চলিতেছে ‘সার্কাস’! গোলাম মোর্তোজা

লিখেছেন লিখেছেন চেতনাবিলাস ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৭:২০:০৮ সন্ধ্যা

যাত্রা পালা’র মতো সার্কাসও এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। সার্কাসের বড় বড় দল ছিল। সার্কাস দলের অনেক সদস্যকে নিয়ে ছিল নানা কিংবদন্তি। সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ জোকার। কাজ দিয়ে এবং কথা বলে তারা মানুষ হাসান। বাংলাদেশ থেকে সার্কাস প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অনেক সমস্যা-জটিলতা। কঠিন জীবনেও হাসির উপাদানের উপস্থিতি যে একেবারে নেই, তা নয়। সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।

১. সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়েই লিখব। তবে একটু পেছনে ফিরতে চাই। ২০০৯ সালে সাবেক বাম নেতা নুরুল ইসলাম নাহিদকে যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, সর্বমহলে একটা স্বস্তি-আনন্দের ভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। কারণ ‘নৈতিক-সৎ’ মানুষ হিসেবে তার একটা পরিচিতি ছিল।

বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের বই পৌঁছে, তিনি তার সাফল্যের সূচনা করেছিলেন। অতীতে সরকারগুলো যা পারেনি, তিনি তা পেরেছিলেন। এখনও পারছেন। প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। গণমাধ্যম শুরু থেকেই ‘সফল এবং সৎ’ মন্ত্রী হিসেবে তার একটা পরিচিতি তৈরি করে দিয়েছে। আমরা তার এই পরিচিতি বারবার তুলে ধরেছি।

২. বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়ের একটি শিক্ষা। প্রত্যাশা ছিল তিনি দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। বিস্ময়করভাবে তিনি এক্ষেত্রে নিরব থেকেছেন। তার সবচেয়ে কাছের লোকজনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তিনি নিরব থেকেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি শুধু দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। গণমাধ্যমে আমরা দুর্নীতির এই বিষয়টিকে সেইভাবে তুলে ধরিনি, যেভাবে তার ‘সাফল্য এবং সততা’র কাহিনি প্রচার করেছি।

বর্তমান মুখ্য সচিব কামাল আবু নাসের চৌধুরী শিক্ষা সচিব হিসেবে যতদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ততদিন মোটামুটি একটা কার্যকর ব্যবস্থা চালু ছিল। বদলির ক্ষেত্রে তিনি একটি নির্মোহ পদ্ধতি চালু করেছিলেন। কামাল আবু নাসের চৌধুরী শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চলে যাওয়ার পর, অধপতন বড়ভাবে শুরু হয়। যা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

এই ভয়াবহ রূপের সবচেয়ে বড় প্রকাশ মন্ত্রণালয়ের সর্বত্র দুর্নীতি এবং দুর্নীতির চেয়েও বেশি কিছু প্রশ্নফাঁস।

৩. ‘প্রশ্নফাঁস’ হয় নাই’ ‘এসব প্রচারণা গুজব’ ‘তদন্ত করব’ ‘ব্যবস্থা নেব’ ‘প্রশ্নফাঁস যুগ যুগ ধরে চলছে’ ‘রাতারাতি প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা যাবে না’... একজন মানুষের পক্ষে যতরকম স্ববিরোধী কথা বলা সম্ভব, গত কয়েক বছরে শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নফাঁস নিয়ে তার সবই বলেছেন। বলা যায় তার কোটা পূর্ণ করে ফেলেছেন।

প্রশ্নফাঁসকে সার্বজনীন রূপ দিয়ে, এখন তিনি কথা বলছেন ঘুষ নিয়ে।

৪. কয়েক বছর আগে শিক্ষামন্ত্রী একটা অভিনব পদ্ধতিতে ঘুষ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অফিস পরিদর্শনে যেতেন আকস্মিকভাবে। পরিদর্শনে গিয়ে কর্মকর্তাদের সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন, ‘আপনি কি ঘুষ খান?’

কর্মকর্তারা বলতেন, ‘না, ঘুষ খাই না।’

‘ঘুষ কমিয়ে ফেলেছেন’- এমন একটা তৃপ্তির হাসি নিয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

বিষয়টি এমন যে, কর্মকর্তারা যদি ঘুষ খেতেন তাহলে তারা তো প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলতেন। যেহেতু ‘না’ বলছেন, সুতরাং তারা ঘুষ খান না।

৫. তার এই ‘ঘুষ না খাওয়া’ কর্মকর্তাদের সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘... আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা ঘুষ খাবেন, তবে সহনশীল হইয়্যা খাবেন। অসহনীয় হয়ে বলা যায় আপনারা ঘুষ খাইয়েন না, এটা অবাস্তবিক কথা হবে।’

শিক্ষা ভবনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের তিনি ঘুষ খাওয়া বিষয়ে এই পরামর্শ দিয়েছেন। ‘সৎ’ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব শুরু করা নুরুল ইসলাম নাহিদ তার কর্মকর্তাদের ঘুষ খেতে বলছেন ‘সহনশীল মাত্রা’য়। অনেক বেরসিক লোকজন প্রশ্ন তুলছেন ‘সহনশীল মাত্রা’ বলতে শিক্ষামন্ত্রী কোন মানদণ্ডের কথা বলেছেন? সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি মানদণ্ড, বেসিক ব্যাংক প্রায় দেউলিয়া করে দেওয়া মানদণ্ড, শিক্ষকদের পেনশনের টাকা থেকে ১০ শতাংশ ঘুষ নেওয়াটা মানদণ্ড? শিক্ষামন্ত্রী তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি। ধারণা করা হচ্ছিল, অচিরেই হয়তো ‘মানদণ্ড’ বিষয়ক বক্তব্য পাওয়া যাবে।

‘মানদণ্ড বিষয়ক ধারণাসূচক’ বক্তব্য পাওয়ার আগেই, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল মন্ত্রীর বক্তব্য বিষয়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলতে চাইল, মন্ত্রী পূর্বের দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ‘সহনীয় মাত্রা’য় ঘুষ খাওয়ার কথা বলেছেন। এখন ঘুষ খেতে বলেননি।

যদিও মন্ত্রীর বক্তব্যের অডিও-ভিডিও শুনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করা গেল না। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য আর মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা- বক্তব্যের সঙ্গে কোনও মিল নেই। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে পূর্বের বিষয নেই। তিনি খুব স্পষ্টভাবে কর্মকর্তাদের ‘সহনীয় মাত্রা’য় ঘুষ খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। এখানে ‘পূর্ব-যদি-কিন্তু-তবে-অথবা’ এসবের কোনও বিষয় নেই।

একটি অসত্য ঢাকার জন্যে অনেকগুলো অসত্য বলতে হয়। তাতে অসত্য ঢাকা পড়ে না, আরও জোরালো বা স্পষ্ট হয়। কোনও প্রবাদই যে অসত্য নয়, শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার পর আবারও তা প্রমাণ হলো।

৬. প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করার পর্ব এখানেই শেষ নয়। ‘ঘুষ খাওয়া’ বিষয়ক যুগান্তর’র প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি এসব নিয়ে কথা বলব না। আপনারা যা ইচ্ছে লেখেন। সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।... যারা (সাংবাদিক) হিউমার (ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ) বোঝে না, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।’

‘হিউমার’ না বোঝা সাংবাদিকদের সঙ্গে মন্ত্রী কেন কথা বলবেন, একদম ঠিক বলেছেন। সব দোষ এই সাংবাদিকদের। মন্ত্রীরা বলতেই পারেন, সাংবাদিকদের তা প্রচার করতেই হবে কেন? মানুষকে না জানালে কী হয়, সব কথা মানুষকে জানাতে হবে কেন? মন্ত্রী যাদের পরামর্শ দিয়েছেন, তারা জানলেই হলো। সব কথা সাধারণ মানুষের তো জানার দরকার নেই। তাছাড়া ‘একদা বাম এবং সৎ’ নেতা হিসেবে পরিচিত একজন মন্ত্রীর বক্তব্য যুক্তি দিয়ে দেখাও ঠিক নয়। তিনি যা বলেছেন তার অডিও-ভিডিও চিত্র থাকলেও, যুক্তি দিয়ে তা বিশ্লেষণ না করে, মন্ত্রীর পক্ষ হয়ে মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ব্যাখ্যা ‘বিশ্বাস’ করতে হবে। প্রশ্ন তোলার মতো ‘উন্নয়ন’ বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি যা বলবেন, সেটাই সঠিক হিসেবে ‘বিশ্বাস’ করতে হবে, যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে না।

শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, ‘... খালি যে অফিসাররা চোর, তা না, মন্ত্রীরাও চোর, আমিও চোর।’

সাংবাদিকরা এই বক্তব্যেরও সমালোচনা করে মহা অন্যায় করছেন। এটাকে যে ‘হিউমার’ এবং একজন মন্ত্রীর ‘মহানুভবতা’ হিসেবে দেখতে হবে, সাংবাদিকরা তা বুঝতেই পারছেন না। ‘ঘুষ খাবেন না’- এটা যে বাস্তবতা বিবর্জিত কথা, মন্ত্রী বুঝলেও, সাংবাদিকরা তা বুঝতে পারছেন না। সাংবাদিকদের জ্ঞান এতটাই কম যে, তারা ‘হিউমার’ও বোঝেন না, বাস্তবতাও বোঝেন না।

৭. অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চালের দাম ‘অসহনীয়’। শিক্ষামন্ত্রী ‘সহনীয় মাত্রা’য় ঘুষ খেতে বলেছেন। দুদক দুর্নীতি কমানোর সুপারিশ করছে। এক মন্ত্রী পচা চাল গম আমদানি করে আনছেন। কোনটা ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়’ আর কোনটা ‘ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ মন্ত্রণালয়’ সাংবাদিকরা তা বুঝতে পারছেন না। সাংবাদিকরা অভিযুক্ত, প্রশ্নফাঁসের সংবাদ প্রচার করে সরকারের ক্ষতি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

গ্রামের মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন কৃষকও অভিযুক্ত করলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকরা অনেক কথা বলেন, কিন্তু সব কথা তো বলেন না।’

কী বলি না?

‘পুলিশের চাকরির জন্যে গত বছর রেট ছিল ৮ লাখ টাকা, এ বছর হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এক বছরে রেট ৭ লাখ টাকা বাড়ানো হলো। এটা নিয়ে তো কোনও কথা বললেন না কেউ।’

রেট ৮ লাখ ছিল, এবার ১৫ লাখ হয়েছে- মানে কী?

বুঝতে পারছি না দেখে, কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিলেন। টমেটো ক্ষেতে স্প্রে করতে করতে বললেন, ‘পুলিশের একজন কনস্টেবলের চাকরি গত বছর হয়েছে ৮ লাখ টাকা দিয়ে। এবার ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে কনস্টেবলের একটি চাকরির জন্যে। ছেলের চাকরির জন্যে জমি বিক্রি করে ৮ লাখ টাকা দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু ১৫ লাখ টাকা দেব কিভাবে, এত জমি তো নাই।’

কনস্টেবলের চাকরির বেতন কত?

‘১৭ হাজার টাকা।’

১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ১৭ হাজার টাকা বেতনের চাকরি?

আবারও হাসি দিয়ে টমেটো চাষি আস্তে আস্তে বললেন, ‘উপরি’ আয় আছে না, ৫ বছরের মধ্যে টাকা উঠে আসবে।’

সত্যি কনস্টেবলের চাকরির জন্যে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় কিনা, আমি নিশ্চিত নই। গ্রাম-শহরে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, কথাটা অসত্য বা অজানা বা গোপন কিছু নয়।

গত দুই দিন আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছি, গ্রামের একজন কৃষক, যার দুর্নীতি করার কোনও সুযোগ নেই, তিনি জমি বিক্রি করে ছেলের চাকরির জন্যে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিচ্ছেন। ঘুষ নয়, তিনি এটাকে ‘রেট’ বলছেন।

ছেলে ‘উপরি’ আয় করে ৫ বছরের মধ্যে সেই টাকা তুলে আনবেন, সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত।

পুলিশ সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দেয়, ইয়াবা চোরাচালানে সম্পৃক্ত হয়, এই সংবাদ দেখে আমরা বিস্মিত হই। শিক্ষামন্ত্রীর ‘সহনীয় মাত্রা’র ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ নিয়ে আলোচনা করি।

ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতি উপর থেকে নিচে, স্তরে স্তরে কতটা বিস্তৃত হয়েছে একজন কৃষকের বক্তব্য থেকে তা পরিষ্কারভাবে বোঝা না যাওয়ার কথা নয়। তাই হয়তো শিক্ষামন্ত্রী এখন সেই শিক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার মহান দায়িত্ব পালন করছেন, ‘ঘুষ খান, তবে একটু কম করে খান, সহনশীল মাত্রায় খান।’

আগামী দিনে হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ‘বাণী’ হিসেবে যা স্থান করে নেবে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন

বিষয়: বিবিধ

৭৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File