মিডিয়া: সেকুলার পবিত্রতা, সেকুলার দেবতুল্যতা
লিখেছেন লিখেছেন চেতনাবিলাস ০২ এপ্রিল, ২০১৬, ০৪:২০:৫২ বিকাল
কদরুদ্দিন শিশির
কোটালীপাড়ায় একটি নির্বাচনী অফিসে হামলার
ঘটনা ঘটেছে। তাতে দুই ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এক. ২০জন
মানুষ আহত হয়েছেন। দুই. অফিসটির কিছু আসবাবপত্র ভাঙচুর
হয়েছে।
এখন এই দুই ধরনের ক্ষতির মধ্যে যদি আমাকে ‘বড় ক্ষতি’
কোনটা সেটা নির্ধারণ করতে হয়, তাহলে আমি কী
করবো?
এটা কোনো বিজ্ঞান বিষয়ক বা রাজনীতি-অর্থনীতির
গভীর জ্ঞানবিষয়ক কোনো প্রশ্ন নয়, একেবারে সাধারণ
জ্ঞানের প্রশ্ন।
সাধারণ জ্ঞান থেকেই শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে
আমরা শিখেছি, ‘প্রাণী’র গুরুত্ব ‘বস্তু’র উপরে রাখতে হয়।
আবার প্রাণীদের মধ্যে ‘মানুষ’কে সবার উপরে স্থান
দিতে হয়। হয়তো আমরা নিজেরা ‘স্বার্থপরতা’ থেকেই
নিজেদেরকে ‘সবার উপরে’ স্থান দেই! কিন্তু দেই তো?
এটাই দাঁড়িয়ে গেছে। এমনটাও হতে পারে যে, গরুজাতি
তাদেরকেই ‘শ্রেষ্ঠ জীব’ মনে করে। সেটা তাদের
‘সোসাইটি’র ব্যাপার। আমরা মানব সোসাইটিতে
মানুষের নিয়ম চালাবো এবং মেনে চলবো। তাই না?
তো মানবসোসাইটির রীতি অনুযায়ী, আমি মানুষকে বস্তুর
উপরে গুরুত্ব দিলাম। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ‘২০জন মানুষ
আহত হওয়ার’ বিষয়টি ‘অফিসের কিছু আসবাবপত্র ভাঙচুর’ এর
চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ‘একজন মানুষ’ এর
স্থলে ‘২০ জন মানুষ’ হওয়ায় গুরুত্বটা আরেকটু বাড়লো বৈকি।
কিন্তু বাংলাট্রিবিউনের নিচের লিংকে দেয়া
সংবাদটিতে আমরা কী দেখছি? দেখছি তারা
শিরোনাম করেছেন “নির্বাচনি সহিংসতায়
কোটালীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর”।
সংবাদ প্রতিবেদনটির ইন্ট্রোতে ট্রিবিউনের
সাংবাদিক লিখেছেন--
“গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় দ্বিতীয়
ধাপের ইউপি নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় বঙ্গবন্ধু ও
প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার
(৩১ মার্চ) উপজেলার কুশলা ইউনিয়নের মান্দ্রা গ্রামে এই
ঘটনা ঘটে।”
২০জন আহত এবং ‘অফিসের আসবাবপত্র’ ভাঙচুরের খবর আমরা
পাচ্ছি আরো দুই প্যারা পরে। সেখানে লেখা হয়েছে--
“হামলাকারীরা শহিদুল শেখের নির্বাচনি অফিসের
আসবাবপত্র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার ছবি ভাঙচুর করে। এ সময় শহিদুল শেখের ২০ জন
সমর্থক আহত হয়।”
এই প্যারাটিতে আমরা লক্ষ্য করলাম একটা অদ্ভুত মজার
বিষয়। লেখা হয়েছে, “নির্বাচনি অফিসের আসবাবপত্র,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
ছবি”।
মানে আমাদেরকে বলা হচ্ছে, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি” আসবাবপত্রের মধ্যে
পড়ে না! ওই অফিসে থাকা চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চি,
শেলফ, ফাইলপত্র, দেয়ালে ঝুলানো নির্বাচনী প্রার্থীর
পোস্টার, ছবি- এসব কিছুই আসবাবপত্র। কিন্তু সেই একই
দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি’ আসবপত্র নয়! এদুটি ছবি
আসবাবের উর্ধ্বের কিছু।
এবং অবশ্যই (বাংলাট্রিবিউনের কাছে) ওই দুটি ছবি ২০জন
মানব সন্তানের চেয়ে, আহত অবস্থায় তাদের কষ্ট-আর্তনাদ
ইত্যাদির চেয়েও উর্ধ্বে! তা না হলে তাদের
প্রতিবেদনের প্রধান দুটি জায়গা- শিরোনাম এবং
ইন্ট্রোতে ২০ জন মানুষ আহত হওয়ার এবং আরো বহু আসবাবপত্র
ভাঙচুরের তথ্যকে বাদ দিয়ে ওই দুটির ছবি ভাঙচুরের কথাই
কেন শুধু হাইলাইট করবে?
এত গুরুত্ব তো দিল, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন দিল?
বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনা দুই ব্যক্তি। অবশ্যই সম্মানিত
ব্যক্তি। বিতর্ক পাশে রেখে প্রথমজনকে বলা যেতে
পারে ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি’।
দ্বিতীয়জন বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য তাদের এসব
পরিচয় বাদ দিলেও ‘মানব সন্তান’ হিসেবেই তাদের জন্মগত
সম্মান পাওয়ার অধিকার আছে। তাদেরকে অসম্মান করা
হলে তারা এর বিচার চাইতে পারেন। যে কোনো
মানুষকেই অন্যায়ভাবে শারিরীক-মানসিকভাবে
হেনস্তা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অফিসের আসবাবপত্র হিসেবে থাকা ‘বঙ্গবন্ধুর ও শেখ
হাসিনার ছবি’ ভাঙচুর করাকে বাংলাট্রিবিউনের এত
গুরুত্ব দেয়ার মোটামুটি স্পষ্ট। তারা এ দুটিকে ‘আসবাবপত্র’
মনে করেনি। যা আগেই দেখানো হয়েছে। হয়তোবা
পত্রিকাটি মনে করে, বঙ্গবন্ধুর ছবিই বঙ্গবন্ধু, শেখ
হাসিনার ছবিই শেখ হাসিনা!
কিন্তু আসলেই কি তাই? বঙ্গবন্ধুর ছবিও কি বঙ্গবন্ধু? শেখ
হাসিনার ছবিও কি প্রধানমন্ত্রী? অথবা নিদেনপক্ষে
শেখ হাসিনার ছবিটি কি ব্যক্তি শেখ হাসিনা? যাকে
আমরা দেখি কথা বলতে, গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করতে
বা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে? যদি শেখ হাসিনার
ছবি বা বঙ্গবন্ধুর ছবিতে তারা উভয়ে হাজির থাকেন,
তাহলে বাংলাদেশে মোট কতজন শেখ হাসিনা বা
বঙ্গবন্ধু এখন আছেন? প্রতিটি সরকারি অফিসে, জেলায়,
উপজেলায়, ইউনিয়নে, ওয়ার্ডে মোট কতজন? বঙ্গবন্ধু
তাহলে কি মারা যান নাই? তাকে হত্যা করা হয়েছে
বলে ১৫ই আগস্ট যে শোক দিবস পালন করি এটি কি ভুয়া?
তিনি তার ছবিগুলোতে ‘জিন্দা’ আছেন? যদি এই
ধারণাটি সত্য হয়ে থাকে তাহলে শেখ হাসিনা এবং
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ‘সর্বত্র বিরাজমান’ সত্ত্বা
হিসেবে গণ্য হবেন! দেশের সীমানা পেরিয়েও পাওয়া
যাবে অনেক ‘বঙ্গবন্ধু’ বা ‘শেখ হাসিনা’কে।
এই ধরনের চিন্তাকে বিজ্ঞানমনস্ক অনেক মানুষই আমার
ধারণা ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দেবেন। তারা বলবেন,
বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার ছবিতে তারা নিজেরা
হাজির থাকেন না। ছবি মাত্রেই ‘বস্তু’।
তাহলে এখন সমাধান কী? জীবন্ত মানুষের ওপরে ওই দুটি
বস্তুকে স্থান দেয়ার বাংলাট্রিবিউনীয় কর্মের
ব্যাখ্যা কী?
একটা উত্তর হতে পারে ‘পবিত্রতা’, ‘দেবতাজ্ঞান করা’!
মানে বিভিন্ন ধর্মে যেসব পবিত্রতার ধারণা আছে,
যেমন ধর্মগ্রন্থ, প্রার্থনার স্থান, পাত্র ইত্যাদি বস্তু হওয়া
সত্ত্বেও মানুষের চেয়েও এসবের অনেকগুলোর মর্যাদা
বেশি। কারণ, বিশ্বাস করা হয় স্থানকাল ভেদে আল্লাহ/
ঈশ্বর/ভগবানের সাথে ওইসব বস্তু সরাসরি জড়িত। যেমন
কোরান আল্লাহ কালাম, বেদ ঈশ্বরের বানী। ফলে এগুলোর
মর্যাদা মানুষের উপরে। দেবতারা মর্যাদায় মানুষের
উপরে।
সেকুলার বলে পরিচয় দেয়া মিডিয়ায় কোনো কিছুকে
নিয়ে ধর্মীয় স্টাইলে এই ধরনের ‘পবিত্রতা’ ‘দেবতুল্যতা’র
প্রমোট করাটা খুবই মজার বৈকি!
বিষয়: বিবিধ
১০০১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ওরা স্বার্থান্ধ, কামের বেলায় "জ্ঞানপাপী"
আর প্রকৃত জ্ঞানের বিবেচনায় "আকাটমূর্খ"
ওদের অধিকাংশ কথা ও কাজ বৈপরীত্বে ভরপূর
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন