১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস নিয়ে
লিখেছেন লিখেছেন অধিকারের কথা ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:২৫:৫৭ রাত
১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষাদিবস। দিনটি পালন করে বাংলাদেশের অনেক প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন। ১৯৬২ সালের এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ শরিফ শিক্ষাকমিশনের বাণিজ্যমুখীন শিক্ষাব্যবস্থা চালুর সুপারিশের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকেছিল।
পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি শিক্ষা কমিশনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ঘোষনা করেন। এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি তার একসময়কার শিক্ষক আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষাবিভাগের সচিব এস এম শরিফকে নিয়োগ করেছিলেন। উক্ত কমিশনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪ জন ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬ জন সদস্য নিযুক্ত করা হয়। শিক্ষাকমিশনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোনাজাতউদ্দিন, ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আতোয়ার হোসেন ও ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ ড. এ রশীদ।
কমিশন ১৯৬২ সালের ২৬ আগষ্টের মধ্যেই অন্তবর্তীকালীন এক প্রতিবেদন প্রেসিডেন্ট বরাবর পেশ করে। পরে ১৯৬২ সালে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট গন্থাকারে মুদ্রিত করা হয়। এই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট পরে সকলের কাছে শরিফ শিক্ষাকমিশন রিপোর্ট হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পায়।
শরিফ শিক্ষাকমিশনের রিপোর্টে কী ছিলো?
শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বহু বিষয়ের মধ্যে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো এবং যেসকল বিষয়ের কারণে এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ সংঘটিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো-
০১. শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়। বলা হয় যে, জাতীয় জীবনে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব রয়েছে। এতে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ডিগ্রি পর্যায় পর্যন্ত কারিকুলামে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক চালু করার সুপারিশ করা হয়।
০২. পাকিস্তানে যে সকল ভাষা রয়েছে সেসকল ভাষার জন্য অভিন্ন বর্ণমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। অর্থাৎ, বাংলা ভাষা বাংলা বর্ণমালায় না লিখে আরবি অথবা রোমান বা উর্দু বর্ণমালায় লেখার সুপারিশ করা হয়। একইসাথে বাংলা বর্ণামালার সংস্কারের সুপারিশও করা হয়।
০৩. তৎকালীন সময়ে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষাকোর্স দুই বছরে সমাপ্ত হতো। কমিশনের রিপোর্টে এই কোর্সের মেয়াদ তিন বছর করার সুপারিশ করা হয়।
০৪. এই কমিশনের রিপোর্টে যে বিষয়বস্তু সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম নিয়েছে তা হলো, এই রিপোর্টে শিক্ষাকে ’অধিকার’ হিসেবে না দেখে শিক্ষাকে ’বাণিজ্য’ হিসেবে দেখা হয়েছিল, অর্থাৎ শিক্ষাকে ব্যবসার কাতারে নামিয়ে আনা হয়েছিল। রিপোর্টে ’অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা’কে অসম্ভব বলা হয়। এতে বলা হয়,
”শিক্ষার জন্য জনসাধারণের নিকট হতে খুব সামান্যই অর্থসাহায্য পাওয়া গিয়াছে এবং আরো স্কুলের জন্য জনসাধারণ যতটা দাবি জানাইয়া থাকে ইহার অনুপাতে ব্যয় বহনের অভিপ্রায় তাহাদের কখনই দেখা যায় নাই।”(তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, ১৮৩০ থেকে ১৯৭১; ড. মোহাম্মদ হাননান; আগামী প্রকাশন)
মোটকথা তৎকালীন ছাত্রসমাজ এই শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিসমূহকে প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
শরিফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা
শিক্ষাকমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা শরিফ কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে হলেও মূলতঃ তৎকালীন সময়ে আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে উভয় পাকিস্তানের জনগণের যে ক্ষোভ ছিলো এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬২ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান(বর্তমান বাংলাদেশ)-এর জনগণের যে জাতিসত্তার জাগরণ ঘটেছিল তাও এই আন্দোলনকে তুঙ্গে নিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল।
শরিফ শিক্ষা কমিশন তার রিপোর্ট প্রকাশের পরে বিশেষতঃ যারা ডিগ্রি পর্যায়ে অধ্যয়ন করছিলো তারা তিন বছরের শিক্ষাকোর্সকে মেনে নিতে পারছিলো না এবং হঠাৎ করে ইংরেজি ভাষার মতো একটি বিদেশী অপরিচিত সাধারণ জীবনযাত্রায় অব্যবহৃত ভাষা চাপিয়ে দেয়ায় ছাত্ররা যারপরনাই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
ঢাকা কলেজ থেকে প্রথমে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এম আই চৌধুরি নামে একজন ডিগ্রি পর্যায়ের ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। পরে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ, কায়েদে আযম কলেজ(বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ)-এর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরাও এতে অংশগ্রহণ করে।
তারা সবাই মিলে ’ডিগ্রি স্টুডেন্ট ফোরাম’ নামে একটি ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তুলেন।
বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্নস্থানে এই ব্যানারে আন্দোলন মিছিল সভা সমাবেশ ধর্মঘট চলছিলো।
প্রথমদিকে ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলনে তৎকালীন সক্রিয় ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ভূমিকা ছিলো না। তবে স্থানীয় ভাবে ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা এতে ছিরো। পরে ১৯৬২ সালের ১০ আগস্ট ঢাকা কলেজ ক্যান্টিনে ¯œাতক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা এক সভায় মিলিত হয়। এতে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক কাজী ফারুক আহমদ বক্তব্য রাখেন। এই বৈঠক থেকে ১৫ আগস্ট সারাদেশে ছাত্ররা সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান করে। এছাড়া ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে সাধারণ ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।
আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে ডিগ্রি স্টুডেন্ট ফোরাম’ ব্যানারের নাম বদলে প্রথমে ’ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’-এর ব্যানারে আন্দোলন চলে। পরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
১৫ আগষ্টে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাবেশে প্রায় ২৫ হাজার ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়। ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক গতি পেতে থাকে। প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে ছাত্ররা মিছিল সভা সমাবেশের আয়োজন করছিলো।
ছাত্রদের এই লড়াকু ভূমিকা দেখে পাকিস্তান সরকার ১০ সেপ্টেম্বরের অবস্থান ধর্মঘটের স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে। প্রেসনোট জারি করে ছাত্রদের সংযত হতে বলে। ছাত্ররা অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। কিন্তু ১৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে হরতালের আহ্বান করে।
এই হরতালে শুধুমাত্র ছাত্রদের অংশগ্রহণ যেন না ঘটে, দেশের ব্যবসায়ী, শ্রমিক, চাকুরিজীবি, কৃষকরা যেন প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয় তার জন্য ব্যাপক প্রচারণা অব্যাহত থাকে।
আন্দোলন স্তিমিত করতে চাল বা চক্রান্ত
ছাত্রদের শরিফ শিক্ষাকমিশন বিরোধী সংগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের জাতিসত্তার জাগরণের সংগ্রাম ও একই সাথে আইয়ুব শাহীর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিকে মোড় নেবার পর্যায়ে চলে আসে। এই পরিস্থিতি দেখে পাকিস্তান সরকার আন্দোলনকে স্তিমিত করতে চেষ্টা চালায়। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সে সময়কার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ১০ সেপ্টেম্বর আটকাবস্থা থেকে মুক্ত করে দেয়। মোহাম্মদ হাননানের বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বইয়ে বলা হয়- গুজব রটে যে, ’পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক ছাত্র অসন্তোষ ও বিরাজমান আন্দোলনের পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করার জন্য সরকারই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছেন’।
বলা হয়ে থাকে সোহরাওয়ার্দী ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলন স্তিমিত করতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের প্রস্তুতি
১৬ সেপ্টেম্বর ডাকসুতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথসভা আহ্বান করে। এতে মিছিলের কথা বলা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর সকালে মিছিল শুরু হয়। মিছিলে তখন হাজার হাজার অংশ নেয়। মূলতঃ ছাত্রদের আন্দোলন হলেও দেখা যায় এই মিছিলে মেহনতি মানুষের উপস্থিতি ছিলো ৯৫ শতাংশের মতো। পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঢাকার হাইকোর্টে মিছিলের গতিরোধ করে ও গুলি চালায়। এতে বাবুল নামে একজন নিহত হন। বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তাফা গুলিবিদ্ধ ও নিহত হন। ওয়াজিউল্লাহ নামে একজন গৃহকর্মী গুলিবিদ্ধ হন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় তিনিও মারা যান। রাজধানীর রথখোলা থেকেও মেহনতি জনগণ মিছিল করে। পুলিশ ও আর্মি গুলি চালায়। ২৫০ জনের অধিক লোকজন এতে আহত হয়। দেশের অন্যস্থানেও মিছিল সংঘটিত হয়।
১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশ-সেনাবাহিনীর গুলি চালনা ও তিনজনকে খুনের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৩ দিনের শোক পালনের ঘোষনা দেয়। ২৪ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা পল্টনে এক ছাত্রজনসভায় সরকারের প্রতি ’চরমপত্র’ ঘোষনা দেয়।
পরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর গোলাম ফারুকের সাথে বৈঠক করেন। সরকার শরিফ শিক্ষাকমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের কাজ স্থগিত ঘোষনা করে।
এছাড়া ১৯৬৩ সালে যারা ডিগ্রি পর্যায়ে পরীক্ষা প্রদানের জন্য ফরম পূরণ করেছিল সরকার তাদের পরীক্ষা গ্রহণ না করে তাদের সবাইকে ’পাশ’ বা উত্তীর্ণ হিসেবে ঘোষনা করে। তবে ১৯৬২ সালের সারা বছরই আন্দোলন সংগ্রাম সংঘটিত হওয়ায় বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে মাত্র ২৭ দিন ক্লাশ চলেছিল বলে জানা যায়।
শরিফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে।
বিষয়: বিবিধ
১২৭৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তিন বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স বা প্রকেীশল শিক্ষায় ইন্ড্রাসট্রিয়াল ট্রেনিং বাধ্যতামুলক করার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল সেটাকে কোনভাবেই প্রকৃত শিক্ষার পক্ষে বলে মনে করা যায়না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রতিবছর অনার্স পরিক্ষা নেওয়ার নিয়ম করা হয় তখনও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু তখনই পৃথিবির সকল প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার বা টার্ম সিষ্টেম চালু হয়ে গিয়েছে। স্রেফ অন্ধ আবেগ আর মিথ্যা প্রচারনা নির্ভর এই আন্দোলনগুলি শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এবং এর ফলেই বরং শিক্ষার বানিজ্যিকিকরন হয়েছে। এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ভর্তি হলে পড়া শেষ হয়না আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পয়সা দিলেই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। এই আন্দোলনগুলিকে আবেগে এর পরিবর্তে যুক্তি দিয়ে মুল্যায়ন করলে এর ভুলগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন