে মিথ্যা নতুন ইতিহাসের বই প্রকাশিত হয়ে যাবে! আর এসব বই পড়ে নুতন প্রজন্ম যে বিভ্রান্ত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতা নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে যথাসময়ে লিপিবদ্ধ হলে তবেই তা হবে ইতিহাসের সঠিক বই। তাহলেই ভবিষ্যত প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জেনে তা থেকে শিক্ষা নিতে পারবে। গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে পাঠক সমাজে রচয়িতার ব্যক্তিগত সততা ও নৈতিকতার প্রশ্ন অনেকাংশেই গুরত্বহীন। কিন্তু ইতিহাস লিপিবদ্ধকারী যিনি; তার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত সততা, নৈতিকতার প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস লিপিবদ্ধকারী যদি তার ব্যক্তি জীবনে সততা, নৈতিকতা ও শ্লীলতা থেকে বিচ্যূত হন তবে তিনিই হয়ে যান মূলতঃ ইতিহাস রচনাকারী! বই কিনে কেউ দেউলিয়া না হলেও ইতিহাস রচনাকারীর ইতিহাস পড়ে যে বিভ্রান্ত হওয়া সম্ভব, সে বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই খেয়াল করা উচিৎ।
বিষয়: বিবিধ
১৯৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন