রামপাল নিয়ে ইউনেস্কোর 'আপত্তি প্রত্যাহারের' খবর পুরাই বানোয়াট !
লিখেছেন লিখেছেন চেতনাবিলাস ০৭ জুলাই, ২০১৭, ০৯:৪৩:৩১ রাত
চলতি সপ্তাহে আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমে যোগদান করলাম। শুরুটা চ্যালেঞ্জিং যাচ্ছে। লন্ডনের ক্যানারিওয়ার্ফের অফিস থেকে হেটেই বাসায় ফিরেছি মাত্র। ফেসবুকে ঢুকতেই চোখে পড়লো সরকার সমর্থকদের উল্লাসের চিত্র। বাংলাদেশ-এর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাতে সরকারপন্থী একটি টেলিভিশনের অনলাইন ভার্সনের খবরে জানা গেল, ‘রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে আর কোনো বাধা নেই। ইউনেস্কো তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে।’
খবরটি দেখে আমার খারাপ লাগলেও কিছুটা বিশ্বাস করে ফেলি। কারন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সর্বশেষ রিপোর্টে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে (রামপালে) বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ দৌড়ঝাপের চিত্র ছিল। এজন্যই খবরটি শুনেই শঙ্কিত হয়েছি। আবার, শেখ হাসিনার স্টাফদের প্রতি সন্দেহের জায়গা থেকে একটু খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করি।
কারন বিনা ভোটের এই প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও স্টাফদের পুরোনো রেকর্ড ভাল না। মিথ্যাচারে ভরপুর। অপপ্রচারে তারা খুবই পারঙ্গম। পাঠক, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের কথা। আপনাদের অনেকেরই মনে থাকবে, ওই বছর ২১ সেপ্টেম্বরের পর পত্রিকায় কড়া লাল হেডলাইন, আর টেলিভিশনে উচ্ছসিত সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।’ জাতিসংঘ অধিবেশন কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের কাছে এ সংবাদটি ছিল বিপুল আনন্দের। দেশের জন্য গৌরবময়!
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা যে দুর্ভাগা জাতি, এই সংবাদেই তার প্রমান মেলে। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির মিষ্টি ও এনাম বিতরণের পরের দিন এই অভাগা অনেক কষ্টে নিউইয়র্কে পৌঁছেছিল। ওইদিনই বাংলাদেশ কনস্যুল অফিসে গেলে চোখে পড়ে উচ্ছসিত চিত্র। সফরকারী সাংবাদিক, কনস্যুলের কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সবাই উচ্ছাসিত। উল্লাসিত। এরই মধ্যে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা সাপ্তাহিকের সম্পাদক আমাকে জানালেন, শেখ হাসিনার অ্যাওয়ার্ড নিয়ে ঘাপলা আছে! পরের দিন সকালে ঢাকা অফিসে ফোনে কথা হয় সহকর্মী জাহেদ চৌধুরীর সঙ্গে। উনিও একই তথ্য জানালেন। তখন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান কারাবন্দী। আমার দেশ-এর অনলাইন সংস্করণ বের হয়। মাহমুদুর রহমানের সহধর্মীনি মাঝে মাঝে আমার দেশ কার্যালয়ে বসেন। তিনিও এমন একটি গুজবের কথা জানালেন। আমার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়লো সত্য উদঘাটনের।
সারা রাত জেগেই অনুসন্ধান চলে আমার। জাতিসংঘের যেই কমিটি সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে, তাদের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগে সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে ‘ভুয়া অ্যাওয়ার্ড’ আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। ভোর হতেই আমার কলটিই ছিল রিসিপশনিস্টের প্রথম ফোন রিসিভ। কানাডিয়ান মহিলা ইনোসেন্টলি সংস্থার প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে পাইয়ে দিলেন আমাকে। তিনি প্রেসিডেন্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট না দিয়ে তার সাথে সাক্ষাতের সময় দিলেন। ছুটে গেলাম ম্যানহাটনের ওই অফিসে। কৌশল পরিবর্তন করে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশাল এই অর্জনের (!) জন্য গর্বিত হয়ে তাদের ফুলের শুভেচ্ছা জানালাম। শুভেচ্ছায় খুশি হলেও শেখ হাসিনা নামটি তার পরিচিত না হওয়ায় একটু লজ্জিত হচ্ছিলেন ভদ্রলোক। পরে সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড প্রকল্পের সমন্বয়কারীকে ডেকে স্মরণিকা আনালেন। আমাকে দেখালেন, নেলসন ম্যান্ডেলা সহ যারা ওইবছর সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, সেখানে শেখ হাসিনা বলে কেউ নেই। তাকে আমি একটি ছবি দেখালে তিনি বললেন, অনেক অতিথিদের মতো এই নারী নেত্রীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন! সেখানে ফটোসেশনে হয়তো তিনি ছিলেন!! এমন দুঃসংবাদে আমি কষ্ট পেয়েছি মনে করে তিনি চা পান করালেন। স্মরনিকাসহ যাবতীয় ডকুমেন্ট আমাকে দিলেন। সংস্থার প্রেসিডেন্টের সাথে আমার সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দিলেন। ফটো সেশনের সুযোগ নিয়েই সেদিন ফিরেছিলাম।
আর এভাবেই আমাদের বর্তমানের বিনা ভোটের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুয়া সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ডের ঘটনা ধরা পড়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত (!!) শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দিতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩২৫ সদস্যের জাতীয় কমিটি বাতিল করা হয়। আর আমাকে পড়তে হয় নানামুখি চাপে। ওই ভুয়া অ্যাওয়ার্ডের তথ্য নিয়ে আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে তিনটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। তখন অন্যরা সত্য প্রকাশের সাহস না দেখালেও নিউএজ পত্রিকা আমার রিপোর্টের অনুসরণে সংবাদ প্রকাশ করে। দৈনিক মানবজমিনের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি মোমিন ভাইয়ের দু’টি রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ায় আমি জীবন শঙ্কা থেকে কিছুটা রক্ষা পাই। সেসময়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবদুল মোমিন সাহেবের ধমকের সুরে আমি দেশে ফিরতে ভয় পেয়েছিলাম। যাইহোক, পরিস্থিতি সামলে নিয়ে নভেম্বরে দেশে ফিরেছিলাম।
‘রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ইউনেস্কোর অনুমতি প্রাপ্তি’র খবর দেখেই আমার শেখ হাসিনার ভুয়া সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ডের কথা মনে পড়লো। তাই প্রথমেই পোল্যান্ডের ক্র্যাকোভে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৪১তম অধিবেশনে এ সংক্রান্ত কান্ট্রি রিপোর্টটিতে চোখ বুলাই। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত গবেষক আলী রিয়াজ সাহেবের ফেসবুক স্টাটাসটি চোখে পড়লো। এতে মনে হলো, আমার আশঙ্কাই হয়তো সঠিক হবে। তাই কান্ট্রি রিপোর্টটির ৫৫ থেকে ৫৮ পৃষ্ঠায় চোখ বুলালাম। দেখা গেল, এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি সুন্দরবনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধী। তারা তাদের আপত্তি আরো স্পষ্ট করেছে।’ ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ দৌড়ঝাপে তাদের বিরক্তিভাবও রিপোর্টে স্পষ্ট। এমনকি ২০১৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারির মধ্যে (৪২তম অধিবেশনের জন্য) আপডেটেড প্রতিবেদন পেশ করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির নির্দেশনা রয়েছে। রিপোর্টটির লিঙ্ক:
click here
এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী অধ্যাপক আলী রিয়াজ লিখেছেন, প্রসঙ্গ রামপাল প্রকল্প এবং ইউনেস্কো -- ধৈর্য্য ধরে চার পৃষ্ঠা পড়ুন ; ৫৫ থেকে ৫৮, তাহলেই বুঝতে পারবেন ইউনেস্কো কী বলেছে; 'অনুমাদনের' গল্প কোথায়?
তারপরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির বরাতে এ সংক্রান্ত চ্যানেলআই অনলাইনের রিপোর্টটি বারংবার পড়লাম। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের ফেসবুকের স্ট্যাটাসটিও বুঝতে চেষ্টা করলাম। তিনি উচ্ছাসিত হয়ে লিখেছেন, ‘এবার হার মানলো জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। তারাও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।’ এক্ষেত্রেও মি. খোকন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জয়ী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার এই স্টাটাসে বিপুল সাড়া পড়েছে আওয়ামী লীগের ফেসবুকারদের মাঝে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভিসিও এ সংবাদকে ‘গ্রেট’ বলে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। ওই ভিসি আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। তিনি বিএনপির শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন শেখ হাসিনা তাকে আরো বড় সম্মান দিয়েছেন। এজন্য তিনি নৈতিকতাবোধ ও দেশপ্রেমকে বনবাসে পাঠিয়ে বিনা ভোটের প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানালে – সেটা বড় কোনো দোষের বিষয় নয় বলেই আমরা মনে হয়।
তবে আশরাফুল আলম খোকনের উচ্ছাস কিংবা দায়িত্ব পালনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও আমি শঙ্কামুক্ত হতে পারলাম না। ঘটনার সত্যতা উদঘাটনের লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১ তম অধিবেশনের খুটিনাটি ঘাঁটাঘাটি করলাম। এমন কোনো তথ্য না পেয়ে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির এবং এই অধিবেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজনকে মেইলে ও ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। অবশেষে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি থেকে জবাব মিললো যে, এ ধরণের কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তবে মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মেরি ডিক্সন ‘১২ জুলাইয়ের আগে চুড়ান্ত কিছু বলা যাবে না’ বলে উল্লেখ করলেন। অর্থাৎ, আগামী ১২ জুলাই পর্যন্ত অধিবেশন চলবে। এর মধ্যে যে কোনো ধরণের সিদ্ধান্ত হতে পারে!
তবে এই অধিবেশনে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে শেখ হাসিনার সরকারের দ্বারা অনাপত্তি নিশ্চিত করাটা অসম্ভবের কিছু নয়। কারন বিনা ভোটের প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ওই অধিবেশনে অংশ নিয়েছেন। সেখানে ভারতেরও শক্তিশালী একটি টিম রয়েছে। সুন্দরবন যৌথভাবে ভারত ও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। দুইপক্ষ একজোট বেধে যেহেতু ছোট ভাই বাংলাদেশের অংশে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য দৌড়ঝাপ করছে, সেহেতু ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি এর অনুমোদন দিতেও পারে। কেননা উপরে বর্ণিত ভুয়া সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড (!) পরের বছর শেখ হাসিনাকে ঠিক-ই এনে দিয়েছিলেন জনাব আবদুল মোমিন গংরা। অতএব, যদি রামপাল নিয়ে মিথ্যাচারও করে থাকে শেখ হাসিনার সরকার, তবে তা নিকট অতীতে তারা বাস্তবায়ন করে দেখাবে। বাংলদেশের নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকা ঘুষ দিয়ে হলেও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী প্রকল্প তাদের বাস্তবায়ন করতেই হবে; এটা যে ক্ষমতা স্থায়িত্বে টনিক হিসেবে কাজ করবে!! কারন প্রকল্পটির মূল উদ্যোক্তা যে আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ। বন্ধুর চাহিদাকে প্রাধান্য না দিয়ে আমরা তো অসভ্যতা করতে পারি না!
--এম মাহাবুবুর রহমান
বিষয়: বিবিধ
৬৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন