মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে হিন্দুধর্মের সম্পর্কই নিবিড়
লিখেছেন লিখেছেন চেতনাবিলাস ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ০৩:২৫:০০ দুপুর
বাংলাদেশে ইংরেজী, বাংলা ও হিজরী তিনটি নববর্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ইংরেজী বর্ষপঞ্জী হিসাবেই এদেশে সব কাজকর্ম হয়ে থাকে। কিন্তু ১লা বৈশাখ উদযাপন করা হয় বাঙ্গালীর আবহমানকালের সার্বজনীন সংস্কৃতি হিসাবে। যা একেবারেই অনৈতিহাসিক ও ভিত্তিহীন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মহলের ও বস্ত্তবাদী নাস্তিক বুদ্ধিজীবীদের দূরদর্শী নীল নকশার অংশ মাত্র। স্বাধীনতা বিরোধী এজন্য যে, এরা এদিন বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে নানাবিধ মূর্তি ও মুখোশ বানিয়ে রাস্তায় মিছিলে নামে। যার মাধ্যমে তারা ভারতের মূর্তিপূজারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে এবং এপার বাংলা ওপার বাংলার মেল বন্ধনের জন্য গদগদ চিত্ত হয়ে বাগাড়ম্বর করে। ওরা কথিত বাঙ্গালী চেতনার বুলি কপচিয়ে ১৯৪৭ সালে বঙ্গমাতার ব্যবচ্ছিন্ন দু’টি অঙ্গকে পুনরায় জোড়া লাগাতে চায়। নাস্তিক বস্ত্তবাদীদের কারসাজি এজন্য যে, এরা আদম (আঃ)-কে মানুষের আদি পিতা ও প্রথম নবী হিসাবে বিশ্বাস করে না। এরা মানুষকে পৃথক সৃষ্টি নয়, বরং বানরের বংশধর ও হনুমানের উদ্বর্তিত রূপ বলতে চায়। আর এগুলিকে বিশ্বাস করানোর জন্য কোটি বছর পূর্বেকার কথিত নানা জীবজন্তুর ফসিল আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে বলতে চায়, এরাই ছিল মানুষের আদি পুরুষ। এরা মানবসৃষ্টি সম্পর্কে কুরআন-হাদীছের বাণীকে অস্বীকার করে। এরা অতি চতুরতার সাথে বিভিন্ন শহরে ‘গুহা মানব’-এর কৃত্রিম প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিক্ষার্থী তরুণদের বুঝাতে চায় যে, তোমরা গুহাবাসী অসভ্য অমানুষ ছিলে। এখন শহরবাসী সভ্য মানুষ হয়েছ। ১লা বৈশাখে বানর, হনুমান, সাপ-পেঁচা ইত্যাদির মূর্তি ও মুখোশ বানিয়ে রাস্তায় প্রদক্ষিণ করার মাধ্যমে ওরা এদেশের মানুষের ঈমানী চেতনা ভুলিয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদী ও নাস্তিক্যবাদী চেতনার অনুসারী বানাতে চায়।
আমরা এদেশেই গ্রামে জন্মেছি, এদেশেই বড় হয়েছি। হিন্দু-মুসলমান মিলিত যে গ্রাম ছোট বেলায় দেখেছি, সেই গ্রাম আজও দেখছি। নববর্ষ উদযাপন বা বৈশাখী মেলার নাম কখনো শুনিনি, দেখিনি বা আজও হয় না। আমরা জানতাম ‘মেলা’ হিন্দুরা করে। যদিও আমাদের গ্রামের হিন্দুদের বৈশাখী মেলা করতে দেখিনি। মুরববীরা বলতেন, মুসলমানদের মেলায় যেতে নেই। তখন বয়স্করা কেউ মেলায় গেলেও লুকিয়ে-চুরিয়ে যেত। বাড়ী এসে ভয়ে মুখ খুলতো না। অথচ আমরা জন্ম থেকেই বাঙ্গলাভাষী, আজও বাংলাভাষী। কিন্তু সংস্কৃতিতে ছিলাম তখনও মুসলমান, এখনও মুসলমান। হিন্দুরা ‘নমস্কার’ দিত। আমরা ‘আদাব’ বলতাম। কিন্তু পাল্টা নমস্কার বলতাম না। তারা ‘জল’ খেত। আমরা ‘পানি’ খেতাম। ওরা শুকর পালন করত ও তার মাংস খেত, আমরা ছাগল-গরু পালতাম ও তার মাংস খেতাম। ওরা ধুতি পরত, আমরা লুঙ্গি-পায়জামা পরতাম। ওরা পৈতা গলায় দিত, মাথায় টিকি রাখত। ওদের মেয়েরা মাথায় সিঁদুর দিত ও হাতে শাখা পরত। ওদের বিয়েতে কত যে নাচগান। আমাদের মধ্যে এসব ছিল না। তারা মাসী-পিসী, কাকা-কাকী, বাবা-মামা বলত। আমরা খালা-ফুফু, চাচা-চাচী, আববা-মামু বলতাম।
তারা ভগবানকে ডাকত ও মূর্তিকে পূজা দিত। আমরা আল্লাহকে ডাকতাম ও মসজিদে সিজদা করতাম। তারা তাদের পূজার সময় ঢোল-বাদ্য বাজাত ও উলুধ্বনি করত। আমরা আমাদের ছালাতের সময় আযান দিতাম ও মসজিদে জামা‘আতে যেতাম। তাদের সাথে আমাদের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। আজও আছে। আমরা উভয় সম্প্রদায় একই গ্রামে শত শত বছর ধরে বসবাস করছি পরস্পরে আত্মীয়ের মত। উভয় সম্প্রদায় বাংলা ভাষায় কথা বলি। কিন্তু আমাদের উভয়ের সংস্কৃতি পৃথক। এ পার্থক্যের ভিত্তি হ’ল আক্বীদা। আমাদের আক্বীদায় রয়েছে তাওহীদ। তাদের আক্বীদায় রয়েছে শিরক। দুই আক্বীদার ভিত্তিতে দুই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
ফলে এই পার্থক্য ভাষায়, পোষাকে, সামাজিকতায় সর্বত্র ফুটে উঠেছে। তাইতো দেখি মুশরিক কবি গেয়েছেন, ‘এসো হে বৈশাখ! দুর্বলেরে রক্ষা কর, দুর্জনেরে হানো’। অথচ মুসলমানের আক্বীদামতে বৈশাখের কোন ক্ষমতা নেই। সকল ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর হাতে। অতএব শুধুমাত্র বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলে পৃথক কোন সংস্কৃতির অস্তিত্ব কোন কালে ছিল না। আজও নেই। এরপরেও ১লা বৈশাখে নববর্ষ সম্পর্কে যদি কিছু বলতে হয়, তবে সংক্ষেপে সেটা এই যে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে ফসলী সনের ১ম দিন হিসাবে ১লা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনা হয় সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খৃঃ) নির্দেশে তাঁর সিংহাসনারোহণের বছর ৯৬৩ হিজরীর ২রা রবীউছ ছানী মোতাবেক ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৪ই এপ্রিল ১লা বৈশাখ শুক্রবার হ’তে। ফসলী সনের ১ম দিন হওয়ায় এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীর হালখাতার দিন হওয়ায় শহরে-গ্রামে এ সময় উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হ’ত। এ দিনটিতে দা, বটি, খোন্তা, কোদাল, লাঙ্গল, জোয়াল, গরুর গাড়ীর চাকা, পিড়ে, চৌকি, মাটির হাড়ি-পাতিল, কাঁসার থালা-বাটি-জগ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের মেলা বসত। ফলে এ দিনটি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের তারিখ হিসাবে উৎসবের চরিত্র ধারণ করত। এদিন কেউ অনৈতিক কাজ করত না। কাউকে কেউ কষ্ট দিত না। এর পিছনে কোন আক্বীদা বা সংস্কৃতি চেতনা কাজ করত না। বরং অর্থনৈতিক কারণই ছিল মুখ্য। মোগলদের সাম্রাজ্য চলে যাবার পর বর্তমানে সে কারণ আর অবশিষ্ট নেই।
উল্লেখ্য যে, সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা নববর্ষ চালু হবার সময় বাংলাদেশে ছিল শকাব্দের ২য় মাস হিসাবে বৈশাখ মাস। কেননা শকাব্দের ১ম মাস হ’ল চৈত্র মাস। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারীতে ডঃ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি মাস গণনার সুবিধার্থে বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত পাঁচ মাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত সাত মাস ৩০ দিনে বর্ষসূচী নির্ধারিত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার তা মেনে নেন। যা আজও চালু আছে। কিন্তু সম্ভবতঃ মুসলিম সম্রাট দ্বারা প্রবর্তিত হওয়ায় এবং হিজরী সনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলা সনের পরিবর্তে শকাব্দ ব্যবহার করে আসছে। ফলে শকাব্দের চৈত্র মাস ৩১ দিনে হওয়ার কারণে তাদের পহেলা বৈশাখ আমাদের ১ দিন পরে হয়ে থাকে। অভিন্ন বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রবক্তারা এখন কী বলবেন?
বিষয়: বিবিধ
৮৭৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন