আমার দেখা কয়েকজন (অ)সাধারন মানুষ।
লিখেছেন লিখেছেন মাটিরলাঠি ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:১৪:০০ রাত
শিরোনামটি দিতে চেয়েছিলাম – The Real Heroes.
নাসিমের মাঃ
১৮১৫ সালে স্থানীয় মহারাজা উপাধীধারী জমিদাররা একটি হাট প্রতিষ্ঠা করেন নাম ছিল রয়্যাল বাজার (Royal Bazar) – কালক্রমে নাম হয়েছে রেলবাজার। নাম বাজার হলেও এটি একটি হাট – সপ্তাহে দুদিন বসে। দোকান ঘরগুলো উপরে টিনের ছাউনী, নীচে মাটির উঁচু মেঝে। এই বাজারে একসময় অনেক নদীভাঙ্গা, ছিন্নমূল মানুষ বাস করত পরিবার পরিজন নিয়ে। হাটবারে বিছানা বালিশ প্যাক করে উপরে ছাউনীর নীচে কাঠের ফ্রেমে রেখে দিত। মানুষ গুলির জীবিকা ছিল – ভিক্ষা করা, বাসা বাড়ীতে কাজ করা, হাটের আগের দিন দোকানদারদের মাটির মেঝে ঝাড়ঝাঁটা দেওয়া ও পানি মিশানো মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া এবং হাটের দিনে দোকানে দোকানে বাজারের কয়েকটি কুয়া ও টিউবওয়েল থেকে কলস ভরে পানি সরবরাহ করা। (বর্তমানে মেঝেগুলো পাকা হয়ে গেছে)।
এখানেই বাস করতেন এক মহিলা নাসিমের মা। দুই চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ। কিন্তু তিনি জীবিকার জন্য পারত পক্ষে ভিক্ষা করতেন না। কয়েকটি দোকান তিনি অন্ধ হওয়া সত্বেও নিজেই ঝাড় দিতেন, তারপর মেঝেগুলো লেপে দিতেন। এবং হাটের দিনে বেশ কিছু দোকানে কলস দিয়ে পানি সরবরাহ করতেন।
দৃশ্যটি ভাবুন – একজন অন্ধ মানুষ হাজার লোকের ভিতর দিয়ে কলস কাঁখে নিয়ে কুয়া বা টিউবওয়েলের কাছে যাচ্ছেন, পানি সংগ্রহ করছেন ও নির্দিষ্ট দোকানে পৌঁছে দিচ্ছেন। খুবই নিষ্ঠার সাথে তার কাজ গুলি করতেন। সর্বদা হাসিখুশী থাকতেন। তখন আমাদের বয়স খুবই কম ছিল, (তখন ব্রেইল পদ্ধতির হয়ত নামই শুনিনি) – আমরা তার কাজগুলি অবাক বিস্ময়ে দেখতাম। উনি এখন বেঁচে নাই। তার সর্বদা হাসিখুশী ও সর্বদা মাথায় ঘোমটা দেয়া অন্ধ মুখটি আজো মনে পড়লে মন ও চোখের পাতা ভারী হয়ে যায়। মহান আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাত নসীব করুন।
কালাম ভাইঃ
পেশায় একজন ঝালাই কার। ছোট বালতি ও হাতে ঘুরানো হাওয়া মেশিন দিয়ে তৈরী তার হাপর। রিপেয়ার করতেন প্লাস্টিকের তৈরী জিনিশপত্র যেমন, ভাঙ্গা বালতি, গামলা, ছেড়া স্যান্ডেল, জুতা ইত্যাদি। অসম্ভব পরিশ্রমী মানুষ। উরু থেকে নীচের দিকে পা-দুটো সম্পূর্ণ কাটা পড়ে এক্সিডেন্টে। নিজের তৈরী একধরনের প্লাস্টিক আবরণ ব্যবহার করতেন পা-দুটোর কাটা অংশে। বাঁধা রিক্সা ছিল, রিক্সাওলাই দিন শেষে তাকে রিক্সায় তুলে নিতেন তার জিনিশপত্র সহ। আবার হাটের দিনে নিয়ে আসতেন। কালাম ভাই স্বভাবে খুবই রাগী ছিলেন। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্বেও ভিক্ষাকে পেশা করেন নাই। মেহনত করেছেন সারাজীবন।
নাম না জানা এক ভাইঃ
টিভি ও পত্রিকায় দেখেছিলাম এক ভাই যুদ্ধে এক পা হারান। কিন্তু বাকী এক পা দিয়েই রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন, অন্যের দারস্থ হন নাই। আমাদের শহরে একজন রিক্সাওলা ভাইকে দেখেছি, তার একটি চোখ ছিল অন্ধ, সুন্দর ভাবে গাড়ী চালাতেন। অনেকে তার রিক্সায় উঠতে ভয় পেতো। আমি তার গাড়ীতে উঠে কখন কোন অসুবিধার সম্মুখীন হই নাই।
কাশেম ভাইঃ
ক্রাচ ছাড়া চলা ফেরা করতে পারেন না কিন্তু সংগ্রামী মানুষ, ভিক্ষা করেন না। ইটের খোয়া ভেঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করেন।
হাফেজা খালাঃ
দীর্ঘদিন আমার ঢাকার বাসায় গৃহকর্মী ছিলেন। ছোট বেলায় তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। যৌবনে তার বাবা তাকে এক লোকের সঙ্গে বিয়ে দেন যৌতুকের বিনিময়ে এবং ছেলে দেখে শুনেই বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পরে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায় কানী অপবাদ দিয়ে এবং অন্য জায়গায় বিয়ে করে। এরপর খালা চলে আসেন ঢাকায়, কিছুদিন রাজশাহীতে, আবার ঢাকায়, পেশা গৃহকর্মী। পরকাল আছে, তাই জীবনে কখনও কোন প্রলোভনে জড়ান নাই। একবার তিনতলা ফ্লাটে আটকা পড়েন। নিজেকে বাচাতে ব্যালকোনী থেকে লাফ দেন, সরাসরি পড়েন গিয়ে গাড়ীবারান্দার টিনে চালে, এই অছিলায় প্রাণে বেঁচে যান। হাসপাতালে ছিলেন অনেক দিন। অসম্ভব স্নেহ করতেন আমাদেরকে ও আমার সন্তানকে। নিজে মুরগী কিনে রান্না করে নিয়ে আসতেন আমার ছেলের জন্য। অনেক বছর পরে তার স্বামী তার কাছে এসে ক্ষমা চায়, ফিরে যেতে বলে, তিনি রাজী হননি। গৃহকর্মীর আয় দিয়ে তিনি ছোট বোনদের বিয়ে দিয়েছেন, তাদের সন্তানদের মানুষ করেছেন। সারা জীবন দিয়ে গেছেন, নেননি কিছুই।
এই রকম অসংখ্য নাম না জানা সুপার হিরো আছে আমাদেরই মাঝে, আমাদেরই আশেপাশে, হয়ত অসম্ভব প্রাণশক্তি সম্পন্ন ও সৎ, বাধা ডিঙাবার অদম্য মনোবল সম্পন্ন কিছু মানুষের কারণে এখনো আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করে চলেছেন।
“পূণ্যময় তিনি, যাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।
যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।” (আল-কুরআন; সুরা-৬৭, আয়াত-১ ও ২)
**পোস্টে ব্যবহৃত নাম গুলি ছদ্মনাম।
**ছবি দুটি আমার তোলা - মোবাইলে।
বিষয়: বিবিধ
২০১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন