গণমাধ্যমের অবৈধ দখলদারদের পক্ষে কলম ধরা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য!!
লিখেছেন লিখেছেন চেতনাবিলাস ১৭ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:১৮:৪২ দুপুর
গতকাল ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার প্রথম পাতার প্রতিবেদন থেকে ধারণা করা যেতেই পারে, প্রথম সারির মিডিয়ার এ আচরণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। পত্রিকাটি অনুসন্ধানের নামে ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনের চার নেতার যে পরিচয় তুলে ধরেছেন। তাতে শুধু তাঁদের সম্মানহানিই নয় বরং সরকারকে তাঁদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার মতো উস্কানি দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ হয়তো আজকের পুলিশি ধর-পাকড়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালেই এই আন্দোলনের সংবাদ প্রচার নিয়ে ‘গণমাধ্যমের ভূমিকা’ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কয়েকটি মিডিয়ার সরাসরি আন্দোলন বিরোধিতা ও সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে কুৎসা প্রচারের প্রতিযোগিতায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল প্রচন্ড ক্ষোভ। ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে মিডিয়াকর্মীদের একাংশ আন্দোলনের সংবাদ প্রচার না করার ঘোষণাও দেয় তখন। যদিও সেই ঘোষণা কোন কাজে আসেনি। সব মিডিয়াতেই আন্দোলনের সংবাদ প্রচারিত হতে দেখা গেছে। কিন্তু প্রচারে কুৎসা বা সাংবাদিকতার নীতিহীন অপপ্রচার থেমে নেই। প্রতিবেদন বা রিপোর্ট এর নামে মনগড়া গল্প পরিবশেন হতে দেখা যাচ্ছে। দৈনিক জনকন্ঠ শিরোনাম করেছিল, ‘ওরা স্বাধীনতাবিরোধী’ এবং মতিয়া চৌধুরীর আন্দোলনকারীদের রাজাকার আখ্যা দেওয়ার পর পরই এক শ্রেণীর মিডিয়া যেন উঠেপড়ে লেগেছে, আন্দোলনকারীদের জামায়াত-বিএনপির এজেন্ট প্রমাণ করার জন্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক আর রাজী র কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জবানকে বলেন, ‘যেকোন মিডিয়াতেই এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ আসলে সাংবাদিকতার বিবেচনায় আত্মহত্যার শামিল। ইত্তেফাকের মতো একটি পত্রিকার কাছে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারপর তা নিয়ে দু:খপ্রকাশ করার ঘটনাটা আসলে হতাশাজনক। সাংবাদিকতার জন্য এমন নজির মোটেও ভাল কিছু নয়’।
দৈনিক ইত্তেফাকের ‘কোটা আন্দোলনের সেই চার নেতার একজন শিবিরের সক্রিয় কর্মী’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে তারা মুহাম্মদ রাশেদ খাঁনকে শিবিরের সক্রিয় কর্মী বলে উল্লেখ করা হয়। সেক্ষেত্রে তারা যে যুক্তি স্থাপন করেছে তা হাস্যকর। ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহাম্মদ রাশেদ খানের একাউন্টে শিবিরের সমর্থক হওয়ার বিভিন্ন প্রমাণ মিলেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন তার আরেক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘একমাত্র ইসলামের ছায়াতলে রয়েছে শান্তির ঠিকানা।’
এছাড়াও নাম না উল্লেখ করে একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে বলা হয়েছে, শিবিরের ফেসবুক পাতা বাঁশেরকেল্লার একাধিক লেখায় লাইক দেয় এই মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন’। আরও উল্লেখ করা হয় রাশেদ খাঁন, ‘২০১২ সালে সূর্যসেন হলের ৫০৫ নম্বর কক্ষে থাকতো। শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় এবং শিবিরের লেখা বাঁশের কেল্লায় লাইক দেওয়ায় সে হলে থাকতে পারতো না।’
অথচ রাশেদ খাঁন জানিয়েছেন তিনি সূর্যসেন হলের ৫০৫ নম্বর কক্ষে কখনোই ছিলেন না।
আন্দোলনের আহ্বয়ক হাসান আল মামুন সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘তিনি কোটা বিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক। বর্তমানে তিনি ছাত্রলীগের ঢাবির মহসিন হল শাখার সহ-সভাপতি। তার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাঁশের কেল্লায় অনেক লেখায় তার লাইক দেওয়া আছে। নেত্রকোনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়জুর রহমান খান উমি বলেন, সে শিবিরের কর্মকান্ডে জড়িত।”
যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন সম্পর্কেও একই রকম তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও বন্ধুর বরাত দিয়ে বলা হয় তিনি শিবিরের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর সম্পর্কে বলা হয় তার বাবা একসময় বিএনপির কর্মী ছিলেন।
পত্রিকাটি বারবার গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানের কথা বলছে। কিন্তু সে সংস্থার নাম প্রকাশ করেনি। দেয়নি কোন প্রমাণও। ইতোমধ্যে ইত্তেফাক পত্রিকা দু:খ প্রকাশ করে তাদের অনলাইন ভার্সন থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলেছে; এতে প্রতীয়মান হয় প্রতিবেদনটির তথ্যের সত্যতা ছিল না। কিন্তু কেন এই মিথ্যাচার?
এর মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হয়রানি করার পথই সুগম হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমই কি তবে সহিংসতার উস্কানি দিচ্ছে? এই আন্দোলন নিয়ে সাংবাদিকতার জন্য গোটা মিডিয়া আজ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্র ও মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বদলে ক্ষমতার পক্ষে থেকে সম্মানহানির অপচেষ্টা সাংবাদিকতার জন্য অশনি সংকেত।
ফলে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির মন্তব্য থেকে এবং ইত্তেফাক পত্রিকার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা আসলে মিডিয়ার বর্তমান চরিত্রই সরল ভাবে উম্মোচিত করে দিয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের তথাকথিত মূলধারার মিডিয়া নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাংবাদিকতা করা হচ্ছে এখন। মোটকথা, এই সরকারের আমলে সাংবাদিকতার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা পরিস্কার হয়ে গেল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে আন্দোলনের এই টানটান উত্তেজনার মধ্যে সরকারের দমন-পীড়নের ভয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন অস্থির তখন এমন প্রতিবেদন যুদ্ধ উস্কে দেয়ার শামিল- বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন। আর বলাই বাহুল্য, এই যুদ্ধে বিশিষ্ট মিডিয়াগুলো জনগণের পক্ষে নাই। আছে ক্ষমতার পক্ষে। ফলে ‘ইত্তেফাক স্ক্যান্ডাল’ সাংবাদিকতার জন্য অনেক শিক্ষনীয় নজির তৈরি করেছে। মিডিয়া নৈতিকতা ভুলে প্রচার যন্ত্র হয়ে উঠলে তা যেমন বিপদ ডেকে আনে অন্যদিকে জনগণও তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। ইত্তেফাকের ঘটনার এটাও একটা বড় শিক্ষা।
জবান
বিষয়: বিবিধ
৬৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন