’জয় বাংলা’ শ্লোগান দেশের ভিন্ন জাতিসত্তার জনগণের আকাঙ্খা ধারণ করে না
লিখেছেন লিখেছেন অধিকারের কথা ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৬:৪২:৪৯ সন্ধ্যা
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ জাতিগতভাবে নিজেদের ‘বাঙালী’ বলেই পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের মধ্যে অন্য জাতিসত্তার জনগনও রয়েছে। তাদের অবস্থানের ইতিহাস স্মরণাতীতকাল ধরে। ১৬ কোটি জনসমষ্টির তুলনায় হয়তো এই ভিন্ন জাতি বা ভাষা-ভাষী জনগনের সংখ্যা এক শতাংশরও কম। কিন্তু তারপরও তাদের অস্তিত্ব যে রয়েছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এবং দেশ নির্মানে এই ক্ষুদ্র জনসমষ্টির ভূমিকা বেশী বই কম নয়।
আমার আজকের এই লেখা অবতারনা করার আগে আমাকে উক্ত কথাগুলো বলতে হলো।
এবার প্রসঙ্গে আসি, শাহবাগের লড়াই বা অন্য যে কোন লড়াইয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন বা জাতির পাশাপাশি অন্য জাতিসত্তার জনগনও সবসময় একীভূত হবার চেষ্টা করেছে।
শাহবাগের লড়াইয়েও তারা সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই লড়াইয়ের শ্লোগানের সবগুলোতে কন্ঠ মেলালেও যখনই ‘জয় বাংলা’ বা ‘তুমি কে, আমি কে – বাঙালী, বাঙালী’ বলা হয়েছে তখনই তারা এই শ্লোগানের সাথে একাত্ম হতে পারেনি। কারণ তাদের ভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্বের চেতনাবোধের জন্য।
এই শ্লোগান দেয়ায় ভিন্ন জাতিসত্তার জনগণের আপত্তি থাকলেই য়ে তা বন্ধ করার আহ্বান জানানো সমীচীন হবে তা মানার মতো কথা নয় হয়তো। একটি বৃহৎ জাতি তার জাতিচেতনাকে লালন করবে সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এই শ্লোগানের আড়ালে যখন থাকে ‘সংকীর্ণ জাত্যাবিমান’, যখন থাকে ‘জাতি বিদ্বেষ’ তখন কিন্তু এই শ্লোগানকে নিছক সাদামাঠা শ্লোগান হিসেবে ভাবা যায় না, ভাবা সম্ভব বা সমীচীনও নয় অন্তত স্বাধীনতার পর থেকে দেশের ইতিহাসকে বিবিচনায় নিয়ে।
আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালের পর শেখ মুজিব যখন রাঙামাটিতে নির্বাচনী ভাষণ দিতে যান তখন তিনি পার্বত্য জুম্ম জনগণকে ‘বাঙালিী জাতিতে প্রমোশন’ দিয়ে দেবার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণার কারনেই পার্বত্য জনগণ সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের কথা চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে প্রণীত দেশ পরিচালানর মূলনীতি সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসমূহের কথা লেখা হয়নি। গত ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালী বলা হয়েছে। সংবিধানের প্রথম ভাগের ‘প্রজাতন্ত্র’ অংশে লেখা রয়েছে,’ (২) বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’। এই সংবিধানের মাধ্যমে অন্য জাতির অস্তিত্বের কথা পুরোদস্তুর অস্বীকার করা হলো, অথবা অন্য জাতির জনগণকে বানানো হলো কার্যত দ্বিতীয়/তৃতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে।
আজ এই ফ্যাসিস্ট সংবিধান নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য কেউ করছেনা। উপরন্তু নতুন যে লড়াই নতুন প্রজন্ম শুরু করেছে সেখানেও আমরা দেখছি এই ‘জয় বাংলা’ বা তুমি কে, আমি কে-বাঙালী, বাঙালী’ শ্লোগান।
এই শ্লোগান যদি কোনো চরম জাতীয়তাবাদীরা দিতো তবে কোনো রা ছিলো না। কিন্তু এখন এই শ্লোগান দিচ্ছে ‘প্রগতিশীল’ ‘গণতান্ত্রিক’ নামাঙ্কিত সংগঠন বা চেতনার ব্যক্তি বা সমষ্টি।
তাদেরই একজনের একটি লেখায় আমি মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছি, “যখন আমরা দুনিয়ার মজদুর বলি তখন আমরা একটি ভাবাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। জয় বাংলা কোন ভাবাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করবে? ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের ঘোষণাকে? ১৭ এপ্রিলের ঘোষণায় দেশের অন্য জাতিসত্তার জনগনের কথা নেই।”
যার বক্তব্যের সূত্র ধরে এই মন্তব্য করেছি তার লেখার সূত্র নিচে
উন্মোচনে অরূপ রাহীর লেখা
লেখককে আমি চিনি একজন প্রগতিবাদী হিসেবে।আমি জানি তাদের সংগঠন বা তারা লালন করেন মার্ক্সীয় আন্তর্জাতিকতাবাদী মতাদর্শ। তাই তাদের এই ‘জয় বাংলা’ প্রীতি এবং ‘বাঙালী’ত্বের প্রতি মমতাবোধ এবং তাকে একটি রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবে ধারণ করাটাকে আমার কাছে মনে হয়েছে স্ববিরোধিতা।
এখানে একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন না করলেই নয়। লেখক তার লেখায় এই ‘জয় বাংলা’ শব্দটির পক্ষে যুক্ত তুলে ধরার ক্ষেত্রে কিছু শব্দ, শব্দসমষ্টি বা বাক্যাংশ জোর দিয়ে ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘জয় বাংলা’- বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্জিত একটা রাজনৈতিক স্লোগান,
একটা রাজনৈতিক ঘোষণা । একটা রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। একটা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা । একটা রাজনৈতিক দাবি। মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের জয়ের আশাবাদ।
কিন্তু এই শ্লোগানের স্বপক্ষে কোনো জোরালো যুক্তি হিসেবে এই বাক্যাংশ বা শব্দসমষ্টিকে অভিহিত করা যায় না। কেননা এই ‘রাজনৈতিক দাবি’ আসলে কী দাবি, বা ‘জয়ের আশাবাদ’ মানে কী জয়ের আশা? বা ‘রাজনৈতিক আকাঙ্খা’ মানে এই ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের মা্ধ্যমে কী বোঝায় তা কিন্তু এই শব্দসমষ্টিতে স্পষ্ট হয় না।
এ বিষয়ে এখানে রাজনৈতিক-মতাদর্শিক বিতর্কের অবতাড়না করে লেখাটিকে ভারাক্রান্ত করার ইচ্ছে নেই। তবে পার্বত্য জনগণ এবং বাংলাদেশের অন্য জাতিসত্তার বা অন্য ভাষা-ভাষী জনগণ এই শ্লোগানের্ প্রতি একটু্ও একাত্মতাবোধ জানানোর পক্ষে থাকতে পারছে না বলেই এত লম্বা একটি লেখার অবতাড়না এখানে করতে হলো।
এই শ্লোগান ভিন্ন জাতিসত্তার জনগণের আকাঙ্খাকে ধারন করে না। এই শ্লোগানের অন্তর্নিহিত যে ভাবার্থ রয়েছে সেই দিকটিকেই বরং আমাদের মত ছোট জাতি সমূহকে বেশী ভাবাচ্ছে।
উপরের লেখাটি বিভন্ন ব্লগ ও আমার ফেসবুক ও আমার ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করার পরে অনেকেই বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। আমি নিচের একটি মন্তব্য এবং আমার বক্তব্য তুলে ধরছি লেখাটির প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তুর দ্বারা যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হন তার জন্য।
পারভেজ আলম নামে আমার এক ফেসবুক বন্ধু জয় বাংলা বা তুমি কে আমি কে-বাঙালী, বাঙালী শ্লোগান বিষয়ে আলোচনা তুলে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন আমি তার চু্ম্বক অংশ তুলে ধরছি,
আমি এটা একজন ব্লগার হিসাবেই বিবেচনা করছি। আমরা এদেশের ব্লগাররা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নৈতিক জোড়ে এতোদুর এসেছি। আমরা চাই গণতন্ত্রের সুস্থ্য চর্চাই এদেশে চলুক। আমরা চাই এই আন্দোলনের পরে যাতে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আর অপরাজনৈতিক এবং অগণতান্ত্রিক চর্চায় ফিরে না যায়। আমরা চাই দেশের প্রত্যেকটা মানুষ এই আন্দোলন ধারন করুক, এবং তাতে সরিক হন। জামাত ছাড়া, জামাতের প্রশ্নই অবশ্য এখানে অবান্তর। এখন আমরা যদি এই আন্দোলনের সমর্থক সকল বাংলাদশের নাগরিক ধারণ না করতে পারি তবে সেটা গণতন্ত্রের প্রতি একটি অশ্রদ্ধা হবে বলে আমি মনে করি। আমরা চাই সমতল অথবা পাহাড়ের প্রতিটা ভাষা জাতির বাংলাদেশী নাগরিক যেনো এই আন্দোলনে সরিক হতে গিয়ে অস্বস্তিতে না পরেন।
তার এই স্ট্যাটাসে লাইক দিয়ে আমি যা লিখেছি তা নিচে তুলে ধরলাম,
কোনো শ্লোগানেই আমার বা আমাদের আপত্তি নেই বা থাকার কথা নয়। এমনকি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানেও না। তবে তার অন্তর্নিহিত ভাবটা যখন তাড়া করে তখন কিন্তু আমাদেরকে ভাবায়। আমরা স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের ‘তোমরা বাঙালী হয়ে যাও’ এই বক্তব্য দেয়া থেকে, ১৯৭২ সালে সংবিধানে অন্য জাতিসত্তার জনগণকে স্বীর্কতি না দেয়া এবং সর্বশেষ গত ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে বাংলাদেশের জনগণকে ‘জাতি হিসেবে বাঙালী’ বানানোর মাধ্যমে অন্য জাতিসত্তার স্বকীয় অস্তিত্বের স্বীকৃতিকে দ্বিতীয় শ্রেনীর কাতারে নিয়ে আসার মাধ্যমে আমরা এটাই ভাবতে বাধ্য হই যে আমরা কতটা জাতিগত বৈষম্যের মাঝে আজ রয়েছি।
জয় বাংলা অবশ্যই থাকতে পারে কিন্তু তার ব্যবহার বা তার লক্ষ্যটি যদি রাজনৈতিকভাবে ‘জাত্যাভিমান’ বা ‘জাতি বিদ্বেষ’ বা ‘অন্য জাতির অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিতে অবহেলা’ তবে তাতেই আমাদের মধ্যে আপত্তি।
এই লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাঠকদের মাঝে অন্য জাতিসত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেনতা এবং তাদের অধিকার প্রদানের প্রতি দায়িত্বশীলতা যাতে গড়ে ওঠে তার জন্য্। এই লেখার অন্য মানে না আনার জন্য অনুরোধ করা হলো।
বিষয়: রাজনীতি
১২০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন