মাওলানা নিজামীকে ফাঁসি দিতে রাষ্ট্র পক্ষের যত মিথ্যাচার

লিখেছেন লিখেছেন চেতনাবিলাস ০৭ মে, ২০১৬, ০৭:০৪:৫০ সকাল

ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের

আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে চারটি

অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং চারটি অভিযোগে যাবজ্জবীন

কারাদণ্ড দিয়েছেল।

এই রায়ের বিরুদ্ধে মাওলানা নিজামী আপলি করলে

তিন অভিযোগ মৃত্যুদণ্ড ও দুই অভিযোগে যাবজ্জবীন

কারাদণ্ড বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন সুপ্রিম

কোর্টের আপিল বিভাগ।

যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে তার ব্যাপারে

রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ও মাওলানা নিজামীর পক্ষে

ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো-

২ নম্বর অভিযোগ-রূপসী, ডেমরা ও বাউশগাড়ী হত্যাকাণ্ড

এই অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ মে পাবনার

সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয়

শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে

অনুষ্ঠিত ঐ সভায় ছিলেন নিজামী। সভার পরিকল্পনা

অনুসারে ১৪ মে দু’টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪৫০ জনকে

পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। এছাড়া প্রায় ৩০-৪০

জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা। এই অভিযোগের

বিষয়ে বিচারপূর্বক সিদ্ধান্তে বলা হয়, চারজন

রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে ৯ নম্বর সাক্ষী আইনুল হক

রূপসী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১০ মে নিজামীকে

স্কুলের সভায় দেখেছিলেন। ১৮ নম্বর সাক্ষীও

নিজামীকে দেখছিলেন। চারজন সাক্ষী কাঠগড়ায়

নিজামীকে শনাক্ত করেছেন। চারজনের সাক্ষ্য আসামির

বিরুদ্ধে অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে। আসামিপক্ষ

তাদের জেরা করেছে। কিন্তু তাদের সাক্ষ্য অসত্য বলে

প্রমাণ করতে পারেনি। সকল সাক্ষ্য-প্রমাণে আমরা

সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে তত্কালীন ইসলামী ছাত্র

সংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী বিরুদ্ধে এই

অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যা

ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এ) ও (জি), ৪ (১), ৪ (২) ধারায়

মানবতাবিরুদ্ধে অপরাধ এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য।

এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল

রেখেছেন আপিল বিভাগ।

মাওলানা নিজামীর পক্ষের বক্তব্য হলো রাষ্ট্রপক্ষের

সাক্ষী মো. আইনুল হক একাত্তরের ১৪ মে কথিত হত্যাকাণ্ড,

অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের ঘটনায়

মাওলানা নিজামীকে উপস্থিত ছিলেন-এ ধরনের কোন

বর্ণনা দেননি। তিনি ঘটনার দিন শান্তি কমিটি গঠনের

বিষয়ে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে যে বক্তব্য প্রদান

করেছেন তা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেননি।

কাজেই মতিউর রহমান নিজামী সম্পর্কে তার বক্তব্য

গ্রহণযোগ্য নয়।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শামসুল হক নান্নু এ-তো বেশী অসত্য

তথ্য ট্রাইব্যুনাল এবং তার বাইরে প্রদান করেছেন তাকে

বিশ্বাস করার কোন সুযোগ নাই। উপরন্তু তার বক্তব্য যে

কতটা অসাড় তার প্রমাণ হলো তার নিজের বক্তব্য- “২৪ মার্চ

পাবনা আলিয়া মাদরাসার নিকটবর্তী দোকানদার

সেকেন্দার আলীর নিকট থেকে জানতে পারি যে

ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী,

মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ইছহাক, রফিকুন নবী

ওরফে বাবলু পাবনা আলিয়া মাদরাসায় বসে পাকিস্তান

ইসলামী ছাত্রসংঘের ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের

নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য ও

সহযোগিতা করার জন্য একটি স্বাধীনতা বিরোধী সেল

গঠন করে”। অর্থাৎ স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই স্বাধীনতা

বিরোধী সেল গঠনের কথা তিনি বলেছেন, এটি হাস্যকর

বক্তব্য।

আর দুই বছর বয়সে মাওলানা নিজামীকে বোয়াইলমারী

মাদরাসায় পড়তে দেখা প্রসিকিউশনের সাক্ষী জামাল

উদ্দিন-এর এই ঘটনা সম্পর্কে কোন প্রত্যক্ষ জ্ঞান নাই। তিনি

সাক্ষী মো. আইনুল হক ও শামসুল হক নান্নুর উদ্ধৃতি দিয়ে

বলেছেন। এই দু’জনের সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায়

তাকেও বিশ্বাস করা যায় না।

সাক্ষী জহুরুল হক এই মামলার তদন্ত সমাপ্ত হওয়ার পরে

প্রসিকিউশনের সাজানো সাক্ষী হিসাবে হাজির

করায় তাকে বিশ্বাস করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।

তদুপরি তিনি দাবি করেন ঘটনার রাত্রে তিনি

বাউশগাড়ি শহীদ আব্দুল জব্বারের বাড়িতে আশ্রয়

নিয়েছিলেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক

খান পরিষ্কার জানিয়েছেন বাউশগাড়ী গ্রামে আব্দুল

জব্বার নামে ওই দিন শহীদ কোন ব্যক্তির নাম তিনি পান

নাই। তিনি তদন্ত কর্মকর্তার সাথে তার দেখা হওয়ার

বিষয়েও মিথ্যাচার করেছেন। কারণ তার মতে, ১৭ মে,

২০১৩ তারিখের আগে তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে দেখা

হয় নাই, দেখা যায় তিনি মূল তদন্তের সময় ২০১০ এর ৬ নবেম্বর

তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে দেখা করেছেন অথচ ঐ সময়

তিনি জবানবন্দী দেননি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে,

তিনি একজন মিথ্যাবাদী ও সাজানো সাক্ষী।

৬ নম্বর অভিযোগ- ধুলাউড়ি হত্যাকাণ্ড

অভিযোগ হলো-একাত্তরের ২৭ নভেম্বর রাত সাড়ে

তিনটায় মাওলানা নিজামী কর্তৃক রাজাকার ও পাক

বাহিনী সাথে নিয়ে ধুলাউড়ি গ্রামের আব্দুল আউয়াল

সাহেবের বাড়িতে ঘেরাও দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর

আক্রমণ করে ভোর সাড়ে ৬টায় পুরুষ-মহিলা ও শিশুদেরকে

ধুলাউড়ি স্কুলে নিয়ে ৩০ জনকে হত্যা। পরে

রাজাকারদের সাথে নিয়ে ২২ জনকে ইছামতি নদীর

তীরে নিয়ে হত্যা। এর শিকার ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি

(আন আর্মড সিভিলিয়ান)।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, এই অভিযোগ প্রমাণে

রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন সাক্ষীকে হাজির করেছে। এদের মধ্যে

রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী মো. শাহজাহান আলী একজন

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তার সাক্ষ্য অনেক বেশি

বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। এছাড়া ১৭ নম্বর সাক্ষীও একজন

মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সাক্ষ্যে নিজামীর অপরাধ

সংগঠনে সম্পৃক্ততা, সংশ্লিষ্টতা ও সহযোগিতার বিষয়টি

সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যা ট্রাইব্যুনাল

আইনের ৩ (২) (এ) ও (জি), ৪ (১), ৪ (২) ধারায় মানবতা বিরুদ্ধে

অপরাধ এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য। এই অভিযোগে

মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। এই অভিযোগে

ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যদুণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল

বিভাগ।

মাওলানার নিজামীর পক্ষে এই অভিযোগের ব্যাপারে

বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী এবং তদন্তকারী

কর্মকতার ভাষ্য মতে, উক্ত ঘটনাটি দু’ পক্ষের একটি যুদ্ধের

মাঝে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড এবং যাদেরকে হত্যা

করা হয়েছিল তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সুতরাং

অভিযোগের বক্তব্য, “নিহত সকলে আন আর্মড সিভিলিয়ান

ছিলেন” এটা তদন্তকারী কর্মকর্তা ও অন্যান্য সাক্ষীদের

বক্তব্য অনুযায়ী সত্য নয়।

প্রথমত উক্ত চার্জের সাক্ষী মো. শাহজাহান আলীর

মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বা

বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, তিনি বলেছেন, “১৯৭১ সালের ২৮

নবেম্বরের আগে মাওলানা নিজামীকে আমি দেখেছি,

আনোয়ারুল হকের নির্বাচনী জনসভায়। নির্বাচনী জনসভা

গৌরী গ্রামে হয়েছিল। গৌরী গ্রামটি সাঁথিয়া

থানাধীন, আমার গ্রাম থেকে ৫ মাইল দূরে। এই জনসভা

শুনতে আমি যাই নাই।” তিনি যদি জনসভায় না-ই যান তবে

সেই জনসভায় মাওলানা নিজামীকে কিভাবে

দেখলেন? সুতরাং তিনি জেরায় অসত্য তথ্য দিয়েছেন।

তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি টিভি চ্যানেলে

অনেকবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তবে তিনি দিগন্ত

টি.ভি, চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কিনা মনে

করতে পারেন নাই। দু’বার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার

কারণে তার স্মরণশক্তি কমে গিয়েছে, কখন কি বলেন তা

মনে থাকে না বলে তিনি দাবি করেন। তবে তিনি সেই

সাক্ষাৎকারসমূহে “১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগে তিনি

মাওলানা নিজামীকে দেখেননি” বলে বলেছিলেন

সেটা অস্বীকার করেন। ডিফেন্স সেই সাক্ষাৎকারসমূহের

ভিডিওসমূহ প্রদর্শন করেছে। সেখানে দেখা যায় যে,

তিনি মাওলানা নিজামীকে ১৯৭১ সালে দেখার

বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এই সাক্ষী শপথ করে

কাঠগড়ায় এসে তার পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে

মিথ্যা কথা বলায় তার সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোন

কারণ নেই। উপরন্তু তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তার

স্মরণশক্তি কমে গেছে তিনি কখন কী বলেন তা মনে

থাকে না। সুতরাং ৪৩ বছরর আগের বিষয়ে এ ধরনের

স্মৃতিশক্তিহীন ব্যক্তির সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়।

তিনি জেরার জবাবে বলছেন, তিনি পাবনা সাঁথিয়ার

মিয়াপুর হাজি জসিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২

সালে এসএসসি পাস করেছেন। অথচ তিনি তার

জবানবন্দীতে বলেছেন, তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আহত

হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেলে ৪ বছর চিকিৎসাধীন

ছিলেন। তিনি বলেছেন, তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ

হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের পর সর্বপ্রথম পাবনায় ১৯৭৫

সালে যান। অতএব, তিনি হয় ১৯৭২ সালে পাবনার একটি

স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার ব্যাপারে মিথ্যা

বলেছেন অথবা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ৪ বছর অবস্থান

শেষে ১৯৭৫ সালে সর্বপ্রথম পাবনা যাওয়ার ব্যাপারে

মিথ্যা বলেছেন। সুতরাং এই স্ব-বিরোধী ও সাংঘর্ষিক

বক্তব্য প্রদানকারী সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং তার

জবানবন্দী গ্রহণযোগ্য নয়।

এই সাক্ষী জেরায় স্বীকার করেছেন যে, ব্যাংক

ডাকাতিতে সহযোগী তার অভিযোগে সোনালী

ব্যাংক থেকে চাকুরীচ্যুত হন। তিনি এই চাকুরীচ্যুতির

আদেশের বিরুদ্ধে কোন আপিল করেননি। সুতরাং এই

সাক্ষী অসৎ এবং তার সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি তার

জবানবন্দীতে বলেছেন যে, তার সাথে যে-সকল

মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের মধ্যে

তাকে ছাড়া তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। অথচ সাক্ষী

তার জবানবন্দীতে বলেন, শাহজাহান ছাড়াও আরও একজন

বেঁচে যান তার নাম মাজেদ। সাক্ষী শাহজাহান আলী

পরে স্বীকার করেন যে, মাজেদ এখনও জীবিত আছেন। এই

ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি অসত্য তথ্য দেয়ায় তার

বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।

দ্বিতীয়তঃ উক্ত অভিযোগের সাক্ষী মো. খলিলুর

রহমানের মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে দেয়া বক্তব্য

গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তিনি বলেছেন, ২৭

নবেম্বর দিবাগত রাতে রাত সাড়ে ৩টায় চাঁদের আলোয়

তিনি মাওলানা নিজামীকে দেখেছেন। অথচ ঐদিন

বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী চন্দ্র অস্ত গিয়েছিল রাত ১টা

২৩ মি. ৫৪ সেকেন্ডে। সুতরাং তার চাঁদের আলোয়

মাওলানা নিজামীকে দেখার বিষয়টি অসত্য।

তার বক্তব্য অনুযায়ী তার সহযোদ্ধাদের মধ্যে ২ জন

(শাহজাহান ও মাজেদ) বাদে সকলে ওই দিন নিহত হন। পরে

তিনি বলেন, উক্ত ২ জন এবং কুদ্দুস ছাড়া তার গ্রুপের বাকি

সবাই নিহত হন। পরে ৪ তিনি বলেন, উক্ত তিন জন ছাড়াও

তার গ্রুপের সালাম ওই দিন বেঁচে যায়। একই সাথে তার

তিন ধরনের বক্তব্য প্রদান থেকেই বুঝা যায় তিনি অসত্য

বক্তব্য দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ঘটনাস্থল ধুলাউড়ি গ্রামে তার আত্মীয়

গফুর সাহেবের বাড়িতে তিনি ১৯৭১ সালে যাতায়াত

করতেন। কিন্তু তিনি একই সাথে উক্ত গফুর ওই সময় বিবাহিত

নাকি অবিবাহিত ছিলেন বলতে ব্যর্থ হন। তিনি যদি ওই

সময়ে তার উক্ত আত্মীয়ের বাড়ীতে সত্যিই বেড়াতে

যেতেন তবে তিনি অবশ্যই বলতে পারতেন উক্ত আত্মীয়

ঐসময়ে বিবাহিত না অবিবাহিত ছিলেন। সুতরাং বলা

যায় ওই সময়ে তার ঘটনাস্থলে যাতায়াতের বিষয়ে

তিনি মিথ্যা বলেছেন।

তিনি দাবি করেছেন যে, মাওলানা নিজামী তার

পাশের গ্রামের লোক হওয়ায় এবং তার গ্রামে মাওলানা

নিজামীর বোন বিয়ে দেয়ায় তিনি ১৯৭১ সালের আগে

থেকেই চিনতেন এবং তিনি শুনতে পেয়েছেন যে,

নিজামী ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। অথচ

জেরার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মাওলানা নিজামীদের

কতজন ভাই-বোন বা মাওলানা নিজামী কোথায় কোথায়

লেখাপড়া করেছিলেন তা বলতে ব্যর্থ হন। তিনি

মাওলানা নিজামীর পিতার ব্যাপারেও কিছু বলতে ব্যর্থ

হন। সুতরাং এটাই প্রমাণিত হয় যে, প্রসিকিউশনের

শেখানো মতে তিনি নিজামীকে জড়িয়ে কথাগুলো

বলেছেন, বাস্তবে আদৌ তিনি নিজামী সাহেবকে

চিনতেন না।

তিনি স্বীকার করেছেন যে, রেজাউল করিম নামে

সাঁথিয়ার একজন সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে একটি

বই লিখেছেন, উক্ত বই ডিফেন্স পক্ষ দাখিল করেছে। উক্ত

বইয়ের ২৭-২৮ পৃষ্ঠায় ধুলাউড়ি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে

কিন্তু মাওলানা নিজামী সেখানে উপস্থিত ছিলেন

মর্মে কোন বর্ণনা নেই। এখান থেকে এটাই প্রমাণিত হয়

যে, মাওলানা নিজামী সাহেব উক্ত ঘটনার সাথে

কোনভাবে সংশ্লিষ্ট নন।

তিনি তার জবানবন্দীতে প্রদত্ত ‘ওই দিন রাত্রি আনুমানিক

সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ করে আর্মিদের পায়ের বুটের

শব্দ শুনতে পাই। তখন আমি ওই বাড়ির ঘরের পূর্ব দক্ষিণ

দিকের জানালা খুলে দেখতে পাই যে, মাওলানা

নিজামী এবং কিছু দখলদার বাহিনী এবং কিছু

রাজাকারসহ আমাদের ঘরের দিকে আসছে।’ বক্তব্যটি

তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছেন বলে দাবি করেন। অথচ

তদন্তকারী কর্মকর্তা তার জবানবন্দীতে অস্বীকার করেন

যে, উক্ত সাক্ষী তার নিকট উক্ত কথাগুলো বলেছেন।

যে ব্যক্তি মাত্র কয়েক বছর আগে প্রদত্ত জবানবন্দীর

ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলতে পারে, তিনি ৪২ বছর আগের

ঘটনা সম্পর্কেও মিথ্যা কথা বলতে পারেন। সুতরাং এই

সাক্ষীকে কোনভাবেই বিশ্বাস করা যায় না।

তৃতীয়ত-সাক্ষী মো. জামাল উদ্দিন এর বক্তব্যও এই ক্ষেত্রে

গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তিনি প্রত্যক্ষদর্শী নন এবং এ ঘটনা

তিনি সাক্ষী মো.শাহজাহান আলীর কাছ থেকে

শুনেছেন। যেহেতু সাক্ষী মো.শাহজাহান আলীর বক্তব্য

গ্রহণযোগ্য নয় সুতরাং তার কাছ থেকে শোনা সাক্ষী

জামালউদ্দিনের বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

প্রসিকিউশনের প্রদর্শিত বই এবং ডিফেন্স পক্ষ কর্তৃক

প্রদর্শিত বইতে ধুলাউড়ি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা আছে, অথচ

কোথাও মাওলানা নিজামীর সংশ্লিষ্টতার কথা

আসেনি। অর্থাৎ প্রসিকিউশনের প্রদর্শিত দলিলেই ঘটনার

সাথে মাওলানা নিজামীর সংশ্লিষ্টতার কথা আসেনি,

সুতরাং মাওলানা নিজামী এই ঘটনার সাথে

কোনভাবেই জড়িত নন।

১৬ নম্বর অভিযোগ-বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

এই অভিযোগে বলা হয় মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে

ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসাবে পদাধিকার

বলে আলবদর ও সহযোগী বাহিনীর প্রধান হিসাবে

বিশেষত ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত বুদ্ধিজীবী

হত্যাকাণ্ডের দায়ে গণহত্যা এবং কমান্ড

রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই অভিযোগের বিচারপূর্বক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ১৯৭১

সালে বাংলাদেশে নৃশংসতা চলাকালে মতিউর রহমান

নিজামী ইসলামী ছাত্রসংঘ ও স্বাধীনতা বিরোধী

সহযোগী বাহিনী আল বদরের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু যখন

দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় আসন্ন হয়ে ওঠে

তখন ছাত্রসংঘ ও আল বদরের সদস্য দেশের বুদ্ধিজীবী

নিধনের ষড়যন্ত্র করে। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে

পরিকল্পিতভাবে নিধন ট্রাইব্যুনালস আইনের ৩ (২) (আই), ৪(১)

ও ৪(২) ধারা অনুসারে গণহত্যা।

রাষ্ট্রপক্ষের সকল সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায় ১৯৬৬ সাল

থেকে নিজামী ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি

ছিলেন। এই ছাত্র সংঘই মুক্তিযুদ্ধের সময় আল বদর

বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। ফলে নিজামী আল বদর

বাহিনীর প্রধান ছিলেন। বুদ্ধিজীবী হত্যায় আল বদর

সদস্যদের সহযোগিতা, অনুমোদন, নৈতিক সমর্থন ও তার

কর্মের বিষয়ে নিজামী সম্পূর্ণরূপে সচেতন ছিলেন। আল বদর

নেতা হওয়ার জন্য অধস্তনদের উপর নিজামীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ

ছিলো। আল বদর সদস্যদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত না করায়

তাদের অপরাধের দায় কোনোভাবেই নিজামী

অস্বীকার করতে পারেন না। এছাড়া বুদ্ধিজীবী ডা.

আলীম চৌধুরী, আজহারুল হক ও হুমায়ূন কবিরের

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সাক্ষ্যের মাধ্যমে

প্রমাণ হয়েছে। আল বদরের ঊর্ধ্বতন নেতা হওয়ায় ৪(২)

ধারায় তিনি অপরাধী। এসব তথ্য প্রমাণে তার বিরুদ্ধে

অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই

অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যদুণ্ড বহাল

রেখেছেন আপিল বিভাগ।

ডিফেন্সপক্ষের বক্তব্য হলো-তদন্তকারী কর্মকর্তার

জবানবন্দীসহ অন্যান্য প্রমাণপত্র হতে দেখা যায়, তদন্ত

রিপোর্ট দাখিলের সময় মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়নি।

পরবর্তীকালে ফরমায়েসি সাক্ষী সংগ্রহের মাধ্যমে

অনেককেই এই অভিযোগের সমর্থনে সাক্ষী মান্য করা

হলেও শুধুমাত্র দুইজন সাক্ষী ছাড়া প্রসিকিউশন পক্ষ কোন

সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করতে পারেন নাই।

প্রথমতঃ- অপরাধের সময়কালঃ চার্জ গঠনের আদেশে উক্ত

অপরাধ সংঘটনের সময়কাল সুনির্দিষ্টভাবে বলা না

থাকলেও বলা হয়েছে প্রধানতঃ অপরাধসমূহ সংঘটিত

হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ অথবা এর আশেপাশের সময়ে।

প্রসিকিউশনের দাবি অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু

হয় ১৫ নবেম্বর ১৯৭১ সাল থেকে। এর সমর্থনে প্রসিকিউশন

একটি বই দাখিল করেছে। এই চার্জের সমর্থনে

প্রসিকিউশনের দুইজন মাত্র সাক্ষী যে দু’টি ঘটনার বর্ণনা

দিয়েছেন তাদের ভাষ্য অনুযায়ী সে দু’টি ঘটনা সংঘটিত

হয়েছিল ১৫ নবেম্বর এবং ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১।

এখন বিচার্য বিষয় হলো উক্ত সময়ে মাওলানা নিজামী

ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসাবে আলবদরের প্রধান ছিলেন

কি না?

দ্বিতীয়তঃ- ছাত্রসংঘ প্রধানঃ প্রসিকিউশনের স্বীকৃত

মতে মাওলানা নিজামী সাহেব ১৯৭১ সালের

সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন।

ডিফেন্সের প্রদর্শনী থেকে দেখা যায় ৩০ সেপ্টেম্বর

১৯৭১ এর পরে মাওলানা নিজামী নন বরং তাসনীম আলম

মানজার ছাত্র সংঘের প্রধান ছিলেন। সুতরাং

ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসাবে পদাধিকার বলে আলবদর

প্রধান হিসাবে ৩০ সেপ্টেম্বরের পরে সংঘটিত

অপরাধের সাথে মাওলানা নিজামীকে জড়ানোর কোন

সুযোগ নেই।

তৃতীয়তঃ- আলবদর প্রধানঃ প্রসিকিউশনের প্রদর্শিত

ডকুমেন্ট অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বরের একটি সভায় আলবদর প্রধান

হিসাবে মতিউর রহমান নিজামী নন বরং অন্য একজন

উপস্থিত আছেন মর্মে দেখা যায়। সুতরাং প্রসিকিউশন

ডকুমেন্ট থেকেই একথা প্রমাণিত যে মাওলানা নিজামী

আলবদর প্রধান ছিলেন না। প্রসিকিউশনের দাবি অনুযায়ী

আলবদর একটি সশস্ত্র অক্সিলারি বাহিনী যার স্বতন্ত্র

সাংগঠনিক কাঠামো, মিলিটারী ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা,

বেতনভাতা ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল। একজন বেসামরিক ব্যক্তির

এরকম একটি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

প্রসিকিউশনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মাওলানা

নিজামী ১৯৭১ সালের পুরো সময়েই একজন বেসামরিক

ব্যক্তি ছিলেন। সুতরাং নিজামী সাহেবের আলবদর

বাহিনীর প্রধান হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। এ

সংক্রান্তে যুগোশ্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ

ট্রাইব্যুনালের আপীল বিভাগে Prosecutor vs Timohir Blaskic,

Case no. IT-95-14-A para-114 মামলায় একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে

যে, একই ব্যক্তি একই সাথে বেসামরিক নাগরিক এবং

সামরিক কর্মকর্তা হতে পারেন না।

চতুর্থতঃ মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আলবদরের সাথে

সংশ্লিষ্ট ছিলেন মর্মে প্রসিকিউশন ৪টি বই দাখিল

করেছে। উক্ত বইসমূহের আলোচনায় স্পষ্টভাবে দেখানো

হয়েছে যে, কীভাবে রেফারেন্স বিকৃত করে অথবা

রেফারেন্স ছাড়াই আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসাবে

মাওলানা নিজামীকে চিত্রিত করা হয়েছে। অন্যদিকে

প্রসিকিউশন প্রদর্শিত দু’টি বইতে মাওলানা নিজামীকে

আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা দাবি করা হয়েছে। উক্ত বই

দু’টির আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে, একটিতে ভুল

রেফারেন্সে এবং অন্যটিতে রেফারেন্স ছাড়াই এ

দাবিটি করা হয়েছে এবং বই দু’টির লেখকদের ১৯৭১

সালের ঘটনার কোন প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই। উল্লেখিত ৬টি

বই-ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালের পরে লিখিত।

সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, মাওলানা নিজামীর

সাথে আলবদরের কোন দূরতম সম্পর্ক ছিল একথা প্রমাণে

প্রসিকিউশন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।

পঞ্চমতঃ আলবদরের পরিচয়পত্র হিসেবে প্রসিকিউশন এই

মামলায় ১১টি প্রদর্শন করেছে। উক্ত কার্ডগুলো

প্রদর্শনকারী তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেন উক্ত

পরিচয়পত্রসমূহ ইস্যু করেছেন একজন ক্যাপ্টেন। এর ইস্যুকারী

এবং প্রতিস্বাক্ষরকারী উভয়েই পাকিস্তানী আর্মি

অফিসার। নিজামী সাহেব যদি আলবদর প্রধান হতেন এবং

এর উপর যদি তার কমান্ড এবং কন্ট্রোল থাকতো তাহলে

অবশ্যই তার স্বাক্ষর থাকতো। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে,

তিনি আলবদরের প্রধান ছিলেন না এবং আলবদর বাহিনী

তার কমান্ড এবং কন্ট্রোলে ছিল না।

ষষ্ঠতঃ আলবদরের প্রতিষ্ঠা এবং এর কমান্ড ও কন্ট্রোল:

প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠা

হয়েছিল একাত্তরের ১৬ মে ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে

এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তরুণ মেজর রিয়াদ হোসাইন

মালিক এবং এর প্রথম কমান্ডারের নাম ছিল কামরান।

সুতরাং প্রসিকিউশনের ডকুমেন্ট দ্বারাই প্রমাণিত যে,

মাওলানা নিজামী আলবদরের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন না

এবং প্রধানও ছিলেন না। ডিফেন্সপক্ষ কর্তৃক দাখিলকৃত

তৎকালীন পাস বাহিনীর ইস্টার্ণ কমান্ডার জেনারেল

নিয়াজি কর্তৃক লিখিত বই The Betrayal of East Pakistan। উক্ত

বইয়ের ৭৮-৭৯ পৃষ্ঠায় জেনারেল নিয়াজি স্পষ্টভাবে

বলেছেন, আলবদর বাহিনী ছিল রাজাকার বাহিনীর

একটি শাখা যার প্রতিষ্ঠা এবং কমান্ড ও কন্ট্রোলে ছিল

পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ডিফেন্সপক্ষ কর্তৃক দাখিলকৃত

THE VANQUISHED GENERALS AND THE LIBERATION WAR OF BANGLADESH

একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক বই, যেখানে ১৯৭১ সালে

পাকবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশেষভাবে

জেনারেল রাও ফরমাল আলী ও জেনারেল নিয়াজির

সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ আছে। বইটির ১৪৯-১৫০ পৃষ্ঠায়

জেনারেল রাও ফরমান আলী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন,

রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং কমান্ড ও

কন্ট্রোলে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন

কর্মকর্তা বিশেষভাবে জেনারেল নিয়াজি। জেনারেল

নিয়াজি তার সাক্ষাৎকারে ১৬৪-১৬৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন,

অনেকে বলে রাজাকার আলবদর জামায়াতে ইসলামীর।

এটা সত্য নয়। আমিই রাজাকার-আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠা

করি এবং আমিই এটা নিয়ন্ত্রণ করতাম, আমি

রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করতাম এবং জামায়াতের

লোকদেরকে আমার কাছে ঘেঁষতে দিতাম না। এখান

থেকেই পরিষ্কার হয় যে, মাওলানা নিজামী নন বরং

পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশেষভাবে জেনারেল

নিয়াজি ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং

নিয়ন্ত্রক।

সপ্তমত প্রসিকিউশন ১৯৭১ সালে মাওলানা নিজামীর খবর

সম্বলিত ২১টি পেপার কাটিং এবং ৬টি গোয়েন্দা

রিপোর্ট প্রদর্শন করেছে। এর কোন একটিতেও বলা হয়নি

যে, মাওলানা নিজামী আলবদর বাহিনীর সাথে

কোনভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন অথবা তিনি আলবদরের

কোন বৈঠকে উপস্থিত হয়েছেন। অথচ এসমস্ত পত্র-পত্রিকা ও

গোয়েন্দা রিপোর্টসমূহে আল বদরের অনেক বর্ণনা পাওয়া

যায়। যা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, নিজামী সাহেব

আলবদরের সাথে কোনভাবেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।

অষ্টমতঃ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে ১৯৭২ সালের ২৮

মার্চ পর্যন্ত পর্যন্ত ৪২টি মামলা হয়েছে। যদিও তদন্তকারী

কর্মকর্তা ৪২টি মামলা হওয়ার বিষয়ে তার অজ্ঞতা প্রকাশ

করেছেন। কিন্তু তার প্রদর্শিত বই ‘একাত্তরের ঘাতক ও

দালালরা কে কোথায়’ হতে দেখা যায়, বুদ্ধিজীবী

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ৪২টি মামলা ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ

পর্যন্ত দায়ের হয়েছে। তার প্রদর্শিত বই থেকে আরও দেখা

যায় যে, বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডটির পরিকল্পনা হামিদুল

হকের মালিকানাধীন অবজারভার পত্রিকার অফিসে

হামিদুল হকের কক্ষেই সম্পন্ন হয়। এছাড়াও ভিডিও ডকুমেন্ট

‘রণাঙ্গনের দিনগুলি’ হতে দেখা যায়, খান এ সবুরের বাড়ি

থেকে মিরপুর মুক্ত হওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের

নীল নকশা উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই নীল নকশার বিবরণ বা

নীল নকশাটি তদন্তকারী কর্মকর্তা সরকারের নিকট আবেদন

করেও পান নাই অর্থাৎ তা আটকে রাখা হয়েছে। অন্যান্য

দলিলপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বুদ্ধিজীবী

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক জহির

রায়হানকে আহ্বায়ক করে একটি বেসরকারী তদন্ত কমিটি

গঠিত হয়েছিল যার অন্যতম সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার মওদূদ

আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। ওই কমিটির

নথিপত্র জহির রায়হান সাহেবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের

বন্ধুপ্রতীম একটি দেশের একজন সাংবাদিকের হাতে তুলে

দেয়া হয়, যা তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ সংগ্রহের কোন প্রচেষ্টা

করেন নাই বা ওই কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ ও

ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথেও যোগাযোগ

করেননি। এ বিষয়ে সরকার কর্তৃক একটি তদন্ত কমিটি গঠনের

কথা আমরা বিভিন্ন দলিলপত্র হতে দেখতে পাই কিন্তু এ

বিষয়ে ওই কমিটি কী রিপোর্ট দিয়েছিল বা কী কী তথ্য

উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন সে বিষয়ে তদন্তকারী

কর্মকর্তা কোন বক্তব্য দেন নাই। তদন্ত সংস্থা কর্তৃক

সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে ১৯৭২ সালে প্রণীত

স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা তদন্ত সংস্থায়

প্রেরিত হলেও তিনি তা সংগ্রহ করেননি বা বুদ্ধিজীবী

হত্যাকাণ্ডের মামলাসমূহে কী বর্ণনা ছিল তা তিনি

জানারও চেষ্টা করেননি। এরপরও যে ২ জন ব্যক্তিকে এই

মামলায় সাক্ষী হিসাবে আনা হয়েছে অর্থাৎ শহীদ ডা.

আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এবং শহীদ

ডা. আজহারের স্ত্রী সালমা হক তাদের স্বামীদের

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা হওয়ার কথা স্বীকার করলেও

ইচ্ছাকৃতভাবে ওই মামলার আসামী সম্পর্কে কোন বক্তব্য

দিতে চাননি তবে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেছেন

যে, ডা. আলীম চৌধুরীর মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে

গিয়েছে।

নবমতঃ এই দু’টি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্তান্তে দালাল

আইনে রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছিল। ওই রিপোর্ট

দাখিলের পূর্বে নিশ্চিতভাবে এই দুই ব্যক্তিকে

জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন তারা

মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে কোন বক্তব্য প্রদান

করেননি তা স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়। সাক্ষ্য

প্রমাণ বিশ্লেষণে আমরা আরও দেখতে পাই, ওই দুই

হত্যাকাণ্ড সংক্রান্তে স্বাধীনতার পরপরই দুইজন ব্যক্তিকে

আটক করা হয়েছিল। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে

তাদেরকে ছেড়েও দেয়া হয়েছিল। তারা মাওলানা

নিজামী সাহেবের অনুগত ব্যক্তি ছিলেন এই মর্মে কোন

প্রমাণ নাই। উপরন্তু ওই দুই সাক্ষী যেভাবে মাওলানা

নিজামীকে জড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী

দিয়েছেন তা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোন কারণ নাই।

কেননা তাদের এই বক্তব্যসমূহ তারা তদন্তকারী কর্মকর্তার

নিকট দেয়া জবানবন্দীর সময় বলেননি।

তদন্তকারী কর্মকর্তা এই চার্জের তদন্ত ও সাক্ষ্য গ্রহণ

সম্পর্কে যে বক্তব্যের অবতারণা করেছেন তা মিথ্যাচার

ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কারণ তদন্তকারী

কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর তদন্ত

প্রতিবেদন দাখিলের পরে তিনি এই মামলার তদন্ত অব্যহত

রাখেন অতিরিক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এই

তদন্তের ধারাবাহিকতাতেই ১৩তম সাক্ষী শ্যামলী

নাসরিন চৌধুরীকে সাক্ষী মান্য করেন যে বিষয়ে

তিনি চিফ প্রসিকিউটর বরাবরে ২০১৩ সালের ২০

জানুয়ারির স্মারক নং- আন্ত: অপ: ট্রাই:/তদন্ত সংস্থা/৮৮

মূলে প্রেরিত চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, তিনি ৩০

অক্টোবর উক্ত সাক্ষীর জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করেন। অথচ

তিনি তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন যে, তার সহযোগী

তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম উক্ত সাক্ষীর

জবানবন্দী গ্রহণ করেন ২০১১ সালের ১০ মার্চ। দেখা যাচ্ছে

যে, তদন্তের ধারাবাহিকতাতেই এই সাক্ষীর জবানবন্দী

গ্রহণের কথা বললেও এই তদন্তের কয়েক মাস পূর্বেই উক্ত

সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে যা অবিশ্বাস্য ও

অসম্ভব। ইতিহাস পিছন দিকে ঘুরলেই ২০১১ সালের ১০ মার্চ

তারিখটি ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর হওয়া সম্ভব। কাজেই

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংক্রান্তে মাওলানা

নিজামীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগটি ফরমায়েসি এবং

সাক্ষ্য প্রমাণও অনুরূপভাবে গৃহীত।

দশমতঃ সাক্ষী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী তার জেরায় যে

সমস্ত বিষয়ে স্বীকার করেছেন তাতে খুব সহজে

প্রতীয়মান হয় যে, তিনি আদালতে অসত্য জবানবন্দী

দিয়েছেন। সাক্ষী সালমা হক তার মামাতো ভাই ইকবাল

আর্সালান বর্তমানে কী করেন তা বর্ণনা করতে পারেন,

তার খালার স্বামী অর্থাৎ খালু ১৯৭১ সালে কীভাবে

নিহত হয়েছেন তার বর্ণনা দিতে পারেন, কিন্তু তার

মামা ডা. আসজাদ কোন সময় জামায়াতে ইসলামী থেকে

এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা বা আদৌ কোন সময়

এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা তা জানেন না বলায়

এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ট্রাইব্যুনালে

ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য গোপন করে অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন।

সর্বশেষ ফরমাল চার্জের অসংলগ্ন ও অসত্য বক্তব্য, সে

অনুযায়ী চার্জ গঠন, সাক্ষীদের অসংখ্য অসত্য তথ্য প্রদান,

মিথ্যাচার, তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্তে গাফিলতি, তথ্য

গোপন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তদন্ত না করা এবং জেরা ও

জবানবন্দীতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, পক্ষাশ্রিত ঘোষিত

মিথ্যাচারী ব্যক্তিদের বই-পুস্তককে সাক্ষ্য হিসাবে

দাখিল করা, কোন কোন ক্ষেত্রে দাখিলি দলিলপত্র

ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন না করা প্রমাণ করে যে,

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ

মিথ্যা।

বিষয়: বিবিধ

১১৮৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

368268
০৭ মে ২০১৬ সকাল ১০:১৭
বিবেক নাই লিখেছেন : ইলম উঠিয়ে নেয়া ও অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করা। ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে আলেমদের মৃত্যু হওয়ার মাধ্যমে। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম এর সপক্ষে হাদিস এসেছে।
368269
০৭ মে ২০১৬ সকাল ১০:১৮
বিবেক নাই লিখেছেন : কি ভাবে সঠিক ইসলামী দলকে চিনবেন?
•যে কোন যুগে তুমি যদি সঠিক ইসলাম পন্থী দলটি খুজে না পাও তাহলে চিহ্নিত ইসলাম বিদ্বেশ্বী এবং পরীক্ষিত ইসলামের শত্রুদের দিকে তাকাও।তারা কোন দলটির প্রতি সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত।কারন সঠিক ইসলামি দলকে চিনতে মসুলমানেরা ভুল করলেও ইসলামের শত্রুরা ভুল করে না।(শেখ ইবনে তাইমিয়া রাঃ)
376879
২৮ আগস্ট ২০১৬ সকাল ১১:৫১
হতভাগা লিখেছেন : আপনার জন্য





মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File