কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নমুনা!!!

লিখেছেন লিখেছেন চেতনাবিলাস ০১ এপ্রিল, ২০১৭, ০৮:০৭:৩৭ সকাল

কুমিল্লা সিটির নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী মাত্র 11 হাজার 85 ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন বলে অবৈধ ক্ষমতাসীন সরকারের চেলারা এক যোগে হুক্কাহুয়া রব তুলেছে যে সেখানে নাকি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী প্রার্থী সীমা যেসব কেন্দ্রে বিজয়ী হয়েছে সেগুলোর ভোটের চিত্র এ কথাই প্রমাণ করে যে জালিয়াতি ছাড়া এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। ইত্তেফাকের আজকের রিপোর্ট পড়লে যে কেউ এটা অনুধাবন করতে পারবেন যে ক্ষমতাসীন সরকার কত জঘন্য ভাবেই না মিথ্যাচার করে যাচ্ছে।

" ভোটে অনীহা ভোটারদের "

নির্বাচনে ভোটদানে ভোটারদে অনীহা দেখা দিয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দুই লাখেরও কিছু বেশি ভোটারের মধ্যে প্রায় এক লাখ ভোটার ভোট দিতে যাননি। বিগত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচনে ১১ দশমিক ২ শতাংশ কম ভোট পড়েছে। গতবার ভোট পড়েছিল প্রায় ৭৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এবার ৬৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিগত বেশকয়েকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ৭০ শতাংশের উপরে ভোট পড়লেও কুমিল্লায় ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। তারআগে ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল ৭৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু কুমিল্লায় এর ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। এ নিয়ে বিশ্লেষকদেরও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া গেছে।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শংকা, স্থানীয়ভাবে নেতায় নেতায় রাজনৈতিক কোন্দল, আধিপত্য, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ও পেশিশক্তির প্রদর্শন-এসব কারণে মারামারি-হানাহানির ঘটনা ভোটার উপস্থিতি অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। দলীয় কোন্দলের কারণেই কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। প্রার্থী পরাজিত হলেও কেন্দ্র দখলের চেষ্টা ছিল দলটির নেতাকর্মীদের। তাছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় এখনো আস্থা ফিরেনি ভোটাররা। বিগত তিন বছরে অনুষ্ঠিত অধিকাংশ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি হয়। যে কারণে ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ভোটাররা। সর্বোপরি কুমিল্লার নির্বাচনী এলাকার মধ্যে জঙ্গি অভিযানের খবরেও ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের আতংক ছিলো।

কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষনে দেখা গেছে, ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ ভোটের মধ্যে বৈধ ভোট পড়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৬০ ভোট। ১০১টি কেন্দ্রের মধ্যে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ৬৭টি এবং আঞ্জুম সুলতানা সীমা মাত্র ৩৪টি কেন্দ্রে জয়লাভ করেছে। ২৩টি কেন্দ্রে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। ৬টি ভোটকেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। অস্বাভাবিক পড়া কেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছে। ইছহাক সরকারি প্রা. উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৯০ দশমিক ৭১ ভাগ, মডার্ণ স্কুল প্রাইমারি শাখা কেন্দ্র-২ এ ৮৯ দশমিক ৬০ ভাগ, দিশাবন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৮২ দশমিক ৯১ ভাগ। অন্যদিকে শতকরা ৫০ ভাগ ভোটারও ভোট দিতে যায়নি বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে। এর মধ্যে নবাব ফয়জুন্নেচ্ছা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ এ ৪৪ দশমিক ৪২ ভাগ এবং কেন্দ্র -১ এ ৪৫ দশমিক ৬৮ ভাগ, ভিক্টোরিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন কেন্দ্রে ৪৭ দশমিক ৫৯ ভাগ এবং বাগিচাগাঁও ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে মাত্র ভোট পড়েছে ৪৭ ভাগ। শহরের কেন্দ্রস্থলে এই কেন্দ্রগুলোর অবস্থান হলেও আতংক এবং নানা কারনে এসব এলাকার ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হননি।

নৌকার পরাজয়ের নেপথ্যে

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ হিসাবে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাস-কোন্দল এবং সমন্বয়হীনতাকেই চি?িত করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতারা মেয়র প্রার্থীর চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা প্রচারনায় এসেছিলেন তারা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার চেয়ে কুমিল্লা শহরের বেশি সময় ব্যয় করেছেন। স্থানীয় এমপি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরিবারের সঙ্গে রাজনৈতক দ্বন্দ্ব বড় হিসাবে দেখছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় এমপির নিজ কেন্দ্রে সামান্য ব্যবধানে জিতেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। প্রার্থীর আত্মীয় স্বজনের নেতিবাচক ইমেজ নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণের ৩১টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৯টিতে ভোট হয়। এর মধ্যে সীমা মাত্র ৯টি ভোটকেন্দ্রে জয়লাভ করে। পাশাপাশি নৌকার ভোট ব্যংক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরো ভোট না পাওয়া, কর্মীদের জন্য প্রার্থীর দেয়া নির্বাচনের খরচের টাকা নেতাদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া এবং স্থানীয় নেতাদের উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশি গুরুত্ব দেয়াও পরাজয়ের নেপথ্য হিসেবে কাজ করেছে।

পরাজয়ের বিষয়ে নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন ষড়যন্ত্র নৌকার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। দুঃখজনক হলেও সত্য আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রের জন্য আমি শেখ হাসিনার কাছে আজ লজ্জিত।

৬৭ কেন্দ্রে সাক্কু ও ৩৪ কেন্দ্রে সীমা

গত বৃহস্পতিবার রিটানির্ং কর্মকর্তার প্রকাশিত নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণের তথ্যমতে, ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে স্থগিত দুইটি কেন্দ্রের ভোট বাদে ১০১ কেন্দ্রের মধ্যে সাক্কু ৬৭ কেন্দ্রে এবং সীমা ৩৪ কেন্দ্রে জয়লাভ করেছে। ১০টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের উপরে ভোট পড়ে। জাঙ্গালীয়া বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ৯০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বাঁদুরতলা নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে ৪৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। ৩১ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশের নিচে; যার মধ্যে সব কয়টিতেই জিতেছেন সাক্কু। অর্থাত্ বেশি ভোট পড়া কেন্দ্রে নৌকার সামী এবং কম ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোতে সাক্কু জয়ী হয়েছেন। তার পরও দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হওয়ার ক্ষেত্রে তার জয় বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি।

২০টি কেন্দ্রে দখল, জাল ভোট

মানুষের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে এই সিটি নির্বাচনে। বলা যায়, ১০৩টি কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে কমবেশি দুপুর ১২টার পর প্রকাশ্যে জাল ভোট, কেন্দ্রদখল করে ব্যালট ছিনতাই, ভোট কর্মকর্তাদের মারধর এবং ভাড়া করা নেতাকর্মীদের শো-ডাউন ছিল ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত। কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল আসতে শুরু করলে নৌকা প্রার্থীর পরাজয় হচ্ছে নিশ্চিত হয়েই সটকে পড়তে থাকেন নৌকার দলীয় কর্মী-সমর্থকরা।

স্থানীয়দের তথ্যমতে, কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে কমপক্ষে ২০টি ভোটকেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে নৌকার প্রার্থীর নিজের মডার্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫টি ভোট কেন্দ্রে ব্যাপক জাল ভোট প্রদান করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। এই কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী ১ হাজার ৬২ ভোট আর ধানের শীষের প্রার্থী পান মাত্র ৯৭ ভোট। গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দু’টি কেন্দ্রে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাল ভোট প্রদান করে নৌকার সমর্থকরা। ইসহাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শালবন বিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দু’টি কেন্দ্র, ধনাইতরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফরিদা বিদ্যায়তনের দু’টি কেন্দ্র, শাকতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদানের ঘটনা ঘটে।

সু-শাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কুমিল্লা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ সব কেন্দ্রেই দখল ও ভোট কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। এতো বেশি কারচুপির পরও নৌকার প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে দুপুরে আগে অধিকাংশই ভোটার ভোট দেয়ার কারণে।

বিএনপির প্রকাশ্য তত্পরতা ছিল না

নির্বাচনে বিএনপির কোন তত্পরতা ছিল না বললেই চলে। ধানের শীষের সমর্থকরা নীরবে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। কোথাও কোথাও তারা বুকে নৌকার ব্যাজ পরে ধানের শীষের ব্যালটে সিল মেরেছে বলে ভোট শেষে জানিয়েছেন ভোটারদের একটি অংশ।

সুষ্ঠু হলে ভোট আরো বেশি পেতাম : সাক্কু

বিএনপির নবনির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেছেন, ভোট সুষ্ঠু এবং ‘ভয়ভীতি ও ধরপাকড় না করলে আমার ভোটের সংখ্যা বাড়ত, সারাক্ষণ আমার কর্মীদের চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। দিনে কাজ করে ওরা রাতের বেলায় অন্যত্র ঘুমাতে যেতেন। আমার দলের নেতার বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে বাড়ি তল্লাশি করা হয়। তাঁর নামে মামলা দেওয়া হয়। ৩২ জনের নামের তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তার-আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। নির্বাচনের আগের দিন কোটবাড়িতে জঙ্গি আস্তানার খবর জানান দেয়া হয়। কুমিল্লার মানুষ এ প্রক্রিয়াকে পছন্দ করেনি। তারা এতে অসন্তুষ্ট হয়ে (দল না করেও) কিন্তু আমাকে ভোট দিয়েছে।

মনিরুল হক বলেন, সবাইকে নিয়ে নগরের উন্নয়নমূলক কাজ করব। বিরোধীদলীয় মেয়র হিসেবে অতীতের চেয়ে এবার যেন নগরবাসীর উন্নয়নে সরকার বেশি বরাদ্দ দেয়, সেই দাবি করছি। আগেরবার কাজ করতে গিয়ে ১০টি কাজের মধ্যে দু-একটি ভুল হয়েছে। এবার এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকব।

বিষয়: রাজনীতি

৯০০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

382488
০১ এপ্রিল ২০১৭ সকাল ১১:০৫
হতভাগা লিখেছেন : এসব স্থানীয় নির্বাচনের সব কটিতে বিএনপি জিতলেই বা কি ?

এসব নির্বচানে হেরে কি আওয়ামী লীগের মসনদ চলে যাবে ?

'নতুন সিইসি এর অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে , আওয়ামী লীগ পারে ফেয়ার ইলেকশন করাতে'- এই বড়ি পাবলিক ও বাইরের মিডিয়াকে গেলাতে ১০০ % সফল আওয়ামী লীগ।

সাক্কু জিতলেও কি ? ২০১৩ তে পাঁচ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জিতেও বিএনপির মেয়ররা দৌড়ের উপর আছেন অদ্যবধি।

সাক্কুর পরিনতিও কি এর ব্যতিক্রম হবে ?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File